সেই তো এলে তুমি পর্ব_৫

0
1161

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৫
#Saji_Afroz

বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেছে বুশরার বাড়িতে। বাড়ির ছাদটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্টেজ করা হয়েছে এখানে। গায়েহলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠান এখানেই হবে৷ তাছাড়া পুরো বাড়িতে করা হয়েছে লাইটিং। ফুল দিয়েও হয়েছে সাজানো চারিপাশ। হরেক রঙের কাপড় দিয়ে করা হয়েছে ডেকোরেশন।
যখন থেকে বুশরা বুঝতে শিখেছে, মা বাবা বলতে যে পৃথিবীতে যে কেউ আছে সে জানতো না। সে জানতো তার সবচেয়ে আপনজন ফুফু আম্মা ও ফুফা জান। যদিও তারা বুশরার খেয়ালই রাখতো না। কিন্তু ওতটুক বাচ্চা কি ওসব বোঝে?
তায়শার যখন জন্ম হয়, তখন বুশরা যেন তার আপন কাউকে পায়! বয়সে পিঠাপিঠি হলেও তায়শার খেয়াল রাখতো বুশরা। তারা একসাথে বড়ো হতে থাকে। এরপর সে বুঝতে শেখে সবচেয়ে কাছের মানুষ একমাত্র বোন-ই হয়। তায়শাও তাকে ভালোবাসতো এবং বাসে। সবসময় তার পাশে থেকেছে সে।
একবার তো স্কুলের বেতন দিতে গিয়ে টাকা হারিয়ে ফেলে বুশরা। তায়শা নিজের জমানো টাকা সহ মা এর কাছ থেকে টাকা চুরি করে তাকে বেতন দিতে সাহায্য করে। এভাবে সবসময় তার পাশে থেকেছে তায়শা। আজ সেই তায়শার গায়েহলুদ। আর কাল বিয়ে। ভাবতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে বুশরার।
তায়শা ও নাফিশা পার্লারে গেছে। আলিয়া খাতুন কাজের বাহানায় বুশরা কে যেতে দেননি। যদিও তায়শা নাছোড়বান্দা ছিল। তিনি বলেছেন, ওদের সাজ শেষ হলেই বুশরা কে পাঠাবেন তিনি।
এই নিয়ে বেশ কয়েকবার মা কে ফোন দেয় তায়শা। আলিয়া খাতুন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এই মুহুর্তে বুশরার যাওয়া সম্ভব না। বাসায় অনেক কাজ।
তায়শা এতক্ষণে চলে আসার কথা। হলুদের সাজে তাকে কেমন লাগছে তা দেখার জন্য মনটা ছটপট করছে বুশরার। তাইতো কিছুক্ষণ পর পরই মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে দেখছে সে তায়শা আসছে কি না।
কিছু এঁটো প্লেট বাটি ধুয়েমুছে আবারও গেইটের সামনে আসে বুশরা। এইবার সে তায়শাকে দেখতে পায়। রিকশা থেকে সে ও নাফিশা নামছে।
বুশরা দ্রুত তার পাশে এসে তাকে নামতে সহায়তা করে। এরপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মাশাআল্লাহ! আমার বোনটাকে হলুদ পরী লাগছে।
.
তায়শা হলুদ শাড়ি ও হলুদ রঙের ফুলের গহনা পরেছে। তাকে দেখতে হলুদ ফুলের রাজ্যের রানীদের মতো লাগছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই! সে বলল, লাগছে তাইনা?
-একদম।
-রুমে আয় তো। আশিককে ভিডিও কল দিই।
.
তারা রুমে এসে আশিককে ফোন দেয়। আশিক তাকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। বুশরা বলল, কি ভাইয়া? মশা ঢুকে যাবে তো মুখে।
.
আশিক হেসে বলল, তায়শা কোথায়?
-আপনার সামনে এটা কে?
-একে তো আমি চিনি না। তায়শা কে চিনি।
.
তায়শা বলল, ঠিক আছে। তবে এই বউটা অন্য কারো গলায় মালা পরিয়ে আসুক?
.
আশিক বলল, এই না! আমি তো মজা করছিলাম।
.
তাদের কথা বলতে দিয়ে বুশরা রান্নাঘরে চলে আসে। আলিয়া খাতুন তাকে বললেন, মহারানীর ছুটাছুটি শেষ হয় না?
-তায়শা এসেছিল। দেখতে গিয়েছিলাম।
-তায়শা আসছে?
-হু। অনেক সুন্দর লাগছে ওকে।
-আমার মেয়েটায় তো এমন।
-বলছি কি আর কি করতে হবে আমায়? না মানে আমিও তৈরী হয়ে নিতাম?
-তোকে এখানে কে দেখবে? এত জলদি হতে হবে না। সবাই খাওয়াদাওয়া শেষে হবি। সবকিছু কি আমি সামলাব?
-ওসবের জন্য তো কাজের মহিলারা আছে।
-কাজের মহিলাদের দিয়ে ঘরের সব কাজ হয়না। আর ওরা কি জানে কাদের কেমন আপ্যায়ন করতে হবে! তুই এত কথা বলছিস কেন?
মিষ্টির বাক্স থেকে কয়েক প্লেট মিষ্টি নিয়ে আয়। আমার ননদরা এসেছে।
.
এই বলে তিনি রুমের দিকে চলে যায়। বুশরা নাস্তা ও মিষ্টি প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আসে রুমে। সবাইকে সালাম জানিয়ে তাদের হাতে হাতে দেয় সে। একটা প্লেট কম হয়। এইজন্য আলিয়া খাতুন তাকে কথা শোনায়।
-বলি কি কাজ চুরি করার অভ্যেস কেনো? এখন গিয়ে আবার নিয়ে আয়।
-আপনিই তো বলেননি কয় প্লেট লাগবে।
-মুখেমুখে কথা না বলে এসে দেখে যেতেও পারতি। যা গিয়ে আরেকটা প্লেট নিয়ে আয়।
.
সে চলে যেতেই আলিয়া খাতুনের ছোট ননদ পারভীন বললেন, ভাবী ওর সাথে ওমন করো কেনো? মেয়ে তো খারাপ না। সবার কত খেয়াল রাখে।
-ওর মা আমার ভাই এর সংসারটা তছনছ করে দিছে। তাই এমন করি। ও কি জানে ওর জন্মের আগেই অন্য কারো জন্য ওর মা ওকে মেরে ফেলতে চাইছিল? ওইরকম মা এর মেয়ে আর কেমন হবে! আমার জানা আছে।
.
বুশরা চলে আসলে তিনি থেমে যান। সে প্লেট দিয়ে চলে গেলে আবারও বলতে শুরু করেন, আমি চাই না ও ওর মা এর মতো হোক। এইজন্যই কড়া শাসনে রাখি।
.
.
নিজের শেরওয়ানি টা উল্টেপাল্টে দেখছে নিখিল। খয়েরী রঙের একটি শেরওয়ানি কিনেছে সে। কিন্তু নেওয়ার পর মনে হচ্ছে আরও ভালো নিতে পারতো।
সে ভাবনায় পড়ে যায়। তখনি তার দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। নিখিল তার মা ভেবে সেটি লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু নিহিরের কণ্ঠ শুনে দরজা খুলে দেয় সে।
নিহিরকে শেরওয়ানি দেখিয়ে বলে, ভাইয়া দেখো তো? আমার মনে হচ্ছে এটা ভালো হয়নি।
-খারাপ কোনদিকে?
-রঙ টা কি বেশ গাঢ় হয়ে গেল?
-উহু। ভালোই লাগছে।
-মনেহচ্ছে শপ এ আরও ভালো ছিল।
.
নিহির হেসে বলল, এটাই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।
-মানে?
-মানে জাস্ট কবুল বলা হবে। তোর বিয়ে কতটা ধুমধাম করে দেব দেখে নিস। তখন দশদিন ঘুরে একটা শেরওয়ানি নিস৷ আর এখনো যদি আরেকটা নিতে ইচ্ছে হয় তো নে।
-না থাক। তখনি নেব বরং।
-হু।
-আচ্ছা তায়শা কী রঙের জামা পড়বে কাল?
-সেটা যেন আমাকে বলেছে।
.
নিখিল হাসলো। কিন্তু মুহুর্তেই তার মুখে অন্ধকার নেমে এল। নিহির কি হয়েছে জানতে চাইলে বলল, মা কে কীভাবে ম্যানেজ করবে?
-করে নেব। উনার একমাত্র ছেলে তুই। নিশ্চয় মেনে নেবেন সবটা।
– দুই মাত্র ছেলে। বড়ো ছেলে তো তুমিই।
-সেটা আর বলতে! এখন ঘুম দে একটা। কালকে ফ্রেশ লাগতে হবে।
-ওকে।
.
.
একে একে সবাই-ই স্টেজে এসে হলুদ লাগিয়ে দেয় তায়শা কে। বাকি আছে বুশরা। নাফিশাকে পাঠানো হয়েছে তাকে ডাকার জন্য।
এত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বুশরা৷ তাই সে মাত্রই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। সাথে সাথে নাফিশা এসে হাজির হয়। তাকে জোর করে ছাদে নিয়ে আসে। বুশরার পরণে পুরাতন জামা, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। তাকে এইভাবে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না তায়শার। নিশ্চয় তার মা এর জন্যই তৈরী হওয়ার সময় পায়নি। আশেপাশে অনেক মানুষ বলে তায়শা নিশ্চুপ রইলো। বুশরা তায়শাকে হলুদ লাগানোর সময় সে খেয়াল করলো, তার চোখে পানি৷ তায়শার চোখেও পানি চলে আসে। দু’বোন নীরবে কাঁদতে থাকে। তখনি এক বোরকা পরিহিত চিকন কণ্ঠের মহিলা বলল, কান্নাকাটি পরে হবে৷ আগে আমি হলুদ লাগাই।
.
তারা চোখ মুছে নেয়। মহিলাটি তায়শাকে হলুদ লাগানোর সময় বুশরা তার হাত ধরে ফেললো৷ তায়শা অবাক হয়ে বলল, কি রে?
-এটা তো কোনো মহিলা বলে মনে হচ্ছে না আমার।
.
তায়শা ঘাবড়ে যায়। সে বলল, তবে?
-ছেলে মেয়ে সেজে এসেছে।
.
তায়শা ভাবে নিখিল আসেনি তো? এতগুলো মানুষের সামনে যদি ঝামেলা করে? কিন্তু বুশরার হাসি দেখে সে যেন প্রাণে বেঁচে যায়।
ছেলেটির হাতটি ছেড়ে বুশরা ফিসফিসিয়ে বলল, এটা হলো আশিক ভাই।
-আশিক?
-হু। তোকে হলুদের সাজে দেখতে এসেছে। আসার আগে আমায় বলেছিল। এইভাবে আসতে আমিই বুদ্ধি দিই।
.
বিষয়টা কেউ বুঝতে পারলো না৷ কিন্তু তায়শা আশিককে নিয়ে নিচে নেমে আসতে চাইলে আলিয়া খাতুন তাদের থামিয়ে বলল, কে উনি? আর কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-অনুষ্ঠান তো শেষ। এখন নাচানাচি হবে। শাড়ি পরে তক নাচতে পারব না। তাই আমি শাড়িটা বদলাতে যাচ্ছি। আর ও হচ্ছে আমার বান্ধবী। ভদ্র বান্ধবী। তাই এভাবে এসেছে। সেও চলে যাচ্ছে। ভাবলাম এগিয়ে দিই।
-আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আয়।
.
আশিককে নিয়ে নিজের রুমে এসে দরজাটা আঁটকে দেয় তায়শা। সবাই ছাদে থাকায় এখানে কেউ নেই। গানবাজনা শুরু হয়ে গেছে। এদিকটা কেউ আসারও সম্ভাবনা নেই৷ আশিক মুখের কাপড়টা সরিয়ে বলল, ওহ শান্তি!
.
তায়শা হাসতে হাসতে বলল, তুমি এইভাবে?
-হবু বউকে ফোনে দেখে বাস্তবে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
.
তায়শা হাসে। আশিক এসে তাকে কাছে টেনে নেয়৷ হুট করে আশিকের এমন কাণ্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় তায়শা। আশিক তার মুখে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, এত সুন্দর আমার বউটা।
-এখনো হইনি। কাল হব।
-হতে আর কতক্ষণ?
-যতক্ষণ আছে ততক্ষণই সবুর করো।
.
আশিক তাকে আরও বেশি কাছে টেনে বলল, শুধু একটা চুমু দাও তাহলে?
-দেব তো।
-সত্যি?
-হু। যদি না ছাড়ো একটা কেনো অনেকগুলো কামড় দেব।
.
এই বলে আশিকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজাটা খুলে দেয় তায়শা। এরপর বলল, যাও তো এখন। কাল এতক্ষণে তো তোমার সাথেই থাকব।
-আর কি করব?
-কি করবে?
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে আশিক বেরুনোর সময় বলল, কি করব না সেটা বলো?
.
সে চলে যায়। লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে যায় তায়শার৷ কাল আসলেই কি হবে?
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা পান করছে নিহির। খালেকুজ্জামান এসে বললেন, ওই বাড়ির মেয়েরা কাল যেই পার্লারে সেজেছিল আজও সেখানেই সাজবে। খবর নিয়েছি আমি।
-শিওর?
-হুম।
-বেশ তাহলে! ওখান থেকে তায়শা কে নিয়ে আসা হবে আজ।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here