সৃজা” পর্ব -২

0
2126

#সৃজা
পর্ব-২
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

সাফওয়ান চৌধুরী নিজ পকেটে দুহাত গলিয়ে আমার দিকে শকুনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ক্ষনিকের নীরবতা কাটিয়ে কাটকাট গলায় বললো “দেখতে সুন্দরী বলেই বুঝি অহংকার বেশি?হাজবেন্ডের সাথে কীরকম আচরণ করতে হয় তা শেখায়নি আমার শাশুড়ীমা?”

“খবরদার আমার সাথে এভাবে কথা বলবেন না।আমাকে গ্রামের অবলা নারী মনে করবেন না।স্বামী বলেই যে সবসময় অধিকার খাটাবেন আর আমিও মেনে নেবো এরকমটা কখনোই মনে করবেন না মি.হাজবেন্ড”।শেষের কথাটা ব্যঙ্গ করেই বললাম।

“বাহ!আমার মা তো আমার জন্য একটা বাঘিনী এনেছে দেখছি।যতটা বোকা মনে করেছিলাম ততটা তুমি নও।ভালোই হলো বাঘের সাথে বাঘিনীকেই মানায়।তবে তোমার এই তেজ কতদিন থাকে তা আমিও দেখবো।”বলেই চলে গেলো।

ক্ষানিক বাদে আবার ফিরে এসে বললো “আজকের রিসেপশনে আমার ক্লায়েন্টরাও আসবে তাই শহরের মেয়েদের মতো স্মার্ট হতে শেখো।যদিও তারা শুধু তোমায় দেখবে কথা বলার সাহস পাবেনা।কারণ সাফওয়ান চৌধুরীর জিনিসে নজর দিতে সবাই ভয় পায়।”কথাগুলো বলে উনি চলে যাচ্ছিলেন।

আমি পেছন থেকে বললাম “বয়েই গেছে আমার আপনার কথা শুনতে”।আমার কথা শুনে খুবই নারাজ হলো মনে হচ্ছে,তবে কোনোকিছু বলেনি, তাতে আমার কী?আমিতো আজ কোনো অনুষ্ঠানে যাবোনা।

উনি চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার শাশুড়ীমা এলেন। তার সাথে একজন সার্ভেন্টের হাতে ট্রে ভর্তি নাস্তা।শাশুড়ীমা সার্ভেন্টকে ইশারা করতেই সে খাবার রেখে চলে গেলো।রুমে রাখা সোফায় তিনি বসলেন, আমাকেও ইশারা করলেন বসতে।আমি তার পাশে বসলাম।

“সকালে তোমার সাথে ওরকম ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি,কিন্তু তাই বলে তুমি তোমার স্বামীর সাথে ওরকম আচরণ করা তোমারও উচিৎ হয়নি।আমার জানামতে তোমার সম্মতিতেই এই বিয়ে হয়েছে।তাহলে তুমি উদ্ভট আচরণ কেনো করছো?প্রথম প্রথম নিজ বাড়ি থেকে এত দূরে থাকায় মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে আমি এটাই মনে করবো।তবে সব মেয়েকেই মানিয়ে নিতে হয়।এই বাড়ি তোমার ভবিষ্যত,অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে স্বাচ্ছন্দে পা বাড়ানোর চেষ্টা করো।দেখবে সব সহজ হয়ে যাচ্ছে। প্রথম যখন তোমাদের গ্রামে গেলাম একমাত্র তোমাকে দেখেই মনে হয়েছে এরকম তেজি,ব্যক্তিত্ববান,সুন্দরী একটা মেয়েই পারবে আমার ছেলেকে বেধে রাখতে।কিন্তু তুমি তার উল্টোটাই করছো।কাল রাতে নাকী ও তোমার সাথে ছিল না,কথা কি সত্যি? ”

“জ্বী,সত্যি।”মাথাটা নিচে নামিয়ে বললাম।

“শুনো সৃজা টাকার জন্য ওর পেছনে মৌমাছির মতো ঘোরা মেয়ের অভাব নেই।আচলে বাধতে শেখো তাকে নয়তো সতীনের ঘর হয়তো করতে হবে না কিন্তু তার থেকেও বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।আর হ্যা এখানকার চালচলন রপ্ত করবে তারাতারি,শুনেছো নিশ্চই “যম্নিন দেশে যদাচার”।আর আজকের অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হয়ে থেকো।বিকেলে পার্লার থেকে মানুষ আসবে সাজাতে।”শেষে নাস্তা করার কথা বলে তিনি বিদেয় হলেন।

একবার নাস্তার ট্রেটার দিকে তাকিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম।দুই তিনটা ছোট ছোট ফুলের গাছ আছে এখানে।সেগুলোর দিকেই আনমনে তাকিয়ে আছি।

বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে নিচে রিসেপশনের কাজ চলছে।বাড়িতেই অনুষ্ঠান হবে।এত বড় বাড়ি থাকলে বাইরে যাওয়ার সত্যি প্রয়োজন নেই।সাফওয়ানকে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে।উনি এখন সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরে আছেন।দেখতে খারাপ না।হঠাৎ মনে পড়লো বিয়ে থেকে শুরু করে এত সময়ের মধ্যে আমি এখন উনাকে ভালো করে দেখলাম।কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।খুবই রাগ করে কথা বলছে।হয়তো রাগ সবসময় ওনার নাকের ডগায় থাকে।এতক্ষণে এটা বুঝেছি ওনার মন মতো কিছু না হলেই উনি রাগ করে।হুমায়ূন আহমেদের একটা বইয়ে পড়েছিলাম রাগী মানুষদের অসুখ-বিসুখ কম হয়।ওনার রাগ দেখে মনে হয় অসুখ ওনার ধারে-কাছেও ঘেষে না।

সকাল থেকে সবাই শুধু আমায় জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে।এখন আমার নিজেরও মনে হচ্ছে আমি এগুলো কী করছি।অন্তত যার সূত্রে আমার এখানে আসা তার সাথে তো ভালো ব্যবহার করতে হবে।অন্তত যেটুকু পেয়েছি সেটাই নিজের মতো করে নিতে হবে।বিয়ের আগে আমি অন্য পরিবারের হলেও এখন এ পরিবারের সদস্য তাই তাদের সাথে তাল মেলাতে হবে।এটা এখন আমারও বাড়ি।কিন্তু সত্যিই কি তাই??মেয়েদের কি আদৌ নিজের বাড়ি বলতে কিছু আছে?বিয়ের আগে বাবার বাড়ি থাকে আর বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি।শ্বশুরবাড়িতে সবকিছু ঠিক থাকলে বাবার বাড়িতেও শান্তিতে দুটো দিন থাকা যায় কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে কিছু হলে,অথবা স্বামী যদি তাড়িয়ে দেয় তাহলে বাবার বাড়িতেও জায়গা হয়না মেয়েদের।সব মেয়েদের ক্ষেত্রেই তাই।তাইতো মেয়েরা আজ ঘর ডিঙিয়ে আকাশ ছোঁয়ার খেলায় মেতে উঠেছে।আমাকে অন্তত পড়াটা চালিয়ে যেতে হবে।শাশুড়ীমায়ের কথা ঠিক না হলেও আমায় এটাই করতে হবে নাহলে তোর পড়াশোনা হবেনা সৃজা।

সারাদিন আমার রুমেই কাটলো,টিউলিপ একবার এসে ঘুরে গেছে।আর সাফওয়ানের আত্মীয়-স্বজন একে একে এসে আমাকে দেখে যাচ্ছিলেন।

বিকেলের দিকে পার্লারের মানুষজন আসলো আমাকে সাজাতে।কতগুলো ভারী ভারী গয়না আমাকে পরানো হচ্ছিলো।এগুলোর ওজন হয়তো আমার থেকেও বেশি।আমার সাজু-গুজু করতে বাজে লাগে।সেই ছোট থেকেই।ছোট বেলায় মা নাকি আমায় লিপস্টিক দিলে আমি মুছে ফেলতাম।

পুরোটা অনুষ্ঠানে আমি একটা সং সেজে দাড়িয়ে ছিলাম আর মানুষের অভিবাদন নিচ্ছিলাম।কিন্তু আমার বাড়ি থেকে কেউ আসেনি শুধু বাবা ছাড়া।মাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হলো।এখন হয়তো অনেক কিছুই নিজের অনিচ্ছায় করতে হবে।মাকে ছাড়া থাকার অভ্যেস করতে হবে কখনো ভাবিনি।কিন্তু বিয়ের পর থেকে মেয়েদের আপনজন ছেড়ে কিছু অপরিচিত মানুষকে আপনজন ভাবতে হয়।এটাই নিয়ম।আমিও এ নিয়মের বাইরে নই।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সাফওয়ান সারাক্ষন আমার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলো।টিউলিপ আমার এক হাত আকড়ে ধরেছিলো আর এক হাত উনি ধরেছিলো সারাক্ষন।বাচ্চারা নাহয় যাকে পছন্দ তার পিছু ছাড়তে চায় না।কিন্তু ওনার হুট করে কি হলো কে জানে।এর মধ্যে সবার সামনেই আমার হাতে একবার ঠোঁট ছোঁয়ালেন।প্রথম কোনো পুরুষ মানুষের ছোঁয়ায় আমার হাতটা অবস হয়ে এলো।অনুষ্ঠান শেষ হলো ১১টার দিকে।

রুমে এসে ফ্রেশ হতে যাবো এমন সময় সাফওয়ান এসে পাজাকোলে তুলে নিলো।আমি ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলাম।আমাকে নিয়ে উনি নিজেও বিছানায় শুয়ে পরলো।”জানো তোমাকে একদম পরির মতো লাগছিলো।আমার সব বন্ধুরা আফসোস করছিলো।যদিও ওরা সরাসরি আমাকে বলেনি কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি পুরো অনুষ্ঠানটা নিজেকে কীভাবে সামলেছি জানো।আমিতো বিয়ের দিন থেকেই তোমাকে ছুয়ে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলাম।কিন্তু তুমিতো আমায় পাত্তাই দিলেনা।আজ ছাড়ছিনা তোমায়।আমার পরিটাকে আজ অনেক আদর করবো।”কথা বলছেন কম ছোয়া দিচ্ছেন বেশি।যত সরাতে চাই তত গভীর হয় তার ছোয়া।অবাক হইনি পুরুষ মানুষতো।আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার অধরে একটা গভীর চুম্বন দিলেন।আমি উঠে গেলাম বিছানা থেকে।কিন্তু উনি নাছোরবান্দা। আমার লেহেঙ্গার ফিতেতে হাত দিলেন। জোরাজোরি করার পর যখন উনি ফিতেটা খুলে ফেললেন তখন আর আটকালাম না।সারারাত ওনার টর্চার সহ্য করতে হলো।কান্না পাচ্ছিলো কিন্তু উনি বকা দিলেন তাই চুপ করে গেলাম।আজান দেয়ার পরই উঠে গেলাম।তলপেট প্রচন্ড ব্যথা করছে।কোনোমতো খুড়িয়ে খুড়িয়ে গোসল করে আসলাম।দেখলাম উনি উঠে গেছেন।চাদরের দিকে একবার তাকিয়ে আমার কাছে এসে বললেন ” কত মেয়েকে আমি টাচ করেছি কিন্তু এর মধ্যে শুধু আমার বউটাই ভার্জিন ছিলো।হোয়াট এ লাক।আমার ভাগ্যটা কত ভালো মিসেস।”

কথাটা শোনামাত্র গা টা ঘৃণায় রী রী করে উঠলো।ছিঃ এ কার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।কোনোমতো বিছানায় গিয়ে বসলাম।উনি গোসল করতে গেলেন।ওয়াশরুমে ঢোকার আগে বললেন” ড্রয়ারে পেইনকিলার আছে।একটা খেয়ে নাও।”কোনো ঔষুধই খেতে ইচ্ছে করছেনা।শরীরের ব্যথার থেকে মনের ব্যথা বেশি মনে হচ্ছে।মনের ব্যথা কমানোর কোনো ঔষধ থাকলে ভালো হতো।পৃথিবীতে তো কত অবিশ্বাস্য জিনিস আবিষ্কৃত হলো কিন্তু এটা আবিষ্কার হয়না কেনো।

এই দুদিনে তাকে ভালোবাসতে না পারলেও স্ত্রী হিসেবে তার ওই কথাগুলো আমি মেনে নিতে পারছিনা।আমি এতটাও উদার নই যে নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা শুনবো।চুল থেকে পানি পরে মেঝে ভিজে যাচ্ছে।তবুও চুলগুলো মুছতে ইচ্ছে করছেনা।নিজেকে জড়বস্তু মনে হচ্ছে।আমার অনুভূতিগুলো কোথাও বাঁধা পরে আছে মনে হচ্ছে।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে টাই বাধছে সাফওয়ান।আমি এক ধ্যানে মাটির দিকে তাকিয়ে আছি।সকালের কথাটা আমার মাথায় ঘুরছে।আমার জীবনের প্রথম পুরুষ উনি কিন্তু ওনার জীবনের প্রথম নারী আমি নই।

গোসল করে একটা তোয়ালে পরে বের হলেন।বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম আমি।পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবালো।তখন আমার মাথায় প্রশ্ন জাগলোউনি কি অন্য মেয়েদেরও এভাবে আদর করতো?

জড়িয়ে ধরেই ঘরে আনলেন আমাকে। উনি অনেক কথাই বলছেন কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছেনা কিছু।হঠাৎ হ্যাচকা টানে উনি আমার কোমর জড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলে বসালেন।বললেন

” কি ভাবছো তুমি??এরপর থেকে তো আমার টাই তোমাকেই বাধতে হবে।তাই শিখে নাও।”

উনি যা শেখালেন কিছুই মাথায় ঢুকাতে পারলাম না।উনি হয়তো আমার চুপ থাকার কারণ কিছুটা বুঝতে পেরেছেন কিন্তু কিছু বললেন না।যাওয়ার আগে অধরে গভীর চুম্বন এঁকে গেলেন।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here