#সেঁজুতি(পর্ব_১১)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
এরমধ্যে সাওন বাড়িতে চলে আসলো। মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাসার ভেতরে ঢুকেই এমন কথাবার্তা শুনতে পেলো। তড়িঘড়ি করে ফোনকল কেটে দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। এদিকে শাশুড়ি-বউয়ের কথা চলতেই রইলো।
.
.
সাওনের উপস্থিতি পেয়ে হকচকিয়ে গেল সেঁজুতি। আনোয়ারা বেগম খমখম করে বললেন, “দেখছো বাবা! তোর বউয়ের কথাবার্তা।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে দৃঢ়ভাবে সাওন বললো, “ তোমাদের কারো কোনো দোষ নেই। সম্পূর্ণ দোষ আমার ভাগ্যের। একটা দিন যদি শান্তি পেতাম তাহলেও কথা ছিল। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন তোমাদের জন্য মাথা খারাপ হয়নি। সমস্যা কী আসলে, বলবা তো?”
আনোয়ারা বেগম মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে শক্ত মুখে বললেন,“ তোর বউরে জিজ্ঞেস কর, কী সমস্যা? কেউ মুখ দিয়ে টু – টা শব্দ করতে পারবে না, তাহলেই গায়ে পরে ঝগড়া শুরু করে দেয়। আমার মেয়েরা আসলেই ওর সমস্যা দেখা দেয় কেন!”
সেঁজুতি দৃঢ়ভাবে বলল,“ আপনার মেয়েরা আসলে আমার সমস্যা থাকবে কেন? আপনাদের কাজ তো করেই দিচ্ছি, তাহলে সমস্যার তো কারণ নেই। কোথাও যেতে ইচ্ছে না করলে আমি যাবো না, তাতে দোষের কী আছে? আপনার ছেলেকে তো বেঁধে রাখিনি, সে তার বোনদের সাথে যাবে তাতে আমার কী?”
আনোয়ারা বেগম বললেন,“ কী কাজ করো? ঘরের কাজ আছে কী?”
সেঁজুতি বললো, “ আপনি সংসার করেননি? আপনি জানেন না, একটা সংসারে কত কাজ থাকে? মেহমান থাকলে তো তুলনাই হয় না। তারপরেও এমন কথা কীভাবে বলেন?”
আনোয়ারা বেগম শক্ত মুখে বললেন,“ কাজের মানুষ ছিল না, নিজের হাতে সবকিছু করেই শাশুড়ির মন রক্ষা করেছি।”
সেঁজুতি শক্ত মুখে বলল, “ ওহ আচ্ছা। সবকিছু তাহলে এই একটা কারণেই হচ্ছে!”
সাওনকে উদ্দেশ্য করে সেঁজুতি বললো, “ হাসিরে না বলে দিয়ো। কাজ করা লাগবে না, সবকিছু আমিই সামলাবো। কাজের মানুষ এনেছো, শুধু শুধু অন্য কাউকে টাকা দিবে কেন!”
সাওন নিশ্চুপ হয়ে শুনেছিল সবকিছু। হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে বললো,“ এই ঘর থেকেই নেমে যাবো আমি। প্রতিদিন এক কাহিনী শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে গেছি। নয়তো ঘুমের ঔষধ খাবো। বিশ্বাস করো তোমরা, এই ঝামেলা আমার ভালো লাগছে না। কীসব ছেলেমানুষী শুরু করেছো দু’জনে? অন্ততপক্ষে, একজন তো চুপ থাকতে পারো। মুখের উপরে জবাব দিলেই সবাই জিততে পারে? একজন বুঝদার মানুষ নেই ঘরে, যে আসে সেই শুরু করে দেয়। তোমাদের কারণে আমার বুদ্ধিও লোপ পাচ্ছে। ”
সাওনের কথার উপরে আনোয়ারা বেগম বললেন,“ তোর বউরে ঠিক কর তাহলেই শান্তি পাবি।”
আনোয়ারা বেগমের মুখের উপরেই সাওন বললো,“ আমিতো জানি, আমার বউ ভালো না। ওর স্বভাব ভালো না, কাজকর্ম ভালো না, মুখ ভালো না। ওরে ঠিক করাই লাগবে। কিন্তু তোমরা সবাই গায়েপড়ে লেগে থাকো কেন? ইনিয়েবিনিয়ে কথা না শোনালে হয় না? একজন তো ঠিক থাকো তাহলেই তো হলো। ”
আনোয়ারা বেগম কিছু না বলে জোরে শব্দ করে হেঁটে রুমে চলে গেলেন। সাওন হনহন করে রুমে গেল। সেঁজুতি সাওনের পিছুপিছু গেল।
সেঁজুতি রুমে যাওয়ার পরেই সাওন বললো,“ ঘর থেকে দশ মিনিটের মতো বের হলাম তারমধ্যেই এমন শুরু করছো? একটা কাজ কর সবাই, শান্তিতে তো থাকতে দিবি না। যখন মুখেমুখে তর্ক করাই লাগবে আগে থেকে বলে রাখবি আমায়। বিষ চেনো, বিষ! খেয়ে মুক্তি দেবো। ”
সাওনের কথা শুনে কাঁপুনি দেয় সেঁজুতির। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বললো,“ সবকিছু তো আমি করি। আমিই মুক্তি দিয়ে দেবো সবাইকে।”
সেঁজুতির কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না সাওন।
চোখমুখে রাগ নিয়ে বসে রইলো। সেঁজুতি খাটের পাশ ঘেঁষেই বসে আছে।
সন্ধ্যের পরে সাওনের বোনেরা আসলো। আনোয়ারা বেগম একেরপর এক সবকিছু বলে যাচ্ছে মেয়েদের।
সবকিছু শুনে সাওনের বোনেরাও দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। একটা বেয়াদব মেয়ে এনেছে ভাইয়ের জন্য।
.
.
রাতে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে সবকিছু গোছাচ্ছে সেঁজুতি। সাওনের বড় বোন এসে বললো,“ তুমি অসুস্থ না-কি! গোছাতে আমরাই পারবো, শুধু শুধু নিজের শরীরের কষ্ট দিয়ো না। পরে আবার আঁচলে লুকানো ভাই বলবে, আমাদের জন্য ওর বউয়ের এমন অবস্থা হয়েছে। ”
বড় বোনের কথা শুনে আহাম্মক হয়ে নিজের রুমে চলে গেল সেঁজুতি। কথাবার্তার শ্রী দেখেই সে ক্লান্ত।
সাওনকে উদ্দেশ্য করে বললো,“ খাবে না?”
জবাবে সাওন কিছু বললো না। সাওনের পাশ ঘেঁষে সেঁজুতি বসলো। তারপরে সাওনের মাথা হাত দিয়ে টেনে তুলে বললো, “ উঠো। খেতে যাবে। ”
সাওন হাত ছিটিয়ে বলল,“ উহু! বললাম তো খাবো না। তুই খা, আমি অশান্তি খেয়েই পেট ভরাচ্ছি। একেরপর এক অশান্তি দিলে খাওয়ার সময় থাকে না। ”
সেঁজুতি বললো,“ আমি অশান্তি দেই?”
সেঁজুতির মুখোমুখি তাকিয়ে সাওন বললো,“ তুই দাও না তো কে দেয়? সবসময় মুখে মুখে তর্ক না করলে হয় না? শ্বশুর বাড়িতে আসলে কতকিছু মানিয়ে চলতে হয়, শিখে আসোনি কিছু?”
সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতি। আর একটা কথাও বের করলো না। চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে কেঁদে দিলো।
মুখে মুখে তর্ক করতে পারে কিন্তু লোক-সম্মুখে কাঁদতে পারে না। এটাই ওর স্বভাব।
রাতে সাওন, সেঁজুতি দু’জনের একজনেও খায়নি। সাওনের বোন আশিককে পাঠিয়েছিলো, তবে কেউই যায়নি। তারা ডাকতেও আসেনি।
না খেয়ে দুজনেই দু’দিক হয়ে শুয়ে আছে। সেঁজুতি খিদে নিয়ে থাকতে পারে না, কিন্তু এখন থেকে থাকতে হচ্ছে।
সকালে না খেয়েই অফিসে চলে যায় সাওন। আজকে তাড়াতাড়িই চলে গিয়েছে বাড়ি থেকে। ঘুম থেকে উঠে সাওনকে দেখতে পায়নি সেঁজুতি। ফ্রেশ হয়ে সবকিছু গোছগাছ করতে গেল।
খেয়েছে বা খাবে কি-না কেউ জিজ্ঞেস করলো না। সেঁজুতি সকালেও কিছু খেলো না।
সবকিছু গুছিয়ে রান্না করছে সেঁজুতি । মাঝেমাঝে আশিক এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে। সেঁজুতির আড়ালে গ্যাসের সিলিন্ডার ধরে, সেঁজুতির চোখে পরা মাত্রই ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়।
ভাত গড়া দেওয়ার সময়ে আশিককে দূরে দাঁড় করিয়ে ভাত নামালো। তখনি দৌঁড়ে এসে সেঁজুতিকে আচমকা ঝাঁপটে ধরলো আশিক। গরম ভাতের পাতিল থেকে ভাত ও গরম পানি আশিকের গায়ে মেখে গেল। উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠলো আশিক। ওর চিৎকারে সবাই ছুটে আসে, এদিকে সেঁজুতির নিজেরও একই অবস্থা। তবে নিজের ব্যথাকে গায়ে না মেখে, আশিককে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
সাওনের দু’বোন, আনোয়ারা বেগম এসে এমন অবস্থা দেখে তাঁদের মাথা পুরো বিগড়ে গেল। মুখে যা বলার বলে যাচ্ছে এবং আশিককে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। ঘরোয়া ভাবে কোনোরকম চিকিৎসা করে মেজো দুলাভাই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে গেল। বাচ্চা ছেলে এমন অবস্থার সম্মুখীন হবে, এর থেকে কাটিয়ে উঠতে ওর কাঠখড় পোহাতে হবে। সবাই কাঁদছে, সাথে সেঁজুতিও। ওর পায়ের অবস্থাও খারাপ হয়ে আছে। নিজের ইচ্ছেতে তো কিছু করেনি, না আশিককে ওর অপছন্দ ছিল।
সাওনের দু’বোন, আনোয়ারা বেগমও হাসপাতালে গিয়েছেন। এবং সিএনজিতে থাকা অবস্থায় সাওনকে ফোন দিয়ে বড় বোন কাঁদতে কাঁদতে বললো,“ তোর বউ তুই কী করবি, তার ডিসিশন আজকেই নিস। আমার বুক থেকে আমার ছেলেরে কেড়ে নিচ্ছে তোর বউ।”
বড় আপুর এমন কথাগুলোর কিছুই বুঝলো না সাওন। কিছু বলবে তার আগেই ফোনকল কেটে দিলো। মেজো আপুর কাছে কল দিয়ে জানতে পারে সবকিছু। মুখের সমস্ত ভাষা হারিয়ে ফেললো, কী বলবে কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গেল। কাঁধ থেকে পেটের অনেকাংশে লাল হয়ে আছে আশিকের।
রাত সাত টা বেজে ৫ মিনিট
হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসে ওরা। সেঁজুতি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ধরে গেছে, পায়ের ফুলা কমেনি বরং এর যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সাওন এসে কষিয়ে থাপ্পড় দিলো সেঁজুতিকে। উচ্চস্বরে বললো,“ কী সমস্যা, তোর? শান্তিতে বাঁচতে দিবি না আমায়? আপুদের সহ্য করতে পারো না মানলাম কিন্তু আশিক কী করেছে? বাচ্চাটার যদি কিছু হয়ে যেতো, তুই দায়ভার নিতিস? তোর এতই সমস্যা আমার সংসার করতে, তুই আছো কেন এ বাড়িতে? যা না, যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবি। আমার সংসার করতে হলে, তোর সব সহ্য করা লাগবে নাহলে তোরে সংসারে দরকার নেই। ইচ্ছে হলে থাক, না হলে যা, তবুও ক্ষতি করিস না কারো। একটু শান্তি দে। ”
সাওনের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সেঁজুতি। অঝোরে কাঁদছে।
ইতিমধ্যে আনোয়ারা বেগম সেঁজুতির বাড়িতে সবকিছু জানিয়ে দিলেন। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে এমন কিছু শুনতে হবে ভাবতে পারেনি সেঁজুতির পরিবার। এমন শিক্ষা দিয়েছে মেয়েকে! কিছু বলতে যাবে তখনি আনোয়ারা বেগম বললেন,“ আপনার মেয়েকে এখন কী করবেন করেন। এভাবে চলতে থাকলে সবাইকে খুন করে যাবে আপনার মেয়ে। ”
আনোয়ারা বেগমের মুখ থেকে এমন কথা শুনে সেঁজুতির বাবা রাগে, অপমানে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কিছু বলার ভাষা নেই তাঁর।
.
তিনি তখনি সাওনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে আসলেন। সাথে সেঁজুতির মা আছেন। আশিককে দেখার পরে নিজেদের মেয়ের কাছে মুখোমুখি হলেন। সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছে।
আশিকের বড় বোন বললো,“ আপনাদের মেয়ে আমার কোল খালি করে কী শান্তি পেতো, জিজ্ঞেস করেন ওরে। ”
আশিকের পরিবারও এসেছে। আশিকের বাবা চুপচাপ ছেলের পাশে বসে আছে। সাওন হাত শক্ত করে বসে আছে। রগগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে।
শেষ বারের মতো যখন সাওনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়েছিলো সেঁজুতি। সাওন ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির চৌকাঠ থেকে বেরিয়ে এলো। কতবার বলার চেষ্টা করেছে, আশিক নিজ থেকেই ওকে ঝাপটে ধরেছিল তাই ব্যালেন্স করতে পারেনি। কিন্তু সবাই ওর কথাটিকে বানোয়াট বলে চালিয়ে দেয়।
বাবার বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই বিভিন্ন কথার সম্মুখীন হতে হয় সেঁজুতিকে। তবে কারো কথার জবাব দেয়নি সে।
#চলবে