সেঁজুতি পর্ব_২৩

0
1705

#সেঁজুতি(পর্ব_২৩)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সেঁজুতির কথা শুনে সমস্ত চিন্তা ভুলে হেসে দেয় সাওন। হেসে বললো,”সত্যিই মারে টানে। এত ঘুম! অপরপাশ থেকে চিল্লাপাল্লা করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেলেও তুমি উঠো না। একটুর জন্য মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস তার আগেজই দরজা খুলেছো। এখন মার দেবো?”

সাওনের কথায় কাঁচুমাচু হয়ে যায় সেঁজুতি। সাওন ফিকলে হাসি দিলো।

কিছুক্ষণ পরে বড় আপু ফোনকল দিল। তিনি বললেন,” আনোয়ারা বেগমকে আনার জন্য যেন সাওন যায়। ”

সাওন বললো,” মাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিন, আমি নিয়ে আসবো।”

বড় আপু বলল,” বোন মনে করে তো আসতে পারো বাড়িতে। সাথে মাকেও নিয়ে যাবি। ”

সাওন খুব শান্ত ভাবে বললো,” আমি যাচ্ছি না। দুই বোনের শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি না।”

বড় আপু বললো,” আমাদের বাড়িতে আসবি কেন? আমরা কিছু হলেতো আসবি। ”

সাওন বলল,” দুই বোনের বাড়িতে গেলেই সবাই চিড়িয়াখানার পোষা প্রাণী দেখার মতো আমাকেও দেখবে। কারণ আমার ঘর-সংসারে যা হয় সেসব কিছু দুই বোনের শ্বশুর বাড়ির মানুষজন জানে। তবে চিন্তা করো না। যেকোনো বিপদে চোখ বন্ধ করে যাবো। বোনের পাশে সবার আগে ভাই ঝাঁপিয়ে পরে, আমিও আমার বোনদের পাশে থাকবো। কিন্তু অকারণে নিজে লোকলজ্জায় পরবো না। সবাই যে জানে আমার সংসারে কথা। ”

সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় বড় আপু।
সাওন শান্ত ভাবে বললো, ” আমি অফিস থেকে সরাসরি যাবো তখন রাস্তায় মাকে পাঠিয়ে দিয়ো। তাহলে তো সমস্যা হবে না। ”

বড় আপু কিছু না বলে কল কেটে দেয়। সাওন নিজেও চুপচাপ। সেঁজুতি পাশে ছিল না বিধায় এতগুলো কথা বলেছে। কারো সামনে থেকে অন্য কাউকে কথা শোনানো ঠিক নয়। এখন থেকে সবকিছু ম্যানেজ করে চলেছে সাওন।
কিছুক্ষণ পরে সেঁজুতি এসে বলল,”কার সাথে কথা বলছিলা?”

সাওন ধীর ভাবে বললো, “বড় আপুর সাথে। আগামীকাল একটু কষ্ট করে একা থাকতে পারবা? আমি অফিস থেকে সরাসরি মাকে নিয়ে বাসায় আসবো। একটু দেরী হবে।”

সেঁজুতি বলল, “হ্যাঁ, পারবো৷”

সাওন বললো,”আজকের মতো ঘুমিয়ে থাকো ঠিক আছে। তবে আমার ফোনকল না পাওয়া অবধি দরজা খুলবে না। দরকার হলে আজকের মতো আগামীকালও দাঁড়িয়ে থাকবো। ”

সেঁজুতি বলল, ” আমার ঘুমকেও খোঁটা দেওয়া হল!”

সাওন হেসে বলল,”হ্যাঁ।”

সেঁজুতিও হাসি দিল।

.

পরেরদিন অফিস থেকে সরাসরি আনোয়ারা বেগমকে আনতে যায় সাওন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল আনোয়ারা বেগমের। কিছুক্ষণ পরে ওর বড় বোন, দুলাভাই দিয়ে গেছে। দুজনের মুখ বেশ ভার ভার। তবে সাওন কয়েক মিনিট কথাবার্তা বলে চলে আসে, সে বাসায় যায়নি। আনোয়ারা বেগমও ছেলেকে মুখ ফুটে কিছু বলেনি, সে জানে তার ছেলের পরিবর্তন।

সোফায় বসে টিভি দেখছে আর অপেক্ষা করছে সেঁজুতি। সাওনের ফোনকল পাওয়া মাত্রই ছুটে গেল। দরজা খুলে দুজনকেই সামনে দেখতে পেল। আনোয়ারা বেগমকে সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে পরলো সেঁজুতি। আনোয়ারা বেগম সালামের জবাব দিয়ে ঘরের ভেতরে আসলো, সাথে সাওন নিজেও ভেতরে আসলো। সেঁজুতি দরজা লাগিয়ে চুপচাপ সাওনের পিছুপিছু চললো।

রাতে খাওয়ার সময়ে আনোয়ারা বেগম চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন। সেঁজুতি সবকিছু গুছিয়ে রুমে গেল। সাওন শান্ত ভাবে বললো, “মায়ের কোনো আচরণ মনে রেখে বসে থেকো না। দেখবা সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সে অবশ্যই বুঝবে সব। ”

সাওনের কথাশুনে সেঁজুতি মাথা নাড়ালো। সাওন চুপচাপ বসে রইল।

.

সকালে সাওন অফিসে যাওয়ার পরে নিজের রুমে ঘুমিয়ে থাকে সেঁজুতি। বেলা দশটা বেজে বারো মিনিটে উঠে যায়। এত বেলা দেখে নিজের মাথায় নিজেই চাপড় দেয়। তড়িঘড়ি করে বিছানা গুছিয়ে বাড়ির কাজে হাত দেয়। আনোয়ারা বেগম পান ছিঁচে মুখে দিচ্ছে আর বলছে,” জমিদারের মেয়ে যদি ছেলের বউ হয়ে আসে তাহলে নিজের মতোই তো চলবে। ছেলেকেও ভয় দেখিয়ে হাত করে ফেলে। হায়রে আমার ছেলে! এত তাড়াতাড়িই পাল্টি খেলো। আল্লাহ জানে বিছানায় পরলে হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দিবে ; তখন বলবে বড়লোকি বউ মায়ের সেবা করতে পারবে না তার কষ্ট হবে। ”

আনোয়ারা বেগমের কথাগুলোর স্পষ্ট ইঙ্গিত বুঝতে পেরেও হজম করে সেঁজুতি। ডাইনিং টেবিলের উপরে পানির বিন্দুগুলো মুছে পরিস্কার করে।
সেঁজুতির কোনো ভ্রুক্ষেপ না দেখে আনোয়ারা বেগম বললেন, ” মেয়ে আসলো একটা কিছু নিজের হাতে তৈরি করে খাওয়াতে পারলাম না। এমনকি নাতিরেও খাওয়াতে পারলাম না। উল্টো মরতে মরতে বেঁচে গেছে। তবুও আমার ছেলে উল্টো গান ধরেছে। ”

আনোয়ারা বেগমের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে শুনছে সেঁজুতি। রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার যোগাড় করে শান্তভাবে রান্নার কাজে মনোযোগ দেয় ।
কিছুক্ষণ পরে ‘হাসি’ এসে ঘর ঝাড়পোঁছ দিয়ে চলে যায়। এসবেও আনোয়ারা বেগমের কথা শুরু হল। তিনি বলছেন,” ছেলের টাকা গেল সব। কতভাবে যে যাবে আরও আল্লাহ জানে। ছেলেটার একটুও হিসেব-নিকেশ নাই। শুধু জায়গায় জায়গায় তেজ দেখিয়ে টাকা উড়াবে। গতকালও তেজ দেখিয়ে আমায় আনতে গেল। এত তেজ তার, যার জন্য বোনের বাড়িতে যায়নি। আমিতো জানিই এসব কার জন্য হয়। বুঝি না কিছু! সব বুঝি। ”

আনোয়ারা বেগমের কথাগুলো সেঁজুতির কানের চারিপাশে ঘুরছে। ও নিজেকে স্থির রেখে রান্না শুরু করলো। যা-ই হোক সাওন ওর পাশে আছে। সাওনের অবাধ্য হবে কীভাবে! নিজে চুপ থেকে সাওনকে ফোনকল দিলো৷ এসব ব্যপারে কোনো কথা উল্লেখ না করে এমনিতেই সাওনের সাথে কথা বললো। নিজেকে ব্যস্ত রাখছে সাওনেতে। সাওন কিছু একটা বুঝতে পেরেও চুপ রইল।

সাওন যখন বাসায় আসে তখন সাওনের কাছে একটা কথাও বলেনি। সাওন নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলো,” বাসায় কিছু হয়েছিল? হঠাৎ যে আজ ফোন দিলা এমন টাইমে। আগে তো দিতে না। ”

জবাবে সেঁজুতি বললো,” কিছু না। তোমার কথা মনে পরেছিল তাই ফোনকল দিয়েছি। ”

সেঁজুতির কথা শুনে কপাল কুঁচকে তাকায় সাওন। তারপরে বলে,”এতদিন মনে পরতো না?”

সেঁজুতি হালকা হেসে বললো,” না। কারণ জিজ্ঞেস করবা না, একদম। ”

সাওন অস্ফুটস্বরে বলল, “আচ্ছা। ”

সেঁজুতি সাওনের সামনে দাঁড়িয়ে ওর চুলে হাত দিয়ে বলল,”খেতে চলো৷ ”

সাওন চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়।
মাগরিবের নামাযের পরে আনোয়ারা বেগমকে ডাকলেন সাওন৷ সাওনের একপাশে সেঁজুতি আর অন্যপাশে আনোয়ারা বেগম বসে আছেন। ও শান্ত ভাবে আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,” মা কী কোনো কারণে আমার উপরে রেগে আছেন?”

আনোয়ারা বেগম,আঁড়চোখে সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল। সাওন শান্ত ভাবে বললো,” যে রেগে যায়, সে হেরে যায়। কারণ রাগের মাথায় অনেককিছু বলা যায় যেগুলো যুক্তিযুক্ত হয় না। আপুদের বিয়ে হয়েছে তাই সবকিছুতে আপুদের সাথে রেখে তোমাদের কথা বলতে চাই না। তাদের যা বলার বলে দিয়েছি। এখন আমার সংসারে মা আর বউ দুজনেই থাকছো। এখানে আপুরা এসে থাকবে না। তাদের নিজেদের সংসার আছে। এখন কথা হল, আমি একটু সামান্যতম ভুল করলেই সবাই তেড়ে আমার দিকে আসো। যে-ই হোক না কেন! বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না কেউ। তোমরা নিজেদের শান্তি সবাই দেখছো, আমার শান্তি চোখে পরে না কারো? যদি আমার জন্য বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা, ভালোবাসা থাকে তাহলে অন্ততপক্ষে শান্তিতে থাকতে দিয়ো। না হলে আমি কিন্তু মাথা খারাপ হলে অনেককিছু করে ফেলি। তোমাদের যার যা ইচ্ছে আমায় বকাবকি করবা কিন্তু একজনকে শুনিয়ে অন্যজন যেন কিছু না বলো। বউ, মা দুজনেরই কিন্তু গায়ে বাজবে তখন। ”

সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় দুজনেই। সেঁজুতি তব্দা দিয়ে যায়। সাওনকে তো এ ব্যপারে কিছুই বলেনি তবুও জানলো কীভাবে!

সাওন শান্ত ভাবে বলল,” বিয়ের পর ছেলেরা পরিবর্তন হয়ে যায়। এমন কথা সচারাচর শুনতে হচ্ছে সবার। তবে এর বাইরে যে আরেকটা কথা আছে সেটা কেউ বলে না। বিয়ের পরে পরিবর্তন হয় ঠিকই, অবস্থানের ভিত্তিতে পরিবর্তন হতে হয়। ছেলে পরিবর্তন হয়, ছেলে বউয়ের পক্ষে থাকলে বউ ছেলেকে তাবিজ করছে, ছেলে মা-বোনের পক্ষে থাকলে কাজের বুয়া হিসেবে বউকে আনছে। যদি তিনজনের পক্ষেই সমান দায়িত্ব পালন করে তখন কথা উঠে ছেলে নিজেই ভালো না। ওরে মা! কোথাও যাবো আমি! এত কথা আমার সত্যিই সহ্য হয় না। তোমাদের তিনকূলের মানুষকেই ভালোবাসি আমি। এরজন্য একজনকে ছেড়ে অন্যজনের কথা শুনবো এমন নয়। একজনের জন্য অন্যজনকে কষ্ট দেবো এটাও নয়। আমার থেকে যার যতটুকু অধিকার সে পাবে। ”

দুজনকে চুপ দেখে সাওন বললো,” একটা মেয়ে খুবই দুঃখী ছিল। সুখের জন্য বিয়ে করে স্বামী সংসার করে। কিন্তু ভাগ্য এত ভালো থাকে তাই স্বামীও মারা যায়। তারপরে আর কী করা! বৃদ্ধ শাশুড়ি নিয়ে থাকতে হয়। কারণ শাশুড়ির জন্য বউ আর বউয়ের জন্য শাশুড়ি ছাড়া চার কূলে কেউ ছিল না এদের। ঘরের ভিটেমাটি ছিল ঠিকই কিন্তু খাওয়ার জন্য কিছু ছিল না। তখন কী করা উচিত! মেয়েটির বিয়ের বয়স তো পরে যায়নি! সে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে পারতো আবারও কিন্তু সে ভাবছে তার কিছুদিনের সুখের কথা। তার জীবনের প্রথম পুরুষ ছাড়া সে অন্য কাউকে জীবনে বহন করতে পারবে না। এবং প্রথম শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার পরে মায়ের মতো যাকে দেখেছে তাকে একা ফেলে অন্য সংসারে যেতে পারবে না। তাই খাবারের জন্য নিজেই মাঠে নেমে গেল। লেখাপড়া ছিল না তাই হাতের কাজ ছাড়া আর বাসাবাড়িতে কাজ ছাড়া অন্যকিছু করার ক্ষমতা নেই তার। তবুও শাশুড়ির জন্য এসব করছে সে। শাশুড়ি যে করেনি এমন নয়, নিজে যতটুকু পেরেছে সে সাহায্য করেছে তার নতুনভাবে বেঁচে থাকার জন্য; যে মেয়েকে পাশে পেয়েছে তার জন্য। এবং পাশাপাশি এই মেয়ের জন্য সে পাত্র দেখা শুরু করেছে। সে আর ক’দিনই বা বাঁঁচবে! তার আগে মেয়েকে নতুনভাবে গুছিয়ে দিবে। কিন্তু যার শেষ ভালো তার সব ভালো হয়। তাদের এমন বউ-শাশুড়ির কাহিনী পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরে। কারণ এমন ভালোবাসা খুব কম দেখা যায়, একজনের জন্য আরেকজন মরিয়া হয়ে থাকে। অবশেষে কি হল, জানো! একজন সুপুরুষ এসে মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। মেয়েটি রাজি নয় কারণ তার বিয়ে হলে তার বৃদ্ধ শাশুড়িকে দেখবে কে? তখন সে সুপুরুষ বলে দুজনের দায়িত্বভার সে নিবে তবুও বিয়ে করবে। কারণ দুজনের কারো মনেই কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই। যেখানে সবকিছুকে হার মানিয়ে একে-অপরের পরিপূরক হতে পেরেছে সেখানে সেই পুরুষ নিশ্চয়ই ভালো থাকবে। তার জীবনে এমন একজন স্ত্রী আর মা লাগবে। তার টাকাপয়সা আছে কিন্তু তার জীবনে সুখ নেই। যদি এমন মন-মানসিকতার স্ত্রী পায় এবং সাথে একজন মা পায় তাহলে তার থেকে ভাগ্যবান আর কেউ নয়। সে পুরুষের কথাবার্তা শুনেও ভালো লাগে দুজনের তবুও মেয়েটি মনমরা হয়ে ছিল। কিন্তু শাশুড়ির জেদের কাছে হার মেনে বিয়ে হয়েই গেল। এবং তাদের সংসার অন্য সবার মতো ঝামেলায় নয়, সুখের সংসারে পরিণত হল।
একে অপরের জন্য হিংসা-বিদ্বেষ না থেকে ভালোবাসা থাকতে হয়। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here