#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫৮
আনুষ্ঠানিক বিয়ের আজ পাঁচ মাস নয় দিন কেটে গেল। এরমধ্যে এরেন ফাইনাল এক্সাম শেষ করে জাকির জামানের ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়েছে। ইলোরা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছে। কথা ছিল তাদের বিয়ের পাঁচ মাস পরেই আবার আনুষ্ঠানিকভাবে ইলোরাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে। কিন্তু তারমধ্যে বাঁধ সাধল ইলোরার ফুপার মৃত্যু। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। ইলোরাদের পরিবার এখনও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই জাকির জামান জানিয়েছেন তারা কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই পুত্রবধূ ঘরে তুলবেন। আগেরবার যেহেতু বেশ ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেহেতু এখন অনুষ্ঠান বিশেষ জরুরী নয়। জাকির জামানের কথামতোই আজ ঘরোয়াভাবে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর আয়োজন করেছেন সাজিদ হোসেন। নিজেদের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিয়ে বাড়ি এনেছেন। মহিলারা সবাই মিলে রান্নাবান্না শুরু করেছে সকালের নাস্তার পরেই। ইলোরার মনটা দোটানায় ভুগছে। একদিকে ভালোবাসার মানুষটার কাছে থাকার আনন্দ, আরেকদিকে পরিবার ছেড়ে যাওয়ার বেদনা। মেয়েদের কী অদ্ভুত নিয়ম মেনে চলতে হয়! যেই পরিবারে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠে, সেই পরিবার ছেড়েই একদিন অন্য একটা পরিবারকে আপন করে নিতে হয়। অথচ এমনও অনেক মেয়ে আছে যারা বিয়ের আগে পরিবার ছেড়ে কোথাও বেড়াতেও যায় না। শেষমেষ নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ মেয়েদের একদিন না একদিন সারাজীবনের জন্য পরিবার ছেড়ে অন্যত্র থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। ইলোরার ক্ষেত্রেও এমনটাই হবে। এতটা বছর যেখানে ভাইকে ছাড়া এক পা-ও ফেলতে পারেনি, সেখানে আজ থেকে ভাইয়ের বদলে থাকবে স্বামী। প্রত্যেকটা দিন নিজের বাবা-মাকে কারণে অকারণে ডাকার বদলে শ্বশুর-শাশুড়িকে ডাকতে হবে। বোনের সাথে খুনসুটি আর জমে উঠবে না। কয়েকদিন পর পর দেখা হলে কি আর সেখানে খুনসুটির কথা মনে পড়ে? ননদকেই বোন ভেবে নিতে হবে। ইচ্ছে করলেও ছুটে আসা যাবে না নিজ পিতৃগৃহে। এতটা দিন নিজের বাড়িতে থাকায় এই ব্যাপারগুলো ইলোরা টের পায়নি। কিন্তু গতরাত থেকেই এগুলো তাকে বড়ো পোড়াচ্ছে। এতটা পোড়াচ্ছে যে চোখের জলগুলোও বারবার বাঁধ ভাঙছে। সকাল থেকে এরেনের সাথেও ঠিকমতো কথা হয়নি তার। এরেন জানে এখন ইলোরার মনের অবস্থা কেমন। তাই সেও খুব একটা জোর করেনি। মেয়েটার একটু সময় দরকার নিজেকে সামলানোর। বোনের মন খারাপ আর চোখের জল সাকিবের দূর্বলতা, বিধায় সে ইচ্ছে করেই দূরে দূরে থাকছে। ইলোরার বন্ধুমহলকে ফোন করে বলেছে তাড়াতাড়ি চলে আসতে। তারা হয়তো মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিতে পারবে। সাকিবের ফোন পেয়েই ইলোরার বন্ধুমহল সকাল এগারোটার দিকে চলে এসেছে। তারা এসেই হুড়মুড় করে ইলোরার রুমে ঢুকে আসর বসিয়েছে। তাদের গল্পে গল্পে ইলোরার মন খারাপ ভাবটা কিছুটা কমে গেল। তবু সে চুপচাপ সবার কথা শুনে যাচ্ছে। সবাই মিলে তাহসিনকে খোঁচা মেরে কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। সবাই বারবার বলছে,“তাহসিন, মনের কথা এত চেপে রাখতে নেই। তারপর দেখবে অন্য পাখি এসে তোমার ডালিম নিয়ে ভেগেছে। সময় থাকতে তা কাজে লাগাও।”
এমন নানা কথা শুনে ডালিয়া মানে মানে সবার মাঝ থেকে কেটে পড়েছে। তাহসিন সবার ক্যাঁচ-ক্যাঁচ সহ্য করতে না পেরে বলল,“মনের কথা বলে দিলেই তো বলে দিলাম। এত তাড়াহুড়োর কী আছে? ধীরে সুস্থে প্রণয় হোক।”
টুম্পা চোখ বড়ো করে বলল,“অলরেডি এক বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও এই কথা বলছিস?”
“হ্যাঁ, তো?”
মুনা বলল,“ভালো কথা কানে নিতে ইচ্ছা করে না তাই না? থাক তুই তোর মনের কথা নিয়া।”
তাহসিন কথা ঘুরানোর জন্য চেহারায় একটু সিরিয়াস ভাব এনে বলল,“এসব বাদ দে। খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা শোন।”
তাহসিনের মুখোভাব দেখে সবাই একটু নড়েচড়ে বসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাহসিন গলা ঝেড়ে সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,“আসলে, বলব?”
টুম্পা বিরক্তি নিয়ে বলল,“ঢং করছিস? তাড়াতাড়ি বল।”
তাহসিন কিছুটা ইতস্তত করতে লাগল। নাদিয়া বলল,“ধুর! বলছিস না কেন? কাহিনি কী?”
তাহসিন আমতা-আমতা করে বলল,“সত্যিই বলব?”
অরিশা বলল,“বললে বল, না বললে যা ভাগ।”
তাহসিন বলল,“আচ্ছা, তাহলে বলেই ফেলি।”
ইলোরা বলল,“বল।”
তাহসিন ফট করে বলল,“আসলে আমার খুব পানি পিপাসা পেয়েছে।”
তাহসিনের কথায় সবাই কপাল কুঁচকে ফেলল। মুনা বলল,“আগে কথাটা বল।”
“বললামই তো।”
“কখন?”
“ঐ যে বললাম পানি পিপাসা পেয়েছে।”
অরিশা ফুঁসে উঠে বলল,“এটা তোর ইম্পর্ট্যান্ট কথা?”
তাহসিন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“হুম।”
ফলস্বরূপ সবার দৌড়ানি খেয়ে তাহসিন রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
দুপুরের কিছু আগে এরেনের পরিবার এল। সঙ্গে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন। কেউ কেউ গিয়ে ইলোরার সাথে দেখা করে এল। ঘরোয়াভাবেই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন হলো। বান্ধবীরা মিলে ইলোরাকে শাড়ি পরিয়ে হালকা সাজিয়ে দিলো। কিন্তু ইলোরার চোখের জলে সাজগোজ সব নষ্ট হবার জোগাড়। বিকালের দিকে বিদায়ের পালা এল। ইলোরার কাছে মনে হলো এর থেকে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি বোধ হয় তার জীবনে কোনোদিনও আসেনি। বাবা-মা আর বোনদের জড়িয়ে ধরে শুরু হলো তার বাঁধ ভাঙা কান্না। ইলোরার পরিবারের মানুষগুলোরও একই অবস্থা। ইলোরার কান্না দেখে এরেনের বুকটা কেঁপে উঠল। মনটাও হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটার কান্না সহ্য করার ক্ষমতা বোধ হয় উপরওয়ালা তাকে দেয়নি। মালিহা বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রায় জ্ঞান হারাবার জোগাড়। সাজিদ হোসেন মেয়েকে এরেনের হাতে তুলে দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিদায়ের আগ মুহূর্তে ইলোরার খেয়াল হলো দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও সাকিবের দেখা পায়নি সে। চারদিকে ভাইয়ের খোঁজ করে ইলোরা কোথাও সাকিবকে দেখতে না পেয়ে অনন্যাকে জিজ্ঞেস করল,“ভাই কোথায়?”
অনন্যা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,“রুমে আছে। আমি ডেকেছিলাম কিন্তু আসবে না। বলল, তোকে বিদায় দিতে পারবে না আর তোর কান্নাও সহ্য করতে পারবে না।”
কয়েকজন সাকিবকে ডাকতে গিয়েও ফেরত এল। শেষে এরেন নিজেই ইলোরাকে নিয়ে সাকিবের রুমে উপস্থিত হলো। রুমের দরজা ভেজিয়ে রেখে সাকিব বিছানায় পা ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিল। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে ইলোরা-এরেনকে দেখে সে মেকি হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এরেন গিয়ে সাকিবকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,“শালা, মেয়েদের মতো ঘরে বসে আছিস কেন? না-কি পর্দা করছিস?”
ইলোরা দু’পা এগিয়ে গিয়ে ধরা গলায় ডাকল,“ভাই?”
সাকিব ফিরে তাকাল। কিন্তু এবার আর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারল না। বোনের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোই তাকে দুর্বল করে দিলো। মুহূর্তে তার চোখ দুটোও জ্বলতে শুরু করল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে সাকিব ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করে বলল,“শ্বশুড়বাড়ি চলে যাচ্ছিস? যা যা, বাড়ি এবার খালি হবে আস্তে আস্তে। তারপর আমার একার রাজত্ব। বোনদের ঝামেলা থেকে মুক্তি। কী বলিস?”
দুষ্টুমি করার ইচ্ছা থেকে সাকিব কথাগুলো বলতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। শেষে গিয়ে ঠিকই গলাটা কেঁপে উঠল। ইলোরা আরও দু’পা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ সাকিবকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ব্যাস, এতক্ষণ যা মনোবল ছিল তা-ও হারাল সাকিব। বোনের কান্নার শব্দ যেন তার হৃদপিন্ডে আঘাত হানল। দুহাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে সেও এবার চোখের বাঁধ ভাঙল। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সাকিব কিছু বলতে চেয়েও পারল না। শব্দগুলো সব গলায় আটকে গেল। অনন্যা এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,“বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে।”
সাকিব ইলোরার মুখটা তুলে ধরে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,“সুখে থাক বোন। তোর ভাই তোকে খুব সুখী দেখতে চায়।”
এরেন সাকিবকে আলিঙ্গন করে পিঠ চাপড়ে বলল,“চিন্তা করিস না। আমার ওপর ভরসা রাখ। তোর বিশ্বাসের মূল্য রাখব আমি। তোর বোন যেমন তোর কাছে থেকে এক ফোঁটা কষ্ট পায়নি, আমার কাছেও তেমনি থাকবে।”
সাকিব হেসে বলল,“এটা জানি বলেই বিয়েটা দিয়েছিলাম।”
সাকিবের থেকে বিদায় নিয়ে এরেন ইলোরার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে এল। ইলোরার খুব ইচ্ছে হলো আরেকবার গিয়ে ভাইটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে। সাকিব পুনরায় বিছানায় ধপ করে বসে দুহাতে মুখ চেপে ধরে জোরে শ্বাস নিল। অনন্যা এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখে সে উলটো দিকে পা বাড়াতে পারেনি। এগিয়ে গিয়ে সাকিবের সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত রাখল অনন্যা। সাকিব মুখ তুলে অনন্যাকে দেখে বলল,“কিছু বলবি?”
অনন্যা জানে মানুষটার বুকের মধ্যে এখন ঠিক কী পরিমাণ তোলপাড় চলছে। বোনটা যে তার প্রাণ! অনন্যা দুহাতে সাকিবের মাথাটা বুকে চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,“আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে।
সাকিব বুঝল আজ আর নিজেকে সামলানোর উপায় নেই। সে হঠাৎই অনন্যার কোমর জড়িয়ে ধরে মৃদু শব্দ তুলে কেঁদে উঠল। বড়ো হওয়ার পর এই মানুষটাকে অনন্যা কোনোদিনও কাঁদতে দেখেনি। হয় গম্ভীর, নয় হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখতেই অভ্যস্ত সে। এমন একটা মানুষের কান্না থামানোর জন্য ঠিক কী সান্ত্বনা দেয়া যায় বুঝে উঠতে পারল না অনন্যা।
গাড়িতে বসেও কেঁদে চলেছে ইলোরা। শরীরটাও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এরেন তাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বারবার কান্না থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ইলোরা সেসব কানেই নিল না। ক্লান্ত হয়ে একসময় এরেনের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ল।
•
রাত প্রায় এগারোটা। জারিন আর তার কাজিনরা মিলে ইলোরাকে ধরে বেঁধে বউ সাজাতে ব্যস্ত। ইলোরা বারবার করে নিষেধ করার পরও কেউ শোনেনি। তাদের একটাই কথা,“বাসর ঘর যেহেতু সাজানো হয়েছে সেহেতু বউও সাজতে হবে।”
ইলোরা অবাক হয়ে বলল,“আবার কিসের বাসর?”
জারিন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“আরে ভাবি, প্রথমবার তোমাদের বাড়িতে বাসর হলো বলে তো এন্ট্রি নিতে পারিনি। কিন্তু এবার তো আর ছাড়ছি না। সুদে আসলে উসুল করে নিব।”
লাল বেনারসী শাড়ি আর ভারী গহনায় ইলোরাকে দ্বিতীয়বার আবার বউ সাজানো হলো। মেকআপের ব্যাপারটা অবশ্য জারিনই নিষেধ করে দিয়েছে। সুন্দর করে শাড়ি-গহনা পরিয়ে, চুলগুলো আঁচড়ে পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছে। সাজানো শেষ করে সবাই ইলোরাকে এরেনের রুমে বসিয়ে দিয়ে ছুটল এরেনের খোঁজে। যাওয়ার সময় বলে গেল তারা গিয়ে এরেনকে রুমে পাঠাবে। সেই যে গেল, তারপর প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেল। কিন্তু এরেনের আসার নাম নেই। এদিকে ইলোরা বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেল। তাই বিছানার কোণ থেকে নেমে দাঁড়াল। এরেনের রুমটা লাভ সেপ বেলুন আর ফুল দিয়ে বেশ সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে। তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে খাট সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝ বরাবর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ সেপ তৈরি করা হয়েছে।
ইলোরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। এরেনের রুমের বেলকনিটা বাড়ির ডান পাশের বাগানের দিকে। বেলকনিতে ছোট্ট একটা বাল্ব জ্বলছে, বিধায় তার ভয় লাগল না। রুমের ভেতর এতক্ষণ শীত আঁচ করতে না পারলেও বেলকনিতে দাঁড়াতেই হালকা শীত অনুভব হলো। তবু ইলোরা বেলকনির রেলিং ধরে বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বাবা-মা, ভাই, মিথিলা, অনন্যা আর ডালিয়াকে খুব মনে পড়ছে। বাড়িতে থাকলে এখন হয়তো ডালিয়া আর মিথিলার সাথে শুয়ে শুয়ে চাদর নিয়ে টানাটানি করত। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে ইলোরা শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে মৃদু চমকে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই এরেন তার গায়ে ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে দিতে দিতে বলল,“চাদর ছাড়া বেলকনিতে এসেছ কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ইলোরা ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসল। এরেন ইলোরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বাহুতে হাত রেখে বলল,“সেই ভীতু মেয়েটা, যে একদিন হুট করে আমার জীবনে এসেই আমার বউ হয়েছিল। অথচ তখন তাকে মেনে নিতেই পারছিলাম না, সেই মেয়েটাই আজ আমার বাড়িতে আমার রুমে বউয়ের অধিকার নিয়ে হাজির হলো! সময়গুলোও এত দ্রুত কেটে গেল! কীভাবে কীভাবে বছরও পেরিয়ে গেল! সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। এই মেয়ে, কী জাদু জানো বলো তো। নইলে এরেন জামানের মন তো এত সহজে গলে যাওয়ার কথা ছিল না। কোন কালো জাদু করে মন কেড়ে নিয়েছিলে?”
ইলোরা মুচকি হেসে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,“এটা তো আমারও প্রশ্ন। কী জাদু করেছিলে?”
এরেন মৃদু শব্দ তুলে হাসল। ইলোরা মুখের হাসি মিলিয়ে নিয়ে অভিমানী মুখে বলল,“কতক্ষণ ধরে একা একা বসে ছিলাম।”
এরেন কপাল চাপড়ে বলল,“আর বোলো না! বাঁদরগুলো আমার পঁচিশ হাজার টাকা মেরে দিয়েছে। এতক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরেছে। রুমের দিকে আসতেই দিচ্ছিল না।”
ইলোরা হেসে উঠল। এরেন কপাল কুঁচকে বলল,“তুমি হাসছো!”
“তাহলে কী করব?”
“অবশ্যই দুঃখ প্রকাশ করবে। তোমার হাসবেন্ডের টাকা মানে তোমারও টাকা। তো তুমি হাসবে কেন?”
“আচ্ছা বুঝলাম। অনেক দুঃখও প্রকাশ করলাম।”
এরেন ইলোরার হাত ধরে রুমে নিয়ে এল। ইলোরাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেরিয়ে এসে বেড সাইড টেবিল থেকে একটা প্লেট হাতে নিয়ে সেও গিয়ে ইলোরার পাশে বসল। ইলোরা প্লেটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“এখন ভাত খাবে? একটু আগে না খেলে?”
এরেন ভাত মাখাতে মাখাতে বলল,“তুমি খাবে।”
“আমিও তো খেলাম।”
“কখন?”
ইলোরা গায়ের চাদরটা খুলে পাশে রাখতে রাখতে বলল,“কখন মানে? আমি তো তোমার পাশের চেয়ারেই বসেছিলাম।”
এরেন ইলোরার মুখের সামনে খাবার ধরে বলল,“আপনি যে কত খেয়েছেন তা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি ম্যাডাম। আজ যে আপনার এক বেলাও পেটভরে খাওয়া হয়নি তা আমার জানা আছে। এখন চুপচাপ হা করুন।”
ইলোরা ঠোঁট উলটে বলল,“এখন তো খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“একটু খেলেও খেতে হবে। চলো হা করো।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইলোরা খাবার মুখে তুলল। এরেনের কথার তালে তালে সে প্লেটের অর্ধেকটা খাবার শেষ করল। তারপর আর খেতে পারল না। এরেনও জোর করল না। ইলোরার মুখে পানির গ্লাস তুলে ধরে বলল,“খেতে না-কি ইচ্ছা করছে না। এখন কে খেল?”
ইলোরা পানি খেয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,“আম্মুর মতো কথা বলছো কেন তুমি?”
এরেন হাসিমুখে প্লেট আর পানির গ্লাস টেবিটে রেখে কাবার্ড থেকে একটা বক্স নিয়ে আবার ইলোরার দিকে এগিয়ে গেল। ইলোরার পাশে বসে বক্সটা তার দিকে এগিয়ে ধরল। ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই এরেন চোখের ইশারায় সেটা নিতে বলল। ইলোরা বক্সটা হাতে নিতেই এরেন বলল,“খুলে দেখো।”
বক্স খুলেই ইলোরার বিস্ময় আরও বাড়ল। সে অবাক হয়ে বলল,“ডায়মন্ডের নেকলেস! এটা কার?”
এরেন বলল,“যার হাতে আছে তার।”
ইলোরা চোখ বড়ো করে বলল,“আমার! আমি এটা দিয়ে কী করব?”
“খাবে।”
“ধুর! ফাজলামি কোরো না। এত দামী নেকলেস আমার প্রয়োজন নেই। এমনিতেও তো আমি তেমন জুয়েলারি পরি না।”
“না পরলে রেখে দিবে। আগেরবার তাড়াহুড়োর মাথায় তোমাকে কোনো গিফটই দেয়া হয়নি। তাই এবার আগে থেকেই ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিলাম।”
ইলোরা মুখ ফুলিয়ে বলল,“শুধু শুধু এত টাকা খরচ করতে গেলে কেন বলো তো? এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এমনিতেও পাঁচ মাস ধরে তুমি খরচ করেই চলেছ।”
এরেন মুচকি হেসে ইলোরার হাত থেকে নেকলেসের বক্সটা নিল। নেকলেসটা বের করে ইলোরার গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বলল,“আমার ইলোনির কাছে এই গিফটটা খুবই তুচ্ছ। ইলোনি তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো গিফট।”
ইলোরাও এবার মুচকি হাসল। এরেন সোফা ছেড়ে হাঁটু গেড়ে ইলোরার পায়ের কাছে বসে পড়ল। ইলোরা অবাক হয়ে বলল,“নিচে বসলে কেন?”
এরেন ইলোরার ঠোঁটে এক আঙুল চেপে ধরে বলল,“হুঁশ, বউটাকে একটু দেখতে দাও। আমার বউটা এত সুন্দর কেন বলো তো?”
এরেনের গভীর দৃষ্টিতে ইলোরা লজ্জায় পড়ে গেল। লাছুক হেসে মাথা নত করতেই এরেন তার এক হাত মুঠোয় নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,“এভাবে হাসবে না তো। এখানটায় লাগে। নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে বসব।”
ইলোরা কপাল কুঁচকে কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে বলল,“কথায় কথায় সবসময় এত হার্ট অ্যাটাক হার্ট অ্যাটাক করো কেন বলো তো?”
এরেন গা দুলিয়ে হেসে বলল,“কেন? তুমি ভয় পাও?”
ইলোরা উত্তর না দিয়ে গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরাল। এরেন নিজের মুঠোয় থাকা ইলোরার হাতের পিঠে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে মুচকি হেসে বলল,“আচ্ছা, আর বলব না। এবার খুশি?”
ইলোরা এরেনের দিকে তাকাল কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। এরেন উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে কাবার্ড খুলে জ্যাকেট বের করে গায়ে জড়াল। তারপর একটা ভারী শাল হাতে নিয়ে ইলোরার দিকে এগিয়ে এল। ইলোরা অবাক হয়ে এরেনের কান্ড দেখছে। লোকটা জ্যাকেট পরে ঘুমাবে কি না সেটাই ভাবছে সে। ইলোরার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে এরেন ইলোরার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,“চলো।”
ইলোরা প্রশ্ন করল,“কোথায়?”
এরেনের সোজাসাপ্টা উত্তর,“যেখানে নিয়ে যাব সেখানে।”
ইলোরা আর প্রশ্ন তুলল না। এরেন ইলোরার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে এল। বাড়ির সবাই এতক্ষণে যার যার রুমের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়েছে। এরেন ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দোতলায় উঠল। জারিনের রুম থেকে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কাজিনদের সাথে আড্ডা চলছে। ইলোরা বিস্ময় নিয়ে শুধু এরেনের সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। ছাদের সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতেই ইলোরা বলল,“এত রাতে ছাদে যাচ্ছি কেন আমরা?”
এরেন ইলোরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হুট করে তাকে পাঁজাকোলা করে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। ইলোরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,“আরে, আমি হেঁটেই যেতে পারব। নামাও।”
এরেন ইলোরাকে কোল থেকে নামাল ছাদের একপাশে গিয়ে। ইলোরা এরেনের দিকে তাকিয়ে বলল,“এতরাতে কী করছো? ছাদে ঘুমাবে না-কি?”
এরেন মুচকি হেসে ইলোরাকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে বলল,“সামনে তাকান মহারানি।”
ইলোরা ভালোভাবে তাকাতেই ছাদের ইলেকট্রনিক লাইটের আবছা আলোয় দেখতে পেল অসংখ্য ফুলের সমারোহ। ইলোরা অবাক হয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,“এত ফুল গাছ! এসব কে লাগিয়েছে? আপু?”
এরেন বলল,“ উঁহু, তোমার বর।”
ইলোরা ঘাড় কাত করে এরেনের দিকে তাকিয়ে বলল,“কবে?”
এরেন মুচকি হেসে বলল,“যেদিন মহারানি বলেছিল তার ফুলগাছ পছন্দ।”
ইলোরা ভ্রু জোড়া হালকা কুঞ্চিত করে বলল,“কবে বলেছিলাম?”
এরেন হাতের চাদরটা ইলোরার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তাকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,“প্রণয়ের শুরুতে। রনিদের বাড়ির ছাদে। সেদিনই একগাদা ফুল গাছ কিনে বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। আম্মী অবাক হয়ে শুধু বলছিল, এত ফুল গাছ কেন? জারিন অবশ্য বুঝে গিয়েছিল। তারপর ওর হেল্পেই গাছগুলো লাগিয়েছিলাম। তারপর থেকে আস্তে আস্তে সব রকমের ফুল গাছ লাগাতে লাগাতে ফুলের বাগানই হয়ে গেছে। এটা শুধুই ইলোনির বাগান।”
ইলোরা হেসে বলল,“পাগল!”
এরেন নিজের মাথা দিয়ে ইলোরার মাথায় মৃদু টোকা মেরে বলল,“বউয়ের প্রেমে।”
এরেন ইলোরাকে ছেড়ে দিতেই ইলোরা এগিয়ে গিয়ে সব ফুলগুলোকে একে একে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। ছাদের কিনারায় এমন সুন্দর একটা ফুলের বাগান ইলোরাকে সত্যিই খুব মুগ্ধ করেছে। এরেনদের বাড়ির ছাদটা আকারে বেশ বড়ো। তাই একপাশে নির্দ্বিধায় বাগান করা গেছে। এরেন কয়েকটা তাজা গোলাপ ছিঁড়ে এনে ইলোরার চুলের ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিলো। ইলোরা সেখান থেকে দুটো গোলাপ নিয়ে এরেনের দুই কানের পাশে গুঁজে দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। মধ্যরাতে প্রেয়সীর প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দ এরেনের কানে মধুর সুর তুলল। এরেন ইলোরাকে নিয়ে ছাদের মাঝ বরাবর যে দোলনাটা রাখা আছে সেখানে গিয়ে বসে পড়ল। ইলোরাকে কাছে টেনে নিয়ে তার চাদরের মধ্যে নিজেও ঢুকে পড়ল। দোলনায় দোল খেতে খেতে ইলোরা এরেনের বুকে মুখ গুঁজল। এরেন ইলোরাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলল,“আকাশে কত সুন্দর অর্ধচন্দ্র উঠেছে। চলো আজ একসাথে ভোর হওয়া দেখি। জোৎস্না রাতের চাঁদ তো প্রায় সব প্রেমী যুগলই দেখে। আমরা বরং ভোর হওয়া দেখি। রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে কীভাবে সকালের সূর্য উঠে পৃথিবী আলোকিত হয় তা দেখি। আজ থেকে সারাটা জীবন তুমি আমার মনের আকাশে সকালের সূর্যের মতোই প্রত্যেকদিন উঁকি মারবে, আর আমার জীবনটাও পৃথিবীর ন্যায় আলোকিত করবে।”
ইলোরা এরেনের কথায় মৃদু হেসে মাথা দোলালো। এরেন ঝুঁকে পড়ে ইলোরার কপালে লম্বা একটা চুমু এঁকে দিয়ে বলল,“ভালোবাসি ইলোনি। যুগ যুগ ধরে এভাবেই আমার বুকে মুখ গুঁজে থেকো। এক দিনের জন্যও আমার চোখের আড়াল হয়ো না। তাহলে নিশ্চিত ঔষধের অভাবে প্রেমাসুখে মরব আমি। প্রচন্ড ভালোবাসি।”
ইলোরার শরীরে প্রেমময় শিহরণ খেলে গেল। মানুষটা এখন হুটহাট ‘ভালোবাসি’ বলে বসে। অথচ যখন সে শুনতে চায় তখন মুখ খোলে না। তখন বলে, ভালোবাসা মুখে বলে প্রকাশ করা লাগে না। প্রকাশিত হোক বা অপ্রকাশিত, ভালোবাসা ভালোবাসাই থেকে যায়। কিন্তু এই মানুষটাই এখন হঠাৎ হঠাৎ ‘ভালোবাসি’ বলে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। আজও তা-ই করল। ইলোরা দুচোখ বুজে প্রিয় মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে তার বুকের সাথে আরও মিশে গেল।
চলবে…………………….🌸
(পাঠকদের কাছে অনুরোধ, আপনারা গল্প পড়ে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। পেইজ থেকে আমি রেসপন্স পাই-ই না। গল্প পড়তে পারলে রেসপন্স করতে দোষ কী?😐)