#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_৩২
#Tahmina_Akther
আমার বুকে কারো গাঢ় নিশ্বাসের আছড়ে পড়ছে। কিন্তু, চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
চট করে গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম, ফুল বেঘোরে আমার বুকে মাথা পেতে ঘুমাচ্ছে।
দেখে মনে হচ্ছে কত রাতের নির্ঘুম সে আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে!
ফ্যানের বাতাসে ওর বেবি হেয়ার গুলো বারবার কপালে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আলতো হাতে ওর কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে শব্দহীন চুমু খেলাম।
কি জানি ও আমার স্পর্শ টের পেলো কি না?
এবার বেশ গাঢ় ভাবে আমার গায়ে সেঁটে রইলো।
গতকাল, রাতে হিয়ার মুখে প্রত্যেকটি শব্দ আমার হৃদস্পনন্দকে বাড়িয়ে তুলেছিলো। কত চমৎকার, সাবলীলভাবে তার মনের কথা আমায় নির্দ্বিধায় বলে দিলো।ওর রাতের বলা কথাগুলো এখনো আমার কাছে প্রাণবন্ত লাগছে,
যেন এখনো আমার কর্ণগুহরে প্রতিধ্বনি হচ্ছে ফুলের কথাগুলো,
“ফুল তার অভিককে অনেক ভালোবাসে। তার অভিকের বুকে মাথা পেতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভালোবাসা উপভোগ করতে চায়। অভিক, দিবে তো আমায় তোমার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ভালোবাসা?”
তখন ফুলের প্রতিউত্তরে অভিকের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না।
হিয়ার মুখে উচ্চারিত এক একটি শব্দ যেন অভিকের সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।
হিয়ার ভালোবাসার স্বীকারোক্তিতে অভিকের হৃদস্পন্দন যেন আজ বলছে,
“অভিকের হৃদয় থাকা সুপ্ত ভালোবাসা তবে আজ মুক্তি পেলো হিয়ার ভালোবাসায়”
আজকের এই নিকেষ কালো আঁধার, মেঘাচ্ছন্ন বর্ষনের রাতে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি তিনটি বাক্য তারই ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে শুনবে ভাবতেও পারেনি।
তার ফুল যে আজ তার হৃদয়ের গহীনে থাকা সুপ্ত ভালোবাসার একছত্র মালিক হতে চাইবে তা শুধু অকল্পনীয় ছিল মাত্র!
অভিক পরম আবেশে হিয়াকে জড়িয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে। হিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার পর মনে হলো, কতদিনের তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে আজ এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়েছে।
হিয়া চুপটি করে অভিকের বুকে মাথা পেতে আছে। অভিক হিয়ার মাথায় চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে ফুল? চুপ করে আছো যে?
-কোথায় চুপ করে আছি! আমি তোমার দ্রুতগতিতে চলা হৃদস্পনন্দন অনুভব করছি। তোমার এই হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে যেন আমার নামে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
-ফুল?
-হুম,
-তুমি কি সত্যি বলছো? আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না! মনে হচ্ছে সবই আমার স্বপ্ন।একবার জেগে গেলে, এই নিকেষ কালো আঁধার, মেঘাচ্ছন্ন বর্ষনের রাতে তোমার ভালোবাসার অনূভুতিকথন, তোমাকে জড়িয়ে ধরার এই স্পর্শ সবই যেন হারিয়ে যাবে অতলগহ্বরে।
-সব সত্য;এই নিকেষ কালো আঁধার, মেঘাচ্ছন্ন, বর্ষনের এই রাত,তোমার জন্য আমার ভালোবাসার অনূভুতিকথন, তোমাকে জড়িয়ে ধরার এই স্পর্শ সবই সত্য। যতটুকু সত্য আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা ঠিক ততখানি সত্য।
অভিকের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো হিয়া। এরপর, ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
-আজ অনেক কথা হয়েছে এখন চলো। এতরাত পর্যন্ত জেগে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। চলো ঘুমাবে। যা কথা হবে কাল সকালে।
ওর কথা শেষ হবার পরমূহুর্তে, অভিক হিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
-আজ আর কোনোকিছুতে মন নেই। আজ শুধুই ফুলের অনুভূতিকথনে, তার পরশে তার সুবাসে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে।
হিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলার আগে হিয়াকে উঁচিয়ে ধরে,
এক তপ্ত চুমুতে তার অধরযুগল আগলে ধরলো অভিক তার ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে।কিছু সময় অতিক্রম হবার পর অভিকের উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় হতে মুক্তি পেলো হিয়ার ওষ্ঠদ্বয়।
অভিকের এই আচমকা চুমু হিয়ার কাছে ছিলো সাংঘাতিক। লজ্জা নিবারণের জন্য জায়গা না পেয়ে অভিকের বুকে মুখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা চলছিলো হিয়ার মাঝে।হিয়ার কান্ড দেখে হেসে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে এগিয়ে চললো।
——————-
গতকাল রাতের কথাগুলো মনে পড়তেই মনটা আনন্দে ছেঁয়ে গেলো অভিকের। এরইমাঝে, হিয়ার ঘুম ভেঙে গেলো।কিন্তু, জেগে উঠার পর যখন দেখলো সে অভিকের বাহুডোরে আবদ্ধ ঠিক তখনি গতকালের এক একটি ঘটনা সুক্ষ্ম ভাবে মনে পড়ে গেলো।
চট জলদি অভিকের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ঘুম থেকে জাগার পর থেকে ওয়াশরুমে যাওয়া পর্যন্ত হিয়া একটিবারও অভিকের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।
হয়তো লজ্জায়! হিয়া ওয়াশরুমে ঢুকতেই অভিক খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো। অভিকের এই হাসির শব্দে ওয়াশরুমের থাকা হিয়াও হেসে ফেলেছিলো। কিন্তু, অভিকের অগোচরে।
—————
এরপরের দিন গুলো ছিলো স্মৃতিতে আঁটকে রাখার মতো। একজোড়া চড়ুই পাখির মতো সারাদিন জোড়ায় জোড়ায় থাকতো অভিক আর হিয়া।
অফিস থেকে ফিরে আসার সময় হিয়ার জন্য ফুচকা বা আইসক্রিম। কখনোবা, ছাদে রাতের আকাশে দু’জনের গায়ে চাঁদের আলো মাখানো।কখনোবা পরিবারের সকলের অগোচরে রাতে লং ড্রাইভে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ভোরে বাড়িতে ফিরে আসা।
এখন দু’জনকে কেউ দেখলে ভাববে হয়তো সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিক যুগল। যারা তাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসা নামক অনুভূতিতে সিক্ত।
জামান পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের মনে আনন্দের জোয়ার বইছে অভিক আর হিয়াকে একসাথে হাসিখুশিতে থাকতে দেখে।
তাদের মনে বিধাতার উদ্দেশ্য একটি প্রার্থনা যেন, অভিক হিয়া যেন সবসময় এমন ভালোবাসাময় অনুভূতির চাদরে মোড়ানো থাকে!
———————
নিত্যদিনের মতো বাড়ির সকলে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে হালকা ভাজাপোড়া খাবার খাচ্ছিলো।
হিয়ার মা, অভিকের মা আর হিয়া মিলে সবাইকে নাশতার প্লেট আর চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছিলো।
অভিক বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকতেই পরিবারের সকল সদস্যকে একসাথে বসে থাকতে দেখলো।ছোট ছোট পা ফেলে খালি সোফায় যেয়ে বসে পড়লো।হিয়া যখন দেখলো অভিক এসেছে ঠিক তখনি দৌড়ে কিচেনে যেয়ে লেবু কেটে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে এনে অভিকের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
হিয়ার হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে শরবতটি এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।
এবার যেন ভিতরটা ঠান্ডা লাগছে। হালকা গলা ঝেঁড়ে নিয়ে তার চাচ্চুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– বড় আব্বু, খুব জরুরি একটা কথা ছিলো।
-কি কথা বলো?
চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন হিয়ার বাবা।
-আসলে কি ভাবে বলি কথাটা? আসলে মানে নিঝুম ভাইয়া কল করেছিলো।তখন জানলাম ফুপি নাকি অনেকটা অসুস্থ কিন্তু আমাদের জানাতে চাইছেন না। আমাদের যতটুকু জানিয়েছে তাও নোভার জোরাজুরিতে।
– বলিস কি?এখন কি অবস্থা শালিনীর?
উদ্বিগ্নের স্বরে বললেন অভিকের বাবা।
-ফুপির শরীরের অবস্থা নাকি একেবারে খারাপ। ওখানকার বেশ ভালো ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু ভালো হচ্ছে না।
-নিঝুমকে বল শালিনীকে নিয়ে বাংলাদেশ চলে আসতে। আমরা ওর চিকিৎসা দেখাশোনা সবকিছু করবো।
হিয়ার মা বললেন।
-আসলে বড় মা আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে ওই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো উন্নত তাই ফুপিকে বাংলাদেশে আনা নিশ্চয়ই বোকামী হবে।
-তাহলে এখন উপায়?
-আসলে নিঝুম ভাই একা ব্যবসা, ফুপির দেখাশোনা সবকিছু সামলাতে পারছে না তাই কিছুদিনের জন্য আমাকে আমেরিকায় যাওয়ার রিকোয়েস্ট করছে। তাছাড়া, বাড়ির কেউ এখন ফুপির কাছে যেতে পারবে না সে জায়গায় আমার ভিসা প্রসেসিং ঠিক আছে। তাই বারবার আমাকে বলছে আমি যেন সেখানে যাই। এখন তোমরা বলো আমার কি করা উচিত?
-এই মুহূর্তে তোর সেখানে যাওয়াটা উচিত আমি মনে করি অভিক।শালিনী সুস্থ হলে তুই নাহয় চলে আসবি।
হিয়ার বাবা সহ সকলেই বললেন অভিক জন্য ওর ফুপির কাছে যায় শুধু হিয়া বাদে।
—————–
রাতের খাবার সকলে ঠিকভাবে খেলেও হিয়া আর অভিক খেতে পারলো না। যেন কেউ গলায় ঠেস দিয়ে রেখেছে!
আনুমানিক রাত ১১টার দিকে অভিক মোবাইলে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করলো। রুমের চারদিকে তাকিয়ে হিয়াকে দেখতে পেলো না। মোবাইলে কথা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দেখলো হিয়া দোলনায় দু’হাঁটুর মাঝে মাথা গুজে বসে আছে।
ধীরপায়ে এগিয়ে হিয়ার সামনে যেয়ে ওর মাথায় হাত রাখলো।
মাথায় কারো হাতের পরশ পেতেই হিয়া মুখ উঁচু করে দেখলো অভিক দাঁড়িয়ে আছে।
অভিককে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে যেন হিয়ার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো।
আচমকা হিয়াকে কাঁদতে দেখে অভিক ঘাবড়ে গেলো। হিয়ার পাশে বসে ওর হাত ধরে বলছে,
-এই ফুল কি হয়েছে? কান্না করছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে? আরে কিছু তো বলবে?
কান্নার দমকে হিয়ার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না তবুও আঁটকে আঁটকে বলছে,
-তুমি আমেরিকায় চলে গেলে আমি কি ভাবে থাকবো অভিক? তোমার অস্তিত্ব ছাড়া আমার নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হয়।
অভিক এতক্ষণে বুঝতে পারলো তার বৌ’টা কেন কাঁদছে? হিয়াকে একহাতে জড়িয়ে ওর মাথা কাঁধের একপাশে রেখে বললো,
-তুমি কি চাও না ফুপি সুস্থ হোক?
-হুম
-তাহলে তো আমাকে যেতে হবে। কারণ, বিদেশ বিভূঁইয়ে নিঝুম ভাইয়ার পক্ষে এত কিছু একহাতে সামলানো সম্ভব না। আর ফুপির তো আমাদের প্রতি হক আছে তাই না? এমনিতেই ফুপি আমাদের ওপর রেগে আজ সারে চার বছর ধরে বাংলাদেশ আসে না। এখন যদি নিঝুম ভাই অনুরোধ করা সত্ত্বেও না যাই তাহলে ব্যাপারটা বিশ্রি দেখাবে বুঝলে বৌ।
-কিন্তু, ফুপি যদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে তুমি চলে আসবে।
“কারণ, তোমায় ছাড়া এক একটা ক্ষণ আমার জন্য মৃত্যু যন্ত্রণার সমান”
#চলবে