সিন্ধু ইগল – (১৪)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
চেহারায় কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা প্রকাশিত ছিল জাদুর। পরক্ষণেই তা বদলে গিয়ে হালকা লাজুকতা ভীড় করল তার ঘুমুঘুমু মুখটাতে। জায়িন নিশ্চুপ রয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল সেই মুখখানা। মুখের ওপর ছড়ানো ছিটানো চুলগুলো জানালা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে হালকা উড়ে চলেছে মাঝে মাঝে। আর চোখদু’টো যেন বেলুনের মতো ফুলে আছে। তবে সেই চোখজোড়া দেখেই জায়িন বুঝে গেল, মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত নেশায় আসক্ত। ব্যাপারটাতে সে খুবই খারাপ বোধ করল। হালকা গোলাপি বর্ণ ঠোঁটটা কেমন শুকিয়ে আছে। তা দেখে জায়িন হঠাৎ একটু হাসল। জাদু তার নিবদ্ধ দৃষ্টি দেখেই ঠোঁটদু’টো আপনা-আপনি চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে নিলো৷ জায়িন তখন জাদুর চোখে দৃষ্টি রেখে হেসেই বলল, ‘বসন্ত এসে গেছে।’
-‘তা তো জানি না।’
সবে ঘুম ভেঙেছে বলে কণ্ঠে একটু জড়তা জাদুর৷ জায়িন ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর জায়গাটাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। জাদুর চেহারাটা তখন যেন কেমন দেখাল! জায়িন তা বুঝতে চাইল না৷ মাথার নিচে দু’হাত পেতে জাদুর দিকে চেয়েই বলল, ‘আমিও জানতাম না। হয়তো বসন্তের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে হতে পারে এখন।’
জাদু উঠে পড়ল জায়িনের কাছ থেকে। সোফার ওপর মাধুর ফেলে রাখা সাদা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে সেখানেই বসল, জিজ্ঞেস করল, ‘এটাই জানাতে এসেছ?’
হাসল না জায়িন। তবে তার মুখটা কেমন হাসিহাসিই লাগছে। জবাব দিলো, ‘এটা তো জানা হতো না, যদি না তোমার শুষ্ক ঠোঁট কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেতাম।’
জাদু মিষ্টি হেসে বলল, ‘মাধু তো এখনো জাগেনি।’
-‘জানি।’
জায়িনের উত্তরটা শুনে সস্মিত চেহারায় জিজ্ঞেস করল, ‘আর কী জানো?’
নির্বিকার ভঙ্গিতেই জায়িন উত্তর দিলো, ‘সকালের ব্রেকফাস্ট ও-ই রেডি করে। এখন যেহেতু ও ঘুমে, তাই তোমাকেই কফি করতে যেতে হবে। আমি তোমার হাতের কফি খেতে পারব কিনা সেটাই জিজ্ঞেস করতে চাইছ তুমি।’
জাদু তার নিজস্ব কায়দায় চেহারায় মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলল, ‘সো ইনটেলিজেন্ট। তাহলে থাকো, আমি আসছি।’
জায়িন কোনো উত্তর দিলো না। জাদুর যাবার পথে চেয়ে রইল। কফি তৈরি করে ফিরতে ফিরতে জাদু এসে দেখল জায়িন চোখ বুঁজে পড়ে আছে৷ তবে সে জাদুর আগমন টের পেয়েছে। অপেক্ষায় আছে কখন জাদু ডাকবে।
একটু হেসে জাদু এগিয়ে এসে জায়িনের গালে গরম কফির মগটা ছুঁইয়ে দিলো। আর অমনি লাফিয়ে উঠল জায়িন। মিটিমিটি হেসে জাদু কফির মগটা দেখিয়ে ইশারা করছে সেটা হাতে নিতে। জায়িন নিশ্চুপ ভঙ্গিতে চেয়ে দেখছে আজ জাদুর অন্য এক অভিব্যক্তি। চেহারায় যেন দুষ্টুমি খেলা করছে ওরর। এর আগে এমনটা দেখেনি সে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে জাদু জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ ছেলেরা তাহলে প্রাচীর টপকে পড়শিদের বাড়ি এসে পড়শির বেডরুমে ঢুকে পড়ে?’
ততক্ষণে জায়িন মগটা নিয়ে নিয়েছে হাতে৷
জাদুর কথা শুনে তা পাশের সেন্টারটেবিলে রাখল। তারপর ওকেও মগটা রাখতে বলল। জাদু তার কথায় প্রশ্নচোখে তাকাতেই জায়িন আবারও তাকে ইশারা করল রাখতে। আর তার কথামতো জাদু মগটা রাখতেই আচমকা ওকে টেনে এনে বিছানাতে ফেলল জায়িন। তখন বুবন জেগে গিয়ে সরে পড়ল। ওদের দু’জনের দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল দূরে গিয়ে। জায়িন ফেলে দিয়েই ক্ষান্ত হলো না। ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে শুয়ে পড়ল সেও। জাদু হতবাক চোখে চেয়ে কিছু বলবার আগেই জায়িন বলে উঠল, ‘প্রাচীর টপকে পড়শিদের বাড়ি আসিনি। হবুবউয়ের কাছে এসেছি। ভেবেছিলাম এসে তোমাকে পাবো না। ভাগ্যক্রমে পেয়েই যখন গিয়েছি তখন পুরো ঘুমটা শেষ করেই তারপর তোমাকে ছাড়ব।’
কথাগুলো বলে জাদুর মুখের দিকে তাকাল জায়িন। জাদুর চেহারাতে প্রকাশ পাচ্ছে, তার এমন আকস্মিক কাণ্ডে না পারছে সে দূরে সরতে আর না পারছে কাছে থাকতে। আর সেটাই যেন জায়িন উপভোগ করছে।
_________
আজ রেজার দিনটাই শুরু হয়েছে বিশ্রীভাবে। চারদিকে বিপদ, সমস্যার অন্ত নেই। এর মাঝে নতুন করে আরেক ঝামেলা সামলাতে হবে। এত সমস্যা নিয়ে কি জীবন পার করা যায়? কবে মুক্তি পাবে সে এই জীবন থেকে? নিজের জীবনের প্রতি সে খুবই তিক্ত। মরে গেলেও অন্তত এই সমাপ্তহীন সমস্যাগুলো থেকে বেঁচে যেত। বিরক্তির সঙ্গে রাগটাও হাজার গুণ বেড়ে চলেছে তার৷
গাড়িটা এসে থামাল কল্যাণপুরের খুব ভেতরের দিকে একটা দো’তলা বিল্ডিংয়ের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত পায়ে চলে এল বিল্ডিংয়ের ভেতরে। তাকে দেখে দু’তিন জন ছেলে সালাম দিলেও সে ওদের সালাম শুনতে পেল না বোধ হয়। রাগের চোটে মাথা টনটনে হয়ে আছে তার। ঘরে ঢোকা মাত্রই একটা মুহূর্ত দেরি না করে ফ্লোরে হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলে রাখা লোকটাকে বেধড়ক মারতে শুরু করল। প্রথম পর্যায়ে হাত, পা দিয়ে ঘুষি, লাথি মারল। কিন্তু তাতেও রাগটা নামল না। লোকটার গোঙানির আওয়াজে আরও বৃদ্ধি পেল। পায়ের কাছে রডটা পেয়ে সেটা উঠিয়েই গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে বিরতিহীন মারতে থাকল। শেষ আঘাত মাথায় লাগার কিছু সময় পরই মুখ বাঁধা অবস্থাতে বমি করে ফেলল লোকটা। জায়িনও ততক্ষণে এসে পৌঁছে গেছে। ঘরে ঢুকে রেজাকে ভয়ঙ্কর রাগান্বিত অবস্থায় লোকটাকে মারতে দেখে বৃদ্ধা আঙুলে কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে এসে বাইরে দাঁড়াল৷ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিকে তাকাতেই ওদের মধ্যে একজন বলতে শুরু করল, ‘নজরে নজরেই রাখছিলাম স্যার। যার জন্য পালায় যাইতে পারে নাই।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জায়িন। মৌপ্রিয়াকে বাস চাপা দেওয়ার বিষয়ে বাসের এই ড্রাইভারটার সঙ্গে ডিল করার সময়ই জায়িনের মনে হয়েছিল, বেইমানি করে বসতে পারে লোকটা। শুধু রেজার অনুরোধে কাজ শেষে ওকে ছেড়ে রেখেছিল। তার মনেও মায়া, ভালোবাসা কাজ করে। তবে তা মানুষ চিনে আর বুঝে। কিন্তু রেজা এতগুলো বছর তার সঙ্গে থেকেও খুব সহজে মানুষ চিনতে পারা শিখল না। সেটাই আফসোস!
ঘরের ভেতর তাকিয়ে একবার দেখে যা বুঝল, রেজা আজ পিটিয়েই ড্রাইভারটাকে মারবে বলে পণ করেছে হয়তো। অকাজে এত এনার্জি এবং সময় নষ্ট করা জায়িনের একদমই অপছন্দ। অতি মাত্রায় বিরক্ত হচ্ছে সে রেজার ওপর। দরজার গায়ে টোকা দিয়ে সে ডেকে উঠল ওকে। তখন রেজা জায়িনের উপস্থিতি টের পেয়ে থামল৷ রড ছুঁড়ে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল ওর সামনে, ‘কাল রাতে এই শুয়োরটা যে কী প্যারা দিয়েছে! দূরে না থাকলে কালই ওকে আজরাইলের মুখ দেখাতাম।’
-‘রিল্যাক্স! তোমার হাইপার লুক থেকে ইনোসেন্ট লুকটাই ভালো।’
জায়িনের মশকরায় আজ রেজা কিছুই বোধ করছে না। শরীরে রাগ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু বোধ হচ্ছেও না তার। কানের কাছে আবার ড্রাইভার লোকটার আর্তনাদ আসতেই এবার সে রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রডটা উঠিয়েই সজোরে মাথায় বাড়ি মেরে দিলো ওর। তিরের বেগে রক্ত ছুটে ভরে গেল ড্রাইভারের চেহারাটা। শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়েছে তার মাঝেই। রক্ত ভেসে যাওয়া লোকটাকে দেখতে দেখতে পেছন থেকে বিড়বিড় করে জায়িন তখন বলে উঠল, ‘আই হেট বিট্রেয়ার।’
ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে রেজা চেঁচিয়ে উঠে বাইরের ছেলেগুলোর মধ্যে মানিক বলে কাউকে ডেকে উঠল। পানি চাইল তার কাছে। মাথাটা এপাশ ওপাশ দু’বার ঝাঁকিয়ে লাশটার দিকে চেয়ে বলতে থাকল, ‘সুখে থাকতে তো কুত্তায় কামড়াচ্ছিল! লাখ টাকা নগদ পেয়েও আরও চাই! আরও চাই! কবরে গিয়ে চাস এবার।’
রাগটা তবুও নামেনি রেজার। ফিরে তাকিয়ে জায়িনকে বলল, ‘বলে কিনা “আমি থানার সামনে দাঁড়াই আছি কিন্তু! বাঁচবার চাইলে জলদি জলদি পঞ্চাশ হাজারের ব্যবস্থা করেন।” কত বড়ো বুকের পাটা ওর! আমাকে ব্ল্যাকমেইল!’
মানিক বহু আগেই পানি নিয়ে জায়িনের পিছে দাঁড়িয়ে ছিল। রেজা একটু শান্ত হতেই পানিটা এগিয়ে দেয় ওকে। জায়িন হাত ঘড়িতে সময় দেখে ছেলেগুলোকে বলে, ‘ডোম এনে লাশ পিস করার ব্যবস্থা কর।’
বলেই সে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। তারপরই রেজাও এলোমেলো, ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসে৷ জায়িনের সাথে কিছু কথা বলে যার যার গাড়ি করে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
কেবিনে এসে ঢুকতেই জায়িন পিছু ডাকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফিরে তাকিয়ে দেখে সিফাত ক্লান্ত চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আজ মনে পড়ল জায়িনের, বেশ অনেকদিনই হলো সিফাতের সাথে একাকী সময়টা কাটানো হয় না। আজ সিফাতের চেহারা দেখেই সে নিশ্চিত হয়ে গেছে, একটু বাদে সিফাত কী চাইবে তার কাছে। কিন্তু এমন মুহূর্তে সে আপাতত নিজের কাজ আর জাদু, মাধু ছাড়া অন্য কিছুতে খামোখা সময় ব্যয় করতে রাজি নয়।
সিফাত তার কাছে এসেই বলল, ‘মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য ফ্রি আছি, জায়িন৷ অনেকদিন হলো তোমার সঙ্গে বসে দীর্ঘ সময় কথাও হয় না আমার। এই তিনটা ঘণ্টার আবদার ফেলবে না প্লিজ। চলো না আমার সঙ্গে!’
-‘আমি তো ব্যস্তই। তুমি নিজেও ব্যস্ত। তার জন্যই একটু সময় দূরে দূরে আমরা। নয়তো এভাবে এসে আমার কাছে তোমাকে আবদার ধরতে হতো না, সিফাত। আর আমাদের কাজগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাইরে দেখা করার রিস্ক তো নেওয়াই যাবে না।’
-‘বাইরে দেখা করতে চাইছে কে? আমার ফ্লাটে যাব।’
-‘আচ্ছা, তিন ঘণ্টা সময় তো? আমার হাতে এখন একটু কাজ আছে। কাজটা এগোতে পারলে কল করব তোমাকে।’
মুখ ভার করে সিফাত চলে গেল। জায়িন কাজ শেষ করলেও ভুলে গেল সিফাতের কথা। বাইরে এসে ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠল সে। পাশে ড্রাইভার ফ্রন্ট মিররে বারবার দেখতে থাকল পেছনের সিটে বসা সিফাতকে। সিফাত ড্রাইভারকে নিষেধ করে রেখেছে, যেন তার উপস্থিতি জায়িনকে না বলে। কিন্তু জায়িনের দৃষ্টির সীমানা সম্পর্কে হয়তো সিফাতের এখনো সমুদয় ধারণা হতে বাকি। কথা শেষ করেই জায়িন ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থেকে নেমে যেতে। রেজা ছাড়া এমনিতেও তার অন্য কাউকে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভিং করাতে ভালো লাগে না। ড্রাইভারটি তার কথামতো নামতেই সিফাতকে উদ্দেশ্য করে জায়িন বলল, ‘স্টিয়ারিংটা এসে ধরো সিফাত।’
প্রচণ্ড খুশি নিয়ে সিফাত বেরিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। তারপর বেরিয়ে পড়ল তাদের গন্তব্যে।
_________
জায়িনের থেকে রাত ন’টায় বিদায় নিয়ে সিফাত সেদিন আবার রওনা দিয়েছিল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। তবে তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। ওখানের কাজ আপাতত শেষ করে মনটাকে সতেজ রাখতে পরদিন দিনের বেলা সে তার সহকর্মীদের সাথে সমুদ্র সৈকত, পাহাড় ঘুরে বেড়িয়েছিল কিছু সময়। ফেরার পথেই ঘটে যায় চরম দুর্ঘটনা। কে জানত, তার মৃত্যুটাও হবে রাজিয়ার মতোই? তবে পরিকল্পিত উপায়ে তার গাড়ির বিস্ফোরণটা হয়েছিল, এ নিয়ে আর কারও কোনো সন্দেহ হয়নি। পুরো ডিপার্টমেন্ট এবার আরও জোরালোভাবে নড়েচড়ে বসলেও জায়িন থাকে ঠান্ডা। এরপর সে যা আবিষ্কার করে তা রেজাকে জানায়, ‘এই ঘটনার উদ্দেশ্যগুলো এতটা গভীরে নিয়ে ভাবা হয়নি, রেজা৷ আমাকে আমার কাজ থেকে অমনোযোগী করায় শুধু উদ্দেশ্য নয়। রাজিয়ার পর সিফাতের মৃত্যু প্রমাণ করে, আমার প্রেমিকা হওয়া মানেই তার মৃত্যু।’
রেজা ভীষণরকম বিস্মিত না হলেও একটু বিস্ময় ঘিরে ধরে তাকে।
-‘একটা কথায় এখন কানে বাজছে স্যার। শি ইজ আ সাইকো।’
জায়িন গাড়ির হুডের সঙ্গে হেলে দাঁড়াল, ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবছে সে। রেজা তখন বলল, ‘ফারজানা ম্যাম তাহলে এখন লাইফ রিস্কে আছে।’
-‘ওর কথায় ভাবছি।’
-‘উনি এখন শ্যুটিঙের কাজে মালয়েশিয়া না? ওনাকে আপাতক ফিরতে বারণ করলে ভালো হয়।’
-‘শ্যুটিং শেষে ওখান থেকে ওকে দেশে ফিরতেই হবে। পরবর্তী শ্যুট দেশে হবে যে। কিছু তো একটা করতে হবে।’
-‘ফিরবে কবে?’
প্রশ্নটা শুনতেই জায়িনের টনক নড়ে, ‘মাই গড! আজ রাতেই ওর দেশে ফেরার কথা।’
কথাটা বলেই হাত ঘড়িতে সময় দেখল সে। রেজা তখন বলল, ‘আমাদের এয়ারপোর্ট যাওয়া উচিত। আর আজ আমাদের গাড়িতেই ওনাকে সঙ্গে আনতে হবে।’
-‘হুঁ, ঠিকই বলেছ। কিন্তু এর মাঝেও আমার সুন্দরী টুইনের প্রশংসা করতে ইচ্ছা করছে, বুঝলে? একটু হলেও চাপে ফেলেছে তারা আমাকে।’
মৃদুহাস্য চেহারায় বলতে বলতে জায়িন গাড়িতে উঠে বসল। ফারাজানা সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে জায়িনকে দেখেই খুশিতে বাকরুদ্ধ। বলা বাহুল্য, জায়িনের প্রেমিকারা তার পেশা এবং তার স্বরূপ, সব বিষয়েই অবগত। আর সকল প্রেমিকের মতো যখন ইচ্ছা তখন প্রেমিকাদের সাথে বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় না জায়িনকে কখনোই। বলা যায়, সেইসব প্রেমিকাদের কাছের বন্ধু এমনকি পরিবারও জায়িনের সাথে তাদের প্রণয় সম্পর্ক বিষয়ে জানায়ও না তারা। আর আজ সেই জায়িনকে হঠাৎ করে সকলের সামনে দেখে আশেপাশের সব কিছু ভুলে ফারজানা ঝাঁপিয়ে পড়ে জায়িনের বুকে। এবং সেই রাত থেকেই ফারজানার জন্য সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে ফেলে জায়িন। তার এতটা খেয়াল রাখার একটাই মাত্র কারণ, ফারজানার মৃত্যু হোক তা সে চায় না। প্রেমিকাদের সে নিজের শিকারের চোখে দেখলেও সব শিকারকে সে মৃত্যু দেয় না। তবে তার সঙ্গে পরকীয়াতে যে নারীগুলো লিপ্ত ছিল, তাদের মৃত্যু ছিল অবধারিত৷
_________
দু’দিন হলো জায়িন বাড়িতে ফেরেনি। বাসার সকলের জানামতে সে হয়তো মাসখানিক পরেও ফিরতে পারে, আবার চাইলে এক সপ্তাহ পরেও ফিরতে পারে৷ হুটহাট তার বাসায় না ফেরা নিয়ে এখন আর কারও মাঝে চিন্তা প্রকাশ পায় না। অভ্যাস হয়ে গেছে তাদের৷
গতকাল জাহিদ ব্যবসায়ের কাজে গেছে ইন্ডিয়া, মাহতাব সাহেব গেছেন এলাকার মসজিদ থেকে তাবলীগে। বাড়িতে পুরুষ বলতে শুধু বাড়ির চারপাশের গার্ডগুলো৷ তাছাড়া সারা বাসায় জান্নাতি বেগম, জাহিদের বউ এশা আর কাজের দু’টো মেয়ে ছাড়া কেউ নেই।
সময়টা চলছিল বিকাল৷ কিছুদিন হলো জাদু আর মাধু কেউ-ই এ বাড়িতে আসে না। এখানে আত্মীয় স্বজন বলতে মেয়েদু’টোর কেউ নেই। বড্ড মায়া হয় জান্নাতি বেগমের, ওদের জন্য। ভাবলেন নিজেই গিয়ে দেখা করে আসবেন ওদের সঙ্গে। তাই কাজের মেয়েটাকে সাথে করে ওদের বাংলোতে এসে দু’বোনের মাঝে একজনকে দেখেই আঁতকে ওঠেন। বিছানাতে যেন নির্জীব হয়ে পড়ে আছে সে। আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে ওর কণ্ঠ থেকে। দ্রুত ওর কাছে এসে দেখেন গায়ে ভীষণ জ্বর ওর৷ আরও দেখতে পান, হাতে পায়ে জখমের দাগ। জান্নাতি বেগম একটু বিভ্রান্তে পড়ে যান এই নিয়েই, যে মেয়েটি মাধু না জাদু? মাধু তা বুঝতে পেরে নিজেই নাম জানিয়ে ব্যথায় জর্জরিত শরীরটাকে টেনে তুলে উঠে বসে। কিন্তু তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, বসে থাকার শক্তিটুকুও নেই ওর শরীরে। এমন অবস্থা কী করে হলো তা জান্নাতি বেগম জানতে চাইলে মাধু জানায়, ছোটোখাটো একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল সে কাল রাতে। কিন্তু শরীরের জখমগুলো দেখে জান্নাতি বেগমের মনে হলো, এগুলো কারও করা আঘাতের দাগ। নিজের ভাবনা নিজের কাছেই রেখে মাধুকে উপদেশ দিলেন হাসপাতাল যাবার জন্য। কিন্তু মাধু কোনোভাবেই হাসপাতাল যেতে রাজি নয়। জিজ্ঞেস করলেন ওকে, ‘জাদু কোথায়? এ অবস্থায় একা একা পড়ে আছ ঘরে৷ আমাকেও তো ফোন করে জানালে পারতে।’
মাধু কোনোরকমে উত্তর দেয়, ‘জাদু গতকাল রাতে সিলেট গেছে জরুরি প্রয়োজনে। ওর ফিরতে ফিরতে অন্তত তিন চারদিন লাগবে। আমি নিজেই খেয়াল রাখতে পারব আন্টি। আপনি টেনশন করবেন না। আপনি এসেছেন, এতে ভীষণ ভালো লাগছে।’
জান্নাতি বেগম এমন অবস্থায় মাধুর একা থাকাটা ঠিক মনে করছেন না। জখমগুলোতে ওষুধ লাগানো হলেও মনে হচ্ছে ক্ষতগুলো এখনো তাজা। আর গায়ে জ্বর তো সাংঘাতিক। এইভাবে নিজের খেয়াল নিজে রাখা কী করে সম্ভব? এতটা অনুদার মনের নন তিনি। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, জাদু না ফেরা অবধি মাধু তাদের বাসাতেই থাকবে। তা শুনে মাধু প্রথম দু’বার অমত করলেও পরে আর না করতে পারল না। জান্নাতি বেগম আর তার কাজের মেয়েটির সহায়তায় চলে এল শেখ বাড়ি। সময় যত যেতে থাকল, মাধুর অবস্থা তত খারাপ হতে থাকল। তবু সে জিদ ধরে বসে আছে, হাসপাতাল কোনোক্রমেই যাবে না। তার একটাই কারণ জানায় সে, হাসপাতাল জায়গাটা সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না৷ এই অবস্থায় একজন ডাক্তারের দরকার খুবই। উপায় না পেয়ে জান্নাতি বেগম মাধুর অবস্থা জায়িনকে ফোন করে জানায়। যাতে সে যেন কোনো ব্যবস্থা করে দেয় মাধুর চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তা শোনার পর জায়িন সে রাতে নিজেই ছুটে আসে গাজীপুর। যা জান্নাতি বেগম কোনোভাবেই আশা করেননি।
____________________________________________
***কিছু পর্বে কখনো কখনো আপত্তিজনক কিছু মুহূর্ত থাকতে পারে। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব, তা শালিনভাবে উপস্থাপন করার।