সুপ্ত_প্রেমাসুখ শেষ পর্বঃ

0
2810

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৬৭(শেষ পর্ব)

“আম্মী, আম্মী, দরজা খোলো।”

এবনের ডাকে বিছানা ছেড়ে নেমে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল ইলোরা। দরজা খুলতেই এবন প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কী হয়েছে? সবার মাঝ থেকে এসে রুমে বসে আছো যে?”

“মাথাটা একটু ধরেছিল বাবা।”

এবন ব্যস্ত হয়ে বলল,“মাথা ধরেছে তো আমাকে বলবে না? চলো মাথা টিপে দিই।”

এবন হাত ধরতেই ইলোরা তাকে আটকে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,“এখন ঠিক আছি। তোকে এত ব্যস্ত হতে হবে না।”

এবন যেন স্বস্তি পেল না। পুনরায় চিন্তিত কন্ঠে বলল,“কী ঠিক আছো? চোখ-মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে।”

“আরে ঠিক আছি রে বাপ। কেন ডাকছিস তা বল।”

এবন এক আঙুলে কপাল চুলকে বলল,“ওই, আরজ ভাইয়ারা চলে যাচ্ছে। আঙ্কেল তোমাকে ডাকছে।”

ইলোরা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,“সেকি! না খেয়েই চলে যাবে?”

এবন ইলোরার হাত ধরে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,“চলো আগে।”

ড্রয়িংরুমে এসে তবেই এবন ইলোরার হাত ছাড়ল। ইলোরাকে দেখে আফসার এগিয়ে এসে বলল,“ইলোরা, আমাদের এখন যেতে হবে। মুন ফোন করছে বারবার।”

ইলোরা বলল,“এখন কেন? ডিনার করুন আগে।”

পাশ থেকে আরজ বলল,“না আন্টি, জানোই তো আম্মুর শরীর ভালো নেই। মৌনতাও আর থাকতে চাইছে না।”

আফসার-মুনার ছেলে আরজ এবং মেয়ে মৌনতা। আরজ দশম শ্রেণিতে, আর মৌনতা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আরজ অনেকটা মুনার মতো হলেও, মৌনতা সম্পূর্ণ আফসারের চেহারার অধিকারিণী হয়েছে। ইলোরা এগিয়ে গিয়ে মৌনতার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিমুখে বলল,“কী আম্মু? ডিনার করে যাবে না? আর একটু সময় থাকো।”

মৌনতা গাল ফুলিয়ে ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“না, এখানে আমার আর ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি যাব।”

এবন ভ্রুকুটি করে বলল,“কেন? তুই কি বাড়ি গিয়ে ফিডার খাবি?”

মৌনতা ফুলানো গাল দুটো আরও একটু ফুলিয়ে বলল,“আমি কি ছোটো পিচ্চি?”

এবন কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল,“অবশ্যই তুই পিচ্চি। পিচ্চি বলেই তো বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিস।”

মৌনতা ঠোঁট উলটে নালিশের সুরে ডাকল,“আন্টি?”

পেছন থেকে সাকিব এবনের মাথায় মৃদু টোকা মেরে বলল,“বাপের মতো হয়েছিস? পাজি ছেলে!”

এবন ডান হাতের তালুতে মাথা ঘষতে-ঘষতে ঘাড় ঘুরিয়ে সাকিবের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসল। পাশ থেকে অনন্যা কপাল কুঁচকে তাকাতেই সাকিব মেকি হেসে বলল,“আরে ম্যাডাম, থাপ্পড় মারিনি আপনার আদরের ছেলেকে। জাস্ট, টোকা মেরেছি।”

এবন ফিক করে হেসে বলল,“মামনি, আমার মামু কিন্তু আমাকে কম ভালোবাসে না।”

মৌনতার গাল ফুলানো না কমাতে পেরে ইলোরা ঠোঁট টিপে হেসে, এবনের দিকে তাকিয়ে রাগ করার ভান করে বলল,“এবন, খুব দুষ্টু হয়েছ তুমি। আমাদের মৌন ক্লাস ফাইভে পড়ে, জানো না? কত বড়ো হয়ে গেছে মেয়েটা।”

ইলোরার কথা শুনে মৌনতা খুশিতে প্রশস্ত হাসল। রনি বলল,“মৌন, তুমি তো এত্ত বড়ো হয়ে গেছ। কিন্তু আমার বউ আছে না? তোমার এই মিথি আন্টি। সে তো এখনও পিচ্চি রয়ে গেছে।”

রনির কথা শুনে মিথিলা কপাল কুঁচকে ফেলল। রনি আড়চোখে তাকাতেই মিথিলা কটাক্ষ করে বলল,“পাঁচ বছর ধরে এক পিচ্চির জ্বালা সহ্য করছি, আবার আট মাস ধরে ওনার আরেক পিচ্চি বহন করে চলেছি, সে আবার আমাকে পিচ্চি বলে। ঢং!”

কথাটা বলেই মিথিলা মুখ বাঁকিয়ে ভারী শরীর নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেল। রনি দাঁতে জিব কাটল। বিয়ের প্রায় সাত বছর হয়ে গেল। পাঁচ বছরের মেয়ে রুহিকে নিয়েই জীবন পার করার কথা ভেবেছিল রনি। কিন্তু মিথিলার জেদে আবারও বেবি নিতে হয়েছে। এখন মিথিলা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সারাক্ষণ তার খিটখিটে মেজাজ সহ্য করতে হয় রনিকে। তবু রনি একটা শব্দে গিয়েই আটকে যায়, ‘ভালোবাসা।’

“অনেক গল্প হয়েছে, সবাই খেতে এসো।” বলেই জারিন রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলো। জারিনের তাড়ায় সবাই গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। কিন্তু মৌনতা এক পা-ও নড়ল না। অরিশা এগিয়ে গিয়ে বলল,“মৌন সোনা, খেতে চলো।”

মৌনতা বলল,“আমি বাড়ি যাব।”

অরিশা মৌনতার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,“যাবে তো সোনা। তোমার আম্মু তো অসুস্থ, তাই না? এখন যদি তুমি না খেয়ে চলে যাও তাহলে তো আম্মু কষ্ট পাবে। তুমি কি আম্মুকে কষ্ট দিতে চাও?”

মৌনতা ডানে বায়ে মাথা দোলালো। তখনই তিন বছরের অনিকে কাঁধে নিয়ে মাহাদি হাসতে হাসতে এসে বলল,“আমাদের মৌন বুড়ির কী হয়েছে?”

অরিশা মাহাদির দিকে তাকিয়ে চোখ বড়ো করে বলল,“একি! অনি উঠল কখন? মাত্র দশ মিনিট আগে ঘুম পারিয়ে এলাম।”

মাহাদি অনিকে কাঁধ থেকে কোলে নামিয়ে বলল,“তোমার মেয়ে আবার কবে লম্বা ঘুম দেয়?”

“এখন ওকে নিয়ে খেতে বসব কীভাবে?”

“তোমাকে নিতে হবে না। আমিই পারব।” বলতে বলতে মাহাদি খাবার টেবিলের দিকে চলে গেল। মাহাদি আর অরিশার বিয়ের চৌদ্দ বছর হয়েছে। প্রথম দশ বছর অনেক চেষ্টা করেও তারা বেবি নিতে পারেনি। অবশেষে যখন বিয়ের এগারো বছর চলমান, তখন হঠাৎ করেই অরিশা কনসিভ করেছিল। আজ সে তিন বছর বয়সী মেয়ের মা। এত বছর পর বেবি হওয়ায় মেয়ে বলতে মাহাদি পাগল। মেয়েকে অরিশা একটা ধমক দিলেও, মাহাদি উলটো অরিশাকে ধমকে বসিয়ে রাখে। অরিশা মৌনতাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে, নিজেও বসে পড়ল। এবনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনন্যা বলল,“এবন, বসছিস না কেন?”

এবন বলল,“বাবাই আসুক, তারপর খাব।”

ইলোরা খাবার পরিবেশন করতে করতে বলল,“তোর বাবাই আসতে অনেক দেরি হবে বাবা। বসে পড়।”

এবন একইভাবে বলল,“যখন আসবে তখনই খাব। আমার তেমন ক্ষুধাও পায়নি।”

আরজ বলল,“আরে বসে পড় ভাই। রাত তো অনেক হয়েছে।”

“হোক।”

এবনের কথা যে আর পালটাবে না, তা সবাই বেশ ভালোভাবেই জানে। তাই কেউ আর জোর করল না। জারিন প্লেটে খাবার নিয়ে বলল,“ভাবি, আমি আম্মীর খাবারটা রুমে দিয়ে আসছি।”

ইলোরা প্রশ্ন করল,“বাবা খাবে না?”

“জিজ্ঞেস করেছিলাম, না বলে দিলো।”

“আচ্ছা যাও।”

জারিন চলে যেতেই এবন বলল,“দাদাভাই এমনিতেই ফিট। এত খাওয়া লাগে না।”

ইলোরা ভ্রুকুটি করে বলল,“এত কোথায় খেতে দেখিস। বয়স হয়েছে, এখন আর আগের মতো খেতে পারে?”

“হুম, যেনতেন বয়স না কি? ভাবো একবার, আমার বয়স চৌদ্দ বছর হলে, দাদাভাইয়ের বয়স কত?”

মিথিলা খাবার মুখে তুলে বলল,“আমাদের সামনে দু-দুজন টিচার বসে আছে। তাদেরকে ম্যাথ করতে দে।”

এবন সহমত পোষণ করে বলল,“একদম ঠিক বলেছ খালামনি।”

আফসার মৌনতার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে আগেভাগেই বলল,“আমি কিন্তু ইংলিশ টিচার।”

সাকিবও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,“আমি বাংলা টিচার।”

ঈশান শব্দ তুলে হেসে বলল,“টিচাররা ভয় পেয়েছে।”

পাশ থেকে ঈশান আর নাদিয়ার তেরো বছরের মেয়ে নামিরা বলে উঠল,“তাহলে তুমি বলো পাপা।”

ঈশান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“আমি কি ওনার বন্ধু না কি, যে সঠিক বয়স জানব?”

নাদিয়া হঠাৎ বলে উঠল,“মুনা, টুম্পা, ডালিয়া আর অন্তুকে খুব মিস করছি।”

নাদিয়ার কথা শুনে তাহসিন, অরিশা আর ইলোরার মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। তাহসিন বলল,“অন্তু, নামটা আজও জীবিতই মনে হয়। মনে হয়, এই তো সেদিন আড্ডায় বসে সবাইকে হাসানোর জন্য বধ্য পরিকর ছিল চঞ্চল ছেলেটা। আর আজ সে কোথাও নেই।”

বলেই তাহসিন মলিন হাসল। নাদিয়া বলল,“মুনার শরীর ভালো থাকলে অবশ্যই আসত। টুম্পা তো সেই বিয়ের পর আমেরিকা চলে গেল, ছয় বছর হয়ে গেল। তবু তো ও ওর হাসবেন্ড, বেবি নিয়ে ভালো আছে। আর ডালিয়া? তিন-তিনটা ছেলে-মেয়ের মা হয়েছে। অথচ এখনও হাসবেন্ডের থেকে সামান্যতম রেসপেক্ট পর্যন্ত পায় না।”

নাদিয়ার কথায় সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবন বলে উঠল,“অথচ আমার তাহসিন মামু আজও দেবদাস হয়েই জীবন কাটিয়ে দিলো।”

তাহসিন খাবার থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,“এই, এসব তোকে কে বলল রে?”

ইলোরা বলল,“কে আবার? ভাই।”

তাহসিন সাকিবের দিকে তাকাতেই সাকিব চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে বলল,“গল্প করার টপিক খুঁজে না পেয়ে, তোমার দেবদাস হওয়ার কাহিনীই ভাগনেকে শুনিয়ে দিয়েছি।”

আরজ বলে উঠল,“আমিও শুনব।”

সাকিব বলল,“এবনের থেকে শুনে নিস।”

তাহসিন হতাশ গলায় বলল,“হ্যাঁ, এসবই শোনাও বাচ্চাদের।”

অনন্যা বলল,“তোমরা বুড়ো হয়ে গেছ। এখন তোমাদের কাহিনী শুনলেই কী, আর না শুনলেই কী?”

তাহসিন চোখ দুটো বড়ো করে বলল,“এটা কোনো কথা বললেন ভাবি! আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি বুড়ো হয়ে গেছি? দেখুন, মাথার চুল সব কুচকুচে কালো।”

তাহসিন বাঁ হাতে তার চুল দেখাতেই ঈশান বলে উঠল,“এখানে কেউ বোকা না ভায়া। তোমার কালো চুলের রহস্য সবার জানা।”

তাহসিন পুনরায় হতাশ গলায় বলল,“নাহ্, এবার মনে হচ্ছে বিজনেস বগলদাবা করে আমায় দেশান্তর হতে হবে।”

আরজ হেসে বলল,“থাক মামু, দুঃখ পেয়ো না। তুমি আমাদের কাছে এখনও ইয়াং-ই আছো। কী বলিস এবন?”

এবন মাথা দুলিয়ে বলল,“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

তাহসিন হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। বয়স বাড়লেও, সে আজও সংসার জীবনে বাঁধা পড়েনি। চেষ্টা করেনি তা নয়। পরিবারের চাপে পড়ে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেন জানি কোনো মেয়েকেই তার পছন্দ হয়নি। হবে কী করে? দৃষ্টি জুড়ে তো একজনই ছিল। যখন বুঝল অন্য কারো সাথে জীবন সাজানো তার দ্বারা সম্ভব না, তখন চেষ্টা করাও ছেড়ে দিলো। বিজনেস গড়ে নিজের মতো জীবন কাটাতে শুরু করল। আর অবসর সময়টুকু সেই পুরনো বন্ধুমহলের সাথেই কাটানো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত বলে, সে নিজেই সবার সাথে গিয়ে দেখা করে আসে। সময়ের সাথে বয়স পরিবর্তন হলেও, তাদের বন্ধুত্ব আজও সেই একইরকম তরতাজা আছে। বন্ধুত্বে এটাই তাদের সবচেয়ে বড়ো তৃপ্তি।

গল্প-আড্ডায় খাওয়া শেষ করে বিদায়ের পালা এল। আরজ আর মৌনতাকে নিয়ে আফসার চলে গেল। নামিরাকে নিয়ে ঈশান আর নাদিয়া চলে গেল। তাহসিনও চলে গেল। সাকিব আর অনন্যা যেতে চাইতে‌ই এবন বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। এবনের অনুরোধে অনন্যার থেকে যেতে ইচ্ছে করলেও পারল না। সাজিদ হোসেন আর মালিহা বেগম বিকালেই বাড়ি চলে গেছেন। তাদের দেখাশোনার ব্যাপার আছে। অনন্যার একটু মন খারাপ হলো। সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে সে মা হওয়ার স্বাদ নিতে পারেনি। এবনকেই নিজের ছেলের মতো ভালবাসে অনন্যা। এবনও তাকে মায়ের থেকে কম ভালোবাসে না। মন খারাপকে সঙ্গ করেই বিদায় নিয়ে সাকিবের সাথে বাড়ি চলে যেতে হলো। মিথিলা আর রনি থেকে গেল। মিথিলার শরীরের কথা ভেবেই রনি এই রাতে বাড়ি ফেরার সাহস করেনি।

জারিন আর ইলোরা খাবার টেবিল থেকে থালা-বাটি গুছিয়ে রান্নাঘরে রাখছে, আর এবন গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছে। অধৈর্য হয়ে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“ধুর! বাবাই এখনও আসছে না কেন আম্মী?”

ইলোরা বলল,“এসে পড়বে এক্ষুনি। ফোন করেছিল তোর ফুপিন।”

কলিংবেলের শব্দ কানে আসতেই এবন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। জারিন হেসে বলল,“ওই তো এসে গেছে। যা, দরজা খোল গিয়ে।”

এবন ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশের হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি একহাতে এবনকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,“কী বাবা? খাওয়া হয়নি?”

এবন ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“নাহ্।”

“আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আরেকটু ওয়েট করো।”

“ওকে।”

বাবাই রুমের দিকে চলে যেতেই এবন গিয়ে পুনরায় চেয়ার টেনে বসে বলল,“ফুপিন, বাবাই ফ্রেশ হতে গেছে। খাবার সার্ভ করো।”

ইলোরা আর জারিনও এবার চেয়ার টেনে বসে পড়ল। খাবার সার্ভ করে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ জারিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে বলে উঠল,“ওদের উঠিয়েছ কেন?”

ছয় বছরের দুই জমজ ছেলেকে দুহাতে ধরে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আরহাম হেসে বলল,“ওরা নিজেরাই উঠে গেছে। রুমে একটু শব্দ পেয়েই দুজনের ঘুম ভেঙে গেছে। আমি কী করব?”

“এবার তুমি ওদের ঘুম পাড়াবে। অনেক কষ্টে দুটোকে ঘুম পাড়িয়েছিলাম।” বলেই গাল ফুলিয়ে বসে পড়ল জারিন। ইলোরা আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,“খেতে বসুন। এবনের কাল স্কুলে যেতে হবে। ঘুমাবে কখন?”

আরহাম দুই ছেলেকে দুটো চেয়ারে বসিয়ে, নিজেও বসে পড়ল। এবন বলল,“বাবাই, আজ এত লেইট কেন?”

আরহাম বলল,“সার্জারি ছিল একটা।”

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল। ইলোরা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সামনে তাকাতেই এরেনের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখে পড়ল। এরেন বলল,“এতক্ষণে আসার সময় হলো?”

“তোমার ছেলে না খেয়ে বসে থাকলে আমি কী করব? ডক্টর আরহাম না ফিরতে তো একদিনও ডিনার করে না।” বলতে বলতে ইলোরা কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। কাবার্ড খুলে একটা প্যাকেট বের করে নিয়ে এসে বিছানায় বসল। প্যাকেট থেকে সবকিছু বের করতেই এরেন প্রশ্ন করল,“শাড়ি পরবে?”

ইলোরা বলল,“নতুন কী? প্রতিবছরই তো পরি।”

এরেন মৃদু হাসল। খুব কম সময়ের মধ্যেই ইলোরা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে, হালকা সাজগোজ করল। অদূরে বসে এরেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল প্রেয়সীর স্নিগ্ধ মুখের দিকে। দরজায় টোকা পড়তেই ইলোরা গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,“কে?”

দরজার ওপাশ থেকে শব্দ এল,“ভাবি, আমি।”

ইলোরা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই জারিন অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,“এই শাড়িটা পরলে এখনও তোমাকে একদম ইয়াং মনে হয় ভাবি।”

ইলোরা জারিনের কথায় কান না দিয়ে প্রশ্ন করল,“কিছু বলবে আপু?”

“হ্যাঁ, তোমার ছেলেই আমাকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে। তোমার মাথা ব্যথা করছে না কি তা জানার জন্য। তার ঘুম পাচ্ছে তাই শুয়ে পড়েছে।”

“না, খাবারের আগে একটু মাথা ধরেছিল, তাই ও তোমাকে পাঠিয়েছে বোধ হয়। পাগল ছেলে!”

“আচ্ছা, আমি যাই। গুড নাইট।” মেকি হেসে কথাটা বলেই জারিন দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। ইলোরা দরজা বন্ধ করে পুনরায় এগিয়ে আসতেই এরেন উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে ইলোরার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“খুব সুন্দর লাগছে ইলোনি।”

ইলোরা মৃদু হাসল। এরেন পুনরায় বলল,“ভালোবাসি ইলোনি।”

ইলোরা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই এরেন ঘুরে দাঁড়িয়ে বেলকনির দিকে পা বাড়াল। পেছন থেকে ইলোরা প্রশ্ন করল,“কোথায় যাচ্ছ।”

“কিছু সময়ের জন্য বেলকনিতে চলে যাচ্ছি। এখনই তো কান্নাকাটি শুরু করবে। আমি তোমার কান্না সহ্য করতে পারি না, জানো না?” পেছন ফিরে না তাকিয়েই কথাটা বলতে বলতে এরেন বেলকনিতে চলে গেল। তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ইলোরা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। টেবিলের ড্রয়ার থেকে ডায়রি আর কলম বের করল। ডায়রি খুলে হাতে কলম নিয়ে, বড়ো একটা দম নিয়ে ধীর গতিতে লেখা শুরু করল।

এবনের আব্বু,
তোমার একটা কথা আমি আজও রাখতে পারলাম না। তুমি আমায় কাঁদতে বারণ করেছিলে। কিন্তু দেখো, চিঠির প্রথম দুটো শব্দ লিখতেই আমার চোখের পানি বেপরোয়ার মতো গড়িয়ে পড়ল। এই চিঠির ইতি টানা পর্যন্ত এই পানি আর থামবে না। বিশ বছর বয়সেও আমি তোমার ছিঁচকাদুনে, আবেগী বউ ছিলাম, পঁয়ত্রিশে এসেও ঠিক তেমনটাই আছি। জানো? আজ সন্ধ্যাটা বেশ ভালোই কেটেছে। কিন্তু দিনটা কেমন বিষাদময় লেগেছে। যে অনুষ্ঠান আগামীকাল হওয়ার কথা ছিল, তা একদিন আগে হলো ডক্টর আরহামের জন্য। কাজের চাপে কাল সে থাকতে পারবে না, তাই। তোমার পনেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কতই না আয়োজন হলো! অথচ যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সে-ই নেই, এই কথাটা মানতে আমার আজও খুব কষ্ট হয়। মনে হয় এই বুঝি আমার শ্বাস রোধ হয়ে এল। কিন্তু তোমার ছেলের কথা মাথায় আসতেই দমে যাই। এই একটা কারণেই তো আজও আমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। নইলে তো সেই পনেরো বছর আগেই তোমার কাছে চলে যেতাম। যেদিন তুমি আমাকে ছেড়েছুড়ে চলে গিয়েছিলে, সেদিন সকালেও বলেছিলে তোমার একটা ছোট্ট বেবি চাই। তুমি চলে যাওয়ার পর পাগলপ্রায় আমার বাঁচার আশা ছিল শূন্যের কোটায়। কতবার যে সুইসাইড করার চেষ্টা করলাম! অথচ তখনও জানতাম না তোমার অস্তিত্ব আমার ভেতরে বাস করছে। যেদিন জানলাম, সেদিন বুকফাটা আর্তনাদ করেছিলাম। অথচ তুমি চলে যাওয়ার সময়ও জানলে না, আমার বেঁচে থাকার কারণ তুমি আমাকে দিয়ে গেছ। শুধুমাত্র তোমার অস্তিত্বকে পৃথিবীতে আনার জন্যই আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলাম। গর্ভকালীন সময়ে না কি স্বামীর সান্নিধ্য খুব প্রয়োজন। অথচ আমি প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তোমার একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য কতই না হাহাকার করেছি! কিন্তু তুমি কোথাও ছিলে না। এবন, সত্যিই তোমার অস্তিত্ব। ওর মাঝে আমি তোমাকে দেখতে পাই। সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখ, সেই চালচলন, সেই কথা বলার ধরণ, সেই হাসি। যেন ছোটো এরেন জামান! মাত্র চৌদ্দ বছরের ছেলে অন্য কিছু শিখেছে আর না-ই শিখেছে। তোমার মতো করে আমার যত্ন নিতে শিখেছে। খুব ছোটো বেলায় ও যখন প্রশ্ন করত,‘আম্মী, আমার আব্বু কোথায়?’ বিশ্বাস করো, এই প্রশ্নের মতো জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি বোধ হয় আমি এই জীবনে কোনোদিনও হইনি। ডক্টর আরহামের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সে তোমার ছেলেকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছে যে, এখন তোমার ছেলে বাবাই বলতে পাগল। ওহ্! তোমাকে তো বলাই হয়নি। তোমার প্রতি তোমার ছেলের প্রধান অভিযোগ হলো, তুমি কেন ওর আম্মীকে একা ছেড়ে চলে গেলে? মাঝে মাঝে আমার বড্ড ইচ্ছে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে তোমার কাছে চলে যাই। কিন্তু ‘আম্মী’ ডাকটা শোনার লোভে নিজের ইচ্ছেকে বুকে চেপে রাখি। তবে আমি আমার সুপ্ত প্রেমাসুখ নিয়ে রোজ অপেক্ষায় থাকি, কবে তোমার কাছে যাব। কী করব বলো? সারাদিন বিজনেস, ফ্যামিলি সামলে রাতে ঘুমাতে গেলেই বুকটা কেমন খাঁ-খাঁ করে। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে আমি তোমাকে আজও অনুভব করি, ঠিক যেভাবে পনেরো বছর আগে করতাম। এই তো একটু আগেও তুমি আমার কপালে চুমু খেলে, ফিসফিস করে বললে ‘ভালোবাসি ইলোনি।’ তুমি দূরে থাকলেও তোমাকে ঘিরে আমার সমস্ত অনুভূতিরা আজীবন জীবন্ত থাকবে। আমার কী ধারণা জানো? তোমার প্রেমাসুখ আমাকেও পেয়ে বসেছে। অথচ তুমি নামক ঔষধটাই আমার কাছে নেই। তাই এই অসুখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোনো উপায়ও নেই। বাধ্য হয়েই প্রেমাসুখটা সুপ্ত রাখি, যাতে কেউ না বোঝে। কথা ছিল যুগ যুগ ধরে এভাবেই ভালোবেসে যাবে আমাকে। অথচ মাত্র দু বছর পেরিয়েই তুমি শান্তির ঘুমে মগ্ন হলে। ভাবলে না, যাকে রেখে যাচ্ছ সে কীভাবে ঘুমাবে। বলেছিলে আমি কোনোদিনও তোমার দৃষ্টির আড়ালে গেলে, তুমি তোমার প্রেমাসুখের ঔষধ ইলোনির অভাবে নির্ঘাত মারা পড়বে। অথচ আমি তোমার এই অসুখটা নিয়েই দিব্যি বেঁচে আছি। হ্যাঁ, তোমাকে ছাড়াই বেঁচে আছি। আচ্ছা? এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে? না কি বাধ্য হয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া বলে? সৃষ্টিকর্তার কী অদ্ভুত নিয়ম তাই না? যেই বাসের অছিলায় একদিন আমি তোমাকে পেয়েছিলাম, সেই বাসই আবার তোমাকে আমার কাছ‌ থেকে কেড়ে নিল! তুমি বলেছিলে আমাদের প্রত্যেক ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে আমাকে নিয়ে বাস জার্নি করবে। অথচ গত পনেরো বছরে না আমি একদিন বাসের ধারেকাছে গিয়েছি, আর না এবনকে যেতে দিয়েছি। সর্বনাশা বাস আমাকে যতটুকু দিয়েছে, তার থেকে হাজার গুণ বেশি কেড়ে নিয়েছে। আমার জীবনের সবথেকে মূল্যবান মানুষটাকেই তো কেড়ে নিল! শোনো, আজ আমি তোমার দেওয়া শেষ উপহারগুলো দিয়ে সেজেছি। মনে পড়ে, টু ইয়ার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে নিজের হাতে আমাকে সাজিয়েছিলে? তারপর তো পনেরোটা অ্যানিভার্সারি আমি নিজেই সেভাবে সেজেছি। লাস্ট যেই বিছাটা তুমি আমার কোমরে পরিয়ে দিয়েছিলে, সেটা মাঝে মাঝেই পরি। কেন জানো? পেটের বাঁ পাশে প্রণয়ের কালো চিহ্নটাকে স্মরণ করার জন্য। এই চিহ্নটা কতশত মুহূর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় আমায়! তোমার দেওয়া সব শাড়ি আমি যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছি, যখন ইচ্ছে হয় পরি। ওহ্, আরেকটা কথা। সেদিন বাবা বলছিল তোমার শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবিগুলো গরীবদের দান করে দিবে। আমি রাজি হতে পারিনি বলে টাকা দিয়ে দিয়েছি। এত বছর ধরে যেগুলো এত যত্নে রেখেছি, সেগুলো কীভাবে ছাড়ি? তা-ও আবার তোমার ব্যবহৃত জিনিস, যাতে তুমি মিশে আছো। দেখো কান্ড, কত লম্বা চিঠি লিখে ফেলেছি! কী আর করব? আবার তো সেই এক বছর পর তোমায় চিঠি লিখব। তাই মনের সব কথা উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করে। এই চিঠি যখন লিখতে বসেছি, তখন রাত এগারোটা পঞ্চান্ন। এর মানে তখন আমাদের ফিফটিন্থ ইয়ার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি ছিল। আর এখন রাত বারোটা দশ। এর মানে, ঠিক এই মুহূর্তে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। চিঠি শুরু করেছিলাম আমাদের সতেরোতম ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে, শেষ করলাম তোমার পনেরোতম মৃত্যুবার্ষিকীতে। আর এটা তোমাকে লেখা আমার পনেরোতম চিঠি। মনে হচ্ছে আর লিখতে পারব না। বুকের বাঁ পাশটা প্রচন্ড ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শেষ একটা কথা বলি। তোমার কাছে না যাওয়া অবধি আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা। শেষবারের মতো একবার তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারিনি আমি। আল্লাহ্ যেন পরকালে এই আকাঙ্ক্ষা মিটাবার সুযোগ দেন। আমি যেন আবারও সেই আদুরে কন্ঠে শুনতে পাই,“ভালোবাসি ইলোনি।”
ইতি
তোমার প্রেমাসুখে আক্রান্ত
ইলোনি

~সমাপ্ত~

(দীর্ঘ পাঁচ মাস পর অবশেষে সমাপ্তি ঘটল। পাঁচ মাস, দীর্ঘ সময়। এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে, সুপ্ত প্রেমাসুখ আর কখনও লিখব না আমি। জানি, কেউ স্যাড এন্ডিং চায়নি। কিন্তু আমি আমার সাজানো থিম অনুযায়ীই সম্পূর্ণ গল্পটা লিখেছি। এতদিন যেসকল পাঠকরা আমার পাশে থেকেছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা। যারা এতদিন শুধু গল্প পড়েছেন, কিন্তু রেসপন্স করেননি। আশা করি তারাও আজ এক লাইন হলেও বলে যাবেন। সম্পূর্ণ গল্পটা পড়ে আপনাদের অনুভূতি কী? আপনারা না বললে আমি বুঝব কীভাবে, গল্পটা আপনাদের হৃদয় ছুঁতে সক্ষম হয়েছে কি না? এখন আমি অ্যাডমিশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব, কিন্তু লেখালেখি একেবারে বন্ধ রাখব না। আশা করি আপনারা সবসময়ের মতোই আমার পাশে থাকবেন। এতদিনে আমার কোনো ভুল চোখে পড়লে মাফ করবেন। সবার সুস্থতা কামনা করছি। আসসালামু আলাইকুম।😊❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here