সিন্ধু ইগল – (১৯) ইসরাত জাহান দ্যুতি

সিন্ধু ইগল – (১৯)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

এক গ্লাস উষ্ণ গরম পানিতে দু’ফোঁটা লেবুর রস আর এক চামচ মধু মিশিয়ে দুই এক চুমুক করে খেতে খেতে আয়মান শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। তবে ঘরে ঢোকার আগ মুহূর্তে তার নজর পড়ল বসার ঘরে সোফাতে বসে জাইমা জুতো মোজা খুলছে। তখনই কানে এল তার ঘরে কারও হাঁটা চলার আওয়াজ। গ্লাসের পানিটুকু দুই চুমুকে শেষ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময় সে। হ্যাংওভার কাটছে ধীরে ধীরে৷ তারপর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল পাবের সেই মেয়েটিকে। সারা ঘর ভরে হেঁটে বেড়াচ্ছে সে, আর আয়মানের ব্যবহৃত সকল জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। একদিনের দেখাতেই যে মেয়েটি আয়মানের প্রতি এত গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়নি, তা আয়মান বুঝে গেছে। মুচকি হাসল আয়মান। তবে এই মুহূর্তে মেয়েটির সামনে যাওয়া যাবে না তার৷ নাইট স্যুটে দেখে মেয়েটি যে এক মুহূর্তে দেরি না করে তার ওপর হামলে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ মেয়ে বলেই আজ আয়মান কিছুটা কোমলতা দেখাচ্ছে ওর প্রতি। কিন্তু মেয়েটির বদলে যদি কোনো ছেলে থাকত তবে কী হতো তার সঙ্গে?

সারা এখনো ফেরেনি৷ রাত দশটা বাজতে চলল। সে কি আজ ফিরবে না? ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে আয়মান জাইমার ঘরে এল৷ জাইমা তখন বাথরুমে। দরজাটা আটকে সে বিছানাতে বসে অপেক্ষা করতে থাকল জাইমার জন্য৷ পনেরো মিনিট বাদে জাইমা গোসল শেষ করে ঘরে এসে আয়মানকে দেখে কিছু বলতে গেলেই আয়মান মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘দিনে দিনে তুমি খুব বেশিই আমার পছন্দের মানুষ হয়ে উঠছ, জাইমা৷’

জাইমা বুঝতে পারল মেগান মেয়েটিকে বাসায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে আয়মান খুশিই হয়েছে। ইশারায় জাইমাকে তার পাশে এসে বসতে বলল। বসার পর সে বলতে শুরু করল, ‘বাসে ওঠার পর মেগান বেশ চোটপাট দেখাতে শুরু করে আমাকে। আমি তখন আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ওর সঙ্গে আরও কেউ আছে কি না তা বোঝার জন্য। তার মাঝেই চোখে পড়ল দু’টো মেয়ে বেশ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে।’
-‘তাহলে তোমার ধারণাই সঠিক? ও একা নয়?’
-‘না, ও একা হলে তো আপনাকে এখানেই কোনো হোটেল নিয়ে উঠত। কিংবা আপনার বাসাতেই আসতে চাইত। তিনজন এক সঙ্গে আপনার সাথে থাকার পরিকল্পনা করেছিল বলেই আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বাস সামনের স্টপেজ থামতেই আমি নেমে পড়ি। আর ওকে বলি আপনাকে চাইলে যেন নেমে আসে। মানে ডিসিশন চেঞ্জ করি আমি। আমার মনে হলো আপনাকে একা রেখে আসাটা ঠিক হয়নি। আমার চোখেই আরও দুজন ধরা পড়ল। হতে পারে ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলটা আরও বড়ো। তাই শুধু ওকে নিয়ে চলে এলাম।’
-‘ওরা আমাকে কতদিন ধরে ফলো করছে বলে মনে হয় তোমার?’
-‘নির্দিষ্ট সময় বলতে পারব না। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই ওদের নজরে পড়েছেন আপনি৷ ওদের কোনো প্ল্যানও থাকতে পারে।’
আয়মান কয়েক সেকেণ্ড সময় চুপ থেকে বলল, ‘সারা এখনো ফেরেনি। ও তো লেট করে না।’
-‘হ্যাঁ আমিও ভাবছিলাম। মেয়েটার চক্করে পড়ে আপনাকে জানাতে ভুলে গেছি। আপনি তো সকালে ঘুমিয়ে ছিলেন৷ আমি সারাকে কলে কাউকে বলতে শুনছিলাম কাজ থেকে বেরিয়ে দেখা করবে সে।’
-‘আচ্ছা। তাহলে ওকে ডিনারটা করিয়ে তারপর ওর রাতের ঘুম ছিনিয়ে নাও।’
বলেই ফিচেল হাসতে হাসতে উঠে পড়ল সে। জাইমাও আয়মানের মশকরাতে হেসে ফেলল। আজ আর নিজের ঘরে ঘুমাবে না আয়মান। সারার ঘরে চলে গেল সে। জাইমা নিজে রাতের খাবারটা খেয়ে মেগানকেও ডেকে খেতে দিলো। কিন্তু মেগান অস্থির হয়ে আছে আয়মানের জন্য। জাইমা তা বুঝে হাসতে হাসতে বলল, ‘এত অধৈর্য কেন মেগান? খাবারটা ধীরেসুস্থে শেষ করে নিজেকে রেডি করে নিয়ো।’
মেগান সজীব হেসে দ্রুত খাওয়া শেষ করে চলে গেল আয়মানের ঘরে। আজ রাতে তাকে কতটা নিপীড়ন হতে হবে তা সম্পর্কে হয়তো বোকা মেয়েটাকে তার মনিব এক ফোঁটাও ধারণা দেয়নি। কিংবা মনিব হয়তো নিজেও জানে না।
___________

গত কয়েকদিন আগের কথা। আলিয়ার থেকে নিশার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জেনেও জায়িন মুম্বাই যায়নি৷ অথচ নিশা আর তার স্বামী এহসান প্রস্তুত ছিল জায়িনের মুখোমুখি হওয়ার। কিন্তু তাদের ধারণাকে বদলে এবং তাদেরকে আতঙ্কিত করে জায়িন তাদেরকেই বাংলাদেশ টেনে আনে। অনাথ ছোটো ভাইটাকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য নিশা তার শখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করতে আরম্ভ করেছিল অল্প বয়সেই। বারো বছর বয়স থেকে আয়মানদের বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা হয়। তারপর সেই পরিবারের বিশ্বস্ত একজন হয়ে উঠতেই তাকে আর অন্য কোথাও কাজের জন্য বের হতে হয়নি। বেশ ভালোই থাকে সে ওদের বাড়িতে। আর সেই সাথে ছোটো ভাইকে বস্তিতে চাচার বাসায় রেখে তাকে মানুষ করতেও শুরু করে। এই ছোটো ভাইয়ের জন্য সে কী না করেনি! কাতার, ওমান, এসব দেশে গিয়ে পর্যন্ত চার বছর খেটেছে, যখন আয়মাদের বাসা ছাড়তে হয় তাকে। আর সেই ভাইকে কিনা খুন করে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে! এমনকি আয়মানের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ পর্যন্ত না করার হুমকিও দিয়েছে তাকে কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তি। যত তাড়াতাড়ি সে দেশে ফিরে ভাইকে উদ্ধার করবে, ততই মঙ্গল হবে তার ভাইয়ের জন্য। নিশা এমন সব হুমকি ধামকি শুনেই পাগলের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করে কান্না শুরু করে। এহসান এসব শুরুতে বিশ্বাস না করলেও যখন নিশার ছোটো ভাইকে আটকে রাখার ভিডিয়ো পাঠায়, তখন সে বিশ্বাস করে। আর এও জানায়, ওদের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখা হচ্ছে। যেন ভুলেও কোনো স্টেপ নেওয়ার চিন্তা না করে তারা। এই ব্যক্তি কে হতে পারে তা নিয়ে ভাবনার সময় নেই নিশার। সে দেশে ফেরার জন্য পাগল হয়ে যায় শুধু। অপরিহার্যভাবে এহসান সেদিনের ফ্লাইটেই নিশাকে নিয়ে দেশে আসে। কিডন্যাপারদের কথামতো চলতে বাধ্য হয় তারা। পরেরদিনই অক্ষত অবস্থায় নিশা ফিরে পায় ওর ভাইকে। কিন্তু মুম্বাই আর ফিরে যেতে পারেনি। উত্তরাতে বেশ পরিপাটি একটি ফ্ল্যাটে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। দেশে ফেরার তৃতীয়দিন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে জায়িন। যাকে দেখে নিশা কিছু সময়ের জন্য ভাবনাতে পড়ে যায়। চেনা চেনা লাগে তার জায়িনকে। কোথায় কখন দেখেছে তা মনে করার চেষ্টা করে খুব।

একজন ভদ্র মানুষের মতোই জায়িন এহসানের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে তার পরিচয় দেয়। আতিথেয়তাতেও কোনো ত্রুটি রাখেনি ওদের। এহসান বা নিশা বিশ্বাসই করতে পারেনি জায়িনকে দেখে, এই ব্যক্তি কতটা মারাত্মক হতে পারে। নিশা আর এহসান দেশে এসে এমনভাবে ফেঁসে যায় যেখানে শত চেষ্টা করেও তারা মুক্তি পাবে না, যতক্ষণ অবধি জায়িন আয়মানের কাছে পৌঁছতে পারে। ছোটো ভাইটার কথা চিন্তা করে সেদিন বাধ্য হয়ে নিশা আয়মানের খোঁজ জানিয়ে দেয়। এবং কখন, কোথায় থাকার পরিকল্পনা আছে আয়মানের তাও বলতে বাধ্য হয় সে।

নিশা আর এহসানকে দেশে টেনে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় পায়নি জায়িন। আলিয়া সব কিছু তাকে জানানোর পর সে রেজার সাথে বসে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে। মুম্বাইতে গিয়ে জায়িন নিশ্চয়ই তার ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে না। খুব বেশি গুরুতর বিষয় না হলে সে কখনোই সাহায্যের জন্য মাফিয়াদের শরণাপন্ন হয় না। আলিয়ার থেকে নিশার বিষয়ে সব জেনে নিশার ছোটো ভাইকে খুঁজতে আরম্ভ করে সে৷ ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে ছেলেটি। শেষমেশ তাকেই কিডন্যাপ করে মিথ্যা ভয় দেখিয়ে নিশাকে দেশে আনার ব্যবস্থা করে সে।
___________

জাকির রোজ রোজ ফোন করেও জায়িনকে সিডনিতে আনতে পারছে না। আর হঠাৎ করে সে কেনই বা এখানে এসেছে, সেই কথাও জায়িন তাকে বলছে না। এক সপ্তাহ হতে চলল অস্ট্রেলিয়া মাসকটেই অবস্থান করছে সে। আয়মানকে বিরক্ত করার জন্য গত পাঁচদিন ধরে দু’তিনজন সমকামী সুন্দরীদেরও তার পিছে লাগিয়ে দিয়েছে। আয়মানকে বেশ মানসিক অশান্তির মধ্যে রাখতে চাওয়াই হলো তার প্রধান উদ্দেশ্য৷ যে জিনিসের প্রতি কোনো মানুষের সব থেকে বেশি ঘৃণা বা অনীহা বোধ হয়, সেই জিনিস অবশ্যই সেই মানুষের দুর্বলতাও। আয়মানকে যতটুকু বুঝেছে সে, তাতে ওকে কাবু করার জন্য ওর দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্তরঙ্গ সম্পর্কের প্রতি আয়মান এতটাই অতিষ্ট যে, শুধু এই কারণেই প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে নিয়ে সে উদাসীন। খুব সহজ হবে না ওকে পাওয়া, তা বুঝতে পেরেছে জায়িন। যার জন্য ছোটো ছোটো পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোতে হচ্ছে তাকে৷ সমকামী মেয়েগুলোর আচরণে প্রতিদিন আয়মান বিরক্ত হতে হতে চারপাশের অনেক কিছু থেকেই তার মনোযোগ সরে যাবে। আর তারপর ওর অমনোযোগী হওয়ার সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে জায়িন ওকে কব্জা করবে। এমনটাই ছিল তার পরিকল্পনা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তার, যখন হসপিটালের সাদা বিছানাতে মেগানকে দেখতে পায় সে। অন্ততপক্ষে মাসখানিকের পূর্বে মেগান কখনো কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়াতে পারবে না। জায়িন যখন তাকে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছিল ওর সঙ্গে, সেই মুহূর্তে মেগান লজ্জা এবং রাগে তাকে সহ আয়মান এবং জাইমাকে নোংরা কিছু গালি দেয়। এরপর আর যাই হোক, জায়িনের বুঝতে বাকি নেই ঠিক কীভাবে আয়মান মেয়েটিকে আদর করেছে। এই ব্যাপারটাতে জায়িনের হতাশ হওয়ার কথা থাকলেও সে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে হসপিটাল থেকে। আর ভাবে, মেয়েটির জায়গায় কোনো ছেলে হলে পরিণাম এমনও হতে পারত যে, পুরুষাঙ্গই কেটে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তার বোকারানি। কিন্তু এরপরও জায়িনের হতাশ না হওয়ার কারণ, সে যে দেখেছে আয়মানের মাঝে তার জন্য দুর্বলতা। তার দৃঢ় বিশ্বাস, অতি শিঘ্রই আয়মানকে সে পেতে চলেছে।

তবে মেগানকে সে এত কষ্টের বিনিময়ে অবশ্যই মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে খুশি করেছে। এর পিছে আরও একটি কারণ আছে। আয়মানের হাতে পড়েও মেগান মুখ খুলে বলেনি জায়িনের কথা।
___________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here