সেই তো এলে তুমি পর্ব_৩৩

0
1167

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩৩
#Saji_Afroz

অস্থির সময় পার হচ্ছে তানিশার৷ বুশরা তার ফোন এখনো চালু করেনি। আজই ফোনটা বন্ধ থাকতে বলল?
একবার ভাবলো, বুশরার বাসায় যাবে সে। মনে মনে এটাই ঠিক করে নিলো। যদিও কখনো ও বাড়ি সে যায়নি। যায়নি বলে যে কখনো যেতে পারবে না এমনটা না! আজ যাবে। বুশরার বাসায় গিয়েই তাকে সবটা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নেয় তানিশা।
সে মনে মনে দুপুরের সময়টাকে নির্ধারণ করে রাখে বুশরার বাসায় যাওয়ার জন্যে।
.
.
বুশরা, তায়শা ও নাফিশা অনেকদিন পর একইসাথে একই রুমে ও একই বিছানায় ঘুমিয়েছে। সবকিছু আগের মতো হয়ে গেছে দেখে বুশরা ভীষণ আনন্দিত।
তায়শার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হলো। কী মিষ্টি মেয়েটা! লোভে পড়ে এসব করে ফেলেছে সে। কিন্তু মেয়েটা এটাই বুঝলো না, এই রূপ নিয়ে লোভ নয় একটা ভালো মন তৈরী করার প্রয়োজন ছিল। তাতে করে সে যা চায় তার দ্বিগুণ পেত। আফসোস! মেয়েটা তা বুঝলো না। তাই প্র‍থমে আশিক ও পরে নিহিরের মতন কাউকে হারালো।
নিহিরের কথা মনে পড়তেই বুশরার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
প্রতিদিন একবার হলেও নিহির ফোন দিয়ে তার খবর নিতো। এখন সেটা আর হয়ে উঠবে না।
কাল রাগ করে ওভাবে হুটহাট ফোন ফেরত দিয়ে আসাটা তার উচিত হয়নি। অন্তত নিহিরকে একটা ফোন করে সব জানাতে পারতো। নিহির নিশ্চয় মনে কষ্ট পেয়েছে!
.
এই ভেবে বুশরা শোয়া থেকে উঠে বসলো। আজ ভালো ঘুম হয়েছে তার। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে নাস্তা বানাতে শুরু করলে তায়শা আসলো। তাকে দেখে বুশরা বলল, তুই এত সকালে? তাও আবার রান্নাঘরে!
-কী নাস্তা বানাবে?
-ভাবছি পরোটা করি। কাল রাতের আলু ভাজি আছে।
-আমি পরোটা বানানো শিখব। শেখাবে?
.
বুশরা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল-
এই আমি কাকে দেখছি!
-আরে শিখতে হবে না! আর তুমি একা একা কত দিনই বা করবে? তাছাড়া তোমার বিয়ের কথা চলছে। বিয়ে হয়ে গেলে আমাকে আর নাফিশাকে তো মা কে সাহায্য করতে হবে। জানো? যখন তুমি ছিলে না মা এর কত কষ্ট হয়েছে!
.
নাফিশা ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল-
কি যে হয় এই তায়শা আপুর। আমাকেও ডেকে দিলো আজ।
.
তাকে দেখে বুশরা হেসে বলল-
তুইও এসেছিস!
.
তায়শা বলল-
হু। কারণ আজ আমরা তিন বোন মিলে সকালের নাস্তা বানাব। এই আপি আমি কিন্তু ভালো ডিম ভাজি করতে পারি। সবার জন্য ডিম ভাজি করব।
.
নাফিশা বলল-
আর আমি বানাব চা।
.
এই বলে সবাই কাজে লেগে পড়লো।
এসব দেখে বুশরার চোখে কোণায় পানি চলে আসলো। তার বোনেরা বড় হয়ে যাচ্ছে!
.
.
নওয়াজের মা ভেবেছিলেন, সকালের নাস্তাটায় তানিশায় বানাবে। যেহেতু এই কয়েকদিন সমস্ত কাজ সেই সামলাচ্ছে। কিন্তু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেও রান্নাঘরে এসে কোনো নাস্তা বা তানিশাকে না দেখে চিন্তিত হলেন তিনি। তার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন শরীর ঠিক আছে কি না তা দেখার জন্য। এসে দেখলেন তানিশা রুমের মাঝে পায়চারি করছে।
তিনি বললেন, তোর শরীর ঠিক আছে?
.
খালাকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো তানিশা। তিনি অবাক হয়ে বললেন-
নওয়াজ কিছু বলেছে তোকে?
.
তানিশা তাকে ছেড়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন-
কিছু না বলেও উনি আমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন। আমার থেকে আলাদা হওয়ার সমস্ত রাস্তা খুঁজে বের করছেন। আচ্ছা খালা? আমি তো বউ হয়ে উঠার চেষ্টা করেছি, তিনি কেনো একটাবার আমার বর হওয়ার চেষ্টা করলেন না?
.
এসবের উত্তর নেই তার কাছে। শুধুমাত্র ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা তিনি বলতে পারলেন না।
.
.
বেলা হয়ে গেছে কিন্তু নিহির অফিসে যায়নি। সেনোয়ারা বেগম এসে তার খবরাখবর নিয়ে গেছেন। নিহির শুধু জানালো, আজ যেতে তার ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু ব্যাপারটা একটু হলেও নিখিল বুঝেছে। হয়তো বুশরা ফোন ফেরত দেওয়াতে ভাই এর মন খারাপ।
মন তো নিখিলেরও খারাপ। নাহলে এত তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙে! চিন্তায় ঘুমোতে পারে না সে। বারবার মনেহচ্ছে বুশরাকে মনের কথা জানাতে। কী যে করবে সে!
.
নিহির অনেকক্ষণ যাবত বুশরার ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু একটা ভেবে সে ফোনটা চালু করলো। নিহির দেখলো, বুশরার কন্টাক্ট লিস্টে তার নাম্বার ছাড়া আর কারও নাম্বারই নেই! এতে করে অবাক হয় নিহির।
গ্যালারি ঘুরেও কোনো ছবি নিহির পেল না। অবশ্য ছবিসহ ফোন তাকে দেবে না এটা জানে নিহির।
কী মনে করে মেসেজ অপশনে যায় নিহির। সাথে সাথেই তানিশার পাঠানো মেসেজটা পায় সে। যা দেখে চমকে উঠলো নিহির৷
সে সাথে সাথেই তানিশাকে কল ব্যাক করে। সবটা তার জানা প্রয়োজন। এদিকে তানিশা বুশরার ফোন পেয়ে আনন্দিত হয়ে উঠে। কিন্তু কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয় সে। পরিচয় জানতে চাইলে নিহির বলল-
দেখুন বুশরার ফোন আমার কাছে। সব কথা তো আর বলা এখুনি সম্ভব না। আপনি আমাকে প্লিজ সবটা খুলে বলুন। আমি বুশরাকে কিডন্যাপ হতে দিতে পারি না।
.
অপরিচিত এই ব্যক্তিটিকেই ভরসা করতে হলো তানিশাকে। তার কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে, বিষয়টা নিয়ে কতটা চিন্তিত সে!
তানিশা তাকে সবটা খুলে বলল। নিহির বলল-
গাড়ি কোন জায়গায় দাঁড়াবে এটা জানেন?
-এটা আমি জানিনা ঠিক।
-প্লিজ যেভাবেই পারুন তা জানার চেষ্টা করুন। বাকি সব আমি ম্যানেজ করব। নওয়াজ ও তায়শার এই প্লান ভেস্তে দেব আমি।
-জি আমি চেষ্টা করছি।
.
ফোন রেখে পেছনে ফিরে নিখিলকে দেখে উত্তেজিত হয়ে সব খুলে বলল নিহির। নিখিল বলল-
সবই বুঝলাম। কিন্তু তুমি কেনো এতটা উত্তেজিত হচ্ছ ভাইয়া?
-আমি বুশরাকে কিডন্যাপ হতে দিতে পারি না।
-কেনো?
-কারণ ওকে আমার চাই।
.
কথাটি বলে থেমে যায় নিহির। মুখ ফসকে এ কী বলে ফেললো সে। নিখিল মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো-
ভালোবাসো তাকে?
.
নিহির কিছু বলল না। নিখিল ভাই এর কাঁধে হাত রেখে বলল-
বুশরার মতো মেয়েকে হারাতে দিও না। ওদের হাত থেকে ওকে বাঁচিয়ে নিজের করে নাও।
.
এই বলে নিখিল ভাই এর রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভীষণ হালকা লাগছে তার।
তার জন্যই তো এই ভাইটা তায়শাকে কিডন্যাপ করার প্লান করেছিল। তার খুশির জন্য নিহির সব করতে পারে। চাইলে সে তায়শাকেই বিয়েটা করে ফেলতে পারতো। কিন্তু করেনি। ভাইকে কষ্ট দিয়েছে বলে তাকে ক্ষমা করেনি নিহির। আর এমন ভাই এর জন্য এতটুকু নিখিল করতে পারবে না? অবশ্যই সে পারবে। বুশরাকে ভুলে যাবে সে। এসব ভুলে এই জীবনে সেও কিছু করতে চায়। দেশের বাইরে গিয়ে ভালো কিছু করতে চায় নিখিল। এরপরেই বিয়ে-সাদির ভাবনা মাথায় আনবে এর আগে নয়।
.
.
নওয়াজ ঘুম থেকে উঠার পরেই তার রুমের পাশে ঘুরঘুর করছে তানিশা। সে জানতে পারলো, নওয়াজ একটি গাড়ি ভাড়া করেছে। গাড়িওয়ালাকে সে তার বাড়ির ঠিকানা দিলো। পরক্ষণেই তায়শাকে ফোন দেয় নওয়াজ। তাকে জানায় মেসেজে ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছে।
এই বলে নওয়াজ গোসল সারতে গেলে তানিশা তার রুমে আসে। ফোনে লক দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তানিশার। কিছুক্ষণ ভেবে সে পাসওয়ার্ড ‘বুশরা’ লিখে চেষ্টা করলো। সাথে সাথেই লক খুলে যায়!
পাগল প্রেমিক যে এই কাজই করবে ধারণা করেছে তানিশা। জলদি ফোন থেকে তায়শাকে পাঠানো ঠিকানাটা নিয়ে নেয় সে। এরপর পাঠিয়ে দেয় নিহিরকে।
নিহির তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলো-
বাকি কাজ আমার!
.
.
-কেনো না করছিস আপি? তোকে আমার সাথে যেতেই হবে।
.
নাফিশার জন্মদিন সামনে। তায়শা তার জন্য উপহার নেবে। তাই সাথে বুশরাকেও যেতে বলছে। কিন্তু বুশরার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। তাই সে যেতে নারাজ। আগামীকাল যাওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আজই তো সব প্লান করলো তায়শা। আগামীকাল হলে নওয়াজের অসুবিধে হবে। গাড়ি অবধি ঠিক রেখেছে সে। তায়শা বায়না করতে লাগলো বুশরার কাছে আজই যাওয়ার জন্যে। সে বলল-
আমার খুব বের হতে মন চাচ্ছে। চল না প্লিজ! তোমারও ভালো লাগবে।
.
তায়শার জোরাজোরিতে বুশরা যেতে রাজি হয়। আর এই সুখবর তায়শা জানিয়ে দেয় নওয়াজকে।
.
.
বিকালে বুশরাকে নিয়ে বেরুই তায়শা। প্রথমে তারা শপিং করে নেয়। এরপর তায়শা বুশরাকে জানায়, এই শপিংমল এর পেছনে একটা ফুচকার দোকান খুলেছে। ওখানে ফুচকা খেতে যাবে তারা।
.
বুশরা জানতো না পেছন সাইডটা একেবারেই ফাঁকা। তাই সে তায়শার সাথে সেদিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু এখানে এসে আশেপাশে কোনো দোকান বা মানুষ না দেখে বুশরা বলল-
একেবারেই নির্জন জায়গাটা।
-দোকান ছিল আপি। দাঁড়াও আমি খবর নিই। তুমি এখানেই থাকো।
.
এই বলে তায়শা সরে যায়। একটু বাদেই বুশরা অনুভব করলো, কেউ পেছন থেকে তার মুখ চেপে ধরেছে! চারপাশ ঝাপসা দেখছে সে। এরপর আর কিছু অনুভব করতে পারে না সে। বুশরা জ্ঞান হারালে সেখানে একটি গাড়ি এসে উপস্থিত হয়। তাকে গাড়িতে তোলা হয়। আচমকা তায়শা এসে পড়ে। সে নিহিরকে দেখে চমকে উঠে বলল, তুমি!
-হু আমি।
-বুশরা আপি কোথায়?
-যেখানে থাকা উচিত সেখানেই যাচ্ছে।
.
গাড়ির ভেতরে তাকিয়ে তায়শা বলল-
তুমি আবারও তাকে কিডন্যাপ করছ?
-সেইবার ভুলে করেছিলাম। এইবার ইচ্ছেকৃত ভাবে করছি।
.
তায়শা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল-
এত ভালোবাসা! ক’দিন আগে আমাকেও বাসতে৷ সেটাও কিন্তু ফুরিয়ে গিয়েছিল।
-এইবার ফুরাবে না। কারণ আমি তোমার সৌন্দয্যের প্রেমে পড়েছিলাম। এটা ছাড়া তো আর কোনো গুণ তোমার মধ্যে বিদ্যমান নেই। তাই অতি সহজেই ভুলে গেছি। আর এখন আমি বুশরার মায়ায় পড়েছি, তার ব্যক্তিত্ত্বের প্রেমে পড়েছি। তাই তার কাছেই আজীবন আঁটকে রইবো আমি।
.
এই বলে নিহির গাড়িতে উঠে বসে চালাতে শুরু করে। তায়শা চিৎকার করে গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকে এতে কোনো লাভ হবে না জেনেও!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here