সেই তো এলে তুমি পর্ব_২

0
1680

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২
Saji Afroz

খালেকুজ্জামান নিহিরের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে বললেন, এভাবে মেয়ে তুলে আনা যায় না কি! অস্থির হইয়েন না। নিখিল বাচ্চা মানুষ। আপনিও তাই না কি?
-আমি নিখিলের বড়ো ভাই। ওর ভালো কোনটায় আমি বুঝি। একবার মেয়েটাকে নিয়ে আসলে বিয়ে দিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুর কম আছে আমাদের? নেই তো!
-ওর বাড়ির লোকের কাছে প্রস্তাব দিতে পারতেন?
-এই মুহুর্তে প্রস্তাব দিলে তারা রাজি হবে চাচা? হবে না। বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তার চেয়ে বরং আমি যেটা চাচ্ছি সেটাই করব। আমার শুধু আপনার সহায়তা লাগবে।
-আমি তো সবসময় আছি।
-আমি চাইনা কাজটা বাইরের কেউ করুক।
-তাহলে?
-আমি নিজেই করব।
.
তার কথা শুনে খালেকুজ্জামান হাসলেন। নিহির অবাক হয়ে বলল, হাসছেন যে?
-আপনিও আপনার বাবার মতো হয়েছেন। জানেন তো আপনার বাবাও কিন্তু আপনার মা কে জোর করে বিয়েটা করেছিল। পরে অবশ্য তাদের মিলমিশ হয়ে গিয়েছিল।
-এইজন্যই তো বলছি একবার বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
খালেকুজ্জামান এর মুখে মা এর কথা শুনে তার রুমের দিকে এগিয়ে যায় নিহির। আজ সারাদিন মা এর দেখা পায়নি সে। রুমে আসতেই দেখলো, তিনি বাবার একটি পাঞ্জাবি জড়িয়ে কিসব আবোলতাবোল বলে যাচ্ছেন। এমনি করেন তিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর তার এমন অবস্থা হয়েছে। যদিও চিকিৎসা করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। মাঝেমধ্যে মনেহয় এত টাকা দিয়ে কী হবে, নিজের মাকেই সুস্থ করতে পারছে না সে।
মা এর কাছে আর গেল না নিহির। এখন তার মাথায় চিন্তার পাহাড়৷ কীভাবে নিখিলকে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে এই অপেক্ষাতেই আছে সে। তার জন্য তাকে যা করতে হয় সবই করবে। এই ভেবে অফিসের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরুই সে।
.
.
শপিং শেষে বাসায় আসতেই আলিয়া খাতুন এগিয়ে এসে বললেন, তোরা কি কি কিনেছিস দেখি?
.
তিনি সব দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তায়শা বলল, নাফিশা মা কে সব দেখা তো। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।
.
এই বলে সে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তার পিছু নেয় বুশরা। তাকে থামিয়ে আলিয়া খাতুন বললেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? রাজ্যের কাজ পড়ে আছে বাসায়।
-আমিও ফ্রেশ হয়ে আসি ফুফু আম্মা। তারপর কাজে হাত লাগাচ্ছি।
-তাড়াতাড়ি আয়।
.
তায়শা ওয়াশরুমে যাচ্ছিলো। তাকে থামিয়ে বুশরা বলল, এইবার বল তো ঘটনা কি?
-কোন ঘটনা?
-তোকে কে, কেনো বিরক্ত করছে?
-ওহ নিখিলের কথা বলছিস আপু!
-নিখিল ফিখিল সেই যেই হোক! তোর সাথে কী সম্পর্ক?
-আমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক করার চেষ্টা করছে।
-মানে তোকে ডিস্টার্ব করছে?
-হু। ফেইসবুকে টুকটাক কথা হত। কতজনের সাথেই তো হাই হ্যালো হয়। ওইরকমই আরকি৷ এরপর যেই দেখলাম অন্য মতলব আমি বলে দিয়েছি সামনে ভাই আমার বিয়ে। কিন্তু ব্যাট্যা এটা জানার পরেই আমাকে প্রপোজ করে বসে। কেমন ছ্যাচড়া দেখো?
-তারপর?
-তারপর আরকি! সেই থেকে আমাকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। তুই বল এখানে আমার দোষ কোথায়? বিয়ে ঠিক আছে তা তো বলেছিই। হাই হ্যালো করলেই কী বিয়ে ভেঙে তার গলায় ঝুলে পড়তে হবে?
-অসভ্য ছেলে একটা। আশিককে সব বলা উচিত তোর।
-ওর মাথা গরম। কখন কী করে বসে। আমার মনেহয় এসব পাত্তা না দেওয়াই উত্তম। বিয়েতে ফোকাস করি, এসব বাদ দিই।
-কোনো ঝামেলা করলে?
-করবে না। আজ ওর ভাইকেও উচিত জবাব দিয়েছি আমি।
-খারাপ ব্যবহার করেছিস?
-হু।
-মোটেও ভালো করিসনি। বুঝিয়ে বলতে পারতি।
-এদেরকে বুঝিয়ে লাভ নেই। আর এসব ছাড় তো এখন। ভালো লাগছে না।
-ফ্রেশ হয়ে নে।
.
বুশরা বেরিয়ে রান্নাঘরে আসে। বেসিনেই হাত মুখ ধুয়ে নেয় সে। দুপুর হয়ে আসছে, অথচ ভাতটা অবধি রান্না হয়নি। ভাগ্যিস সকালে তরকারি কেটে গিয়েছিল। নাহলে বিকাল হয়ে গেলেও কারও পেটে খাবার যেত না। এই ভেবে তাড়াতাড়ি চুলোয় চাল বসিয়ে দেয় সে। আরেকটি চুলোয় দেয় তরকারি।
নাফিশা এসে তাকে নিজের ফোনটা দিয়ে বলল, নওয়াজ ভাই ফোন দিয়েছে।
.
নাফিশা সবেমাত্র কলেজে উঠেছে। আর বুশরা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। নাফিশার ফোন আছে। অথচ বুশরার নেই। ফুফু কড়াভাবে তাকে নিষেধ করেছে ফোন ব্যবহার না করতে৷ এতে করে না কি ঘরের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না সে৷ তাছাড়া ফোনে কারও সাথে আলাপ চালিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়াক এটা ফুফু চায়না। তাই তিনি বুশরাকে ফোন ব্যবহার করতে দেন না। কিন্তু সে ঠিকই তায়শা বা নাফিশার ফোন থেকে মাঝেমধ্যে নওয়াজের সাথে কথা বলে। খুব বেশি কথা না হলেও সে সন্তুষ্ট। সম্পর্কে যে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে হবে তার কোনো দরকার আছে বলে সে মনে করে না। সারাদিনে একটিবার মানুষটির কণ্ঠ শুনতে পেলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়।
বুশরা দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে বলল, হ্যালো নওয়াজ?
.
নাফিশা চলে যায়। ওপাশ থেকে নওয়াজ বলল
-কেমন আছ?
-ভালো। তুমি?
-ভালো।
.
আর কিছু বলার আগেই আলিয়া খাতুন রান্নাঘরে চলে আসেন। তার উপস্থিতি টের পেয়ে বুশরা ফোনের লাইন তো কাটতে পেরেছে কিন্তু ফোন লুকোতে সক্ষম হয়নি। তার হাতে ফোন দেখেই তিনি গজগজ করতে করতে বললেন, রাজ্যের কাজ পড়ে আছে আর তিনি ফোন নিয়ে ব্যস্ত।
-আমি সব চুলোতে দিয়ে দিয়েছি।
-চুলোতে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ফোন টিপতে হবে? বাসায় আর কোনো কাজ নেই? ঘরটা মুছে দিলেও পারতি। আর তোকে আমি ফোন হাতে নিতে না করেছি না? কার ফোন নিয়েছিস?
-নাফিশার।
.
নাফিশাকে গলা হাঁকিয়ে ডাকলেন তিনি। সে ছুটে আসতেই তিনি বললেন, ফোন কোথায় থাকে দেখিস না?
-আপু রান্না বসিয়েছিল তো, আমি বললাম গেইম খেলতে রান্না দেখে দেখে৷ সময় কাটবে।
-আর কখনো তোর ফোন ওর হাতে দেখলে তোর থেকেও ফোন কেড়ে নেব।
.
বুশরার হাত থেকে সে ফোন নিয়ে দ্রুত চলে যায়। তিনি বললেন, ঘর মুছে সবাইকে খেতে দে। তারপর গোসল করে তুই খেয়ে নিস।
.
এই বলে তিনি চলে যান।
.
বুশরার চোখে পানি চলে আসলো। তার ফুফাও তার সাথে এমনি আচরণ করেন। কিন্তু ফুফু তো তার নিজের কেউ। তারপরেও এমন করেন কেনো! তায়শার কাছ থেকে শুনেছে তার বাবা তার খরচের জন্য প্রতিমাসেই টাকা পাঠান। খবর না নিলেও এটা করতে ভুলেন না তিনি। তবুও এই বাড়িতে সে বোঝা হয়ে আছে। তার খুব কষ্ট হয়। নওয়াজ দেশে ফিরলে হয়তো এর শেষ হবে।
তুমি কবে দেশে ফিরবে নওয়াজ! এই বলে সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। জানেনা তার এই কান্নার সমাপ্তি আদৌ হবে কি না।
.
.
সবাই খাওয়া শেষে বুশরা গোসল করতে যাচ্ছে। সেই সময় তার ফুফু এসে বললেন, আমার মেয়ের জামাই এর এত টাকা খরচ করতে তোর লজ্জা করলো না? আরে সম্পর্কে তুই ওর বড়ো হোস। ঢ্যাং ঢ্যাং করে শপিং তো করতে গেলি। সাথে এত টাকা দামের জামা, জুতা নিয়ে এলি! কি কাণ্ডরে বাবা।
.
তায়শা বিছানায় শুয়ে ছিল। মা এর কথা শুনে উঠে বসে বলল, এসব কি ধরনের কথাবার্তা? আমার বোন হয় ও৷ আর বোনের জামাই যদি শখ করে কিছু নিয়ে দেয় তাতে সমস্যা কি?
-তাই বলে এত দামি! আমি তো ভেবেছিলাম সেটাও তোর। এখন বুশরাকে নিজের কাছে নেওয়ার সময় বুঝলাম।
.
বুশরা ক্ষীণস্বরে বলল, আমার লাগবে না। তায়শায় রাখুক ওটা।
-এহ! ন্যাকামি। নিয়ে এসে এখন ঢং করা হচ্ছে।
.
তায়শা রেগেমেগে বলল, তুমি বুশরা আপুকে আরেকটা কথা বললে ভালো হবে না বললাম। আশিক একজন ব্যাংকার ছেলে। তার অনেক টাকা পয়সা আছে। ওর টাকা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।
-বেশি মাথায় তুলছিস তো ওকে। দেখবি ওর জন্যই তোর সবচেয়ে বড় ক্ষতি টা হবে।
.
তিনি চলে গেলে মুখে ওড়না চেপে কাঁদতে শুরু করে বুশরা। তায়শা তাকে শান্তনা দিলে সে বলল-
কেনো ফুফু আমাকে এত ঘৃণা করে, কেনো!
.
.
বিকেলের দিকে তায়শা টেইলর এ আসে কাপড় সেলাতে দিতে। আর তখনি এই এলাকায় গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে নিহির। তার উদ্দেশ্য তায়শার বাড়ি চেনে যাওয়া।
টেইলর এ তায়শা একাই এসেছে। নাফিশা স্যারের কাছে পড়তে গেছে। আর বুশরা তার ফুফুর ভয়ে বের হতে চায়নি। বাসায় অনেক কাজ বলে থেকে গেছে।
লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে তায়শাদের বাসা চেনে নেয় নিহির। বেশকিছুক্ষণ গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়ির সামনে বসে ছিল সে। দোতলা হলেও আকারে ছোট বাড়িটি। ডিজাইনটাও বেশ পুরাতন। কি দেখে যে তার ভাই এই মেয়েকে পছন্দ করেছে সে বুঝতে পারছে না। হতাশ হয়ে সে ফিরে যেতে থাকে। কিন্তু পথে তাকে গাড়ি থামাতে হয়। একটি মেয়ের দিকে তার চোখ গিয়ে আটকায়। কয়েকটি ছোট মেয়ের সাথে খিলখিল করে হাসছে সে। কি সুন্দর হাসি, আর মেয়েটাও কত সুন্দর!
নিহির গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
দুধে আলতা গায়ের রঙ তার, চুল গুলো কোকড়ানো, সাদা রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পরেছে সে। গায়ের রঙের সাথে কামিজের রঙটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আর মেয়েটার হাসির শব্দটাও অদ্ভুত রকমের সুন্দর!
তায়শা খেয়াল করলো তার দিকে গাড়ির ভেতরে থাকা একটি ছেলে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। সে আরেকটু খেয়াল করে দেখে ছেলেটি কে। বেশ হ্যান্ডসাম ছেলে তো! এই এলাকায় প্রথম দেখছে। কিন্তু তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো!
সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মেয়েগুলোকে বলল, আমি আসি রে এখন।
সে চলে যেতে থাকে। একটু গিয়ে পেছনে ফিরে দেখে ছেলেটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তায়শা লজ্জা পায়। কিন্তু তার মনের মাঝেও ভালো লাগা কাজ করছে। এমন সুদর্শন এক পুরুষ এভাবে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে, লজ্জা পাওয়ারই কথা।
.
মেয়েটিকে যতটুক দেখা যায় দাঁড়িয়ে দেখেছে নিহির। এরপর হেসে গাড়িতে উঠে বসে। এসেছিল এখানে অনেকটা রাগ নিয়ে। কিন্তু তার এই রাগ যে কেউ কমিয়ে ফেলবে ভাবতেও পারেনি সে।
.
চলবে
.
বিঃদ্রঃ গল্প পড়ে কমেন্ট/মন্তব্য করতে ভুলবেন না। আপনাদের মন্তব্য পেলে লেখার আগ্রহ বাড়ে৷ এইবার নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব। তাই মন্তব্য করে পাশে থাকবেন। 🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here