সীমারেখা শেষ পর্ব

#সীমারেখা
০৪
_______অবনী রায়

বেলা বারোটায় শ্বশুরের বাড়িতে আসার সময় হলো। কানে হেডফোন লাগিয়ে সাইয়া সাইয়া গানে নাচতে নাচতে বাড়ি ঢুকলেন উনি।
-হেই মম আই’ম সো হাংরি।
লও ঠেলার সের দেড় টাকা।এতদিন বাংলায় জ্বালাইছে এখন আবার ইংলিশ ঝাড়ে।কোনদিন না জানি ঘরে এসে চায়নার চুং চাং, ফুং ফাং বলে।
-খাবার দেরি আছে আগে বসুন কথা আছে।
-হুম বলো।
-ছোট বাচ্চা মতো এত লাফালাফি না করে শান্ত হয়ে বসুন আগে বলি তারপর লাফান।
-সিরিয়াস কিছু বৌমা?
-বাবা এসব আপনি কি করে বেড়াচ্ছেন? আপনার নাহয় কিছু যায় আসেনা অন্যের কথায় কিন্ত একবার আমার কথাটাও তো ভাববেন।আত্নীয় স্ব্জন কারো কাছে মুখ দেখাবার জো নাই আমার।
-তোমার কি খুব সমস্যা হয় তাতে?
-আপনি বাচ্চা ছেলে নন বাবা।বোধবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়নি নিশ্চই আপনার। মানুষের একটা নিদিষ্ট বয়স থাকে বাদরামি করার কিন্ত আপনি সব কিছুর উর্ধ্বে, একদম বাদর কিসিমের মানুষ।কথায় আছে না বান্দর বুড়া হইলেও গাছে চড়ে ঠিক তাই।
-ঠিক আছে বৌমা নিশ্চিত থাকো আর কোন কথা শুনতে হবেনা তোমায় আমার জন্য।
– ধন্য হলাম। এবার বসুন খেতে দেই।
-রেখে দাও পরে খেয়ে নিব।
মুহুর্তেই হাসি মুখটা মলিন করে ঘরে ঢুকলেন উনি।তেমন টা পাত্তা না দিয়ে আমি নিজের কাজে মন দিলাম।
প্রায় পাচঁ ছয় দিন হয়ে গেলো বাবা আর ফেইসবুকে একটিভ হয়না।বাড়ি থেকে দরকার ছাড়া বের হয়না। আমার আর শোভনের সাথেও কাজের কথা ছাড়া বেশি কথা বলেনা।সারাদিন ঘরে বসে থাকে মন মরা হয়ে।
ব্যাপার টা আমার নজরে আসার আগেও শোভনের নজরে এলো। বাবাকে কিছু না বলে সোজা আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-অবনী বাবার কি হয়েছে?
-বাবার কি হয়েছে সেটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে বাবাকেও তো করতে পারো।
-কথা এড়িয়ে না গিয়ে আগে বলো কি বলেছো তুমি বাবাকে।
– কিছু বলতে দিয়েছো কি? রোজ রোজ নালিশ শুনতে ভালো লাগছিলোনা তাই বলে দিয়েছি বাদরামি টা যেন আর না করে।
শোভন কথা শেষ হতেই গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো।
আমি গালে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম, যে মানুষ টা কখনো কথার কাটাকাটি করেনা আমার সাথে সে মানুষ টা আজকে চড় মারলো।অংক মেলাতে পারলাম না।
শোভন কিছু না বলে বাথরুমে চলে গেলো। জানি এখন মাথায় জল ঢালবে।এর আগেও এমন অনেক হয়েছে, আমার উপর রাগ উঠলে আমাকে কিছু না বলে মাথায় জল ঢালতে যায় ও।
শোভনের উপর রাগার আগে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি ভুল কিছু করিনাই তো?

কুড়ি মিনিট পর শোভন বেড়িয়ে এসে পাশে বসলো,
-সরি অবনী। তোমার গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হয়নি আমার, কিন্ত ভুল তুমিও করেছো।
তুমি জানো আমার বাবা যখন ছোট তখন তার মা মারা যায়।এরপর বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য দাদু বিয়ে করে।কিন্ত সেই মা আমার বাবাকে দেখবে কি, উল্টো তার কাজ কর্ম, সন্তান দেখতেই বাবার ছেলে বেলা কেটে গেলো।
একটা মানুষ যে ছেলেবেলার সাধ পায়নি, যখন খেলতে ইচ্ছে হয়েছে তখন তাকে কাজ করতে হয়েছে, দিনে সৎ মায়ের কাজ, অত্যাচার সব সহ্য করে রাত জেগে পড়েছেন তার ভবিষ্যত সুন্দর হবে এই আশা করে।কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি সুখের মুখ দেখেছিলেন। মাকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল, ছোট একটা সংসার পাতলো টোনাটুনির। কত স্বপ্ন ছিলো তার চোখে, কিন্ত আমার অভাগা বাপের কপালে সেই সুখটাও সইলো না। আমার ছ মাস বয়সে একটা কার এক্সিডেন্ট এ মা মারা গেলো।
কি পেয়েছে ওই বয়সে? না পেলো কৈশোরে সুখ আর না পেলো যৌবনের। যেন আমাকে তার মত সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করতে না হয় তার জন্য নিজে বিয়ে করেনি।কাজের লোকের হাতে যেন আমার অযত্ন হয় এটা ভেবে কাজের লোক পর্যন্ত রাখেনি। আমাকে সাথে নিয়ে অফিস করেছে, পিঠে বেধে রান্না করেছে। খাইয়ে, বুকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে আর সেই বাবাকে তুমি বাদরের সাথে তুলনা করছো?
অবনী আমি একটা জামা চাইলে আবার বাবা দুটো এনে দিতো। একটা খেলনা চাইলে কয়েকটা খেলনা হাজির করে।আমার সব অভাব পুরন করা বাবাটা পুজোতেও পুরোনো শার্ট পড়তো। এত ত্যাগ তার আমার উপর আর আমি সেটা দুদিনেই ভুলে যাব?
শোনো অবনী আমি তোমাকে কেন পুরো পৃথিবীকেই ছাড়তে পারি বাবার জন্য।আর আমার বাবা, শুধু আমার বাবা নয়, পৃথিবীর সব বাবাই শুধু বাবা নয় একেকজন যাদুকর।যার কাছে ভরসা বিশ্বাস সুখ শান্তি সব মেলে।
শোভনের চোখ কথা বলার সাথে সাথে চলেও ভরে গেছে।বুঝতে পারলাম খুব বড় ভুল করেছি আমি।
আমার বাবাকে পাইনি কখনো, ছোট থেকে মায়ের কাছেই বড় হয়েছি। শুনেছি কোন এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে বাবা, ঠিক তখন থেকেই বাবা ডাকটার উপর শ্রদ্ধা উঠে গেছিলো আর আজ নতুন করে নিজেকে এক বাবার মধ্য পেলাম।ছুটে গেলাম ওনার রুমে।
উনি তখনো ঘরের মধ্যেই বসে আছে, একটা বই হাতে নিয়ে,
পা ধরতেই তাড়াহুড়ো করে হাত পা দুটো সরিয়ে নিলেন।
-একি বৌমা কি করছো?
-আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দিন।
– ওই দেখো পাগলী মেয়ে এভাবে কেউ কাদে? উঠো, বসো এখানে আর বলো কি হয়েছে? কি করেছো তুমি?
– আমি সব শুনেছি আপনার ছেলের থেকে।আমায় ক্ষমা করুন বাবা, আমি বুঝতে পারিনি আপনাকে।আপনার যেমন খুশি আপনি তেমন ভাবেই চলুন আমার কোন আপত্তি নেই।
-না বাবা থাক। আমার লাগবে না, আজ এভাবে বলছো আর কাল আবার একটা নালিশ পেলে আবার আসবে মায়ের মতো বকতে।
-সে নাহয় একটু মা হয়ে বকে দিলাম তাতে কি খুব কষ্ট হবে বাবা.?
-হবে, না।
-কি হবে না করছেন?
-বলছি যে একটু কষ্ট হবে, আবার না ও হবে।তবে তোমায় কিন্ত আমার মায়ের মতোই আমাকে ভালোবাসতে হবে।
হেসে ফেললাম ওনার কথায়। আসলেই উনি খুব সরল একটা বাচ্চা যেনো।

দুদিন কেটে গেছে শ্বশুর বাবা আবারো রিয়াক্ট বয় দীসুতে ফিরে গেছে।ওনার কাজ কর্মে ইদানিং আমারো আনন্দ হয় । ছোট ছোট বাচ্চামি গুলো দেখে মনে হয়, থাক না কিছু সময় গন্ডির বাহিরে, এত সীমারেখায় বেধে কিই বা হবে জীবনটা তো দুদিনের।

বিকেলে ও বাড়ির সেই ডিভোর্সি আন্টি এলো, হাসি মুখে বললাম,
-কেমন আছেন আন্টি? বসুন অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম।
আন্টি ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো,
-আদ্যিক্ষেতা দেখানো হচ্ছে? আজ আমি একা আসিনি সাথে পুলিশ ও নিয়ে এসেছি। কোথায় তোমার শ্বশুর ডাকো তাকে।
পেছনে দেখলাম সত্যিই দুজন পুলিশ। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে? কি করেছে আমার শ্বশুর?
-শোন মেয়ে অনেকদিন হয়ে গেছে ডিভোর্স হয়েছে।এবার ভাবলাম বিয়ে করবো। ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম পাশের এক পার্কে, ওখানে তোমার বদমাইশ শ্বশুর এসে বাপ্পারাজের মতো করে গান বলে,
প্রেমের সমাধী ভেঙ্গে মনের শিখল ছিড়ে
কুন্তি যায় চলে যায়।
কুন্তি আমার রিদয় ভেঙ্গে যায়।
বুঝতে বাকি রইলো না আর পরের ঘটনা। কুন্তি আন্টির নাম নিয়ে গান গাওয়াতে ওনার বিয়ে ভেঙ্গে যায় আর তিনি রাগে পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত। হায় রে শ্বশুর শান্তিতো তো দিবি না আমারে।তুই শুধু বাড়ি আয় রিয়াক্ট বয় দীসুর বাচ্চা দীনেশ,আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।

সমাপ্ত

নোটঃ সম্পূর্ণ ফানি আঙ্গিকেই লিখেছি গল্পটা।কাদাতে সবাই পারে, কিন্ত হাসাতে ক’জন? আমার গল্পে শিক্ষনীয় কিছু নেই আমি চেয়েছি সবাইকে হাসাতে আর সফল ও হয়েছি। এটাই অনেক বড় পাওয়া। তথাপি অনেক যায়গাতেই ভুল আছে, আমার ভুল ত্রুটি গুলো একটু ধরিয়ে দিবেন আমি চেষ্টা করব পরবর্তীতে সেগুলো সুধরে নেওয়ার।সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। 🙏

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here