সেঁজুতি পর্ব_১০

0
1896

#সেঁজুতি(পর্ব_১০)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সেঁজুতির কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সাওন। ঠোঁটে কাঁপুনি দিচ্ছে, মুখমণ্ডলে কেমন অস্থিরতার ছাঁপ বয়ে যায়। চাপা কান্নার আভাস মিলছে ওর মুখমণ্ডলে। তবে খুব দৃঢ় থাকায় নিজেকে সামলে নিলো সাওন। একটা জোরেসোরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর থেকে।

বারো শব্দের দুটো বাক্য চারিপাশে ভেসে আসছে সাওনের। যার সঠিক ব্যখ্যা জানলেও মুখ খুলে কেউ প্রকাশ করে না। এতটাই কঠিন এই কথাটি।

“একজন মেয়ের আর্তনাদ কম-বেশি সবার নজরে যায়। কিন্তু একজন ছেলের আর্তনাদ ক’জন দেখে?”

.
.

সাওন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। এত চুপচাপ স্বভাবের ছেলে খুব কম দেখেছে সেঁজুতি। এতক্ষণে অন্যকেউ হলে নিশ্চয়ই মুখের উপরেই কষিয়ে থাপ্পড় দিতো। অথচ সাওন নিশ্চুপ হয়ে আছে।
সেঁজুতি আর কথা বাড়ালো না। মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলেও বুঝতে দিলো না সাওনকে।
সাওন আবারও বেহায়ার মতো পাশ ঘেঁষে বললো,“ আজকে চলো। তারপরে আমরা অন্য একদিন যাবো। ”

সেঁজুতি চোয়াল শক্ত করে বললো,“ আমি বলেছি তাই ইচ্ছে জাগলো, আমায় নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা? আর এখন যথেষ্ট ঠাণ্ডা মাথায় আছি। শুধু শুধু লোক দেখানো আবেগ নিয়ে আমার মাথা খারাপ করবেন না। এমনিতেও আমি আছি বা নাই এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছাতেও কারো কিছু আসে যায় না। তাই আমি না গেলেও কোনো সমস্যা হবে না। আপনারা যেতে পারেন।”

সাওন দৃঢ় ভাবে বললো, “ সেঁজুতি! সারাক্ষণ একঘেয়েমি চলে না। কখন নিয়ে যেতাম? সারাক্ষণ তো ঘরে ঝামেলা করে আসছো। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন তোমাদের জন্য একটু শান্তিতে থাকতে পারছি। প্রতিটি দিন কানের কাছে চেঁচামেচি, এমনকি অফিসেও দৌঁড়ঝাপের উপরে যেতে হয়েছে। আমার কি একটু শান্তির দরকার হয় না?”

সেঁজুতি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ আমি ঝামেলা করতাম? তারা উস্কানিমূলক কথা বলতো কেন? এ বেলায় তাদের কোনো দোষ নেই? যা কিছু হবে আমার ঘাড়ে এসে পরে। ”

সাওন জোরেসোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,“ অন্ততপক্ষে আজ ঝামেলা করো না। ”

সেঁজুতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, “আমি নিজ থেকে কখনোই ঝামেলা করি না। আপনারা যাবেন শুধু শুধু আমাকে জড়িয়ে ঝামেলায় পরবেন না৷ আমি বলেছি যাবো না, তো যাবোই না। তাছাড়া, আমার যাওয়া আসা নিয়ে কারো কোনো সমস্যা হবে না।”

সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ সেঁজুতি! ”

সেঁজুতি কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলো।

.
.
সাওনের বোনেরা তৈরি হয়ে আশিককে পাঠালো সাওনের রুমে। ওরা তৈরি হয়েছে কি-না খোঁজ নিতে। আশিক দুষ্টুমি করতে করতে রুমে এসে ধীর ভাবে বলল, “ আম্মু, খালামনি তোমাদের ডাকছে।”

সাওন শান্ত ভাবে বললো,“ গিয়ে বলো তোমার মামীর মাথাব্যথা। সে যেতে পারবে না। ”

আশিক চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। সাওনের বোনদের কাছে বলা মাত্রই মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে গেল। তড়িঘড়ি করে সাওনের রুমে এসে বললো,“ সারাক্ষণ তো ভালোই ছিলো। এখন কোথাও যাওয়ার কথা শুনে অসুস্থ হয়ে গেল?”

সাওন শান্ত ভাবে বললো,“এভাবে কথা বলছো কেন আপু? রান্নাবান্নার তো কম ঝামেলা না, আর শরীর খারাপ তো বলে আসে না কারো।”

সাওনের কথায় ওর বড় বোন খমখম মুখে বললো,“ কোনো একটা অনুষ্ঠান, কাজ যাই হোক না কেন অসুস্থ হতেই হবে। তুই যাবি?” সাওনকে উদ্দেশ্য করে বলল।

বড় বোনের কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে সাওন বলল,“ না। ”

“থাক বউয়ের আঁচল ধরে।” কথাটি তিনি সরাসরি বলেই চলে আসলেন।

সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। সবদিক সামাল দিতে হয় ওর। এখন বোনদের অতিরিক্ত কিছু বললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, আর সেঁজুতিকেই বা কী বলবে! যেদিকে যাবে সেদিকেই ঠেলা খেতে হয়। দোষ নিজেরই দিচ্ছে সাওন, প্রথম থেকেই নিজের শক্ত হওয়া উচিত ছিল৷ চোখ কান খুলে নিজেরই সবকিছুর তদন্ত করে বিচার করা উচিত ছিলো। তাহলে অন্ততপক্ষে এখন কথার সম্মুখীন হতে হতো না। একপাক্ষিক মানুষ কখনোই সুখী হতে পারে না।
কটমট করে দাঁতে দাঁত চেপে রইলো সাওন। সেঁজুতি শুয়ে শুয়ে সবকিছুই শুনেছিল। মেজাজ অতিমাত্রায় খারাপ হয়ে আছে, সাওনের বোনের কথা শুনে। তবুও চুপচাপ ছিল সবসময় উত্তর না দিলেও চলে। সাওন তো যা বলার বলেই দিয়েছে, উল্টো কথা শুনেও বসে আছে।
সেঁজুতি বিড়বিড় করে বললো, “বউ শাড়ি পরলে আঁচল তো ধরতেই পারে স্বামী। এতে কথা শোনানোর কী আছে? ”

সেঁজুতির কথা শুনে চোখ গরম করে তাকালো সাওন। সেঁজুতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মনে মনে সাওন ও ওর বোনদের হাজারো কথা শুনায়।

মেজো দুলাভাই সাওনের মেজো বোনের কাছে জিজ্ঞেস করে, “ ওরা যাবে না?”

জবাবে তিনি বলেন,“ সেঁজুতি অসুস্থ হয়ে গেছে না-কি কাজ করতে করতে। তাই সাওন নিজেও যাবে না। ”

মেজো দুলাভাই বললেন,“ আসলেই সমস্ত কাজই তো ভাবির সামলাতে হয়। কিন্তু ওদের ছাড়া যাবো, এসব ভালো দেখায়? ”

মেজো বোন বললেন,“ ওদের সাফাই গেয়ো না তো। কী কাজ আছে ঘরে? মানুষ দেখলেই যার অসুস্থ হওয়ার অসুখ তার সাফাই গেয়ো না। আর নিজ থেকে অসুখ অসুখ বললে ওদের জন্য আমরা অপেক্ষা করবো কেন? আমার ভাই একটা আছে, বউ ছাড়া কিছু বুঝেই না সে।”

মেজো দুলাভাই বললেন,“ ভাইয়ের বউয়ের ব্যপারে এমন না বললেই কি নয়? তোমার কথা আমি শুনতে পারলে, তোমার ভাবির কথাও সাওন শুনতে পারবে। শুধু শুধু অন্যের দোষ দিচ্ছো কেন?”

মেজো দুলাভাইয়ের কথা শুনে কটমট করে তাকালো সাওনের বোন। মেজো দুলাভাই কথা বাড়ালেন না। শ্বশুর বাড়িতে ঝামেলা না করাই ভালো, এখন কোনো জবাব দিলেই তর্ক বেঁধে যাবে। তাই তিনি চুপ রইলেন।

.
.
সাওনের দুইবোন, মেজো দুলাভাই, আশিক বাহিরে চলে গেল। তাদের যাওয়ার পনেরো মিনিট পরে সাওন নিজেও বাহিরে চলে গেল। এখন সেঁজুতি আর আনোয়ারা বেগম ঘরে।

ইশারা ইঙ্গিতে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে সেঁজুতির। তবে চুপচাপ সে, আজকে তর্ক করার ইচ্ছেতে নেই। তর্কে তর্ক বাড়ে, এখন কিছু বললে মেজো দুলাভাইয়ের সামনেই সেঁজুতিকে কথা শুনাতে ছাড়বে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপেও সহ্য করতে হচ্ছে।

পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলের সামনে গেল সেঁজুতি। তখন আনোয়ারা বেগম শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন,“ আমার মেয়েরা আসলেই যত অসুখের ছড়াছড়ি দেখা দেয়। এর আগে তো দিব্যি থাকে মানুষে, আর ঘরে আহামরি তো কোনো কাজ নাই। যে কাজ করা লাগে তার জন্যও আমার বলদ ছেলে কাজের মানুষ রেখে দিছে। বিয়ের পরে বউয়ের আঁচল ধরে থাকতে থাকতে সম্পূর্ণ গেল। না আছে টাকাপয়সার হিসেব, না আছে একটু শান্তি। সামান্য কারণেও উরাধুরা ভাঙবে, এতে সংসার টেকে?”

আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সেঁজুতি ঢকঢক করে পানি গিললো। তারপরে বললো, “ আপনার মেয়েরা আসলে কাজের পর কাজের তো অভাব থাকে না। তাছাড়া অসুখ তো বলে আসে না আপনার মেয়েরা যখন আসবে তখন আমার বাধ্যতামূলক সুস্থ থাকতেই হবে ; কারণ মিনিটের পর মিনিট খাটুনি করাই লাগবে। আর আপনার ছেলে আমার আঁচল কি আপনাদের সামনে ধরে ঘুরঘুর করে? বিকেলে আপু বলে গেল এখন আপনি বলছেন। মা আর বোন হয়ে এমন কথা বলতে মুখে বাঁধে না? আপনার ছেলে সত্যিই একটা বলদ, আজকে মুখের উপরে অনেককিছু বলা উচিত ছিলো তার। বোন হয়ে ভাইকে ওভাবে কথা বলে কেন? তাও একজন এতবড় ছেলেকে। তখন মুখের উপরে কথা বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিলো।”

আনোয়ারা বেগম কটমট করে বললেন,“ বউ ভালোভাবে কথা বলবা। গায়ে পরে লাগতে আসো কেন? ”

সেঁজুতি উচ্চস্বরে বললো,“ ভালোভাবে কথা বলতে জানি না আমি। আপনার ছেলের টাকার হিসেব তো আমি নেই না, তাহলে টাকা খরচ করি কীভাবে? আর একটার পর একটা সমস্যা আমাকে ঘিরেই হচ্ছে তাহলে নাক গলাতেই হবে। আপনারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নাগ গলাতে পারলে, আমিও আমার ব্যপারে নাক গলাবো। ”

এরমধ্যে সাওন বাড়িতে চলে আসলো। মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাসার ভেতরে ঢুকেই এমন কথাবার্তা শুনতে পেলো। তড়িঘড়ি করে ফোনকল কেটে দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। এদিকে শাশুড়ি-বউয়ের কথা চলতেই রইলো।

#চলবে

  • (ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here