সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩২) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩২)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৫৫.
‘নিদ্রা আপু দুলাভাই খুব সুন্দর তো! ইশ্ এখন অনেক আফসোস হচ্ছে। বিয়েটাতে গেলেই পারতাম।’

নিদ্রা বিরক্ত হলো। আর বিয়ের কথা শুনতে ভালো লাগছেনা। বিয়ে টা বিয়ে পর্যন্তই আটকে আছে। কোনো অগ্রগতি নেই এর মধ্যে। একটা উটকো ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছেনা তার এই সম্পর্ক। সে বুঝতে পারছে তার রাগ এহসানের উপর করা উচিত। তবুও সে অকারণেই সবার উপর ত্যক্ত হচ্ছে। একটু আগে আদাহ্ যখন এহসানকে দেখতে চেয়েছিল তখন তার ইচ্ছা করছিল চড়িয়ে আদাহ্ কে রুম থেকে বের করে দিতে। অতি কষ্টে ইচ্ছে দমন করেছে সে। এখন আবার আদাহ্ যখন এহসানের প্রশংসা করল তখন নিদ্রার রাগের মাত্রা আরো কয়েক ধাপ বৃদ্ধি পেল। সে চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,
-‘কেন বিয়েতে না যাওয়ার আফসোস হচ্ছে? ভালো করেছিস যাস নাই। গেলে দেখা যেত তোকেও ধরে বেঁধে দিয়ে দিচ্ছে কারো সাথে।’
-‘এমন সুন্দর কারো সাথে দিলে খুশি খুশি রাজি হতাম। বিশ্বাস করো!’

নিদ্রা খেয়াল করল আদাহ্ খুশি হয়ে গেছে খুব। তার মুখের সেই হাস্যকর ভাবটা, আনন্দের ঝলকানিই তা প্রকাশ করছে। নিদ্রা এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘এটা মোটেও আনন্দের নয় আদাহ্। যন্ত্রণাদায়ক।’
-‘তোমার খুব কষ্ট নিদ্রাপু?’
নিদ্রা চমকে গেল। তার কষ্ট কী খুব প্রকাশ পাচ্ছে? সে তো চাইছেনা প্রকাশ পাক। কেউ জানুক তার যে বুকভরা কষ্ট। কেউ না জানুক। নিদ্রার চোখ ছলছল করে। সে দৌঁড়ে গিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। দরজায় ছিটকিনি এঁটে বেসিনের সামনে গিয়ে ভেতরকার কান্না উগড়ে দেয়। তার এত কেন কান্না পাচ্ছে? উফ! অসহ্যকর। এমন হচ্ছে কেন?

—————-
বাস চলছে আপনগতিতে। মাঝে মাঝে উঁচু নিচু রাস্তা এলে ঝাকুনি দিয়ে উঠছে। এতে কয়েকবার নির্ঝরের সাথে নিহারীকার বাহুর সংঘর্ষন হয়েছে। তাতে দুজনেই বিব্রত হয়ে পড়ে। নির্ঝর এদিক ওদিক খুঁজেও মৃত্যুঞ্জয়কে দেখল না। একটু ভালো করে তাঁকাতেই দেখে সে সামনের সিটে বসে ঘুমাচ্ছে। বাসে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে আছে। তবে অভ্র আর এহসান জেগে আছে কীনা সে জানেনা। তারা একটু বেশিই পেছনে বসায় চোখের আড়াল হয়ে আছে। নির্ঝর ভেবেছিল কিছু একটা বলতে। তার মনে হচ্ছে মেয়েটা তাদের ফলো করছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে! তা না হলে তারা যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই এর দেখা পেয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত না? তবে নিজেই এই কঠিন কৌতূহল দমিয়ে রেখে শক্ত হয়ে বসে রইল। না তাকাবে বামে আর না তাকাবে ডানে। একদম স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। তবে তার ধারণা নিহারীকা নিজে তার সাথে কথা বলতে আসবে। আর হলোও তাই। নিহারীকা বলল,
-‘বাহ! আজকাল ভাগ্য দেখছি ভারী প্রসণ্ণ। যেদিকে তাকাই আপনাকে দেখতে পাই।’

রগচটা নির্ঝর! মেজাজ গরম হলে তার মাথা ঠিক থাকেনা। তবে সে মান’সি’ক বি’কা’রগ্র’স্হ ও হয়ে পড়ে না। যা একটু মুখের ভাষা উগ্র হয়। গলার স্বর উঁচু হয়। সে বলল,
-‘আপনার ভাগ্য প্রসণ্ণ কীনা সেটি আপনি মনে মনে চিন্তা করুন। অযথা আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান করবেন না।’
-‘আপনি আমাকে এত অপছন্দ করেন কেন বলুন তো?’
-‘আপনি পছন্দ করার মতো?’
-‘আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আপনার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর জন্য আপনারা আমাকেই পছন্দ করেছিলেন।’
-‘ভুল ছিলাম। মানুষ ভুল করে। সেই ভুল থেকে শেখে তারপর দেখা যায় সেটা পরবর্তীতে আর পীড়া দেয় না। আর ভুল হয়না।’
-‘কে বলল দেয় না? হুম! কে বলেছে সেই ভুল থেকে শিখলে পরবর্তীতে তা আর পীড়া দেয়না? আর ভুল হয়না?’
-‘সবার জানা কথা। আর কাজেও এমনটা ঘটে।’
-‘আমার সাথে কখনো ঘটেনি।’
-‘সেটা আমার ভাববার বিষয় নয়।’
-‘ভাবতে চাইলে বিষয় লাগেনা। এমনিতেই ভাবা যায়। মন থেকে ভাবা যায়।’
-‘আমি চাইছিনা।’
-‘বেশ। তবে আপনি চিন্তা করুন।’
-‘আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো। একটা কথাও আর শুনতে আগ্রহী নই আমি।’
-‘সাবধানে! ঘুমের ঘোরে আমার কাঁধে ঢলে পড়বেন না। আপনার মেয়েলি সমস্যা আছে তা সবাই জানে।’

নির্ঝররের এবার চরম রাগ ওঠে। নিজের মনকে নানাভাবে বুঝিয়ে শান্ত করে। এখানে সীনক্রিয়েট করা যাবেনা। কোনো মতেই না! সে বলল,
-‘আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট ইন গার্লস লাইক ইউ।’
-‘যা হবে দেখা যাবে।’

নির্ঝর চোখের পাতা বন্ধ করল। কী অপমানটাই না করেছে তাকে? ছিঃ ছিঃ শেষমেষ এই ফালতু, বেয়াদব মেয়ে তাকে কথা শোনায়! রাগে গা জ্বলে যায়। অসহ্য একটা মেয়ে।

৫৬.
রাতের শেষভাগ। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিদ্রা শোয়া থেকে উঠে বসে। পাশেই আদাহ্ স্লিপিং স্যুট পড়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। স্লিপিং স্যুটটা নিদ্রা এনেছে। আদাহ্ দের বাড়িতে মেয়েদের শাড়ি আর থ্রী পিসের বাহিরে কিছু পড়ার নিয়ম নেই। আদাহ্ এসব পড়ে দিনে থাকতে পারলেও রাতে পারেনা। ঘুমাতে অসুবিধা হয়। নিদ্রাকে সে জানিয়েছিল ব্যাপারটা। নিদ্রাও আসার আগে সেটা মনে করে কয়েকটা স্লিপিং স্যুট আর ফ্রী সাইজ প্লাজো এবং টি-শার্ট কিনে আনে। এগুলো রাতে ঘুমানোর সময় আদাহ্ পড়লে আরাম পাবে। সবকিছু দেখে আদাহ্ তখন সে কী খুশি! ঝটফট শাড়ি বদলে সে এই বেগুনী রঙের বার্গার আর পিৎজ্জার ছাপওয়ালা স্লিপিং স্যুটটা পরে নেয়। বেশ মানিয়েওছে বটে!

নিদ্রার ঘুম আসছেনা। কেমন উতলা হয়ে ওঠছে তার ভেতরটা। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক পায়চারি করে। তখন মনে পড়ল সিন্ধুর নীল বইটার কথা। অনেকদিন হলো পড়া হয়নি। সে চেয়েছিল তবে ব্যস্ততা এতটাই ছিল যে পড়ার সময় পায় নি। নিদ্রা ব্যাগ খুলে বইটি হাতে নিল। ছুঁতেই কেমন মেরুদন্ডে একটা শীতল প্রবাহ বিরাজ করে। গা ছমছমে লাগে। কিন্তু নিদ্রা বইটিতে গা ছমছমে কিছুই পেল না এখন অব্দি। জানেনা শেষটায় কী আছে! তবে নিদ্রাকে এখন আবার টানছে! জমিদার শাহনেওয়াজ, সাপুড়ে কন্যা সিন্ধু।

☆☆☆☆
শাহনেওয়াজ মহলে ফিরেছে দিন ছ’য়েক হলো। তার কাজকর্ম সব নিয়মমাফিক হচ্ছে। তবে প্রাণ নেই। কেমন নিষ্প্রাণ লাগে। তার মনের কোণে কোথাও কারো জন্য প্রবল রাগ। তবে সেটা আদৌ রাগ কীনা সেটাই ভাববার বিষয়। বেগম সুগন্ধ্যার সাথে তার দেখা হলো তার ফেরার তৃতীয় দিন রাত্রিবেলা অন্দরমহলে। বলে রাখা ভালো! বেগম সুগন্ধ্যা এতদিন অন্দরমহলে থাকলেও কিছু কারণবশত তার দেখা হতো না জমিদারের সাথে। কারণ জমিদার নিজেই বেগমের খোঁজে আসেনি। এতে বেগম ভীষণ মনে কষ্ট পান। তিনিও আর যেচে পড়ে আসেননি। তবে ভালোবাসার যে একটা টান আছে সেই টান উপেক্ষা করা এই ভুবনের কারো পক্ষে কী সম্ভব? স্বামীর থেকে মুখ ফিরিয়ে আর কয়দিন থাকবেন? তিনি সেই রাত জমিদারের নিজ কক্ষে হানা দিলেন। তখন শাহনেওয়াজ গদিতে বসে চুপ করে গভীর ভাবনায় মত্ত ছিল। বেগম এলে সে বুঝতেও পারেনা। যখন সুগন্ধ্যা ডাকেন,
-‘হুজুর!’

শাহনেওয়াজ বর্তমানে ফিরে আসে। উঠে গিয়ে বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। কপালে গভীর চুম্বন করেন। হাঁটু গেড়ে বসে পেটে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ নিরব হয়ে থাকেন। সুগন্ধ্যার ভারী চিন্তা হলো। সে বলল,
-‘আপনি কোনো বিষয়ে চিন্তিত? আমাকে খুলে বলুন।’
-‘বেগম আমি একটি মানসিক পীড়া বোধ করছি।’

বেগম সুগন্ধ্যার বুকটা ধক করে উঠল। কোনো খারাপ কিছু হয়নি তো! তার কানে টুকটাক কথা এসেছে। ইংরেজ নাকি ক্ষেপেছে জমিদারের উপর কেন সে আফিম চাষ করতে বাধা দিয়েছে। সেই নিয়ে কোনো বিরোধ নয় তো? এদের ভরসা নেই। কখন কাকে কী করে বসে! শাহনেওয়াজকে কী সাহস দিবে সে নিজেই কেঁপে ওঠে অস্বাভাবিক ভাবে। শাহনেওয়াজ তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে বসায়। তার পাশে বসে বলে,
-‘আপনার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। শুধু শুধু উল্টো পাল্টা ভেবে নিজের এবং আমাদের অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি করবেন না।’
-‘আমার ভয় করছে হুজুর। ইংরেজরা কিছু করল না তো!’
-‘ওদের সেই সাহস আছে? আমার আছে নিজ স্থানে অটল দৃঢ় প্রত্যয় এবং মৃত্যুকে জয় করা মৃত্যুঞ্জয়। আমার কোনো ভয় নেই আর না-ই বা আছে চিন্তা। তারা না পারবে প্রত্যয়ের উদ্দেশ্য নষ্ট করতে আর না পারবে শেখ মৃত্যুঞ্জয়ের দাপট থেকে বাঁচতে। চিন্তা মুক্ত থাকবেন সবসময়। অযথা চিন্তা করবেন না। আপনার চিন্তা আমার শিশুর সর্বনাশের কারণ হোক আমি চাইছি না। বুঝতে পারছেন?’

বেগম সুগন্ধ্যা যেন একটু স্বস্তি পেল। যাক! ওতো চিন্তার কিছু নেই। তবে বেগম সুগন্ধ্যার সেদিন জানা হলো না জমিদারের সেই মানসিক পীড়া, যন্ত্রণাটি আসলে এক অনন্য সাধারণ কন্যা! সে সাধারণের মধ্যেও কিন্তু অসাধারণ। সেই কন্যা যে এক সময় বেগম সুগন্ধ্যার গলায় কা’টা’র ন্যায় আটকে থাকবে। আহ্! সে কী কষ্ট!

—————
সিন্ধু নদীর ধারে বসে আছে। সাথে সঙ্গী সাথীগণ নেই। আজ কেন যেন একা একা ঘুরতে বেরিয়েছে। তার শহর যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে সেটা হয়তো এখন আর সেটা ভালো কারণে হবে না। কারণ, এলাকার বৃদ্ধ ধনী ব্যক্তি লিয়াকত মিয়া তার পঁয়তাল্লিশ বছরের দামড়া ব্যাটা মঞ্জুর জন্য সিন্ধুর পিতার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। এটাও উল্লেখ্য যে সে সিন্ধুকে শহরে নিয়ে পড়াবে। সিন্ধুর কাজ কেবল মঞ্জুর দুই বড় বড় ছেলে আর ছেলে বউদের শাসন করা। যেদিন থেকে মঞ্জুর স্ত্রী গত হয়েছে সেদিন থেকেই পুত্র, পুত্রবধূরা খুব শয়তানি করছে। ঘরে শান্তি নাই। এখন এমন কাউকে দরকার যে চাবি ঘোরাতে পারবে ভালো। সিন্ধুর ব্যাপারে গ্রামে কম বেশ অনেকেই অবগত। এমন চালাক-চতুর, শিক্ষিত মেয়ে নেই এখানে। তাই সবার আগে সিন্ধু নজরে আসে। তবে সাপুড়ের মেয়ে বলে কেউ আর আগায় না। এই ধনী এগিয়ে এলো তার পেছনে কারণটা স্পষ্ট। স্বার্থ! স্বার্থের বাহিরে এক ফোঁটা কেউ কারো জন্য করেনা। সিন্ধুর পিতা নিমরাজি। যেকোনো মুহূর্তে কিছু হয়ে যেতে পারে। ভয়ে আতঙ্কে তার যাচ্ছে তা অবস্থা! সে তার পিতার অনুগত। যা বলে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে। এখন যদি এটা বলে যে বিয়েটা করতে। তখন? তখন কী করবে সে!

সিন্ধু ঢিল ছুঁড়ছে নদীর স্তব্ধ পানিতে। এখন পানির ঢেউ নেই। একদম যেন বসে আছে! ঠিক বরফের মতোন। কেবল ঢিল ছুঁড়লেই যা একটু নড়ে ওঠে।

-‘আপনে ঐ মাইয়া না যারে জমিদার বাবু ধইরা নিছিলো?’
আকস্মিক কারো গলা শুনে সিন্ধু পেছন ফিরে তাকায়। সেদিনকার ছোঁকরা! এ কত অপমানটাই না করল সেদিন!

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here