সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৭

0
1915

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৭
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.
.

উঁচু পাহাড় থেকে পাথরের ওপর প্রবলবেগে ঝরে পড়া জলপ্রপাতের ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালে কেমন লাগে?

বালতি বালতি ননস্টপ জল মাথায় ঢালতে থাকলে চোখদুটো যেমন খুলতে চায় না, তিন্নিরও তেমন মনে হচ্ছিল, হঠাৎ ঘোর কেটে গেল ওর। কোথায় জলপ্রপাত? ও তো শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দৌড়োচ্ছিল ট্রেন ধরতে! এখানে কি করে এলো ?

ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়েই মাথাটা আবার টলে গেল তিন্নির, আর সঙ্গে সঙ্গেই রোদে পোড়া তামাটে, শক্ত কড়াপড়া একটা হাত আলতো করে ধরে ফেললো ওকে, পড়ে যাওয়ার আগেই।
— “আস্তে! এত তাড়া কিসের?”

সায়কের গলা তো এত ভারী আর হাস্কি নয়! এ আবার কে? কোথায় আছে ও? কারো কোলে শুয়ে আছে নাকি তিন্নি? অনেক কষ্টে চোখদুটো খুলে দেখতে পেল ওরই দিকে তাকিয়ে আছে অচেনা একজন যার গাঢ় বাদামী দুটো চোখ, চওড়া কপাল, খাড়া নাক, চিন্তার হালকা ছায়া মুখে লেগে আছে।

দু তিনবার চোখ পিটপিট করলো তিন্নি, ভুল দেখছে কি? তারপর আবার উঠে বসার চেষ্টা করলো। বাদামী চোখদুটোয় হালকা বিরক্তি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, ওর বলিষ্ঠ হাতগুলো তিন্নিকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো। অল্প ছোঁয়ায় পিঠের কাছে কড়াপড়া শক্ত হাতে সাপোর্ট দিয়ে বললো
— “ঠিক আছেন এবার? দাঁড়াতে পারবেন তো? “

ঝিম ধরে যাওয়া ঘাড় নাড়লো তিন্নি, চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ট্রেনে তবে উঠতে পেরেছে ও! জংলী ছাপ কালো টি শার্ট পরা স্বাস্থ্যবান, ছয়ফুটের পেশী দৃঢ় লোকটার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ স্বরে বললো — “থ্যাঙ্ক ইউ। আপনিই কি আমাকে……”

তিন্নির কথা শেষ হওয়ার আগেই হাস্কি স্বর বলে উঠলো — “ট্রেনের তলায় কাটা পড়া থেকে বাঁচিয়েছি? হ্যাঁ, বলতে পারেন। তা আপনার এই তাড়াহুড়ো স্বভাবটা তো বেশ খতরনক? প্রায়ই করেন নাকি আজ স্পেশাল ডে?”

মুখ গম্ভীর থাকলেও গলায় ব্যঙ্গের ছাপ স্পষ্ট। পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু অবধি জ্বলে উঠলো তিন্নির! আচ্ছা বেয়াদপ লোক তো! জানা নেই শোনা নেই ট্রেনে উঠতে সাহায্য করেছে বলে টোন কাটার সুযোগ পেয়ে গেছে! ছ্যাবলা লোক কোথাকার।!
মনের বিরক্তিটা চেপে রেখে তিন্নি বললো — “থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে ট্রেনে উঠতে হেল্প করার জন্য। এটা কত নম্বর কামরা বলতে পারবেন? আমি পরের স্টেশনেই নেমে যাব!”

হাস্কি স্বর একটু গম্ভীর হল। তিন্নির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সরাসরি যেন ওকে মাপতে থাকলো পা থেকে মাথা অবধি। রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠে তিন্নির কিছু বলার আগেই গম্ভীর গলায় লোকটা জিজ্ঞেস করলো — “আপনি কি আগেও এমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন নাকি আজই প্রথম হলো?”

ঠোঁট কামড়ালো তিন্নি। আজও ও ব্ল্যাকআউট হয়ে গিয়েছিলো? এবার একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে যে করে হোক। নিজের দিকে খেয়াল হলো ওর, পরনের কালো শিফন জামাটা জলে ভিজে শপশপে গেছে, নিশ্চয়ই এই লোকটা বোতল বোতল জল ঢেলেছে ওর জ্ঞান ফিরোনোর জন্য। ইনার দেখা যাচ্ছে নাকি? ওইজন্যই লোকটা কি তাকিয়ে আছে ওর দিকে?

সহসাই একটু কেঁপে উঠলো তিন্নি, গায়ে বসে থাকা জলে ভেজা জামার ঠান্ডায়, নাকি লজ্জায় না ভয়ে তা বলা শক্ত। লোকটার নির্নিমেষ দৃষ্টির সামনে নিজেকে কেমন বেআব্রু মনে হলো ওর! হাত দিয়ে শিফন টপটা গলার কাছে একটু টেনে নিলো। চোখ ফিরিয়ে নিল লোকটা। একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় প্রায় আদেশের সুরে তিন্নির উদ্দেশ্যে বললো — “এখানে দাঁড়ান, আমি আসছি!”

বলে কামরার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বেশ অবাক হল তিন্নি! ভারী অদ্ভুত লোক তো! অজানা অচেনা মেয়েদের এমন শাসন করছে, আদেশ করছে যেন স্কুলের বুড়ো হেডমাস্টার। অথচ বয়স তো খুব বেশি হলে আঠাশ কি তিরিশ। আর দরজার সামনেই কেন দাঁড় করিয়ে রাখলো তিন্নিকে? কামরায় ঢুকলে কি হবে? রাতের নর্থবেঙ্গল মেল ট্রেনে প্রাইভেট কোচ আছে বলে তো তিন্নির জানা নেই! ট্রেনের মেঝে থেকে হ্যান্ডব্যাগটা কুড়িয়ে নিল তিন্নি। পাশে পড়ে থাকা ভারী রুকস্যাকটা হাতে নিয়ে ভাবলো কি করবে এবার? এক্সপ্রেস ট্রেনের কামরাগুলো তো কানেক্টেড হয়, পরের স্টেশন অবধি অপেক্ষা করার থেকে বেটার, ভেতর দিয়েই না হয় এস ওয়ান কামরায় চলে যাবে!
দরজা ঠেলে কামরায় ঢুকতে যাবে, লোকটা বেরিয়ে এলো, বিরক্ত গলায় বললো — “আপনাকে বলে গেলাম না এখানে ওয়েট করতে?”

এইবার তিন্নি আর চুপ থাকতে পারলো না। তখন থেকে লোকটা সমানে ধমকে যাচ্ছে ওকে, ইয়ারকি পেয়েছে নাকি? চিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো
— “ট্রেনটা তো আপনার পার্সোনাল প্রপার্টি নয়! আমি কোথায় যাবো তাতে আপনি বাধা দেওয়ার কে? আর তখন থেকে খামোকা ধমকে যাচ্ছেন কেন বলুন তো?”

অপ্রস্তুতের একটা হালকা ছায়া পড়লো কি লোকটার মুখে? আর্মি প্রিন্টের একটা জ্যাকেট এগিয়ে দিল তিন্নির দিকে। মুখে বললো — “এটা গায়ে জড়িয়ে নিন, আপনার জামাটা জলে ভিজে গেছে।”

তিন সেকেন্ডস থ হয়ে দাঁড়িয়ে লোকটার হাত থেকে জ্যাকেটটা প্রায় কেড়ে নিয়েই পিছন ফিরে গায়ে জড়িয়ে নিল তিন্নি। লজ্জায় কান মাথা গরম হয়ে গেছে ওর, লোকটা ঠিক কি ইঙ্গিত দিতে চাইলো তা না বোঝার মতো বোকা নয় তিন্নি! তাও যে লোকটা কামরা ভর্তি লোকের থেকে ওর সম্ভ্রম বাঁচাতেই জ্যাকেটটা এনে দিয়েছে সেটা ভেবেই মনটা আরো অপরাধবোধে ভরে গেল তিন্নির! একটু আগেই এর সম্বন্ধে কি না কি ভাবছিলো ও। এদিকে না ফিরেই ক্ষীন গলায় বললো — “থ্যাঙ্ক ইউ এগেন! কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো …”

— “না না! ঠিক আছে। আপনি এদিকে ফিরুন, সংকোচের কোনো কারন নেই।”

হাস্কি স্বরের গলাটাও একটু নরম হয়ে এলো কি? জ্যাকেটটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরেই তিন্নি ফিরলো। অন্ধকারে ট্রেনের আধা খোলা দরজা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরেও কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কতদুর এসছে, কোন স্টেশন পেরিয়েছে ওরা। ইতস্তত করে তিন্নি জিজ্ঞেস করলো লোকটাকে — “ ইয়ে…. মানে….কতক্ষন অজ্ঞান ছিলাম আমি?”

ঘন অন্ধকারে ট্রেনের আধা খোলা দরজা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত লোকটা আলগোছে বললো — মিনিট কয়েক হবে। তবে তারপর আপনার জ্ঞান ফিরে এলেও চোখ খুলছিল না। পোস্ট কনকাসন এফেক্ট।

ঢোঁক গিললো তিন্নি। কয়েক সেকেন্ডস চুপ করে থেকে একটু কাতর হয়েই লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলো — “এটা কত নম্বর কামরা একটু বলবেন? এক্সপ্রেস ট্রেনের কামরাগুলো তো কানেক্টেড হয়, পরের স্টেশন অবধি অপেক্ষা করার বদলে আমি না হয় ভেতর দিয়েই নিজের কামরায় চলে যাবো?”

তিন্নির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে “গম্ভীর গলা” জিজ্ঞেস করলো — “আপনার টিকিট কোন কোচে?”

— এস ওয়ান।

— বর্ধমান আসুক, আপনাকে উঠিয়ে দেবো।

বলতে বলতে তিন্নির দিকে ফিরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাত থেকে রুকস্যাকটা টেনে নিয়ে ওটার ওজন পরখ করছে যেন, এমনিভাবে লোকটা বললো — “আপনার পক্ষে তো ব্যাগটা বেশ ভারী, বেড়াতে যাচ্ছেন নাকি??”

চিড়বিড়ানি রাগটা আবার ফিরে আসছিল তিন্নির। আজব লোক তো মাইরি। একটা প্রশ্নের জবাব দেয় না, নিজেই খালি প্রশ্ন করছে আর অর্ডার দিচ্ছে! তিন্নি কি বাচ্চা নাকি ওকে ওর কামরায় “উঠিয়ে আসতে” হবে? আর কামরার ভেতর দিয়ে গেলেই বা অসুবিধা কি?
কেটে কেটে বললো
— “ধন্যবাদ, আমি পারবো, আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। ব্যাগটা দিন, দেখি ভেতর দিয়ে এস ওয়ান অবধি পৌঁছতে পারি কিনা, নাহলে পরের স্টেশনে নেমে যাবো।”

ওর কথা যেন লোকটার কানেই গেল না। তিন্নির ব্যাগটা হাতে নিয়েই ঘন অন্ধকারে ট্রেনের আধা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। তিরিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করে অধৈর্য্য হয়ে তিন্নি রুকস্যাকটা কেড়ে নিতে গেল লোকটার হাত থেকে, আর ঠিক সেই সময়েই আচমকা ট্রেনের লাইন চেন্জ হলো। হুমড়ি খেয়ে তিন্নি টলে পড়লো লোকটার বুকের ওপর।

মিউজিয়ামে রাখা গ্রিক ভাস্কর্যের মতো চিজেল কাট প্রশস্ত বুক, তেমনি পাথরের মতো শক্ত! ঠোঁটে একটা শক্ত শীতল ধাতব স্পর্শ পেলো তিন্নি, লোকটার পাতলা টি শার্টের তলায় একটা লকেট আছে বোধহয়! ভাগ্গিশ আছে, নাহলে সোজা লোকটার বুকের মাঝে তিন্নির ঠোঁটটা গিয়ে পড়তো! ঘোর লাগিয়ে দেওয়া প্রবল পুরুষালি গন্ধ লোকটার বুকে, কতদিন পর কোনো পুরুষের এত কাছে এলো তিন্নি, এর আগে সেই মানব, কলেজের প্রথম বছর! মিনিটখানেকের জন্য তিন্নির হৃৎপিন্ডটা যেন থেমে গিয়েছিলো, তারপর আবার দ্বিগুন বেগে চলতে শুরু করলো, কান নাক দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরোতে লাগলো, স্পষ্ট বুঝতে পারলো চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ওর। আর এদিকে অসাধারণ রিফ্লেক্সে লোকটা ডানহাতে ওর রুকস্যাক ধরে রাখা অবস্থাতেই বাম হাত দিয়ে তিন্নিকে আগলে খুব ক্যাজুয়ালি আবারো বললো — “আস্তে! এত তাড়া কিসের?”

কেঁপে উঠলো তিন্নি।

নেশা জড়ানো ঘোর লেগে যাচ্ছিলো, কতক্ষন তিন্নি ওভাবেই ছিল ওর খেয়াল নেই, কখন যে ওর পিঠের ওপর থেকে লোকটার বলিষ্ঠ হাতও সরে গেছে সে খেয়ালও নেই। আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেলো ও , চমকে উঠে লোকটার গায়ের ওপর থেকে সরে গিয়ে বললো — “সরি, ট্রেনটা এমন টান নিলো যে … আমি… সামলাতে না পেরে…”

— ইটস্ ওকে।
ছোট্ট করে খুব ক্যাজুয়ালি কথাটা বলে আবার বাইরের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো লোকটা।

“ইশশ! নিশ্চই ভাবছে কি বেহায়া মেয়ে আমি! কিন্তু…..ব্যাগটা যে দিলো না?”
মনে মনে বললো তিন্নি, বেশ খানিকক্ষন পর একটু ইতস্তত করে আবার চেষ্টা করলো — “আমার ব্যাগটা…”

— বর্ধমানে নামিয়ে দেবো, বললাম তো?

— আমি ভেতর দিয়ে গেলে কি প্রবলেম?

— আপনি ভেতর দিয়ে যেতে পারবেন না, তাই।

— কি আশ্চর্য্য। কেন পারবো না?

এতক্ষনে লোকটা তিন্নির দিকে ফিরে কাটা কাটা স্বরে বললো — “কারণ এটা আর্মি কম্পার্টমেন্ট, সিভিলিয়ান কামরার সাথে কানেক্টেড নয় আর ভেতরে অনেকেই হার্ড লিকারস টানছে। কেউ কেউ প্রকৃতিস্থও নয়। তাই এ অবস্থায়, এখানে আমার সাথে থাকাটাই আপনার পক্ষে সেফ। আর কিছু জানতে চান?”

তিন্নি কিছুক্ষন হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আর্মি প্রিন্ট জ্যাকেট, লোকটার জংলা টি শার্ট, মেদহীন ছিপছিপে সটান চেহারা, আদেশের সুরে কথা বলা… এ কি তবে ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ করে? একইসাথে ভয় আর সম্ভ্রম মেশানো কেমন অদ্ভুত একটা অনুভুতি উঠে এলো তিন্নির মনের ভেতর থেকে, তারপর ঘাড় নেড়ে “না” বলে লোকটার মুখোমুখি আধখোলা দরজার ঠিক পাশটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

কিছুক্ষন পর লোকটা আবার ওর দিকে তাকালো, একটু ইতস্তত করেই বললো
— আপনি এইদিকে এসে দাঁড়ান! হঠাৎ হাওয়ায় দরজাটা পুরো খুলে গেলে পিষে যাবেন!

তর্ক করার জন্য তিন্নির মুখটা একটু ফাঁক হয়েও বুজে গেল। চুপচাপ জায়গা চেন্জ করে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আগে খেয়াল করে নি, এখন দেখলো অভিমন্যুর ঘাড়ের কাছে একটা কাটা দাগ, কপালে ভুরুর ঠিক কাছেও আর একটা গভীর দাগ, এটা বোধহয় সদ্য শুকিয়েছে।দাগগুলো কিসের এবং কি জন্য হয়েছে তা বুঝলেও হজম হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো তিন্নির। খবরের কাগজে পড়া “মৃত্যুকে হাতে নিয়ে লড়া ভারতের বীর জওয়ানরা” আর চোখের সামনে সেই লড়াইয়ের ক্ষতচিহ্ন দেখা – দুটো আলাদা জিনিস। অনেকক্ষন পর মুখ খুললো তিন্নি — “থ্যাঙ্ক ইউ।আমি বুঝতে পারি নি।”

ওর দিকে না ফিরে বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতেই লোকটা বললো — “আবার “থ্যাঙ্কইউ” কেন?”

কোন আবেগে তিন্নির গলা বুজে আসছিল ও নিজেও জানে না। ভেঙে যাওয়া গলাতেই বললো — “দেশের জন্য আপনারা যা করছেন… “

কথাগুলো শেষ করতে পারলো না তিন্নি! অবাক হয়ে লোকটা ফিরলো ওর দিকে —- “এটা তো আমাদের সবারই কর্তব্য, তাই না?”

কোনো জবাব দিলো না তিন্নি। লোকটাও আবার বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

ট্রেনের খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা জোলো হাওয়া আসছে, ভেজা জামা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে তিন্নির। মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা চুল কখন আলগা হয়ে খুলে গেছে, হাওয়ায় উড়ছে এপাশ ওপাশ। উড়ন্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে নিতে নিতে কেমন একটা অদ্ভুত শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়লো ওর সারা শরীরে, গায়ের চামড়া থেকে রক্তে শুদ্ধু। স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে তিন্নি, ওর মস্তিষ্ক থেকে আ্যড্রিনালিন নিঃসৃত হয়ে মিশে যাচ্ছে সবকটা রক্তকণিকায়, কাহারবা তালে নেচে যাচ্ছে ওর শিরায় শিরায়। তিন্নির হাতের তালু ঘামছে অল্প অল্প করে, গাল লাল হয়ে গেছে, হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে প্রায় দেড়গুন। ঝমঝম শব্দে রাতের নর্থবেঙ্গল মেল-ট্রেন ছুটে চললো পরের স্টেশনের দিকে। নাম না জানা অচেনা দুটো মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরের অন্ধকারের দিকে।
.
.
.
.
.
কপালের ওপর একটা আলতো হাতের ছোঁয়ায় তিন্নির চটক ভেঙে গেল, ও কি ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি? মুখ তুলে দেখলো লোকটা সতর্ক ডানহাতে ওর শরীরকে হালকা সাপোর্ট দিয়ে আছে যাতে তিন্নি এলিয়ে পড়ে না যায় অথচ ওকে জড়িয়েও ধরে নেই।
চুড়ান্ত বিব্রত হয়ে তিন্নি বললো — “আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? উঠিয়ে দিলেন না কেন?”

ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লোকটা বললো — “গাড়ি বর্ধমানে ঢুকছে। অনলি আড়াই মিনিট দাঁড়াবে, আপনার ব্যাগটা গুছিয়ে নিন!”

চুপচাপ হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিল তিন্নি, রুকস্যাকটা বোধহয় তিন্নিকে দেবে না, ও-ও আর টানাটানি করলো না। বর্ধমান প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে অনেকটা স্লো হয়ে আসতেই চলন্ত ট্রেন থেকে টুপ করে নেমে পড়লো লোকটা, তারপরই হাঁ করে অবাক তাকিয়ে থাকা তিন্নি কিছু বোঝার আগেই অবলীলাক্রমে ওকেও প্রায় কোলে করে নামিয়ে নিল।সামনের দিকে ছুটতে ছুটতে বললো — “ট্রেনের অন্য মাথায় এস ওয়ান, জলদি চলুন!”

প্রাথমিক অবাকভাবটা সামলে স্নিকার্স পায়ে তিন্নিও সাথ মেলালো কিন্তু একটু দৌড়েই হাঁফ ধরে গেল ওর। লোকটা পিছিয়ে এসে ওর হাত ধরে একরকম টেনেই নিয়ে চললো। এসওয়ান কামরায় তিন্নিকে তুলে দিয়ে বললো — “চললাম! বাকি রাস্তাটা সাবধানে যাবেন। “

কি এক অদৃশ্য টানে হঠাৎ কেমন বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো তিন্নির। একরকম চেঁচিয়েই উঠলো — “কিন্তু আপনার নামটা যে জানা হলো না…….???”

গমগমে গলা ভেসে এলো — “অভিমন্যু সেন। ঘোরা শেষ হলে একটু ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন। আপনার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। “

ভোঁওওও করে ট্রেনের সিগন্যাল বেজে উঠলো। তিন্নির দিকে হাত নেড়ে ছয়ফুট লম্বা শরীরটা দৌড়ে মিশে হয়ে গেল ভিড়ে। যতক্ষন তাকিয়ে থাকা যায়, তিন্নি তাকিয়ে রইলো ছেড়ে যাওয়া স্টেশনের দিকে…. লোকটা কি ট্রেনে উঠতে পারলো? একবারও কি ফিরে তাকাবে না?

নাহ্….. কিছু কিছু মানুষ ফিরে তাকায় না।

ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

***********************__******************************

এরপর কাল।❤️

আজকের বেস্ট অংশ কোনটা লাগলো? আমার প্রিয় অংশ নীচে কমেন্ট করলাম। আপনারাও করুন।

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
art 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n

Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here