সেই তো এলে তুমি পর্ব_১৩

0
880

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_১৩
#Saji_Afroz
.

নিহির বাইরে থেকে আসলে সেনোয়ারা বেগম তাকে খেতে বললেন। সে খেয়ে এসেছে বলে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। পথিমধ্যে নিজের মা এর রুমে চোখ যায় তার। বুশরার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। আর বুশরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে গল্প শোনাচ্ছেন।
মনোয়ারা বেগমের সাথে আগে কেউ এমন আচরণ করেছে কি না নিহিরের জানা নেই৷ যতটুক সে দেখেছে, তার জন্য এত টাকা দিয়ে মানুষ রাখলেও তারা খুব বিরক্ত হত। মন থেকে কোনো কাজ করতো না। কেউ কেউ বলেই দিয়েছিল, অন্য কোনো কাজ হলে করবে নতুবা এই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। তাকে সর্বক্ষণ দেখে রাখার জন্য কাউকে পায়নি নিহির। পরবর্তীতে দিপ্তী কে রাখে তার যাবতীয় কাজ করার জন্য।
আর এখন বুশরা কে পেয়ে গেল তার মা এর ছায়া হিসেবে। বুশরাও নিজের কাজ আন্তরিকতার সাথে করার চেষ্টা করছে। যা দেখে খুশি হলো নিহির। মন থেকে চাইলো, বুশরার সাথেও ভালো কিছু হোক।
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে নিলো নওয়াজ। তার মা নাসরিন আক্তার তাকে বারবার বলছেন, এত সকালে উঠার কী দরকার ছিল? আরেকটু ঘুমাতি। এত হয়রানি গেল ক’দিন।
-আহ মা! দেশে এসে ঘুম মানায়? সবার সাথে সময় কাটাতে চাই যতদিন আছি।
.
মা এর হাতে বানানো নিজের পছন্দের নাস্তা খেয়ে সে রুমে ফিরে আসে। বুশরার জন্য রাখা উপহারের ব্যাগটা নিয়ে বেরুই সে। মা কে বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
-ব্যাগ নিয়ে?
.
সে আমতাআমতা করে বলল,
আসলে এটা অন্য জনের।
-ও আচ্ছা! ঠিক আছে দিয়ে আয়।
.
আবার তাকে থামিয়ে নাসরিন আক্তার বললেন,
দুপুরে কী খাবি?
-তোমার যা খুশি করো।
-তুই কিছু একটা বল?
-উম্ম… শুটকি ভর্তা করো।
-আচ্ছা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।
.
সে বেরিয়ে যায়। নাসরিন আক্তারের হঠাৎ বুশরার কথা মনে হলো। এই ব্যাপারে নওয়াজ কে জানানো উচিত ছিল। বাইরে কারও থেকে শুনে ছেলেটা না রেগে যায় আবার!
.
.
আলিয়া খাতুনের সামনে বসে আছে নওয়াজ। তার মাথা থেকে পা অবধি ভালো করে দেখছেন আলিয়া খাতুন। ছেলেটাকে অনেক আগে থেকে চিনলেও কখনো এত ভালো করে লক্ষ্য তিনি করেননি। ভালোই তো দেখতে সে। আমেরিকা থাকে। শুনেছে ওখানে ভালো চাকরি করে। শিক্ষিত ছেলে বটে। তা হঠাৎ তার বাড়িতে এই ছেলের আগমন ঘটলো কেনো! কখনো তো এভাবে আসেনি সে।
তিনি নওয়াজ কে প্রশ্ন করলো, তা হঠাৎ কী মনে করে?
-অনেকদিন পর দেশে আসলাম। ভাবলাম দেখে যাই আপনাদের। ভালো আছেন?
.
নওয়াজ বুশরার জন্য আসলেও সেকথা জানাতে পারলো না। বুশরা নিশ্চয় নাস্তা দিতে আসবে। সে এই কাজটা মেহমান আসলে করে থাকে। সেই সাথে তার দেখাও পেয়ে যাবে, সম্ভব হলে ব্যাগটা দিয়ে যাবে।
আলিয়া খাতুন ব্যথিত স্বরে বললেন, আর ভালো থাকা! পরের মেয়ের দায়িত্ব নিলে ভালো থাকা যায়?
-বুঝলাম না।
-মা কিছু বলেনি?
-কি বিষয়ে?
-আমাদের সাথে যা ঘটেছে।
-কী ঘটেছে?
.
এইবার আরো ভালোভাবে নওয়াজকে দেখলেন তিনি। তায়শার সাথে তাকে ভালোই মানাবে। তায়শা কে যদি নওয়াজের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারেন, মন্দ হয় না। এই ভেবে তিনি বললেন, ওই যে বুশরা? সে তায়শার ছবি দিয়ে নিজে মোবাইলে প্রেম করে বেড়িয়েছে। আমার তায়শার বিয়ের দিন ওর জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়। পরে কী হলো? বুশরা ঠিকই ওই ছেলের সাথে চলে গেল। এদিকে বিয়েটা ভাঙলো আমার মেয়ের।
.
একথা শুনে নওয়াজ যেন আকাশ থেকে পড়লো। মনে হলো মুহুর্তের মধ্যেই তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। সে অবাক হয়ে বলল, এসব কী বলছেন?
-তোমার মায়েরাও সব জানে। জিজ্ঞাসা করো।
.
সে কিছু একটা ভেবে বলল, তায়শা কোথায়?
.
আলিয়া খাতুন ভাবলেন নওয়াজ হয়তো তায়শা কে শান্তনা দিতে ডাকছে। অথচ সে ডাকছে সত্যটা প্রমাণের জন্য। তবুও তিনি তায়শা কে সামনে আনলেন না। যদি সে সত্যিটা বলে দেয়!
তিনি বললেন, সে তো বাসায় নেই। নাফিসা কে নিয়ে তার কলেজে গেছে একটা কাজে। আর বলো না বাবা, আমার মেয়েটা সারাক্ষণ দুঃখী থাকে। সে তো…
.
নওয়াজ বলল, আমি আসি এখন।
-সে কী! কিছু খেয়ে যাও?
-অন্যদিন খাব।
.
এই বলে নওয়াজ নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। নাসরিন আক্তার তাকে দেখে বললেন, ব্যাগ নিয়ে এলি যে?
-বন্ধুটিকে পাইনি মা।
.
নওয়াজ রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে বালিশের উপরে। শেষ কবে তার চোখে পানি এসেছিল মনে নেই। হয়তো বাবাকে যেদিন হারিয়েছিল সেদিন। বাবা তো পৃথিবী থেকে চলে গেছে। আর বুশরা? সে তাকে ঠকিয়ে তার জীবন থেকে সরে গেছে। তবুও তার জন্য চোখে পানি আসছে কেনো!
.
.
আজও বুশরা বাসায় ফোন করেছে নাফিশা বা তায়শা কেউ রিসিভ করবে এই আশায়। কিন্তু আজ রিসিভ করেছে তার ফুফা। বুশরা হতাশ হয়ে ফোন রেখে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো। নওয়াজ কে ভীষণ মনে পড়ছে তার। কতদিন হয়ে গেল তার কণ্ঠস্বর শোনেনা। তার অবস্থা সম্পর্কে নওয়াজ কে জানাতেও পারছে না। নওয়াজের পরিবার তাকে কিছু বলেছে কি না সেটাও সে জানেনা। সবমিলিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে বুশরা।
-বাসায় ফোন করেছ বুঝি?
.
সেনোয়ারা বেগমের প্রশ্ন শুনে বুশরা বলল, জি।
-ভালো আছে সবাই?
-হুম।
-ভালো তো থাকার কথা। তাদের মেয়ে কে অন্যের কাধে তুলে দিতে পেরে নিশ্চিন্তে আছেন। দারুণ ব্যাপারটা আসলেই।
.
বুশরা কথা বাড়ালো না। মাথা নিচু করে সে রান্নাঘরে আসে। দিপ্তী থেকে মনোয়ারা বেগমের সকালের নাস্তা নিয়ে তার রুমের দিকে এগিয়ে যায় সে। পথিমধ্যে দেখা হয় নিহিরের সাথে। সে বলল, শুভ সকাল।
-শুভ সকাল।
-নাস্তা করেছেন?
-নাহ। আন্টিকে করিয়ে করব।
-ওহ আচ্ছা। কোনো কিছুর দরকার হলে আমায় বলবেন।
আর মা বেশি জ্বালাতন করছে না তো?
-জ্বালাতন করলেও উনিই এই বাড়িতে আমার একমাত্র আপনজন। আর আপনজনের জ্বালাতন সহ্য করা যায়।
.
এই বলে সে চলে যায়। নিহির তার কথায় এত গুরুত্ব না দিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। নাস্তা সেরে অফিসে যেতে হবে তাকে।
.
.
দুপুরের খাবার খেতে বসেছে নওয়াজ তার পরিবারের সঙ্গে। নওয়াজ কে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। নাসরিক আক্তার আন্দাজ করলেন, হয়তো কারও কাছ থেকে বুশরার ব্যাপারে জেনেছে। ব্যাপারটা খারাপও হয়নি। এতে তিনি আরও রসকষ মেশালে মন্দ হয় না। এই ভেবে তিনি ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন, পাশের বাড়ির বুশরা আছে না? কি কাণ্ড টায় না ঘটিয়েছে। এইজন্যই মা বাবা ছাড়া মেয়ে গুলো ভালো হয় না। সঠিক শিক্ষা পায় না তারা।
.
নওয়াজ কিছু না বলে নিজের দিকে প্লেট টেনে বাটি থেকে তাতে তরকারি তুলে নেয়। মা অনেক কিছুই রান্না করেছে। কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করছে না। না খেলে মা এর এত কষ্ট বৃথা যাবে। এই ভেবে খেতে এসেছে। কিন্তু বুশরা কে নিয়ে তার মাও এসব বলবে ভাবেনি।
তিনি বললেন, মাংসটা দিই?
-নাহ৷ আগে ভর্তা দিয়ে খাই।
.
তিনি একটু কেশে বললেন, বলছিলাম কি এইবার যখন এসেছিস বিয়েটা করে নে। আমেরিকা থেকে যখন তখন আসা যায় না। বিয়ে করে বউ রেখে গেলে, পরবর্তীতে বউ কেও নিয়ে যাবি।
.
নওয়াজের বোন নূরী হেসে বলল, বউ নিয়ে গেলে তুমি একা থাকবে কীভাবে?
-আমিও চলে যাব।
.
এই বলে তিনি হাসলেন। নূরি মুখ গোমড়া করে বলল, তবে আমি?
-শশুরবাড়িতে থাকবি তুই।
.
নওয়াজ বলল, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। অন্তত এখন আমার কোনো প্রিপারেশন নেই।
-তা বললে কী হয় বাবা? নূরীর বিয়েও দিতে হবে। একটা বউ নিয়ে আসলে ননদের বিয়েতে কত কাজে লাগবে ভেবেছিস? তাছাড়া নূরীকে বিয়ে দিয়ে আমিও একা হব না আর।
.
নূরী মুখ বাঁকিয়ে বলল, আমিও এত জলদি বিয়ে করব না।
-কবে করবি?
-অনার্স শেষে।
-কেনো? বুশরার মতো কাণ্ড ঘটানোর জন্য।
.
নূরী দাঁড়িয়ে পড়ে। খানিকটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, খালি ওই মেয়ের নামে কথা বলো। সত্য মিথ্যা তুমি নিজে জানো? সব শোনা কথা সবসময় সত্যি হয় না। আর সত্যি হলেও আমার সাথে মেলাচ্ছ কেনো? আমার তো মা বাবা দু’জনেই ছিল।
.
এই বলে সে চেয়ার টেনে একপাশে রেখে রুমে চলে যায়। তিনি নওয়াজের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখলি তো কেমন ব্যবহার হচ্ছে। মনে তো হচ্ছে তোর আগে ওকেই বিয়ে দিতে হবে।
.
মা আরও কিছু বলতে লাগলেন। কিন্তু কোনো কথাই নওয়াজের কানে গেল না। শুধুমাত্র নূরীর বলা কথাগুলো এখনো তার কানে বেজে চলেছে। সত্যতা যাচাই না করেই নওয়াজ ভুল বুঝলো না তো বুশরা কে? হয়তো বা। তায়শার সাথে দেখা করা প্রয়োজন তার। সে নিশ্চয় তার বোনের নামে মিথ্যা বলবে না!
.
.
বেশ কয়েকবার তায়শা কে ফোন করেছে নওয়াজ কিন্তু সে রিসিভ করে না। পরবর্তীতে সে নাফিশা কে ফোন করে তায়শা কোথায় জানতে চায়। নাফিশা বলল, সে বাসায় নেই। নাফিশার কাছে নওয়াজ কিছু জানতে চায় না। কারণ সে ছোট। তার কাছে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে বিবেক বাধা দিচ্ছে নওয়াজের। তবে সে তায়শা কোথায় গেছে তা জানতে চায়। নাফিশা জানায় সে শপিংমল এ গেছে। কোন শপিংমল এ গেছে এটাও সে জানায়। নওয়াজ দেরী না করে বেরিয়ে পড়ে। পথিমধ্যে সে তায়শা কে অবশ্য বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। তায়শা রিসিভ করেনি। যদিও নওয়াজ সে বাসায় আসা অবধি অপেক্ষা করতে পারতো। কিন্তু এখন একটা মিনিট তার শত বছরের মতো মনে হচ্ছে।
.
এদিকে শপিংমল এ পৌঁছে যায় তায়শা। অপরিচিত নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা কল দেখেও আগ্রহ দেখালো না সে। বাসায় গিয়ে ব্যাক করবে ভেবে সে নিহির কে ফোন দেয়। তাকে জানায় সে বান্ধবীর জন্মদিনের উপহার কিনতে শপিংমল এ এসেছে। নিহির শুনে বলল, ফ্রি থাকলে আমি আসব?
.
এটাই তো চেয়েছে তায়শা। নিহিরের মানসিকতা কেমন এটাও তার জানা দরকার। টাকা থাকলেই তো হবে না। খরচ করার মানসিকতা থাকতে হবে। আর আজই তা বোঝা যাবে। তায়শা তাকে আসতে বলে। নিহির এড্রেস শুনে বলল, আমার থেকে কাছেই। অপেক্ষা করো আসছি।
.
তায়শা শপিংমলের রেস্টুরেন্টে এসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে নিহিরের জন্য। এদিকে আবারও সে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। তায়শা এইবার বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। সাথে সাথেই সেখানে উপস্থিত হয় ওয়েটার। সে তায়শা কে বলল, ম্যাম কিছু লাগবে?
.
ফোনের ওপাশের কথা না শুনেই ওয়েটার কে তায়শা বলল, আপাতত ড্রিংকস নিয়ে আসুন।
তায়শা হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে যায়। তায়শা ব্যাক করলে ফোন বন্ধ পায়। হঠাৎ তায়শার মনে হয়, বুশরা ফোন দেয়নি তো? কিন্তু তৎক্ষনাৎ তার মনে পড়ে, বুশরা কেবল বাসার নাম্বারটাই মুখস্থ রেখেছিল। তবে কে ফোন করতে পারে?
.
এদিকে নওয়াজের ফোনে চার্জ না থাকার কারণে ফোনের লাইন কেটে গেছে। কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয় সে। তায়শা শপিংমল এর রেস্টুরেন্টে রয়েছে! এইবার দ্রুত তার কাছে পৌঁছানোর পালা…
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here