সেঁজুতি পর্ব_১

0
3704

#সেঁজুতি (পর্ব_১)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
১+২
ঘরভর্তি মানুষ বসে আছে সেঁজুতির বিচার করতে। ওর শাশুড়ির মুখে মুখে জবাব দেওয়ার জন্যই এই সমাবেশের আয়োজন।

একেরপর এক বিচার দিয়েই যাচ্ছেন আনোয়ারা বেগম। এতটুকু ছোট মেয়ে হয়ে মুখে মুখে তর্ক করে, এতবড় স্পর্ধা পেল কীভাবে! এই নিয়ে বিশাল কাণ্ড বয়ে যাচ্ছে বিচারসভায়। সেঁজুতির স্বামী সাওন চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। ওর ইচ্ছে করছে এই ভরা সভাতেই সেঁজুতির বিচার নিজের হাতে করার। কতবড় সাহস! ওর মায়ের মুখে মুখে জবাব দেয়! ওর খেয়ে ওর ঘাড়েই ছোবল দেওয়ার শাস্তি তো দিতেই হবে।

সবার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে সেঁজুতি। একেরপর এক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে আজ। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হচ্ছে সবকিছু। খানিকটা ভয়ে ভয়েও আছে সেঁজুতি। কখন আবার এই ভরা জনমুখে কথা কাটাকাটি শুরু করে। একেরপর এক কথা শোনাবে, আর ও সহ্য করে যাবে! এমন মেয়ে নয়। মুখে মুখে তর্ক না করতে পারলেও একেবারে ছেড়ে কথা বলবে এমন ভদ্রতা সেঁজুতির নেই। একেবারেই গায়ে লাগানো কথা সহ্য করতে পারেনা। তারমধ্যে নিজের পরিবার তুলে বললে তো সহ্য করবেই না। তারমধ্যে, যতক্ষণ না মুখ থেকে ফেনা বের হবে ততক্ষণ আনোয়ারা বেগমের রেডিও বাজতেই থাকবে। তবে সেঁজুতি খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে থাকায়, এই রেডিও শান্তভাবেই বন্ধ করে দেয়। কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না বলবে, ততক্ষণ বাজতেই থাকে। তাই সেঁজুতিও চুপচাপ বন্ধ করার দায়িত্ব নেয়। এই নিয়ে সাওন বেশ কয়েকবার মারধর করেছিল। তখন সেঁজুতির এককথা ছিল, ওর সাথে সেধে সেধে লাগতে না আসলে ও কাউকে কিছু বলেনা আর ভবিষ্যতেও বলবেনা। এটা শোনার পরে রাগে কটমট করে তাকাতো সাওন। সেঁজুতি ভাবলেশহীন ভাবে মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতো।

আজ সকালেও সাওনের সাথে এই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হয়। কোনোরকম সময় পাড় করে না খেয়েই অফিসে চলে যায় সাওন। সাওনের না খেয়ে চলে যাওয়া একদম’ই পছন্দ না আনোয়ারা বেগমের। সে আকারে-ইঙ্গিতে একেরপর এক কথা শোনাতে লাগলো সেঁজুতিকে। প্রথমে সহ্য করলেও পরবর্তীতে একটা কথায়ও ছাড় দেয়নি সেঁজুতি।

“ মডেল আনছি ঘরে। না জানে কোনো কাজ, না আছে যোগ্যতা। সারাদিন সেজেগুজে ঘুরাঘুরি ছাড়া তো আর কোনো যোগ্যতাই নাই। শুধু যোগ্যতার মধ্যে একটাই আছে, ঘরের কেউ শান্তি পায় না। আর আমার ছেলেরে একটু শান্তি দেয় না। সারাদিন অফিস করবে না খেয়ে। একটা দিনও শান্তিতে খেয়ে যেতে পারেনি। না পারে ঘরে এসে শান্তিতে থাকতে। ”

আনোয়ারা বেগমের কথাশুনে প্রথমে চুপ থাকলেও পরবর্তীতে চুপ থাকতে পারলো না সেঁজুতি। বেশ ভদ্রভাবেই জবাব দিল তাঁর।

“ আম্মা। এভাবে আফসোস না করার থেকে আপনি বরং খাবার নিয়ে অফিসে যান। নিজ হাতে এতবড় ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে আসবেন। শুধু শুধু আমায় কথা শুনাচ্ছেন কেন? যার পেট তাঁর খিদে লাগলে এমনিতেই খাবে, তাতে অন্য কাউকে বারবার দোষারোপ করছেন কেন?”

“ তোমাকে কিছু বলিনা বউ, তুমি চুপ থাকো। ”

“ একেরপর এক আকারে-ইঙ্গিতে কথা শুনাচ্ছেন আমাকে উদ্দেশ্যে করে। এটাকে কিছু বলা হয়না? ”

“ তোমারে কৈফিয়ত দিতে হবে এখন? আমার ছেলের ভাত আমি খাই, তোমারে কৈফিয়ত দেবো কেন?”

“ আপনি আপনার ছেলের ভাত খাচ্ছেন, আমিও আমার স্বামীর ভাত খাই। তাঁর জন্য দুজনেরই চিন্তা থাকবে। আপনি মা, তাই একটু বেশিই চিন্তিত। তবে আমি সহধর্মিণী বলে আমার একটুও চিন্তা থাকবেনা! আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথাকাটি, মন-মালিন্য হতেই পারে তারজন্য ইঙ্গিত করে কথা শোনাতে হবে? ”

“ সারাক্ষণ এমন কথা-কাটাকাটি হবে কেন? একটা দিনও আমার ছেলে শান্তি পায় না। সব তোমার জন্য না? ”

আনোয়ারা বেগমের কথাশুনে রাগ উঠলেও শান্তভাবে সেঁজুতি জবাব দিল,
“ আপনি এত কথা বলেন কেন, আমাকে ইঙ্গিত করে? তারজন্য আমার জবাব দিতেই হয়। কারণ, কেউ অযথা উল্টাপাল্টা কথা শোনালে আমি চুপ থাকতে পারিনা। আপনার উচিত ছেলেকে সকালে খাইয়ে অফিসে পাঠাতে হলে ; একটু হলেও চুপ থাকা। কারণ, আপনার বিরবির করা কথার জবাব তো দিতেই হবে আমায়। যদি চুপ থাকেন তাহলে আপনার কথার জবাব দেবো না, আর আপনার ছেলের সাথেও কথা কাটাকাটি হল না। কিন্তু আপনি চুপ থাকেন? এই তো সারাক্ষণ কথা বলতেই থাকবেন। তাহলে সব দোষ আপনাকে দিতে পারিনা? আপনার জন্যই তো এমন ঝগড়া হয়। ”

সেঁজুতির কথাশুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো আনোয়ারা বেগম। চেঁচামেচি করে বলতে শুরু করলো,
“ আমার ঘরে থেকে আমারেই কথা শোনাও? নাক টিপলে দুধ পরে, এতটুকু মেয়ে আমায় একেরপর কথা শুনিয়ে যাচ্ছে!”

সেঁজুতি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, “ এতই ছোট হলে আমাকে ঘরের বউ করে আনলেন কেন? এখন তো জেলে দেওয়া উচিত আপনাদের। এখন আমার শৈশব, অথচ পরের বাড়িতে থেকে থেকে ঝগড়া করতে হচ্ছে? ”

এবারে সেঁজুতির কথায় রাগে কটমট করছে আনোয়ারা বেগম। এতটুকু মেয়ে হয়ে মুখে মুখে তর্ক করছে! এর পরিবার নিম্নতম শিক্ষাটুকুও দেয়নি তাই এমন আচরণ মেয়ের। বেয়াদব আনছে ঘরে তাও নিজের হাতে।

পরিবারের কথাশুনে এবারে সেঁজুতি রেগে গেল। যা হবে ওর সাথে হবে, এখানে পরিবারকে টানছে কেন! ওর শ্বশুর বাড়িতে তো পরিবারের কোনো কাজ নেই! তাহলে ঝগড়ার বেলায় পরিবার টানতে হবে! সেঁজুতি বললো,
“আম্মা, এখানে আমার পরিবারের কাজ নেই কোনো। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, এখানে তারা কেউ এসে থাকেনা। তাছাড়া, কথায় কথায় পরিবার টানবেন না। ”

“তোমার কাছ থেকে জ্ঞান শুনতে হবে? এমন বেয়াদব আচরণ তো পরিবারের কাছ থেকেই শিখেছো, তাহলে পরিবারকে তো টানবোই। ”

“ আপনার ভুল কথাগুলোর সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য বেয়াদপ হয়ে গেলাম? কই! আমি কী একবারো বলেছি আপনার পরিবারের কথা? কারণ, আমি তো জানি আপনার পরিবার যেমন আপনার আচরণ গুলো তেমনই হবে। ”

সেঁজুতির কথায় রেগে গেল আনোয়ারা বেগম। এতবড় কথা! শেষে কি-না তার পরিবারের কথা তুলেছে! এর হেস্তনেস্ত করতেই হবে। একদিন না, দুইদিন না, প্রায় কয়েকদিন এমন কথা বলেছে সেঁজুতি। বিয়ের বয়স ছয়মাসও হয়নি এখনি এমন কথা শুনাচ্ছে? এমন বেয়াদব মেয়ে রাখলে প্রতিদিন এমন কথা শুনতে হবে। তার থেকে আগেই হেস্তনেস্ত করা উচিত।
আনোয়ারা বেগম সেঁজুতির পরিবার, সাওনের চাচা, খালু, ফুফাকে বাড়িতে আনলো। যা হবার আজকেই হবে।

সেঁজুতি কিছুই জানেনা এসবের। গোসল করে নামাজ আদায়ের পরে, না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বিকেল। তখনি বাড়িতে এমন কাণ্ড চোখে পরে। সবার সামনে অপরাধীর মতো বসে থাকতে হয়। সব মুরব্বিরা এখানে আছে, তাই চুপ হয়ে বসে আছে সেঁজুতি।

সেঁজুতি। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে মাঝামাঝি অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায়। পরিবারের ইচ্ছেতেই এই বিয়েটা করতে হয়। হাজারো চেষ্টাতেও বিয়ে আটকাতে পারেনি। ওর প্রেমিক অভ্র ওর সাথেই পড়ে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন বিয়ে করবে কীভাবে! তাহলে পরিবারকে কী বলবে? আর বউকে খাওয়াবে কী? মাঝপথেই ওদের সম্পর্কের ইতি ঘটে। তবে নিজ থেকে যতটুকু পারে, সব সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্তি নেয় সেঁজুতি । নতুন জীবন নতুনভাবে শুরু করে। অভ্রের জন্য মন খারাপ হলেও কাউকে বুঝতে দেয় না। কারণ, কোনোভাবে এটা জানাজানি হয়ে গেলে আর নিস্তার নেই। সারাজীবন এরজন্য কথা শুনতে হবে। তবুও শান্তি নেই সেঁজুতির। ওর শাশুড়ির মন-মতো চলতে পারেনা তাই একেরপর কথা শুনতেই হয়। তবে সবকিছু যে চুপচাপ সহ্য করে যাবে এমন মেয়েও নয় সেঁজুতি। নিজের জবাব নিজেই দিতে জানে।

#চলবে

#সেঁজুতি (পর্ব_২)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সেঁজুতির বাবা রেগে বললেন, “ এই শিক্ষা দিয়েছি? বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, জানো না? এখানে বিচারের জন্য আসতে হবে কেন? ”

সেঁজুতি শান্তভাবে বললো, “ সে পরিবার তুলে কথা বলেছে কেন! তাই আমিও জবাব দিয়েছি। ”

সাওনের মামা বললো, “ বউ, তুমি নতুন আসছো। একটু গুছিয়ে চলবা। এখানের পরিবেশের ধরণ বুঝে তারপরে কথা বলবা। ”

মামু, আমি তো কিছুই বলিনি আম্মাকে। সে নিজে থেকেই তো লেগে থাকে।

সাওনের মা উচ্চস্বরে বললো, “ দেখছো! এখনো সবার মুখে মুখে কথা বলে। তাহলে ভাবো আমার সাথে কেমন করে!”

আনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ্যে করে তাঁর ভাই বলল, “ তুই চুপ কর। ”
সেঁজুতিকে উদ্দেশ্যে করে বললো, “ কিছু হয়েছিল? শুধু শুধু লাগতে যাবে কেন? ”

সেঁজুতি শান্তভাবে বলল, “ আমি সাজি কেন? ঘুমাই কেন? রান্নাবান্নার পরে নিজ থেকেই বেড়ে খাই কেন? তার ছেলে সকালে না খেয়ে যায় কেন? সবকিছুর জন্য আকারে-ইঙ্গিতে কথা শুনাবে। তাহলে চুপ থাকবো কেন আমি? আমি তো বোবা না। মুখ আছে, ঠোঁট আছে, আলজিহ্বা আছে কথা বলতেই পারি। ”

সেঁজুতির কথাশুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আনোয়ারা বেগম। উচ্চস্বরে বললেন, “ এতটুকু মেয়ে কতবড় কথা বলে যাচ্ছে। ওর জন্য একটা দিনও সাওন খেয়ে যেতে পারেনা। প্রতিদিন ঝগড়াঝামেলা করবে। এর প্রতিবাদ করলেই আমি খারাপ? বিয়াই আপনার মেয়েরে কোনো শিক্ষা দেননি? ”

সেঁজুতি আবারও শান্তভাবে বলল, “আমার বাবা যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন আমায়। তারজন্যই তো চুপ আছি। সবকিছু সহ্য করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অতিরিক্ত কথা শুনলে তো সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তখন প্রতিবাদ করাই লাগে। সেটাতো পরিবারের শিক্ষার জন্য না, তা হল শ্বশুর বাড়ির শিক্ষা। বাড়ির বউদের উচিত কম কথা বলা, কিন্তু তা না করে সারাক্ষণ যদি কথা বলেই যায়। তাহলে আমি একটুও বলতে পারবোনা? এটা আপনারও শ্বশুর বাড়ি, আমারও শ্বশুর বাড়ি। ”

এবারে সেঁজুতির কথায় বেশ রেগে গেল আনোয়ারা বেগম। সাওন নিজেও রেগে গেছে। সবার সামনে মুখে মুখে তর্ক করছে! তবে ভদ্রতার খাতিরে লোক-সম্মুখে কিছু বলতে পারছেনা। সেঁজুতির বাবা রেগে তাকালো মেয়ের দিকে ; সেঁজুতি শান্তভাবে বললো, “ উচিত কথার ভাত নেই এই দুনিয়ায়। এখন থেকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলবো। তখন যেন আমার দোষ হয়না। সবাই তো মিথ্যের পক্ষে যাচ্ছে, এরপরে আমি নিজেও মিথ্যা কথা বললে সবাই আমার পক্ষে আসবেন। জানিয়ে দিলাম, পরে যেন কথা শুনতে হয়না। ”

সেঁজুতির কথাগুলো অন্যকারো ভাল না লাগলেও সাওনের ফুফার মনে ধরেছে। সে জনসম্মুখে হেসে দিলো। হেসে হেসে বললো, “ যেমন শাশুড়ি তেমন বউ। ”

সাওনের মামা বোনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, “ আচ্ছা। শাশুড়ি সাথে মিলেমিশে থাকবে। ঝামেলা করা ভাল না, মা। একটু মানিয়ে চলবা। ”
সাওনের মামার জানা আছে তাঁর নিজের বোনের সম্পর্কে। আর সেঁজুতির কথাগুলোও ভালভাবে শুনলেন, সবকিছু স্পষ্ট তাঁর। নিজের বোনের জন্য শুধু শুধু অন্য মেয়েকে দোষারোপ করবে কেন! তাই বুঝিয়ে বললেন সেঁজুতিকে, যদিও মানা না মানা ওদের ব্যপার। তবে বুঝিয়ে বললে তো দোষের কিছু হবেনা। তিনি নিজের বোনকেও বুঝালেন। কিন্তু আনোয়ারা বেগম সন্তুষ্ট হলেন না। শুধু শুধু মানুষ জমায়েত করলো তিনি, কাজের কাজ কিছুই হল না।

এতদূর থেকে ছুটে এসেছে সবাই, একেবারে রাতের খাবার খেয়েই বিদায় হলো। সেঁজুতির পরিবার যাওয়ার সময় কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে গেল, ভালভাবে চলতে। জবাবে সেঁজুতি বলেছিল, একজন সারাক্ষণ বলে যাবে আর আমি চুপ থাকবো? আমার জন্য যদি তোমাদের খারাপ লাগে তাহলে এসো না এখানে। তবুও জ্ঞান দিবা না কেউ। অনেক জ্ঞান দিয়েছো এতদিন। এখানে তো নিজের পছন্দে আসিনি আমি, তোমাদের পছন্দের বাড়িতে এসেছি। তাহলে তোমরা কথা শুনাচ্ছো কেন? অনেক ভাল দেখেছো আমার, দয়া করে আর জ্ঞান দিয়ে ভাল দেখতে হবেনা। আমি যথেষ্ট ভাল আছি এখন। ”

সেঁজুতির মুখোমুখি এমন কথার জবাব দিতে পারলো না ওর পরিবার। নিজেদের পছন্দমতো মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, এখানে সেঁজুতির পছন্দমতো আসলে অন্যকথা ছিল। এখন এর দায়ভার তো সেঁজুতির পরিবারের মানুষের’ই নিতে হবে। তবুও সবকিছু এড়িয়ে ঠিকই সেঁজুতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেল সবাই। যাওয়ার সময় বারবার বুঝিয়ে গিয়েছে, সবার সাথে মিলেমিশে থাকার কথা। সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাইকে বিদায় জানালো। ওর কথা শোনার মতো কেউ নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবকিছুর দায়িত্ব ঠিকই ওর মাথায় চাপিয়ে দিবে সবাই।

শত মন খারাপের মধ্যেও সেঁজুতি খেয়ে নেয় আগে। ও নিজের শরীরের প্রতি অনেক দায়িত্বশীল। অন্যদের সাথে রেগে না খেয়ে থাকবে কেন! দরকার হলে যাদের জন্য রাগতে হয় তাদেরকে না খাইয়ে রাখবে। তবুও নিজে না খেয়ে থাকবেনা। উপোস থাকলে নিজের আচরণ নিজেই চিনতে পারে না। তবে আজকে খেতে ইচ্ছে করছেনা ওর। নিজের পরিবারের মানুষের প্রতি রাগ জমে আছে। কত ভালভাবে বুঝিয়ে গেল। অথচ, এখানে নিজের পছন্দমতো আসলে সব দোষ ওর মাথায় চাপিয়ে দিতো। এখন নিচ্ছেনা কেন, এর দায়ভার?
ওর শাশুড়ি একটা কথাও বলেনি ওর সাথে। ভদ্রতার খাতিরে নিজেই শাশুড়িকে ভাত বেড়ে সামনে দিল। আনোয়ারা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নিজের ভাত নিজে আলাদা প্লেটে বেড়ে খেল। তার এমন মুখ ঘুরানো কেউ দেখলো না। এখানে সেঁজুতি কিছু বললে ঘুরেফিরে দোষ ওর দিকেই আসতো। তবুও সেঁজুতি বুদ্ধিমতী মেয়ে, ভাতের প্লেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওর শাশুড়ির সামনেই দিল। ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সেঁজুতি। সাওন বিছানায় চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। সেঁজুতি দেখেও না দেখার ভান করে অন্যপাশে যেয়ে বসলো।

সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ সারাক্ষণ ঝামেলা বাঁধিয়ে কি শান্তি পাও? সব মানুষ জড়ো করে শান্তি পেয়েছো? বিয়ের ছয় মাস যেতে না যেতেই বিচারসভা শুরু। এখনো সময় পরে আছে, তখন কি করবা? লোক-সম্মুখে তোমরা মেয়ে মানুষ তো চলাচল করো না, আমরা পুরুষ’রা চলাচল করি। এমন কাহিনী করলে মুখ দেখাতে পারবো? ”

সাওনের কথায় ফিক করে হেসে দিল সেঁজুতি। মুখে মৃদ্যু হাসির রেখা টেনে বললো, “ মুখ দেখাতে না পারলে নেকাব পরে থাকবা। তবুও উচিত কথার ছাড় দেবো না আমি। বিন্দুমাত্র ছাড় দেবো না। ”

সেঁজুতির কথাশুনে রেগে গেল সাওন। উচ্চস্বরে সেঁজুতির নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। সাওনের কথা গায়ে না লাগিয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পরলো সেঁজুতি। সাওন মেজাজ কটমট করে তাকালো।

খিদের জন্য ঘুম আসছেনা সেঁজুতির। শ্বশুর বাড়িতে এসেই খাবারের সাথে রাগ করতে হল! নিজের বাড়ি থাকলে অন্যকথা ছিল। যখন ইচ্ছে তখন খেতে পারতো কিন্তু এখানে এত রাতে কিভাবে খাবে! যার যেমন ইচ্ছে সে তেমন ভাবুক, পেট ঠিক থাকলে সবকিছু ঠিক। এসব ভেবে ভেবে উঠে বসলো সেঁজুতি। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে সাওন নেই, হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছে। কিন্তু এখন রুমের বাইরে যাওয়া তো ঠিক হবে না, সাওন এসে যদি সেঁজুতিকে না দেখে তখন এলাহি কান্ড ঘটে যাবে।
তাই খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন দেখলো ওয়াশরুম থেকে সাওন আসছেনা, তখন নিজেই ওয়াশরুমের সামনে গেল। এখানে সাওন নেই, শুধু শুধুই লাইট জ্বালানো। ভ্রু কুঁচকিয়ে বিছানায় আসলো সেঁজুতি। কিছুক্ষণ পরে সাওনের উপস্থিতি টের পেল, খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে কাছে এগিয়ে আসছে সাওন। সেঁজুতির সামনে খাবার রেখে বলল, “ যখন উপোস থাকতেই পারো না, তখন না খেয়ে থাকার কি দরকার ছিল? এখন খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো। ”

খাবার হাতে নিয়ে সেঁজুতি বলল, “ আপনি দায়িত্বশীল স্বামী, তা প্রমাণ করতে হবে না? নিজের জন্য না হলেও স্বামীর জন্য মাঝেমাঝে উপোস থাকতে হয়। একটু হলেও যেন খোঁটা দিতে পারেন। কারণ, খোঁটা দেওয়ার মতো তো কিছুই নেই আপনার হাতে। ”

সেঁজুতির কথাশুনে হা করে তাকালো সাওন। ভাল করতে যেয়েও ঠিকই কথা শুনিয়ে দিল। সাওনের এমন হা করে তাকানো দেখে খাবারের লোকমা মুখে দিয়ে দিল সেঁজুতি। ওর এমন কাণ্ডে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে যায় সাওন। কোনো ভাবেই সেঁজুতির কথায়, ওর কর্মকাণ্ডে জিততে পারেনা।

খাবার শেষে চুপচাপ সাওনের মুখোমুখি হয়ে বসলো সেঁজুতি। সাওন ভাবলেশহীন ভাবে বলল,“ পেট শান্তি! এখন ঝগড়া করার মতো যথেষ্ট এনার্জি আছে, সকালে তাড়াতাড়ি উঠাবে। তোমার সাথে ঝগড়ার পরে যেন অফিসে খেয়ে যেতে পারি। প্রতিদিন এক ঝামেলা ভাল লাগেনা। ”

সেঁজুতি মুখ বাঁকিয়ে বললো, “ এতবড় খোঁটা! একদিন আফসোস করবা এই ঝগড়ার জন্য। ”
কথাটি বলেই মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পরলো সেঁজুতি। সাওন কিছু না বলে সেঁজুতির পাশ ঘেঁষে শুয়ে রইলো। ভাল বললে কথা শুনিয়ে দেয়, আর খারাপ বললে তাতেও কথা শুনিয়ে দিল! মেয়দের মন বোঝা বেশ মুশকিল। কোনদিকে যেয়ে তাদের সঙ্গ পাবে এটা বুঝতে পারছেনা। একটা বড়সড় নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো সাওন।

#চলবে

( ভুল-ত্রুটি জানিয়ে দিবেন। যদিও আমার লেখার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধুই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য লেখালেখি। তবে সঠিকভাবে লিখতে চাই। আশা করি পাশে থাকবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here