#সৃজা
পর্বঃ৯
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
সকালে সূর্যের তীর্যক রশ্মিতে সৃজার ঘুম ভেঙে গেলো।বিছানায় নয় আজ সৃজা খাটের এক কোণ ঘেসে বসেছিলো সেখানেই তার চোখ লেগে গেছিলো।অভয়াসের বসে সে হাতড়ে সাফওয়ানকে খুজলো কিন্তু হায় সাফওয়ান তো নেই।যখন তার চেতন মন এটা বুঝতে পারলো তখন চট করে ফোনের কথা মনে পরলো। সাফওয়ান ফোন দেয়নি কেনো এখনো।যাওয়ার আগে তো বললো যোগাযোগ রাখবে।
ওয়াশরুমে গিয়ে অবসাদ মনেই সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো সৃজা।এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়াতেই দেখতে পেলো একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি যার চোখ স্বামীকে দেখার তৃষ্ণায় ছলছল করছে,যার মুখ স্বামীর সাথে কথা বলতে না পারায় শুকিয়ে গেছে।নিজের অবস্থা দেখে সৃজা নিজেই অবাক হলো।এতোটা পাগল কবে হলো ও।
খিদে জেকে বসেছে সৃজার পেটে।রাতে কিছু খাওয়া হয়নি।কাল দুপুরেই শুধু একটু খেয়েছিলো তারপর রাতে ডেকেছিলো তাকে খাওয়ার জন্য কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামলেতো সে খাবে।
দরজায় নক করার শব্দ এলো সৃজার শাশুড়ী এসেছে তার হাতের ফোনটি সৃজাকে এগিয়ে দিলো।ইশারায় বোঝালো কথা বলতে।ফোনটি দিয়ে তিনি চলে গেলেন।কেউ হ্যালো বলছে।কন্ঠটা কানে যেতেই কান্নারা আবার দলা পাকিয়ে উঠলো।ওপাশ থেকে সাফওয়ান বলছে
“প্লিজ কান্না করে না জান।আমি খুব শীগ্রই চলে আসবো।আমার কিচ্ছু হবে না।আমি এখানে ভালো আছি।”
কান্না কোনোমতো আটকে সৃজা প্রশ্ন করলো
“খেয়েছেন?আর আপনি কোথায় আছেন?আমাকে ফোন দেননি কেনো?”
“রিল্যাক্স আমি এখন মালয়েশিয়া আছি।রাতে এখানে পৌঁছে ফোন দিয়েছিলাম মম বললো তুমি ঘুমাচ্ছো তাই ডাকেনি।”
“কখন ফোন দিয়েছিলেন আপনি?আমি জানিনা কেনো? আর আপনি আমাকে একা রেখে কেনো গেছেন?”কথাটা বলে সৃজা নিজেই লজ্জা পেলো।
“আজ তো তুমি অনেক কথা বলছো পাগলী।বাসায়তো তোমার মুখে কোনো কথাই থাকে না।শুধু ভাঙচুর করো।তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে মমকে ফোন দিয়েছিলাম।তোমাকে সাথে আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার পাসপোর্ট নেই।ওটা তৈরি করতে সময় লাগবে।এবার দেশে এসেই তোমার পাসপোর্টটা তৈরি করে ফেলবো।”
অর্থাৎ আম্মা সৃজার অজ্ঞান হওয়ার কথা বলেনি সাফওয়ানকে।না বলে ভালো করেছে শুধু শুধু চিন্তা করতো।সাফওয়ানের কথায় নিজের ফোনটা চেক করলো।সত্যিই ফোনটা বন্ধ হয়তো চার্জ নেই।
“আমি এখানে আগেও এসেছি অনেকবার তাই কোনো প্রবলেম হবে না।তুমি চিন্তা করো না।পড়াশোনা ঠিক করে করো।একটা পিচ্চি বউ আমার।তাকে পড়াশোনার কথাও বলতে হয়।তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে জান।”
শেষের কথাটা শুনে সৃজার আবার কান্না পেলো।নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো এতো ছিচ্ কাদুঁনি কবে হলি তুই সৃজা?নাকি স্বামীকে দেখতে না পেয়ে চোখের ভেতর সমুদ্র হয়ে গেছে।
“এই ঘৃণ্য কাজটা কে করেছে? আর আপনাকেই কেনো এর জন্য দায়ী হতে হবে?”সৃজা সরল মনে প্রশ্নটা করে বসলো।
” এ কাজটা যে ই করেছে, সে আমাদের কোম্পানির ভালো চায়না।তুমি জানো এখন কি পরিমান লস হবে আমাদের।যে বাস্টার্ড আমার পিছু লেগেছে তাকে আমি দেখে ছাড়বো।একবার আসল অপরাধী ধরা পরুক আমিও দেখবো সাফওয়ান চৌধুরীর ইমেজ নিয়ে কে খেলছে।কার এতো বড়কলিজা।”সাফওয়ান যে রেগে যাচ্ছে তা স্পষ্ট।
সৃজা শান্ত হতে বললো আর নিজের খেয়াল রাখতে বললো সাফওয়ানকে।ফোন কেটে দেয়ার পরও ফোনটা কানে লাগিয়ে রাখলো কতক্ষণ সৃজা।
একটা স্বাভাবিক পরিবার চেয়েছিল সৃজা।সবসময় এসব পুলিশ তার ভয়ের কারণ।তাদের থেকে দূরে দূরে থাকাই তার অভ্যাস।কিন্তু এখন সারাক্ষণ বাড়িতে পুলিশ আসে আর সৃজার শ্বশুরের সাথে কথা বলে।
একবার জীববিজ্ঞান ক্লাসে ইংরেজি শিক্ষক এসে সিডিউল ভুল হওয়ায় সৃজার উপর রাগ না করলেও মন খারাপ করে চলে গিয়েছিল। তখন সৃজা ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ায় তার দায়িত্ব ছিল এসবের।স্যার মন খারাপ করে চলে যাওয়ায় সেখানেই সে কান্না করে দেয়।বায়োলোজি স্যার এটা দেখে বলেছিল এই মেয়ের স্বামী ব্যবসায়ী হলে সমস্যা, স্বামীর ভেঙে পরার আগেই এ ভেঙে পরবে।মন খুবই দূর্বল এর।ব্যবসায়ী স্বামীকে সাহস জোগানোর শক্তি পাবেনা।কিন্তু ভাগ্যে তো তার ব্যবসায়ী স্বামীই ছিলো।এখন সে বুঝতে পারছে তাকে কতটা স্ট্রং হতে হবে।তার স্বামীকে সাহস জোগাতে হবে।তাকে ভেঙে পরলে হবে না।শাশুড়ী মায়ের মতো দৃঢ় মানসিকতা তাকে ধারণ করতে হবে।প্রথমে সৃজার মনে হয়েছে সাফওয়ান তার একমাত্র সন্তান তাহলে উনি বিচলিত হচ্ছেন না কেনো।কিন্তু না পরক্ষণেই বুঝতে পারলো তার শাশুড়ীর এসব পরিস্থিতির অভ্যেস আছে।
সকালে স্বাভাবিকভাবেই সকলে নাস্তা করলো। শুধু সাফওয়ান ছিলো না খাবার টেবিলে।এ নিয়ে কারো কোনোরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।আব্বা আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন
৷ “কখন আসবে তোমার ভাই?পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলো।আর যত টাকা লাগে দাও।শুধু আমার আশানুরূপ ফল চাই।”
আম্মা খেতে খেতেই বললেন
“ফোন দিয়েছি।চলে আসবে খুব শীগ্রই। আর টাকার কথা না বললেই কি নয় এখন।”অনেকটা রাগ করেই বললেন।
“ওকে অবশ্যই টাকা নিতে হবে তাই আগেই বলে রাখা ভালো।”
এরপর পিনপতন নীরবতা আবার ঘিরে ধরলো।তবে কথা শুনে বুঝলাম সাফওয়ানের মামা আসবে।কিন্তু তার কি কাজ এখন।মাথায় ঢুকলো না।বেয়াদবি হবে মনে করে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
দুপুরের দিকে একজন লোক আসলো হাতে ট্রাভেল ব্যাগ।লম্বা কোট পরা চোখে কালো চশমা আর মাথায় গ্রে কালার হ্যাট।হ্যাটআর চশমার কারনে তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না।এসেই বড়দি বড়দি বলে চিৎকার করা শুরু করলো।ওনার চিৎকারে সবাই হলরুমে হাজির হলো।আমি উপরেই দাড়িয়ে সব দেখছিলাম।
আমার শাশুড়ী মাকে সালাম করলেন তিনি।বললেন
“এবারতো অনেক দিন পর আসতে বললে বড়দি।দুলাভাই কোথায় আসতে বলো আমারও বেশি সময় নেই।তুমি বললে তাই না করে পারলাম না।যতই হোক তোমাদের নুন খেয়ছি।কথার অমান্য তো করতে পারিনা।”
শাশুড়ী মার চোখ ছলছল করে উঠলো।ওনার একটা মাত্র ভাই।তাও দূরে দূরে থাকে।স্বামী পছন্দ করে না তাই।কিন্তু প্রয়োজন পরলে ঠিকই ডেকে পাঠায়।কারণ উনি জানে সবাই না করলেও ও কখনো না করবে না।
ভাইকে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাদঁলেন তিনি।অতঃপর আমার শ্বশুর মশাইয়ের আগমন ঘটলো।দুই ভাই বোনের ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটলো।
শশুড় মশাই তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন।বললেন
“যে কাজের জন্য ডেকেছি নিশ্চয় জানো।তোমাকে প্রয়োজন হতো না যদি না সাফওয়ানকে এর জন্য সমস্যায় পরতে হতো।একমাত্র আদরের ভাগ্নের জন্য নিশ্চয়ই আমাকে তোমার পা ধরতে হবে না।তাই কাজটা ঠিক ভাবে করো।চিন্তা করো না পারিশ্রমিক বেশি পাবে।যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করার চেষ্টা করবে। দুদিনের মধ্যে সাফওয়ানকে এ বাড়িতে চাই আমার।” বলেই গটগট করে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে উপরে চলে গেলেন।
আম্মা তাকে বললেন এখানেই থাকতে।অনেক জোরাজোরি করার পর রাজি হলেন।এখানে থাকলে হয়তো কাজের সুবিধা হবে।আম্মা জিজ্ঞেস করলেন
“তোর রুমে থাকবি না??”
“আমার রুম কোথায় বড়দি।এ বাড়িতে তুমি ছাড়া তো কিছুই আমার না।”
শাশুড়ী মা কথা কাটানোর জন্য আমাকে ডাকলেন।বললেন
“সাফওয়ানের মামা।তোমার মামা শ্বশুর।”
এতক্ষণে তার মুখ দেখতে পারলাম।সালাম দিলাম।
আমাকে দেখে খুশি হলেন মনে হচ্ছে।ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে আমাকে দিলেন আর বললেন
“একমাত্র ভাগ্নের বিয়েতে আসতে পারিনি কাজে ব্যস্ত ছিলাম বৌমা।কিন্তু তোমার জন্য গিফ্ট কেনার কথা ঠিকই মনে ছিল।”
গিফ্টটা নিলাম এবং তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম।এর বেশি কিছু বলতেও পারি না আমি।কি জিজ্ঞেস করবো ওনাকে তো প্রথম দেখলাম।
উনি আমার সাথে এমনভাবে কথা বললেন যেনো আমি তার অনেকদিনের পরিচিত।বললেন
“আগে দিনগুলোই অন্যরকম ছিলো।সানিয়া সাফওয়ান যখন ছোট ছিলো আমার কাছছাড়া হতে চাইতো না।সানিয়া তো এই মামা বলতে পাগল ছিলো।কিন্তু এখন আমার ভাগ্নিটা মামার সাথে ফোনে কথা বলার সময়ও পায়না।” একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো।
পরিস্থতি সামলে শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন
“এই পুতুলটা কোথায় পেলি বড়দি।আমার সাফওয়ানের যোগ্য অর্ধাঙ্গিনী।”
শাশুড়ী মা কথাটা শুনে সন্তুষ্ট হলেন তার চেহারার উজ্জলতা তার প্রমাণ।বললেন
“যাক তুই বললি এখন যতটুকু চিন্তা ছিলো তা ও নেই।এসব কথা রাখ এখন খেয়ে রেস্ট নে।তোর তো আবার ব্যস্ত হলে কিছুই মনে থাকেনা।”
ওনাকে গেস্ট রুমে থাকতে দেয়া হলো।তবে ওনার বিয়েতে না আসার ব্যাপারটা আমার সত্যি মনে হলো না।হয়তো এর অন্য কোনো কারণ আছে।
চলবে…..