সিন্ধু ইগল – (১৬) ইসরাত জাহান দ্যুতি

সিন্ধু ইগল – (১৬)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

স্টিলের একটা গ্লাসে পানি ঢেলে টেবিলের অপর প্রান্তে বসা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো জায়িন। মাথাটা নিচু করে গম্ভীরভাবে বসে আছে মেয়েটি। টেবিলের ওপর পানি ভর্তি গ্লাসটা দিয়ে কয়েকবার ঠকঠক শব্দ করে মেয়েটির মনোযোগ কাড়তে চেষ্টা করল সে। কিন্তু মেয়েটি ভীষণ একরোখা আর রাগী। রাগের আভাসটা চেহারাতেই প্রকাশিত তার৷ ওভাবেই বসে রইল তাই। মোলায়েম স্বরে জায়িন তাকে একবার ডেকে উঠল, ‘আলিয়া মেহজাবিন!’

চোখ তুলে তাকাল এবার মেয়েটি। চোখে তার ভয়ঙ্কর ক্রোধ। ঠোঁটদু’টো চেপে ধরে শক্ত মুখ করে চেয়ে রইল জায়িনের দিকে৷ ঘামে জর্জরিত শরীর তার। গলা, ঘাড়, কপালের কোণ বেঁয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে৷ জায়িন তার মুখের সামনে একটু এগিয়ে এসে শুধাল, ‘ক্লান্ত ভীষণ?’
এক টানা বিশদিন ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করার জন্য কণ্ঠ ডেবে গেছে মেয়েটির। স্বরভঙ্গি বদলে গেছে তার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে, ‘বিট্রে করে পার পেয়ে যাবে তুমি?’
-‘বিশ্বাসঘাতকতা আমার বৈশিষ্টে নেই। ওটা তোমার বৈশিষ্ট্য, ডিয়ার প্রেমিকা।’ বলেই ফিচেল হাসল সে।
বিদ্রুপাত্মক হাসি ধরে জবাব দিলো মেয়েটি, ‘আয়মান মেহরিন। আ সাইকো অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডিক্টেড সিরিয়াল কিলার। যে শুধু মানি আর ড্রাগস চেনে৷ এর বাইরে সে দুনিয়া বলতে কিছু বোঝে না। তাকে বউ করার স্বপ্ন দেখাটা সাগেশিয়াস জায়িন মাহতাবের সঙ্গে ঠিক যায়নি। এখনো সময় আছে জায়িন৷ আমাকে এখান থেকে বের করো। অনেক উপভোগ্য জীবনযাপন করার সুযোগ পাবে তুমি আমার সঙ্গে।’

জায়িন চিন্তামগ্ন চেহারায় গম্ভীর হয়ে বসে রইল শেষ কথাটি শুনে। তারপর মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল, ‘শেষবার জিজ্ঞেস করব মাধু। উপস্ স্যরি, আলিয়া। বাংলোর মালিক কে? কোথায় আছে সে? তার ডিটেইলস বলো আমাকে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, স্বাভাবিক জীবন দেবো তোমাকে। আমার কথা আমি রাখব।’
মাধুও এবার জায়িনের মতোই গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সেই জীবনটা আমি তোমার সঙ্গে চেয়েছিলাম, জায়িন। তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ আমার সঙ্গে।’
-‘উহুঁ, আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম এই ভয়ঙ্কর জীবন থেকে তোমাকে বের করে আনব৷ স্বাভাবিক জীবন উপহার দেবো তোমাকে। একবারও বলিনি, বিয়ে করব তোমাকেই। তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাতে চেয়েছিলে, তোমার আশা পূরণ করেছি কতগুলো রাত ধরে। এর থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার যোগ্যতা তুমি রাখো না।’
-‘কেন রাখি না? তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য কোথায়?’
জায়িন হাসতে হাসতে বলল, ‘এই একটা জায়গায় তোমার সঙ্গে আমার দারুণ মিল৷ নারী শরীরের ঘ্রাণে না ডুবলে আমার মন আর মস্তিষ্ক চাঙ্গা থাকে না। আমি কখনো ভাবিনি, আমারই মতো কেউ একজন কখনো আমার প্রেমিকা হতে পারে।’
-‘স্টপ ইট জায়িন। তোমাকে কাছে পাবার পর থেকে আমি দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে কাছে টানিনি।’
-‘বেচারা লেকচারার! নামটা যেন কী ছিল? টিটো না কি টিটু? হোয়াটএভার, ছেলেটা তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ওকে বিয়েটা করলে তোমাকে আজ এখানে থাকতে হতো না।’
-‘আমার আর তোমার কথা বলো জায়িন। তুমি কেন আমার সাথে এমন করলে?’
-‘কারণ, তোমার বোনকেই আমার চায়। তোমাকে নয়।’
উত্তেজিত হয়ে পড়ে মাধু জিজ্ঞেস করল, ‘ওর আর আমার মাঝের তফাৎটা কী? স্বাদ তো নিয়েছ আমার শরীরেরই। ওর প্রতি কেন এত টান তাহলে?’
-‘ভালোবাসা! ভালোবাসা! আর ভালোবাসা।’
আর শুনতে মন চাইল না মাধু। চোখমুখ খিঁচে জায়িনকে শুধু বলল, ‘আমাকে এখান থেকে মুক্ত করো প্লিজ৷ আর সহ্য করতে পারছি না আমি।’
-‘কথা যেহেতু দিয়েছি, সেই কথা রাখব তো অবশ্যই। দু’দুটো খুনের আসামি হয়েও তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলাইনি। সমস্ত ব্লেম মৃত আয়মানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তোমাকে মাত্র কয়েকটা বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। শুধু ওকে সাপোর্ট করার দায়ে। একটু তো কষ্ট করতেই হবে। দাঁতে দাঁত চেপে এখানেই পড়ে থাকতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই তোমাকে মুক্ত করার। সেই পথ তোমার বোন বন্ধ করে দিয়ে গেছে নিজেকে ধরা না দিয়ে।’
-‘ও মরে গেছে, এটা বিশ্বাস করতে বলছ? কোনো ব্যাকআপ প্ল্যান না রেখে ও লাইফ রিস্ক নেয়নি।’
-‘আমি নিজ হাতে ওর ডেডবডি উদ্ধার করেছি।’
-‘ওই ডেডবডি দেখলেও আমি বিশ্বাস করব না।’
জায়িন মুচকি হেসে বলল, ‘আমিও না। এ জন্যই তো বলছি, ওকে খুঁজতে হলে আমার জানা প্রয়োজন বাংলোর মালিকের বায়োডাটা।’
-‘এতোটা বোকা আমি নই, জায়িন। আমাকে এখান থেকে বের না করলে মানকে তুমি কোনোদিনও খুঁজে পাবে না।’
বিশটা দিন ধরে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চলেছে জায়িন। কোনোভাবেই মাধুর মুখ থেকে বাংলোর মালিকের খোঁজ জানতে পারছে না সে। যতদূর মাধুকে চিনেছে সে, মরবে তবু জাদুর হদিস সে পেতে দেবে না। কিন্তু জাদুকে না পেলে সে মাধুকেও বাঁচিয়ে রাখবে না।

এগিয়ে এসে মাধুর দু’আঙুলের ফাঁকে কলম গুঁজে খুব শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘এই হাতে প্রথম যাকে খুন করেছিলাম, সে আমার অতি প্রিয় একজন মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ঠিক একইভাবে তুমিও আমার আরেকজন প্রিয়’র সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ৷ তোমাকে মেরে দিতে আমার খুব বেশি সমস্যা হবে না। শুধু এই মুখটার সঙ্গে আয়মানের মুখটা মিল বলেই তোমাকে মারতে আমার মায়া লাগছে। সেই সতের বছর আগে থেকেই তুমি আমার চক্ষুশূল ছিলে। তার দুটো কারণ, আমার যা পছন্দ তা আমি ওয়ান পিস দেখতেই ভালোবাসি। সেই জিনিসের সেকেণ্ড পিস থাকলে তা আমি কোনোদিনও গ্রহণ করিনি। সেখানে আমার সব থেকে দামী সম্পদটারই আরেক পিস, তা আমি মানতে পারছিলাম না। আজও পারি না। তোমাকে দেখলেই আমার ইচ্ছা করত, এই চেহারাটা আগুনে পুড়িয়ে দিই। তোমাকে সহ্য করতে না পারার সেকেণ্ড অ্যান্ড লাস্ট রিজনটা কী জানো? আমার আয়মান বড্ড সরল আর বোকা ছিল। তার জন্যই ওকে মারলে কাটলেও ও প্রতিবাদ করতে জানত না৷ যেখানে ও মায়ের অতি আদরের কন্যা ছিল, সেখানে প্রায়ই ওর গালে থাপ্পড়ের দাগ, হাতে, গলায় খামচির দাগ দেখতে পেতাম। কে মেরেছে জিজ্ঞেস করলেই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলত, “আমার বোন মেরেছে।”

যন্ত্রণায় আওয়াজটুকুও করতে পারছে না মাধু। তবু একবার মুখে উচ্চারণ করল না ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে৷ ওর এত সহন শক্তি দেখে জায়িন আঙুল থেকে কলম তুলে বলল, ‘এখন অবধি অল্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছি আমি। ওকে খুঁজে না পেলে কসম, তোমাকে জানে শেষ করব।’
কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মাধু, ‘খুব দরদ, না?’
চকিতেই জবাব দিলো জায়িন, ‘হ্যাঁ ভীষণ।’
-‘আজ কিংবা কাল, যখনই মুক্তি পাই। আমাকে ধোঁকা দেওয়ার খেসারত মানকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হবে। আর তোমাকেও।’
হেলেদুলে হেঁটে এসে জায়িন আবার তার পূর্বের জায়গায় বসল। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে জবাব দিলো, ‘ধোঁকা তো তুমি দিলে তোমার বোনকে৷ কিন্তু আমাকে ধোঁকা দেওয়ার শাস্তি তোমার বোনও পাবে। আর তুমি তো পাচ্ছই।’
কথাটা বলে আবার সোজা হয়ে বসে মাধুকে বলল, ‘কী বললে তখন? আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি না তোমরা দুইবোন আমাকে দিয়েছ? প্রপোজ করেছি একজনকে, আর প্রেম করেছ আরেকজন। তুমি নিজে থেকেই বাঘের খাঁচায় এসে ধরা দিয়েছিলে। এমনটা কেন করেছিলে বলো তো? এর পেছনের উদ্দেশ্য কী ছিল? একবারের জন্যও মনে হয়নি, তোমাদের এই অদল বদল খেলা আমি ধরতে পারব?’

এতক্ষণ জিদ দেখিয়ে পানিটা না খেলেও এবার আর জিদ ধরে রাখতে পারল না মাধু। পানিটা খেয়ে চুপচাপ মাথা নত করে রইল। জায়িন নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল মাধুকে, ‘ওকে কেন মারতে চাইতে? কীসের রাগ তোমার ওর প্রতি? ও বড়ো বলে কি তোমার থেকে বেশি আদর পেত তোমাদের বাবা-মা’র থেকে? এর জন্যই কি ওকে তুমি হিংসা করতে? আমি যতটুকু দেখেছি তোমাদের, তাতে ও তোমাকে সব সময় ভয় পেয়ে চলত। তুমি ছোটো হওয়ার পরও ও তোমাকে আপু বলে ডাকত। কী করেছিল ও? যার জন্য ওকে খুন করতে চাও?’
-‘আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না। যাও এখান থেকে।’
-‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসে তোমার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি কি
এমনি এমনি?’
মাধু মুখ তুলে কৌতূহল দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাকে আর মানকে কীভাবে আলাদা করতে?’
প্রশ্নটায় জায়িন হা হা শব্দে হেসে উঠল, ‘এতদিন বাদে অবশেষে জানার ইচ্ছা হলো তাহলে? আমার এই চোখদু’টোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পর্কে তুমি অনবগত। এমনি এমনি এই ডিপার্টমেন্টে আমার মূল্যায়ন তৈরি হয়নি।’
কথাগুলো বলেই একটু থেমে মাধুর কাছে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটের দিকে চেয়ে বলল, ‘মুচকি হাসলে আমার আয়মানের অধরের মাঝ বরাবর নয় ঠিক, তার থেকে একটু বাঁ পাশে খু্বই ছোটো আর সুন্দর একটা ডিম্পল তৈরি হয়। ওর সেই ছোটো থেকেই এই সৌন্দর্যটা আমার নজরে পড়েছিল। বড়ো হবার পর ওই ডিম্পলটা আরও স্পষ্ট হয় হাসলে। ভাগ্যবশত তোমার দু’বোনই আমার সামনে আসলে মুচকি হাসতে। আল্লাহ পাক তোমাকে আমার আয়মানের রূপটা দিলেও ভাগ্যিস ওই অসাধারণ ডিম্পলটা দেননি।’
-‘সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এত সুক্ষ্ম জিনিসও তোমার নজর এড়ায়নি?’
চেহারায় দাম্ভিকতা এনে জায়িন বলল, ‘এ জন্যই তো আমি জায়িন মাহতাব৷’
জায়িনের সুন্দর চোখদু’টোর দিকে চেয়ে মাধু নিশ্চুপ রইল তখন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমি মুক্তি চাই না। পারো তো খুঁজে নাও তোমার আয়মানকে। সো কল্ড ভালোবাসার জন্যই তো আমাকে পেয়েও হেলা করলে। আমি আলিয়া বলছি, আয়মানকে দখল করতে পারলেও আয়মানের মনকে দখল করতে পারবে না। আর পারবেও না ওকে ধরে রাখতে। তুমি যত বড়ো শিকারিই হও, আয়মানকে ধরে রাখার ক্ষমতা তোমার নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, শিকারি নিজেই শিকার হবে। আয়মানের হাতে তোমার নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি আমি। যে সহজ সরল, বোকা আয়মানকে ভালোবেসে ওকে খুঁজতে যাচ্ছ, সেই বোকা, সহজ সরল আয়মান আর নেই। যেমনটা ও নিজেকে আমাদের সামনে দেখিয়েছে, ওটা ওর নাটক ছাড়া কিছু নয়। ওর সঙ্গে এতটা কাল থেকেও ওর নাটক আর ওর পরিকল্পনা ধরতে পারলাম না আমি। আমার সঙ্গেও গেম খেলে গেল ও। তবে আমি চাই, তোমার মৃত্যুটা ওর হাতেই হোক। আমি চাই, তুমি ওকে খুঁজে বের করো। আর ওর বিষয়ে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা ইনফরমেশন দিই তোমাকে। শি হেটস ম্যারিটাল রিলেশনস। দ্য মোস্ট হেটেড সেক্স। আর তাই তুমি হবে ওর জীবনে ঘৃণার আরেক নাম জায়িন। আমি কিছুই বলব না। ওর কাছে গিয়েই না হয় ওকে জানো আর চেনো। সো বেস্ট অফ লাক, প্রিয়।’
মৃদু হেসে উঠল মাধু। জায়িন চুপচাপ ওর কথাগুলো শুনে এবার উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘চ্যালেঞ্জ ছোড়াছুড়ি আমার কাছে বাচ্চাদের খেলা ছাড়া কিছু মনে হয় না। তোমার লিটল সিস্টার আজও বোকাই আছে, ডিয়ার শালিকা! যার সঙ্গে প্রায় একটা বছর মিশেছি, তারপরও সে আমাকে চিনতে পারল না। অথচ, তুমি কত দ্রুতই আমাকে চিনে নিয়েছ।’
মাধু স্মিতহাস্যেই বলল, ‘এর যথাযোগ্য কারণও আছে। তা জানলেই বুঝতে পারবে, তোমার আয়মান তোমাকে কেন চিনতে পারেনি। আমার তো মনে হয় তোমাকে ও মনেও রাখেনি।’
__________
ধৈর্য ধরুন। প্রথম পর্ব থেকে এখন অবধি যা যা অপরিস্কার, সবটাই একে একে পরিস্কার হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here