#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ২৯
মানুষ চলে যায়,রেখে যায় শুধু স্মৃতিগুলো। সে তো দিব্যি চলে যায় স্মৃতিগুলো ফেলে রেখে। অথচ সেই স্মৃতিগুলো তার আত্মার সাথে মিশে যাওয়া মানুষগুলোকে বড্ড পোড়ায়। ক্যাম্পাসের মাঠে গোল হয়ে বসে আছে বন্ধুমহল। অথচ আজ আর নেই সেই জমজমাট আড্ডা। হাসি,আড্ডা,দুষ্টুমি,খুনসুটি সবই যেন এক অদৃশ্য বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে। বহুক্ষণের নীরবতা ভেঙে অরিশা বলল,“তাহসিন,আমরা এখনও অন্তুর সুইসাইডের কারণ জানতে পারলাম না। তুই কি বলতে চাইছিস না আমাদের?”
তাহসিন মাথা দুলিয়ে বলল,“বলব। কিন্তু ওসব কথা মুখে আনতে ইচ্ছে করে না রে।”
নাদিয়া বলল,“এটুকু বুঝতে পারছি যে এসবের সাথে কোনো না কোনোভাবে টুম্পাও জড়িত আছে।”
তাহসিন ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,“গত কয়েকদিন আগে অন্তু কিছু কথা আমার সাথে শেয়ার করেছিল। ওর ফ্যামিলিতে অনেক ঝামেলা। ওর বড়ো ভাই আর ভাবির সাথে ওর মিলে না। তারা ওকে একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু ওর মাকে আর ওকে তো তাদের সাথেই থাকতে হত। কারণ ও প্রতিদিন সন্ধ্যায় যে দু একটা টিউশনি করাতো তাতে পড়াশুনা আর হাত খরচের টাকা উঠত না। এসব নিয়ে ও প্রচন্ড ডিপ্রেশড ছিল। কিন্তু আমরা কেউই এসব জানতাম না,কারণ ও কখনও কারো সাথে শেয়ার করেনি। তারমধ্যে আবার আরেক ঘটনা ঘটল। সৃজনকে চিনিস তো তোরা। ওই যে একদিন টুম্পার হাত ধরে টান মেরেছিল বলে অন্তর মারল। ওই ছেলের সাথে টুম্পা রিলেশনে জড়িয়ে গেছে। অন্তু সেটা জানতে পেরেছিল। তারপর ও টুম্পাকে অনেক বুঝিয়েছিল। ছেলেটা খুব একটা সুবিধার না এই কথাটা টুম্পা বিশ্বাসই করেনি। উল্টো অন্তুকে অনেক কথা শুনেয়েছিল। ওইদিন যে ও ভার্সিটিতে এল না। আমরা ফোন করার পর বলল বাসায় কাজ আছে। এ সবকিছুই মিথ্যা। সেদিন ও সৃজনের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। আর দুর্ভাগ্যবশত অন্তুর সামনে পড়ে গিয়েছিল। অন্তু যখন টুম্পাকে সৃজনের সামনেই বুঝানোর চেষ্টা করছিল তখন ওই ছেলে অন্তুকে সাইডে ডেকে নিয়ে টুম্পার আর তার বিষয়ে অনেক আপত্তিকর কথা বলেছিল। এমনকি এটাও বলেছিল যে টুম্পা আর ও একসাথে রাতও কাটিয়েছে। এসব কথার সত্যতা কতটুকু তা জানি না। এসব শুনে অন্তু খুব রেগে গিয়ে সৃজনের গায়ে হাত তুলেছিল। টুম্পা দূর থেকে সেসব দেখে দৌড়ে গিয়ে অন্তুর গালে চড় মেরেছিল। অন্তুর কোনো কথাই ও বিশ্বাস করেনি। সৃজন যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছে। একদিকে ফ্যামিলির প্যারা আরেকদিকে টুম্পার। দুই মিলিয়ে ও ডিপ্রেশনের চরম মাত্রায় পৌঁছেছিল। আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু ও কিছুই বুঝল না। নিজের কষ্ট শেষ করতে ও নিজেকেই শেষ করে ফেলল। আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ও এমন একটা কাজ করবে। এখনও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
বলতে বলতে তাহসিনের গলা ধরে এল। মেয়েরা সবাই নীরবে চোখের পানি ফেলল। ডালিয়া ধরা গলায় বলল,“তাহলে এজন্যই টুম্পা আমাদের কারোর সাথে যোগাযোগ করছে না?”
“করবে কীভাবে? ও নিজের কাছেই নিজে অপরাধী। অপরাধী কী বলছি? ওকে তো খুনি বলা চলে।”
তাহসিনের কথায় মুনা চোখ মুছে বলল,“কিন্তু ও এভাবে ফোন বন্ধ রেখে,ভার্সিটিতে না এসে কতদিন থাকবে?”
তাহসিন শক্ত মুখে বলল,“সারাজীবন থাকুক। তাতে আমার কী? ওর চেহারা দেখার ইচ্ছেও আমার নেই। ওই সৃজনকে একবার হাতের কাছে পেলে আমি ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম ভুলিয়ে দিতাম। কিন্তু ওই কাওয়ার্ডটা অন্তুর সুইসাইডের কথা শুনেই ঢাকা ছেড়েছে।”
ইলোরা আফসোসের সুরে বলল,“নিজের বন্ধুকে টুম্পা বিশ্বাস না করে অন্য একটা ছেলেকে বিশ্বাস করল! অন্তু যে ওর ভালো চায় সেটা বুঝল না। ওর মন মানসিকতা এমন হলো কবে আল্লাহ্ জানে।”
“হ্যা,ওর অবিশ্বাস আর নির্বুদ্ধিতার কারণে মাঝখান থেকে আমরা একজনকে হারিয়ে ফেললাম।”
তাহসিনের কথায় সবার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। অন্তরের হাস্যোজ্জ্বল দুষ্টুমি ভরা চেহারাটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ইলোরার হাতের ফোনে তখনই মেসেজ টোন বাজলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ। ইলোরা মেসেজটা ওপেন করল। সেখানে লেখা,“ক্লাসে যেও না। ওদের কিছু একটা বলে ক্যাম্পাসে থেকে যাও। জারিন আসবে তোমার সাথে কথা বলার জন্য।”
ইলোরা ভ্রুকুটি করে কিছু ভাবতেই মনে পড়ল জারিন এরেনের বোনের নাম। এরেনের নাম্বারটা সেভ করা হয়নি তাই সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারেনি। কিন্তু এখন সে ক্লাসে না গিয়ে ক্যাম্পাসে থাকবে কীভাবে? সবাই তো প্রশ্ন করবে। ইলোরার ভাবনার মাঝেই সবাই ক্লাসে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। ইলোরাকে একইভাবে বসে থাকতে দেখে ডালিয়া বলল,“তুই বসে আছিস কেন? ক্লাসে চল।”
ইলোরা আমতা-আমতা করে বলল,“আমার না ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। একদম ভালো লাগছে না।”
“ক্লাস কামাই দিবি?”
“তোরা যা। পরের ক্লাসের সময় আসছি আমি।”
“তাহলে আমিও যাব না।”
তাহসিন ডালিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,“ফাঁকিবাজি কম কর। তুই যাবি না তোর ঘাড় যাবে।”
মুনা ইলোরাকে বলল,“আচ্ছা তুই তাহলে পরে আসিস। আমরা যাই।”
ইলোরা বলল,“আচ্ছা।”
ইলোরা বাদে সবাই ক্লাসে চলে গেল। ইলোরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এটা ভেবে যে কেউ তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেনি আর জেদও ধরেনি। হঠাৎ তার মনে পড়ল সাকিবের কথা। ভাই যদি এখন দেখে সে ক্লাসে না গিয়ে এখানে বসে আছে তখন কী উত্তর দিবে? আর জারিনের সাথে কথা বলার সুযোগই বা পাবে কীভাবে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ইলোরা কপাল চাপড়াল। তখনই কোত্থেকে এসে যেন এরেন ধপ করে তার পাশে বসে পড়ল। ইলোরা কিছুটা হকচকিয়ে গেল। এরেন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,“তোমার জামাই এখনও বেঁচে আছে। কপাল চাপড়াও কোন দুঃখে?”
ইলোরা নড়েচড়ে বসে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাকিব আর রনিকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু আশেপাশে কোথাও তাদের কাউকে চোখে পড়ল না। ইলোরা ভাবছে ভাই যদি এসে এরেনকে তার পাশে বসা দেখে,তাহলে কী ভাববে? ইলোরার ভাবভঙ্গি দেখে এরেন হেসে বলল,“ওরা এখন ক্যাম্পাসে নেই।”
ইলোরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এরেন আবার বলল,“জারিন তোমার সাথে কী কথা বলবে জানতে চাইলে না তো?”
ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন হেসে বলল,“জানতে চাও?”
ইলোরা ইতস্তত করে বলল,“হ্যাঁ,প্রথমবার যখন দেখা হয়েছিল তখনও আপু আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলতে পারেনি।”
“সেজন্যই আজ আবার আসছে।”
“কী বলার জন্য?”
“ও এলেই জেনে নিও। তবে ও তোমাকে প্রশ্নও করবে। ভেবে জবাব দিও।”
“কিসের প্রশ্ন?”
“ভেবে নাও আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে।”
ইলোরা ভীষণ অবাক হলো। জারিন তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করবে মানে কী? সে কি এই সম্পর্কের ব্যাপারে জানে? ইলোরাকে অবাক হতে দেখে এরেন বলল,“জারিন প্রথম থেকেই সব জানে। চাইলেও ওর থেকে কোনো কথা লুকাতে পারি না আমি। সবসময় সবকথা সবার আগে ওর সাথে শেয়ার করি।”
ইলোরা ছোটো একটা শব্দ করল,“ওহ্।”
এরেন প্রশ্ন করল,“তোমার মন ভালো?”
ইলোরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপর নিচে মাথা দোলালো। এরেন হঠাৎ মৃদু শব্দ করে হেসে মজার ছলে বলল,“চুরি করাটা সার্থক হয়েছে। এমন দু একটু চুরি করলে যদি উপকার হয়,তো চুরিই ভালো।”
ইলোরা কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,“মানে?”
“মানে গতকাল সাকিবের ফোন থেকে তোমার নাম্বার চুরি না করলে তোমার সাথে কথা বলাও হত না। আর এখন তোমার পাশে বসে কথা বলার সুযোগটাও পেতাম না।”
ইলোরা মৃদু হাসল। এরেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“কান্নায় তোমাকে মানায় না। এই যে মুচকি হাসলে। এই মুচকি হাসিটাতে তোমাকে কত সুন্দর লাগছে,তুমি কি জানো?”
ইলোরা লজ্জিত হলো। পাশে বসে এমন প্রশংসা করলে তো লজ্জা পাওয়ারই কথা। এরেন এবার কিছুটা ঝুঁকে আবেগী কন্ঠে বলল,“লজ্জা পেলে আরও সুন্দর লাগে। একদম আবেদনময়ী মনে হয়!”
ইলোরার এবার ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে এখান থেকে চলে যেতে। এরেন সোজা হয়ে বসে বলল,“অগোছালো কবিতা শুনবে? সেদিনের মতো? মনে যা আসে তা-ই শুনাব কিন্তু।”
ইলোরা এবার আগ্রহী হয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। রনিদের বাড়ির ছাদে সেদিন এরেনের কবিতাটা তার খুব পছন্দ হয়েছিল। আবার ইচ্ছে জাগলো তেমন কবিতা শোনার। এরেন বুঝতে পারল ইলোরা শুনতে চায়। সে মুচকি হেসে ইলোরার মুখের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি শুরু করল,
“লাজুকলতা,তোমার ওই আলতা রঙের বদনখানি,
ওই হরিণীর মতো টানা অক্ষিযুগল
দেখার অধিকারটা কেবল আমাকেই দিও।
আমি ব্যতিত অন্য কেউ যেন
না দেখে তোমায় মুগ্ধ দৃষ্টিতে,
এ যে আমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে লাজুকলতা।”
ইলোরার লজ্জা এবার লাফ দিয়ে আরো কয়েক ধাপ উপরে উঠে গেল। দ্রুত সে এরেনের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল। এরেন হাসিমুখেই প্রশ্ন করল,“কী? পছন্দ হয়নি?”
ইলোরা মুখ খুলে উত্তর দিতে যাবে তখনই কেউ মেয়েলি কন্ঠে বলে উঠল,“বাব্বাহ্! বউকে কবিতা শোনানো হচ্ছে?”
ইলোরা চমকে সামনে তাকাল। হাস্যোজ্জ্বল মুখে জারিন দাঁড়িয়ে আছে। এরেন হেসে বলল,“আয়,বস।”
জারিন এসে ইলোরার আরেকপাশে বসে পড়ল। তারপর ইলোরাকে বলল,“কেমন আছো?”
ইলোরা মুচকি হেসে বলল,“ভালো,তুমি কেমন আছো?”
“ভালো। তো? বরের মুখে তো দিব্যি কবিতা শুনছিলে। ওর এই বস্তা পঁচা কবিতা তোমার ভালো লাগে?”
‘বর’ শব্দটা শুনে ইলোরা লাজুক হাসল। এরেন কটমট করে জারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ভাগ্যিস এটা ভার্সিটি তাই ছাড় পেয়ে গেলি। বাসায় যাই একবার। আজকে তোর খবর আছে।”
জারিন এরেনকে মুখ বাঁকিয়ে ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলল,“দেখো তোমার বর কেমন হারামি। সারাক্ষণ আমার সাথে এমন করে। তোমার চিন্তা নেই। তুমি তো তার বউ। দেখবে সারাক্ষণ তোমার আঁচল ধরে ঘুরবে।”
ইলোরা এরেনের দিকে ফিরেও তাকাল না। এরা দুই ভাইবোন মিলে আজ তাকে লজ্জায় ফেলার প্রতিযোগিতা লাগিয়েছে বোধ হয়। এরেন জারিনের মাথায় টোকা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“ফালতু কথা রেখে আসল কথা বল। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করবি। আমি আশেপাশেই আছি।”
জারিন মাথায় হাত দিয়ে কটমট করে তাকাতেই এরেন দ্রুত পায়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেল। ভাই বোনের খুনসুটি দেখে ইলোরা মুচকি মুচকি হাসছে। জারিন ঠোঁট উল্টে বলল,“তুমি হাসছো? তোমার এই শয়তান বর দিনরাত আমাকে মারে। মনে হচ্ছে তুমি ছাড়া একে কেউ ঠিক করতে পারবে না।”
ইলোরা হাসিমুখে বলল,“আচ্ছা,বাদ দাও আপু। তোমার কথা বলো। হঠাৎ আবার আমাকে মনে পড়ল যে?”
জারিন অবাক হয়ে বলল,“হঠাৎ! তোমার কি মনে হয় তোমাকে আমার হঠাৎ মনে পড়েছে? কী যে বলো না! তোমাকে তো প্রত্যেক দিন মনে পড়ে। আমার বউ পাগল ভাই তো আমার কানের কাছে একটা নামই বাজাতে থাকে,ইলোরা ইলোরা ইলোরা।”
ইলোরা অবাক হয়ে বলল,“তাই!?”
“হুম। বউকে ঘরে না তুলতেই ভাইটা আমার বউ পাগল হয়ে গেছে। যাইহোক,বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে হবে।”
ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“হ্যাঁ বলো।”
জারিন বলতে শুরু করল,“আমি শুরু থেকেই সবকিছু জানি। তোমাদের বিয়ে থেকে শুরু করে সব কাহিনি। বলতে গেলে তোমার আর ভাইয়ার পর আমিই সেই ব্যক্তি যে তোমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানে। বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হওয়ায় তোমরা দুজনই মেনে নিতে পারোনি ঠিকই। কিন্তু বিয়ের একমাস পর যখন আবার তোমার সাথে ভাইয়ার দেখা হয় তারপর থেকেই ও তোমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ঠিক করে যে ও তোমাদের সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দেবে। কারণ বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন তো আর কিছুই করার নেই। আমাকে এটাও বলেছে যে ও তোমার সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নেবে। কিন্তু ও তোমার অস্বস্তি কাটার অপেক্ষায় ছিল। অথচ তোমার তো অস্বস্তি কাটছেই না। আর আমার ভাইটা এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে তোমার সাথে কোনো কথাই বলতে পারল না। সেজন্যই আমি ওকে বলেছি যে আমি তোমার সাথে কথা বলব। কারণ আমার মনে হয় তুমি আমার সাথে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করবে না। সেদিন আমি একারণেই এসেছিলাম,কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেলাম না। তোমার জানা দরকার যে ভাইয়া চাইছে তোমাদের সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিয়ে তোমাকে স্ত্রীর অধিকার দিতে। ওর ধারণা তুমিও এটাই চাইছো। তোমার মুখ দেখেই না-কি ও বুঝতে পেরেছে তুমি কী চাও। কিন্তু আমি ওর অনুমানের ভিত্তিতে কিছু বলতে বা করতে চাই না। আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই,তুমি কী চাও? তোমার উত্তর শুনেই আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হব।”
ইলোরা অবাক হয়ে জারিনের কথা শুনছিল। এরেন আর তার চাওয়া তাহলে সত্যিই এক,ভাবতেই প্রচন্ড খুশি লাগছে তার। কিন্তু জারিনের প্রশ্ন শুনে সে ইতস্তত বোধ করল। অপ্রস্তুত ভাবে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। জারিন নিজের বাঁ হাতটা ইলোরার ডান হাতের উপর আলতো করে রেখে হেসে বলল,“আমার সাথে দ্বিধা করো না প্লিজ। মন খুলে কথা বলতে পারো। আমি কিন্তু শুধু তোমার সাথে কথা বলার জন্যই এসেছি। সাকিব ভাইয়া হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে। তোমার উত্তর জানাও। তুমি কি চাও এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে?”
ইলোরা এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসে মৃদু কন্ঠে বলল,“চাই আপু। কোন মেয়ে চায় যেচে দুটো বিয়ে করতে? কিন্তু আমার প্রচন্ড ভয় হয়।”
“কিসের ভয়?”
“আব্বু-আম্মু,ভাই এই বিয়ের ব্যাপারে জানলে তাদের রিয়েকশন কী হবে,কী ভাববে এসব নিয়ে খুব ভয় হয়। কারণ সেদিন আমার দোষেই এমন একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেছে আমার লাইফে। আমি যদি রাগ করে একা কিশোরগঞ্জ না যেতাম তাহলে হয়তো এমন কিছুই হত না। তাছাড়া বিয়ের প্রায় চার মাস পর যদি শোনে আমার এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়েছে,তা-ও আবার খুব বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে তাহলে তাদের মনের অবস্থা কী হবে? এই বিষয়টা তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে,আব্বুর হার্ট দুর্বল। হঠাৎ করে এসব কথা শুনলে যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়? এমনও তো হতে পারে যে এসব শুনে আমার ভাই তোমার ভাইয়াকে ভুল বুঝল। তাহলে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি কোনো বিপদ বাড়াতে চাই না আপু।”
কথাগুলো বলতে বলতে ইলোরার মন খারাপ হয়ে গেল। জারিনও গোমড়া মুখে বলল,“এসব চিন্তা আমরাও করি। যদিও আম্মীকে নিয়ে বেশি ভাবি না। কারণ ভাইয়া যা চাইবে আম্মী তা-ই মেনে নিবে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে অনেক টেনশনে আছি। বাবা এত সহজে এসব মানবে না। সে খুব কড়া মানুষ। তবু আমরা ভেবেছি আম্মীর হেল্প নিয়ে চেষ্টা করব। এখন তো মনে হচ্ছে তুমি তোমার বাড়িতে এ ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে পারবে না। যাইহোক,দেখি কী করা যায়। আপাতত তোমার মনের কথা তো জানতে পেরেছি। এটুকু শুনলেই তোমার বর খুশিতে লাফালাফি করবে।”
কথাটা বলে জারিন হাসল। ইলোরাও মুচকি হাসল। জারিন হাসিমুখে বলল,“আমি বলি কী,এখন আপাতত তুমি ভাইয়ার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো। ওর সাথে সহজভাবে কথা বলো মন খুলে। কোনো অস্বস্তি বা ভয়কে পাত্তা দিও না। দরকার পড়লে এই বিয়ের কথা হাইড করে সবার মতামত নিয়ে তোমাদের আবার নতুন করে বিয়ে দেবো। কেউ জানবেও না আগেও তোমাদের বিয়ে হয়েছিল। আইডিয়াটা দারুণ না? আজ থেকেই আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করা শুরু করে দাও। ভাববে তোমরা নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা। আর পরের বিয়েটাকে ভাববে লাভ ম্যারেজ। বুঝেছো? ফ্যামিলি নিয়ে প্যারা নিও না। আমরা দুই ভাইবোন মিলে দুই ফ্যামিলিকে পটিয়ে ফেলব। তুমি শুধু আড়াল থেকে আমাদের হেল্প করবে। ওকে?”
ইলোরা হেসে বলল,“আচ্ছা আপু,চেষ্টা করব।”
জারিন দৃঢ়ভাবে বলল,“চেষ্টা কী বলছো? বলো পারবে। পারতেই হবে তোমাকে।”
“কী পারতে হবে জারিন?” বলতে বলতে সাকিব এগিয়ে এল। সাকিবের সাথে এরেন আর রনিও আসছে। ইলোরা আর জারিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়াল। জারিন মুখে হাসি টেনে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে বলল,“তেমন কিছু না ভাইয়া। পড়াশুনার কথা বলছিলাম।”
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এরেন বলল,“বুড়ি,তোকে কি বাসায় পৌঁছে দিতে হবে? না-কি একা যাবি?”
জারিন কিছু একটা ভেবে বলল,“একা যেতে ইচ্ছে করছে না। তুইও চল।”
এরেন বলল,“আচ্ছা চল। এই সাকিব-রনি আমি আসছি।”
জারিন মুচকি হেসে ইলোরাকে বলল,“আসছি,ভালো থেকো।”
ইলোরাও হাসিমুখে বলল,“তুমিও।”
এরেন আর জারিন চলে গেল। রনি ইলোরাকে প্রশ্ন করল,“ইলোরা,তুমি এখন এখানে কেন? তোমার না ক্লাস চলছে? ওরা সবাই কোথায়?”
ইলোরা আমতা-আমতা করে বলল,“ওরা ক্লাসে আছে। আসলে আমার ভালো লাগছিল না তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ পরে যাই ক্লাসে। তারপর হঠাৎ জারিন আপুর সাথে দেখা হয়ে গেল। তাই আপুর সাথে গল্প করছিলাম।”
সাকিব বলল,“এখন কি ক্লাসে যাবি? শরীর ঠিক আছে তো?”
ইলোরা উত্তর দিলো,“হ্যাঁ ভাই। আচ্ছা,আমি ক্লাসে যাই।”
সাকিব বলল,“যা।”
ইলোরা দ্রুত পায়ে হেঁটে ক্লাসের দিকে চলে গেল। ইলোরা চলে যাওয়ার পর সাকিব সন্দিহান কন্ঠে রনির উদ্দেশ্যে বলল,“জারিন তো আগে কখনো ভার্সিটিতে আসত না। এখন আসে কী করতে? তোর সাথে দেখা করতে না-কি?”
রনি কটমট চাহনিতে তাকিয়ে বলল,“একশ বার বলছি ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করলে করবি না করলে চুপ থাকবি।”
সাকিব শব্দ করে হেসে সামনের দিকে পা বাড়াল। অগত্যা রনিও তার পেছনে ছুটল।
চলবে……………………🌸