সেঁজুতি পর্ব_২২

0
1511

#সেঁজুতি(পর্ব_২২)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

গাছের শিকড় মজবুত থাকলেই তো গাছ সতেজ থাকে। আমিও নিজে ঠিক থাকলে আমার পরিবার ঠিক থাকবে। হয়তো এতদিন নিজের মধ্যে ব্যর্থতা ছিল, তাই কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু সবসময় মানুষ এক থাকে না, পরিবর্তন হয়। হয়তো ভুল পথের সব মানুষদের পরিবর্তন হয়ে, সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়। ”

সাওনের কথা শুনে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে সেঁজুতির চারিপাশে বিচরণ করে। সেঁজুতি শান্ত হয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো সাওনের বুকে পরে থাকে। সাওন চুপচাপ বসে আছে।

.

যেদিন সেঁজুতি সাওনের সাথে চলে যাবে, সেদিন সেঁজুতির ভাই সাওনের মুখোমুখি হয়ে বলল,” বিয়ের পর থেকেই বোনের দায়িত্ব তোমার হাতে দিয়েছি, তার অযত্ন করো না। একটু গুছিয়ে রাখো। আর সেঁজুতির কোনো বেয়াদবি পেলে তুমি নিজে ঠিক করবা। অন্যকেউ যেন হস্তক্ষেপ না করে। ”

সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,” যাই হোক কারো সাথে যেন বেয়াদবি না শুনি বোন। কোনো ঝামেলা থাকলে সাওনকে বলবা, নিজের কিছু বলার দরকার নেই। যদি বলতেই ইচ্ছে করে তাহলে ঘরের দরজা লাগিয়ে নিজেকে নিজে বলবা। অন্যকে নয়। নিজে ভালো থাকলে জগত ভালো, এটা মনে রেখো। ”

ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় সেঁজুতি। ভাবি বললো,”সাবধানে যেয়ো। তাছাড়া, রান্নাবান্নার ক্ষেত্রে খেয়াল রেখো। গ্যাসের সমস্যা কিন্তু সবথেকে ভয়াবহ, খেয়াল রাখবা। তাড়াহুড়ো করে রান্নার দরকার নেই, যেহেতু রান্নায় সময় লাগে তাই কিছুক্ষণ আগে থেকে সবকিছু গুছিয়ে রাখবা। তাড়াহুড়োতে ক্ষতি হবে, সবসময় ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হয়। যেকোনো কাজই ঠাণ্ডা মাথায় করলে সুফল পাওয়া যায়।”

ভাইয়া ভাবির কথায় সম্মতি দিলো সেঁজুতি। পরিবারের সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের পথে চললো দুজনে।
বাসায় যেতে যেতে বেলা এগারোটা বেজে গেছে। ঘরের অবস্থা গোছগাছ থাকলেও কেমন একটা ভ্যাপসা ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছে। বাসার জানালা গুলো খুলে বিছানায় বসে পরলো সেঁজুতি। গায়ের জামাকাপড় ছেড়ে বাসার জন্য আরামদায়ক পোশাক পরিধান করলো। দুপুরের রান্নার জন্য রান্নাঘরের দিকে পা ফেললো। পাতিল, কড়াইয়ের ঢাকনা উঠানো মাত্রই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে আসলো। বাসি খাবার গুলো থেকে গন্ধ বেরিয়ে গেছে। সবকিছু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রান্নার কাজে মনযোগ দিলো সেঁজুতি।
আজকে সংক্ষেপে যা করা যাবে তাই করবে। গলদা চিংড়ি আর ডাল রান্না করবে। ডাল, ভাত বসিয়ে মাছ কাটতে লাগলো। মাছ কাটার পরে ঘর ঝাড়ু দিলো।
রান্না শেষের দিকে প্রায়। চুলো মুছে, রান্নাঘর গোছাতে লাগলো। পিছনে তাকানো মাত্রই চমকে গেল সেঁজুতি। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে সাওন৷ সেঁজুতি তাকানো মাত্রই হাসি দিয়ে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। পিছন থেকে সেঁজুতির কাঁধে থুতনি রেখে বললো,” বুড়োর বুড়ী ধীরে ধীরে কাজে পটু হয়ে যাচ্ছে। এটা মানা যাচ্ছে না। একদম’ই না।”

সাওনের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কেন, মানা যায় না? ”

সাওন জোরেসোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,” তাড়াতাড়ি কাজ করা মানাচ্ছে না। আমিতো অফিসে থাকবো, তাছাড়া যেখানে সেখানে তো জ্বালানো যাবে না। তাই এর একটা বিহিত তো করতেই পারি, তাই না?”

সাওনের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালে সাওন বলে,” মনে করো, তুমি তাড়াহুড়ো করে সব কাজ করে যাচ্ছো কিন্তু সেসব আমার ভালো লাগছে না। তখন কী করা উচিত? নিশ্চয়ই তোমার কাজে বাগড়া দেওয়ার জন্য কারো সাহায্য নেওয়া উচিত! এবং সে সারাক্ষণ তোমার পিছুপিছু আঁচল ধরে দৌঁড়াবে, ঘুরবে। তখন বাগড়া দেওয়া হলো, না বলো!”
কথাগুলো বলে বাঁকা হাসে সাওন। সেঁজুতি ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ঢোক গিললো।
সেঁজুতিকে চুপ দেখে সাওন বললো,”ফোনে তো দুনিয়ার সব কথা বলতে পারো। সামনে থেকে বলো না কেন? এখন চুপচাপ! এটাও মানা যাচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময়ে যদি চুপ হয়ে যাও, তখনও বাগড়া দেবো।” কথাগুলো বলে এবারে ভুবন ভরানো হাসি দেয় সাওন। জোরেসোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে, কাজে মন দিল সেঁজুতি।
রান্নাঘর থেকে রুমে আসার সময়ে পিছুপিছু সাওন নিজেও আসলো। সাওনের এমন স্বভাবগুলো দেখে সেঁজুতি হেসে দিলো। হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন হয় সাওনের। এবং আগের থেকে অতিমাত্রায় স্বভাবগুলো পরিবর্তন হচ্ছে।

সাওন গোসল করে মসজিদে যাওয়ার সময়ে সেঁজুতিকে বারবার বলে গেল, দরজা যেন না খুলে। সাওন আসলে ফোনকল দিবে তখন যেন যায়। ফোনকল না পাওয়া পর্যন্ত কখনোই যেন দরজা না খুলে। দরকার হলে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে।
সেঁজুতিও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।

বাইরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সাওন। সেঁজুতির কোনো খবর নেই, ফোনকলে কল দিলো তিনবার তবুও রিসিভ করছে না। দরজার সাথে হেলিয়ে চুপচাপ মোবাইল ঘাটতে লাগলো সাওন। সেঁজুতি কেবল গোসল থেকে বেরিয়েছে। সাওন বাসা থেকে বের হওয়ার পরে বাসা মুছে গোসলে গেল। একটু সময় তো লাগবেই। আজকে বাসাতে কেউ নেই তাই হাসিকে ডাকেনি, নিজেই কাজ করেছে।
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সাওন তিনবার কল দিয়েছে। চারবারের সময়ে কল দেওয়া মাত্রই রিসিভ করে বললো,” আসছো, তুমি?”

সাওন শান্ত ভাবে বললো,” এগারো মিনিট আগে। ”

সেঁজুতি জিহ্বায় কামড় দিয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজার অপরপাশ থেকে একগাল হেসে বাসার ভেতরে আসলো। সেঁজুতি দরজা লাগিয়ে সাওনের পিছুপিছু আসতে আসতে বললো,”তোমায় খাবার দেবো?”

সাওন মাথা ঘুরিয়ে বললো,” তুমি, খাবে না?”

সেঁজুতি বললো,” নামাজ আদায়ের পরে। ”

সাওন গম্ভীরমুখে বললো,” তো! আমায় একা খেতে বলছো? আমি খাদক নই, হুহ। তুমি নামাজে যাও, আমি অপেক্ষা করছি।”

সেঁজুতি হেসে সম্মতি দিয়ে চলে গেল।

ডাইনিং টেবিলে যখন দুটো প্লেট ধুয়ে রাখে তখন সাওন একটা সরিয়ে ফেলে, এক প্লেটে খাবার রাখে। সেঁজুতি কপাল কুঁচকে তাকালে একগাল হেসে দেয় সাওন। শান্ত ভাবে বললো, ” এত সুখ করে খেতে হবে না। আজকে যখন সুযোগ পেয়েছি আজকে জ্বালাবো। এখন চুপচাপ বসে থাকো।”

সাওনের কথায়, সেঁজুতি শান্ত ভাবে ওর পাশের চেয়ারে বসে। সাওন খাওয়াচ্ছে এবং নিজেও খাচ্ছে। সেঁজুতিও শান্ত ভাবে খাচ্ছে। এর আগেও বহুবার খেয়েছে, যতবার সাওনের হাতে খায় ততবারই একটা অনুভূতি কাজ করে। নতুন ভাবে ভালোবাসার অনুভূতি।

.

চারদিন হল আনোয়ারা বেগম এখনও মেয়ে বাড়িতে। সে নিজে আসতে চাইলেও কেউ আসতে দেয় না, তাই বাধ্য হয়ে সেখানে থাকতে হচ্ছে।
এতদিন সেঁজুতির বাবার বাড়িতে থেকে অফিসে গিয়েছিলো সাওন। কিন্তু এখন বেশ চিন্তা হচ্ছে। বাসায় সেঁজুতিকে একা রেখে যাবে, আনোয়ারা বেগম হয়তো কিছুদিন থেকেই আসবেন। কিন্তু আপাতত কী করবে! চিন্তিত ভাবে সেঁজুতির দিকে তাকালে আশ্বাস দিয়ে সেঁজুতি বললো,” একা থাকলে ভয় পাবো না। তুমি যাও এবং আসার পরে আমাকে কল দিয়ো। তার আগে দরজার আশেপাশেও যাবো না। এবার চিন্তা ঝেড়ে শান্ত ভাবে অফিসে যাও। এবং সুস্থ ভাবে বাসায় ফিরো।”

সেঁজুতির কথা শুনে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে চলে গেল সাওন।

অফিসে যাওয়ার পরে সুযোগ পেলেই ফোনকল দিয়ে খোঁজ রাখে সাওন। সেঁজুতি ভয় পেয়েছে কি-না! কেউ দরজায় নক করেছে কি-না! ভীষণ চিন্তিত সে। সাওনের কাণ্ড দেখে ফোনের এপাশ থেকে সেঁজুতি হেসে দিল। সাওন ধীর ভাবে বললো, “আমার অবস্থানে থাকলে তুমি বুঝতা, এই পৃথিবীতে শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়া কত কঠিন।”

সাওনের কথা শুনে সেঁজুতি কিছু বললো না। সাওন কাজের ব্যস্ততায় ফোনকল কেটে দিলো।

অফিস থেকে আসার পরে সাত-আট বারের মতো ফোনকল দিয়েছে সাওন। কিন্তু সেঁজুতির কোনো হদিস নেই। চিন্তিত হয়ে কলিংবেল বাজাচ্ছে, ফোন দিচ্ছে। তবুও খোঁজ পাচ্ছে না। এদিকে সেঁজুতি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পরপর দুইবার শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে উঠেই ফোনে চোখ বুলালো। সাওন কতগুলো কল দিয়েছে। দৌঁড়ে দরজা খোলা মাত্রই চোখেমুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো সাওন। সেঁজুতি চোরের মতো ভাব নিয়ে পিছুপিছু আসলো। সাওন কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সাওন এসেই পাশ ঘেঁষে বসলো। শান্ত ভাবে বললো,” কতক্ষণ আগে আসছি, জানো?”

সেঁজুতি কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বললো, “আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আজকেই দুনিয়ার সব ঘুম আমার চোখে এসেছে। কারণ আজকে হয়তো আমায় মারে টানে। ”

সেঁজুতির কথা শুনে সমস্ত চিন্তা ভুলে হেসে দেয় সাওন। হেসে বললো,”সত্যিই মারে টানে। এত ঘুম! অপরপাশ থেকে চিল্লাপাল্লা করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেলেও তুমি উঠো না। একটুর জন্য মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস তার আগেই দরজা খুলেছো। এখন মার দেবো?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here