সেই তো এলে তুমি পর্ব_৩

0
1258

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩
#Saji_Afroz

বাসায় এসে গায়ের ওড়নাটা বিছানার উপরে রেখে ছুড়ে আয়নার সামনে আসে তায়শা। সবাই বলে, সে দেখতে একদম পরীর মতো হয়েছে। ডানা কাটা পরী! তাই তো যেই দেখে তাকে চোখ সরাতে পারেনা। সবসময় ভাবতো এক রাজকুমারের ঘরের বউ হবে সে। কিন্তু যতই সুন্দরী হোক না কেনো, সেই রাজকুমারের দেখা সে পায়নি। সুদর্শন অনেক পুরুষ আসলেও টাকা পয়সার দিক থেকে সবাই ছিল পিছিয়ে। আশিকের প্রস্তাবটা পারিবারিক ভাবেই এসেছে। খারাপ না তবে খুব একটা ভালোও না। ব্যাংকার ছেলে, দেখতেও ভালো। চলে!
এই ভেবে রাজি হয়ে যায় তায়শা। কিন্তু আজ! আজ কি দেখলো সে? এত বড় গাড়ি থেকে নেমে সুন্দর এক ছেলে স্যূট টাই পরে এক ছেলে তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিল!
ইশ! মাথাটায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। আশিকের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে ভুল করলো না তো সে?
-কাপড় গুলো তাড়াতাড়ি দিতে বলিস নি?
.
বুশরার প্রশ্নে তার দিকে তাকিয়ে তায়শা জিজ্ঞাসা করলো, আমার কি বিয়েটা আরও পরে করা উচিত ছিল? না মানে আরও ভালো কাউকে পেতাম হয়তো।
.
বুশরা একটু ভেবে বলল, মোটেও না। ভালো তো দুনিয়াতে অনেক আছে রে। ভালোর শেষ নেই। কিন্তু তোর জন্য যেটা ভালো সেটাই তোর কাছে ধরা দিয়েছে৷ হঠাৎ এমন কেনো বলছিস?
.
বিছানার উপরে বুশরাকে বসিয়ে তাকে একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা বুঝিয়ে বলল তায়শা। বুশরা তা শুনে হেসে ফেললো৷ হাসতে হাসতেই বলল, আরে পাগলী সে শুধুই তাকিয়েছে৷ তোর সম্পর্কে কিছুই জানেনা। দূর থেকে দেখতে সব জিনিসই সুন্দর।
-আমি কি কাছ থেকে অসুন্দর?
-সুন্দর শুধু চেহারার দিকে হয়না। যেমন ধর সে বড়োলোক আমরা নই। এটা জেনেও হয়তো পিছপা হতে পারে।
-তা ঠিক বলেছিস। কিন্তু ছেলেটার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে রে। এমন একটা ছেলে যদি আমার বর হতো!
-হুশ! আশিক ভাইকে নিয়ে ভাব এখন। উনার সাথে তুই অনেক সুখে থাকবি। আর দেখবি উনিও গাড়ি কিনতে পারবেন।
-সত্যি বলছিস?
-একদম।
.
তায়শা মাথাটা ঝেড়ে বলল, হাবিজাবি সব বাদ, এখন আশিক শুধুই আমার।
.
.
আজ রাত করেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে নিহির। তার চাচী সেনোয়ারা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন। তাকে দেখে নিহির বলল, ঘুমাননি?
-তোকে খেতে না দিয়ে কীভাবে ঘুমাই?
-ওহ চাচী! কতবার বলেছি বুয়াকে সব বুঝিয়ে দিয়ে তুমি ঘুমিয়ে যেও।
-ছেলে বাসায় না আসলে মা এর ঘুম কীভাবে হবে?
-আমি যে খেয়ে এসেছি!
-এত রাত হয়েছে খিদা পাওয়ারই কথা। ভালোই হলো খেয়ে নিয়েছিস।
-জি।
-একটু বয় তো আমার পাশে।
.
নিহির এসে তার পাশে বসলো। তিনি বললেন, ভাবছি ঘরে নতুন সদস্য আসা দরকার৷ ঘরটা খালি খালি লাগে।
-ঠিক বুঝলাম না।
-আমার বড়ো ছেলেকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি৷ সহজ কথায় বুঝেছিস?
.
নিহির হেসে ফেললো।
সেনোয়ারা বেগম বললেন, মেয়ে কী দেখব না কি আছে কোনো পছন্দ?
-সেভাবে নেই আবার আছেও!
-থাকলে আমারও কষ্ট কম। মেয়ে খুঁজাখুঁজি করতে হবে না।
-তোমার কথা আমি মাথায় রাখব। তবে আমার কিছুদিন সময় দরকার। একটা দরকারী কাজ আছে। ওটা শেষ করে নিই। এরপর না হয় এসব নিয়ে ভেবো?
-ঠিক আছে। কিন্তু আমার তাড়া আছে। একা একা আর ভালো লাগে না। তোর মা তো থেকেও নেই।
.
এই বলে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললেন তিনি। নিহির বলল, আমি বুঝি তোমার কষ্টটাও।
.
এই বলে সে উঠে নিজের রুমে আসে। ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ে সে৷ চোখ বন্ধ করতেই সেই মেয়েটির হাসিমাখা মুখটা দেখতে পায়। সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলে নিহির৷ কি আছে মেয়েটির মাঝে? যা কে প্রথম দেখাতেই এত ভালো লেগে গেছে তার!
.
.
আশিকের সাথে ফোনে কথা বলছে তায়শা। নাফিশা ঘুমিয়ে গেছে। বাড়ির সব কাজ শেষ করে রুমে আসে বুশরা। তিন বোনই একই রুমে থাকে।
বুশরা ফ্রেশ হয়ে এসে দরজা টেনে দেয়৷ এরপর নাফিশার মোবাইল নিয়ে ফোন দেয় নওয়াজকে। নওয়াজ ফোন কেটে সেদিক থেকে ব্যাক করে। প্রায় সাথে সাথেই সে রিসিভ করে বলল, হ্যালো নওয়াজ?
-তখন কেউ চলে এসেছিল বুঝি?
-হু। ফুফু আম্মা।
-আমি বুঝিনা উনারা এমন কেনো! নাফিশার ফোন আছে তোমার নেই। কতবার বলেছি আমি একটা পাঠাই।
-তার দরকার নেই। এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
-নিজে কিনেছ বলবে।
-সামান্য টিউশনি করে কি ফোন কেনা যায়? তাছাড়া তারা চায়না আমি ফোন ইউজ করি।
-রেজাল্ট দিয়ে নিক। আমি জানি তুমি ভালোই করবে। এরপর একটা জব করবে। আমি ফোন পাঠাব। তখন বলবে জবের জন্য ফোন দরকার আছে।
-আচ্ছা।
-আমি আসলে জবও করতে হবে না তোমায়।
-তুমি কবে আসবে?
-ডুবাই এসেছিও আমি বেশিদিন হচ্ছে না। মাত্র দেড় বছর। আরেকটু সবুর করো।
-করছি।
.
বুশরার পাশের বাড়িটায় নওয়াজের বাড়ি। নওয়াজ তাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করলেও কখনো কিছু বলেনি। বুশরা তাকে নওয়াজ ভাই বলে ডাকতো।
দেড় বছর আগে ডুবাই যাওয়ার সময় তায়শার ফোন নাম্বার নিয়ে যায় সে। যাওয়ার আগে তায়শাকে মনের কথা জানায়। তায়শার মাধ্যমেই তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়। প্রেমের শুরুতেও বুশরা বারবার তাকে নওয়াজ ভাই বলে ডাকতো। ইদানীং তা অনেকটায় কমেছে।
নওয়াজের মাঝেমধ্যে আফসোস হয়। দেশে থাকতেই মনের কথা বুশরাকে জানালে ভালো কিছু সময় কাটাতে পারতো তারা।
.
.
রাতে বাইক নিয়ে তায়শার বাড়ির সামনে চলে আসে নিখিল। তায়শাদের রুমটা দোতলায়। সে আশিকের সাথে কথা বলছিল। সে সময় জানালা দিয়ে খেয়াল করলো, বাইক নিয়ে নিখিল দাঁড়িয়ে আছে। তায়শার রাগ হলেও নিজেকে সামলে নেয় সে। ইচ্ছে করেই বারান্দায় আসে। তাকে দেখে নিখিলও ইশারা করে। কিন্তু তায়শা তা না দেখার ভান করে আশিকের সাথে কথা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে সে আশিককে ফোনের মধ্যেই চুমু দেয়। মূলত সে এটি ইচ্ছে করেই করেছে নিখিলকে দেখিয়ে।
নিখিলের সারা শরীর রাগে কাঁপতে থাকে। সে আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে চলে যায় সেখান থেকে। এদিকে তার চলে যাওয়া দেখে তায়শা হাসে। আর আপনমনে বলল, এমন ছ্যাচড়া আর দু’টো দেখিনি!
.
.
সকালে নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে নিহির। সেই সময়ে তাকে থামিয়ে খালেকুজ্জামান জিজ্ঞাসা করলেন, কবে মেয়েটিকে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন?
-বিয়ের দিন।
-বিয়ের দিন? মানে আর দু’দিন পরেই।
-সেদিন আনলেই মেয়েটিকে অন্য কেউ বিয়ে করতে রাজি হবে না। বিষয়টা জানাজানিও হবে।
-কিন্তু তারা যদি পুলিশের ঝামেলা করে?
-মেয়ের বাবার এত ক্ষমতা নেই।
-ওহ।
.
নিহির গাড়িতে উঠে বসে। খালেকুজ্জামান এর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। জানেনা কি হতে চলেছে সামনে।
.
.
সেনোয়ারা বেগম নাস্তা নিয়ে কয়েকবার নিখিলের রুমের সামনে এসেছেন। কিন্তু সে দরজা খুলেনি। বারবার বলেছে তাকে যেন বিরক্ত না করে। ছেলেটার হঠাৎ কি হলো কে জানে!
এদিকে নিখিল সারারাত ঘুমোতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলেই আশিককে করা তায়শার সেই চুমুর কথা মনে পড়ছে।
আচ্ছা, তারা কি একে অপরকে সরাসরিও চুমু করেছে?
এটা ভাবতেই নিখিলের রাগ হতে থাকে।
ভালো যদি অন্যজনকেই বাসবে তবে কেনো তাকে তৃতীয়জন হিসেবে বেছে নিয়েছিল!
নিখিল ইজি চেয়ারটায় এসে বসে৷ চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে তায়শার সাথে কাটানো দিনগুলো।
.
বেশিদিন নয়। মাত্র বিশদিন আগে তায়শাকে একটি শপিংমলে দেখে নিখিল। তখনি তার ভালো লেগে যায়। তার পিছু নিয়ে বাড়িটিও চেনে যায়৷ আর টাকার জোরে এলাকার ছেলেদের কাছ থেকে জেনে নেয় ফেইসবুক আইডি৷ পরেরদিন রাতেই তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেও একসেপ্ট করে না। তাই সে নিজেই অনেকগুলো মেসেজ দিতে থাকে৷ এতগুলা মেসেজ পেয়ে রিপ্লাই দেয় তায়শা-
হ্যালো! কে আপনি!
-অবশেষে রিপ্লাই পেলাম।
শান্তি লাগছে।
-আপনার পরিচয়?
-আপনি পরিচয় দিলে নতুন একটা পরিচয় পাব।
-মানে?
-ফোন নাম্বার পেতে পারি?
-অপরিচিত কাউকে নাম্বার কেনো দেব?
-দেবেন। আমি জানি নিশ্চয় দেবেন।
.
আশিকের ফোন আসে। তায়শা বিরক্ত হয়ে নিখিলকে ব্লক দেয়। নিশ্চয় কোনো বখাটে হবে। সে তার প্রোফাইলটা অবধি দেখেনি।
এদিকে নিখিল হতাশ হয়ে যায়। দুষ্টুমি না করে পরিচয়টা দিলেই তো হত!
তবে নিখিল হার মানেনি। পরেরদিন একগাদা উপহার নিয়ে পাঠিয়ে দেয় তায়শার বাড়ি।
দরজা কড়া নাড়তেই বুশরা এসে দরজা খুলে দেয়। কুরিয়ার বয় একটা বড় প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল, তায়শা কে? উনার জন্য উপহার এসেছে।
-কে পাঠিয়েছে?
-নাম নেই।
.
বুশরা ভেবেছে হয়তো আশিক পাঠিয়েছে। সে বড়ো প্যাকেট টা এনে তায়শাকে দেয়। তায়শাও বেশ অবাক হয়। আলিয়া খাতুন ও নাফিশাও দেখতে চলে আসে প্যাকেটের ভেতরে কি আছে।
সে প্যাকেট খুলে। প্রথমেই একটি চিরকুট দেখতে পায়। তা সে নিজের কাছে রেখে বলল, পারসোনাল জিনিস।
.
এরপর দেখলো অনেক গুলো দামি চকোলেট, একটি সুন্দর গাউন, তার সাথে মিলিয়ে গহনা ও জুতো। সাথে রয়েছে কিছু ফুল। আলিয়া খাতুন খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন, দেখেছিস? আশিক কত ভালো ছেলে।
.
তায়শাও বেশ খুশি হয়ে যায়। সে খুশিতে গদগদ হয়ে চিরকুটটি খুললো। কিন্তু তাতে লেখা ছিল-
নিখিলের তরফ থেকে পাঠানো সামান্য উপহার। ভালো লাগলে এই নাম্বারে একটা ফোন দিও।
.
একটি নাম্বারও দেয় সে।
বুশরা বলল, কি লিখেছে ভাইয়া?
.
তায়শা আমতাআমতা করে বলল, সেটা তোদের বলা যাবে না কি।
.
এতগুলো সুন্দর উপহার পেয়ে তায়শা আসলেই অনেক খুশি হয়। তাই সে রাতে সেই নাম্বারে ফোন দেয়।
অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠে নিখিল। এটা নিশ্চয় তায়শা হবে! এটার অপেক্ষাতেই তো ছিল সে। রিসিভ করে হতাশ হলো না নিখিল। তায়শা ফোন করেছে জেনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।
তায়শা বলল, মেয়ে দেখি ভালোই পটাতে পারেন।
-পটাতে আসিনি আমি।
-তবে?
-বুঝাতে এসেছি। ভালোবাসা বুঝাতে এসেছি।
.
তায়শা হাসলো। নিখিল বলল, উপহার পছন্দ হয়েছে?
-হু। তবে গাউনটার রঙ গোলাপি হলে আরও বেশি ভালো হত।
-আসলে আপনার প্রিয় রঙ সম্পর্কে ধারণা ছিল না আমার।
-সমস্যা নেই।
.
সেই রাতে একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে নেয়। তবে আশিকের ফোন আসায় নিখিলের সাথে আর খুব বেশি সময় কথা বলেনি তায়শা।
নিখিলের ফোন রেখে আপনমনে বলল, শুধুমাত্র এতগুলা উপহার পাঠিয়েছে বলে একটু কথা বললাম। নাহলে কে পাত্তা দিচ্ছে!
.
তবে পরেরদিন তায়শা এতবেশি অবাক হয়ে যায় যে, এমন কিছু ঘটবে সে আশাও করেনি। নিখিল তার জন্য আবারও উপহার পাঠিয়েছে। আর তা হলো গোলাপি রঙের গাউন! গতকাল সে বলেছিল তার পছন্দ গোলাপি রঙ।
বাড়ির সবাই জানে এসব আশিক পাঠিয়েছে। সত্যিটা কেবল তায়শা জানে।
নিখিলের এমন কাণ্ডে মনের অজান্তেই তার ভেতরে লোভের জন্ম নেয়। তাই সে রাতে আবারও ফোন দেয় নিখিলকে। আর আজ আশিকের সাথেও কথা না বলে সারারাত সময় দিয়েছে নিখিলকে। তার কি পছন্দ অপছন্দ সবটা জানিয়েছে তাকে। আর সেই থেকে শুরু হয় তাদের ফোন আলাপ।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here