#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩২
#Saji_Afroz
নওয়াজ বাড়িতে প্রবেশ করার সময় হোঁচট খেয়ে মেঝেতে প্রায় পড়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনি তাকে তার মা ধরে ফেললেন। তিনি চিন্তিত কণ্ঠে বললেন-
আহ বাবা! সাবধানে চলাফেরা কর।
.
দরজার সাথে লেগে নওয়াজের পা খানিকটা ছিড়ে গেছে। যেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। তা দেখে তিনি তানিশাকে চেঁচিয়ে ডাকলেন। নওয়াজ বলল, ওকে ডাকছ কেনো?
-তুই এসে বস তো। পায়ে কেটেছে দেখেছিস?
-সামান্যই!
.
তানিশা দেখে বলল-
সামান্য কিছু থেকেও বড়ো কিছু হতে পারে।
আপনি বসুন আমি আসছি।
.
এই বলে ভেতর থেকে তানিশা ফার্স্ট এইড বাক্স নিয়ে আসে। খুব যত্ন করে নওয়াজের ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে তাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। এরপর নওয়াজকে রুমে গিয়ে আরাম করতে বলে।
নওয়াজ রুমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। তার মাথায় অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে কী করবে এই নিয়ে চিন্তিতও রয়েছে সে। কিডন্যাপের মতো কাজটা কী নিজে করবে না কি কাউকে ঠিক করবে? নাহ … লোক ঠিক করলে নানা ধরনের ভেজালে পড়তে হয়। টাকা পয়সাও খরচ হয়। নিহিরের মতো বড়ো মানুষ যদি এমন কাজ করতে পারে, সে কেনো পারবে না! তায়শার সহযোগিতায় কাজটা সহজ হতে পারে। তবুও চিন্তাটা থেকে যায়। এমন কাজ যে আগে কখনো করেনি নওয়াজ।
এসব ভাবতে ভাবতে নওয়াজের মাথা ভার হয়ে আসে। চারদিক ঝাপসা দেখছে সে। মুহুর্তের মাঝেই মাথা ব্যথা শুরু হয় তার। মনে হচ্ছে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে। নিজের মাথা দু’হাতে চেপে ধরে মা কে ডাকলো নওয়াজ। তিনি ওয়াশরুমে থাকাতে শুনতে পাননি। তানিশা শুনে ছুটে আসলো। নওয়াজকে এভাবে দেখে ঘাবড়ে যায় সে। কাছে এসে বলল-
কিছু লাগবে আপনার?
-এক কাপ গরম চা। আমার মাথাটা ব্যথা করছে। বোধহয় চা খেলে ভালো লাগবে।
.
তানিশা তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে আসলো। দ্রুত চা বানিয়ে নওয়াজের কাছে ছুটে যায় সে।
নওয়াজ তাকে দেখে উঠে বসে। সময় নিয়ে চা পান করে শুয়ে পড়ে। তানিশা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখলো নওয়াজের চোখ পেয়ে পানি পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। ব্যথার যন্ত্রণায় নওয়াজ ছটফট করছে।
তানিশা নিজের রুমে এসে একটা টাইগার বাল্ম নেয়। এরপর নওয়াজের কাছে এসে তার মাথার কাছে বসে পড়ে৷ মাথায় তা লাগিয়ে দিতে থাকলে নওয়াজ বলল, কী করছ?
-মাথা টিপে দেব৷ ভালো লাগবে।
-মা কে পাঠাও। তুমি যাও।
-আমি আপনার সাথে রোমান্স করছি না যে আপনার লজ্জা লাগবে। মাথা টিপি দিচ্ছি জাস্ট। এই সামান্য কাজে মা কে কেনো দরকার?
-বকবক করে আমার মাথা খেওনা। এমনিতেই ব্যথা করছে।
-আমি শুরু করেছি? চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমার কাজ আমায় করতে দিন।
.
আসলেই তানিশার হাতের ছোঁয়াই নওয়াজের মাথাটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। সে আরামে চোখ বুজে নেয়। আড়াল থেকে সেই দৃশ্য দেখে নওয়াজের মা এর চোখে পানি চলে আসে। দুটিকে কত ভালোই না মানিয়েছে। সারা জীবন যদি তারা একসাথে থাকতো!
.
.
বুশরা বাড়ি প্রবেশ করতেই তায়শা তাকে আটকালো। সে ব্যঙ্গ করে বলল-
ভেবেছিলাম তোমায় আসতেই দেবে না নিহির।
-তিনি বাসায় ছিলেন না।
-নাহলে বুঝি আটকাতেন?
.
এই বলে হাসলো তায়শা। বুশরাও মুচকি হেসে বলল, সে তো তোকেও আটকায়নি। কই! আমি তো এভাবে হাসিনি! বরং তোর দুঃখে দুঃখ পেয়েছিলাম।
-দুঃখ পেয়ে নিহিরকে বিয়েই করে নিচ্ছ?
-করিনি তো! একবারও আমি বলেছি তাকে বিয়ে করব বা করতে চাই? তিনি বলেছেন। আর সেইজন্য দায়ী তুই নিজেই।
-তুমি কী চাচ্ছ? চুপচাপ তোমাদের লীলা খেলা দেখে যাব আমি?
-লীলা খেলা আর আমি! ওটাই তুই ভালো খেলতে পারিস বোন। আমার চাওয়া না চাওয়া তে কী আসে যায়? আমি তো চাই তুই এখন এসব খেলা-টেলা বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যা। আর অন্যের লাইফ নিয়ে পড়ে না থেকে নিজের লাইফটা গোছানো শুরু কর।
.
এই বলে বুশরা ভেতরে চলে যায়। তায়শা রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল-
আচ্ছা তাই! আমি তো ভালো হব না। যতদিন না তুমি আমাকে ভালো হতে দিচ্ছ ভালো আমি হব না। তোমাকেও দেখে নেব আমি।
.
পেছন থেকে এসব শুনে নাফিশা বলল-
এর আগেও তুই বুশরা আপির নামে আজেবাজে কথা বলে ওর ভালোবাসাটা ছিনিয়ে নিয়েছিস। এসব করে নিজেরই ক্ষতি হয়েছে তোর। হয়নি? তবুও তোর শিক্ষা হবে না?
.
নাফিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুশরার কাছে যায় তাকে শান্তনা দিতে।
তায়শা কিছু একটা ভেবে তার পিছু নেয়।
নাফিশার সাথে সেও বুশরার পাশে এসে বসলো। বুশরার চোখে পানি। তায়শাকে দেখে চোখের পানি লুকোনোর চেষ্টা করলো সে। আর অভিমানী স্বরে বলল, আবার কেনো এসেছিস?
-ক্ষমা চাইতে।
.
নাফিশা ও বুশরা দু’জনেই অবাক চোখে তায়শার দিকে তাকালো। তায়শা বলল, আসলে আমি রাগ থেকে এসব বলেছি। এখন তো তুমি ফোনটাও ফেরত দিয়ে এসেছ। আর কোনো রাগ আমার মধ্যে নেই। যা করেছি তার জন্য লজ্জিত। সবটা নিহিরকে পাওয়ার জন্য করেছিলাম। এখন ওসব থেকে সরে আসতে চাই আমি। প্লিজ আপু মাফ করে দাও। আগের মতো হয়ে যাই আমরা। প্লিজ?
.
তায়শার কথা শুনে বুশরার নরম মনটা সহজেই গলে গেল। বোনকে আদরে জড়িয়ে ধরলো সে। তায়শাও গভীর মমতা অনুভব করলো বুশরার প্রতি।
সে যা করতে চলেছে তা সঠিক না কী ভুল তা সে জানেনা। শুধু জানে, এতে করে বুশরা নওয়াজকে ফিরে পাবে আর তায়শা নিহিরের মনে জায়গা করার আরেকটা সুযোগ পাবে! আর এইজন্য বুশরার সাথে ভালো হয়ে যাওয়াটা তার প্রয়োজন ছিল। নাহলে কাজটা করতে তার কষ্ট হবে।
.
.
নওয়াজের ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। আজ সারাটা দিন ঘুমিয়েছে সে। ঘুম ভাঙতেই উঠে বসলো নওয়াজ। মাথাটা হালকা লাগছে তার। ব্যথা একেবারেই চলে গেছে। কী অসহ্য যন্ত্রণা টায় হচ্ছিল!
হঠাৎ তানিশার আগমন ঘটলো। নওয়াজকে উঠে বসতে দেখে সে বলল-
এখন কেমন লাগছে?
-ভালোই।
-ব্যথা আছে?
-নাহ নেই।
-চা দিই?
-ভালো হয়।
-খিদে পায়নি? খাননি কিছু।
-পেয়েছে কিছুটা।
-আচ্ছা। নাস্তা রেডি করে রেখেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।
.
তানিশা চা নাস্তা টেবিলে সাজায়। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে রাতের খাবার তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নওয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসলে তার মা বলল-
মেয়েটা সারাদিনে কতবার যে তোর রুমে গিয়ে উঁকি মেরেছে!
.
নওয়াজ ভ্রু কুচকে বলল-
কেনো?
-তুই উঠেছিস কি না, কোনোকিছুর প্রয়োজন কি না; তোর খারাপ লাগছে কি না এসবের জন্য। কতক্ষণ তোর মাথা টিপেছে জানিস! তুই তো ঘুম। পরে আমি গিয়ে নিয়ে আসলাম ওরে। এরপর আবার নাস্তা তৈরী করে রেখেছে।এখন গেছে রাতের খাবার রান্না করতে। সারাদিন কিছু খাসনি বলে তোর প্রিয় রান্না করতে গেল। যাতে পেট ভরে খেতে পারিস।
-এসবের কোনো প্রয়োজন নেই মা। এত মায়া বাড়িও না। তিন মাস শেষ হলেই সব শেষ।
.
কথাটি শুনে তার মুখে অন্ধকার নেমে এলো। এই ছেলের মন কী গলবে না কখনো!
.
.
নিহির বাসায় এসে জানলো, বুশরা তার ফোন ফেরত দিয়ে গেছে। সেনোয়ারা বেগম ফোনটি নিহিরের তাকে দিয়ে চলে গেলেন।
ফোন হাতে নিয়ে অভিমানি চোখে তাকিয়ে রইলো নিহির। বুশরা তাকে ফোন ফেরত দেবে এটা অন্তত জানাতে পারতো! সে এমনটা করেনি। হয়তো কোনো সমস্যা পড়ে সে এটা করেছে। কিন্তু তার সমস্যা কী তা নিহিরকে জানানো যায় না? এখনো কী এতটুকুও সে বুশরার আপন হয়ে উঠতে পারেনি?
.
.
রাতে তায়শার ফোন পেয়ে নিজের রুমের বারান্দায় চলে আসে নওয়াজ। তায়শা বলল, সব ঠিকঠাক। ওর কাছে ফোনও নেই। আপনি কখন কাজটা করতে পারবেন?
-যত দ্রুত সম্ভব আমি করতে চাই। যদিও কিডন্যাপের মতো কাজ আমি প্রথমবার করতে যাচ্ছি, কিন্তু ভালোবাসার মানুষকেই তো কাছে আনব তা ভেবে সাহস পাচ্ছি। যাই হোক, বুশরাকে কিন্তু গাড়ি অবধি তোমাকেই আনতে হবে।
-হ্যাঁ আনব আমি। কিন্তু বাকি কাজ আপনার।
-তবে কাল বিকেলে প্লান করো।
-শিওর?
-হু। ওকে কাছে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে আর দমিয়ে রাখতে পারছি না। কিছুদিনের জন্য দু’জনে অনেক দূরে চলে যাব।
-ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। আপনিও তৈরী হয়ে নিন। কাল কথা হচ্ছে।
.
রাতের খাবারের পর নওয়াজের জন্য গরুর দুধ গরম করে তার রুমে এসেছিল তানিশা। তার শরীর খারাপ বলে নিজে বের হয়ে গরুর দুধ খুঁজে এনেছে সে।
কিন্তু এখানে এসে তায়শার সাথে নওয়াজের ফোনে কথোপকথন শুনে ফেললো তানিশা। সে টেবিলের উপরে দুধের মগটা রেখে নিজের রুমে চলে আসে।
ধপাস করে বিছানার বসে পড়ে সে।
নওয়াজের মন পেতে এই ক’দিন কী না করেছে সে! কিন্তু কী হলো? ফলাফল শূন্য। তানিশার ভালোবাসার কোনো মূল্যই তার কাছে নেই। বুশরাতেই আঁটকে আছে সে। তাই তো তাকে কিডন্যাপ করে হলেও পেতে চায় নওয়াজ। এসব ভেবে কাঁদতে থাকে তানিশা। কী করবে বুঝতে পারে না সে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে সকালে। ঘুম ভাঙতেই এক লাফে উঠে বসে তানিশা। বুশরার বলা কথাগুলো মনে পড়ে তার। বুশরা তো নওয়াজকে চায় না এখন। তাকে জোর করা নওয়াজের উচিত হচ্ছে না। তানিশা যখন সত্যিটা জেনেছে বুশরাকে তার জানানো প্রয়োজন। এই ভেবে বুশরাকে ফোন দেয় তানিশা। ফোন বন্ধ পেয়ে হতাশ হয় সে। এরপর সোজা চলে যায় ছাদে। সেখানে সে পায়চারি করতে থাকে, যদি বুশরার দেখা পায়!
বুশরার ফোনে হয়তো চার্জ শেষ। এই ভেবে তাকে মেসেজ পাঠিয়ে দেয় তানিশা। সে লিখলো-
জরুরী কথা আছে। আপনাকে কিডন্যাপের প্লান করেছে তায়শা ও নওয়াজ। প্লিজ বাড়ির বাইরে যাবেন না। আর আমার সাথে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
.
মেসেজটা পাঠিয়ে কিছুটা শান্তি অনুভব করলো তানিশা। কিন্তু আফসোস! সে জানেনা বুশরার ফোন তার কাছেই নেই এবং তা আর চালু হবে না!
.
চলবে