#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_৯(Confessed)
#Tahmina_Akther
সদর দরজা থেকে ড্রইংরুমে থাকা মানুষদের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অভিক চাপা নিশ্বাস ফেলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে অভিকের নজর পড়লো হিয়ার দিকে সে সোফার এককোণে বসে আছে বিমর্ষ মনে। আরেকদিকে নিঝুম একটু একটু পর পর হিয়ার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে।
অভিকের মেজাজ খারাপ হওয়ার জন্য এই দৃশ্যটি যথেষ্ট ছিলো। নিঝুমকে কিছু বলবে তার আগেই ওর ফুপি ওকে কাছে ডাকলেন। তাই এই বিষয়টি আপাতত একপাশে রেখে ওর ফুপির পাশে যেয়ে বসলো।ফুপি অভিকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,
-কেমন আছিস আব্বু, এখানে আসার পর একবারও কি ফুপির কথা মনে পরে নি? এই যে আমি এত দূর থেকে তোদের কাছে এলাম তোদের দেখতে। আর তুই কিনা আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলি না, ফুপি কেমন আছো?
ফুপির সাথে রাগ করেছিস,আব্বু ?
বেশ নরম কন্ঠে কথাগুলো বললেন অভিকের ফুপি।
-না, ফুপি তোমার সাথে আমি কি কখনো রাগ করতে পারি বলো?আমার একটি বিশেষ চিন্তার জন্য কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না ফুপি।
-কি হয়েছে ফুপিকে বল? শুনি তোর বিশেষ চিন্তাটা কি?
-আমি তোমাদের বলতে পারবো না মানে কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। শুধু এই ব্যাপারটা আমি বাবাকে বলতে চাই।
-তুই তোর বাবাকে বলবি! আমাদের অভিক তাহলে তার বাবার সঙ্গে কথাও বলে!কিন্তু, তোর বাবা তো এখন বাড়িতে নেই। সে একবারে সন্ধ্যার পর আসবে। কারণ,হিয়ার সাথে নিঝুমের সন্ধ্যার পর আংটিবদল হবে। এই নিয়ে তোর বাবা আজ একটু ব্যস্ত থাকবে।
-আজই আংটিবদল মানে! ফুল কি রাজি হয়েছে?
বিস্ময়ের সুরে বলল অভিক।
– অভিক তোর হিয়াকে এই ভাবে ফুল ডাকার অভ্যেস এখনো যায় নি? ও তোর বড় বোন ওকে কিভাবে তুই ফুল বলে সম্বোধন করিস?
-শুনো ফুপি ও আমার বয়সে বড় মানছি কিন্তু ও আমার আপন বোন নয় জাস্ট সে আমার কাজিন হয়। ওকে আমি ফুল বলেই ডাকব এতে তোমাদের হাজারটা সমস্যা থাকুক আই ডোন্ট কেয়ার।
বেশ চিল্লিয়ে কথাগুলো বলে উঠে চলে যাচ্ছে অভিক। কয়েকধাপ সিঁড়ি পাড় হবার হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমার জন্য এককাপ চা নিয়ে আসো তো ফুল।
বলেই চলে গেলো অভিক। ড্রইংরুমের উপস্থিত সবাই যেন আজ পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখেছে।কারণ, অভিক খুবই শান্ত মেজাজের। সেই শান্ত মানুষ যদি আচমকা অশান্ত হয়ে উঠে তাহলে সেই পরিবেশ কেমন হবে তার ধারণা সবারই আছে।
হিয়া আস্তে করে উঠে চলে গেলো রান্নাঘরে চা বানাতে। আর নিঝুম সে মনে মনে বেশ বড় কিছু করবার জন্য প্ল্যান করছে।
-হিয়াকে যেই করেই হোক আমার করবই।আর এর জন্য আমাকে যা যা করতে হবে তাই করবো।শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে বলছে নিঝুম।
হিয়ার চা বানানো শেষ হলে একটি কাপে চা ঢেলে নেয়। এরপর আরেকটি বাটিতে চানাচুর মুড়ি মাখিয়ে অভিকের প্রিয় ঝালমুড়ি বানিয়ে একটি ট্রেতে করে সব সাজিয়ে নিয়ে চললো অভিকের রুমের দিকে।
আর এদিকে হিয়ার ফুপি এবং অভিকের মা একে অপরকে ইশারায় কি যেন বলছে?
————-
দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই অভিক ওর হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিলো জানালা দিয়ে। জলদি করে ওয়াশরুমে যেয়ে মুখ কুলকুচা করে হাতমুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো।তারপর, সারা রুমে সুগন্ধি স্প্রে করে দরজা খুলে দিলো। দেখলো
হিয়া এসেছে, হিয়ার হাত থেকে ট্রে নিয়ে ওকে ভিতরে এসে বসতে বললো।
হিয়া ভিতরে এসে খাটের উপর বসলো।আজ যে ওর মন খারাপ ওর চেহারাতে যেন স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। অভিক ট্রে নিয়ে রাখলো টি-টেবিলের উপর তারপর হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে বসলো হিয়ার পাশে।
আগে চা খাওয়ার দরকার, প্রচন্ড রকমের মাথা ধরে আছে অভিকের।চা খাওয়ার পরে নাহয়
হিয়ার সাথে কথা বলবে।
হিয়া খাটের উপর বসে জানালা দিয়ে অদূর আকাশপানে তাকিয়ে আছে। কেন যেন আজ এই উজ্জ্বল আকাশে তাকিয়ে থাকতে হিয়ার চোখ ধরছে না?অভিকের কথা শুনে হিয়ার ধ্যান ভঙ্গ হলো।
-ফুল, তুমি কি সত্যি এই বিয়েতে রাজি আছো?
-না হয়ে উপায় কি? আম্মু গতকাল রাতেই আমার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেছে। তাদের ভাষ্যমতে,
ফুপি, চাচ্চু-চাচী, মা এবং নোভা তারা সকলেই নাকি চাচ্ছিলো নিঝুম ভাইয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। কিন্তু, আমি বা নিঝুম ভাইয়া রাজি হবে কি না এই শঙ্কায় তারা আমাদের এই ব্যাপারে কিছু বলেনি?কিন্তু, কাল যখন চাচী জানতে পেরেছে নিঝুম ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে তিনি এই ব্যাপারটা সবাইকে বলে দিয়েছেন। আর এতেই সবাই খুশীতে আটখানা। আম্মু তো বলেই ফেলছে, নিঝুম ওয়েল সেটেলড, আমি সুখে থাকবো হেনতেন তবে আম্মু বলেছে যদি আমার নিঝুম ভাইয়াকে পছন্দ না হয় তাদের যেন জানাই।
তবে কাল সারারাত ভেবে দেখলাম, পরিবারের সবাই যেখানে আমার জন্য নিঝুম ভাইয়াকে চয়েজ করেছে তাহলে আর এখানে আমার কি বলার আছে তাই আমি আজ সকালে তাদের হ্যা বলে দিয়েছি।
অভিক তার ফুলের উচ্চারিত প্রত্যকেটি শব্দ মনোযোগ সহকারে শুনছিলো।কিন্তু, নিঝুমকে তার ফুল বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এই কথাটি যেন তার পুরো শরীরে দহন সৃষ্টি করে তুলেছে। হাতে থাকা কাপটি মূহুর্তে ছুড়ে ফেলে দিলো।তারপর হুংকার ছেড়ে বললো,
-সবাই শুধু টাকাপয়সা, ওয়েল সেটেলড দেখছে। তাদের চোখে কি ভালোবাসা কতটুকু আছে এই জিনিসটা যাচাই করতে ইচ্ছে করে না। আর তুমি কি ভাবে এই কথাগুলো বলছো ফুল?তুমি এই বিয়ে করতে পারো না।
বলেই দেয়ালে ঘুসি মেরে বসলো অভিক।আর হিয়া ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।হিয়া এগিয়ে যেতে চাইলো অভিকের কাছে কিন্তু অভিক ওকে কাছে আসতে বারণ করে দিয়েছে।
হিয়া কান্না করছে আর বারবার বলছে,
-অভিক, শান্ত হ ;দেখ তোর হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমাকে তোর হাতটি ধরতে দে আমি ব্যান্ডেজ করে দেই। এই অভিক শুনতে পাচ্ছিস আমি কি বলছি?
এরই মাঝে দরজায় সবাই করাঘাত করছে হয়তো হিয়ার চিৎকার শুনতে পেয়েছে। হিয়া দরজা খুলতে যাচ্ছিলো কিন্তু অভিক ওর হাতটি ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে। হিয়া বারবার ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু অভিকের কাছ থেকে কোনোভাবেই ছাড়া পাচ্ছিলো না। অভিক এবার হিয়াকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ করতে বললো। হিয়াও হঠাৎ করে স্থির হয়ে গেলো।অভিক, হিয়ার সামনের এলোমেলো ছোট চুল গুলো কানের পিছে গুজে দিলো। এরপর, হিয়ার মুখটি দুহাতে উঁচিয়ে পরখ করে দেখলো। হিয়া কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু, অভিক ইশারায় চুপ থাকতে বলে। এবার অভিক বলতে শুরু করলো,
-তোমাকে আমি কেন ফুল বলে ডাকি আজ কারণটি শুনবে তুমি?
হিয়া আস্তে করে মাথা দুলালো, যার অর্থ হ্যা।
-কারণ, আমি তোমায় ভালোবাসি ফুল। তোমাকে ফুল বলে এই জন্যই সম্বোধন করি কারণ ফুল হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধ, পবিত্রতম জিনিস ঠিক তোমার মতো। এই জন্যই আমি তোমার নাম রেখেছি ফুল। সেদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমি কবে থেকে সিগারেট খাচ্ছি? তবে শুনো, যেদিন থেকে আমি জানতে ও বুঝতে পেরেছি যে তোমাকে আমি ভালোবাসি ঠিক সেদিন থেকে। তোমার ভালোবাসার নেশা থেকে মুক্তি পেতে আমি সিগারেটের নেশাকে আপন করতে শিখেছি ফুল।
আরও কিছু বলতে চাইছিলো অভিক কিন্তু মূহুর্তের মাঝে ওর গালে সপাটে চড় মেরে দিলো হিয়া। অভিক শুধু চেয়ে থাকলো হিয়ার দিকে যেন সে জানতো ওর অব্যক্ত অনূভুতির কথা যেদিন হিয়া জানতে পারবে সেদিন ঠিক এইভাবে আচরণ করবে তার সাথে।
#চলবে