সেই তো এলে তুমি পর্ব_৬

0
902

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৬
#Saji_Afroz

কাল ধকল যাওয়ার কারণে আজ সারাদিনই ঘুমে তায়শা। বুশরার জোরাজোরিতে উঠে কোনোমতে গোসলটা সেরে নেয় সে বিকেলের দিকে। আবারও ঘুমোতে যাচ্ছে তখন বুশরা একটা প্লেট হাতে নিয়ে এসে বলল, পার্লারে যেতে হবে ভুলে গেছিস?
-উহু। বিয়ে তো আরও দেরী আছে।
-তোকে বিকেলে যেতে বলেছে না? কম সময় নিয়ে সাজালে পেত্নী লাগবে। ঘুম তো সবসময় যেতে পারবি। বিয়ের দিন কি আর আসবে?
.
তায়শা চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, ঠিক বলেছিস। যাচ্ছি আমি।
-তার আগে বিরিয়ানি টা খেয়ে নে। সারাদিন কিছু খাসনি। ঘুমে কি পেট ভরবে?
-খাইয়ে দে।
.
বুশরা হাত ধুয়ে এসে খাইয়ে দিতে থাকে তায়শা কে৷ আলিয়া খাতুন বুশরাকে খুঁজতে আসেন। কিন্তু এমন একটা দৃশ্য দেখে তার নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে।
আর যাই হোক, বুশরা তার মেয়ে দুটোকে সবসময় এভাবে আগলে রেখেছে।
তিনি চোখ মুছে এসে বসলেন তায়শার পাশে।
তায়শা মা কে বলল, একবার বুশরা আপিকে বললাম খাইয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। তোমাকে বললে কত কাজ বেরুই।
-কত কাজই তো করছি। বিয়ে বাড়ি বলে কথা।
.
খাওয়া শেষে তায়শা ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নেয় পার্লারে যাওয়ার জন্যে। বুশরাও প্লেট রেখে হাত ধুয়ে আসে। সে সব গুছিয়ে দিতে সাহায্য করে তায়শা কে। নাফিশাও তৈরী। তায়শা বলল, আশিক যে ড্রেসটা কিনে দিয়েছে ওটা পরবে তুমি।
.
বুশরা হেসে বলল, আচ্ছা।
-কি আচ্ছা? ওটা নাও আর আমাদের সাথে চলো।
.
বুশরা আলিয়া খাতুনের দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলল, আসলে বাসায় কাজ আছে। তোরা যা না। আমি এখানে নিজে তৈরী হয়ে নেব।
-দেখেছি কাল কি হয়েছিস। আমার মাত্র দু’টো বোন। তারাই যদি ভালো করে তৈরী না হয়? আরে বর পক্ষের সামনে ছোট হয়ে যাব তো।
.
আলিয়া খাতুন বললেন, ওকে পরে পাঠান। তোরা চলে যা।
-সেটা তুমি কালও পাঠিয়েছ। দেখো ও না গেলে আমিও আজ যাব না। এইভাবে বিয়েতে বসব।
.
বুশরা তাকে বোঝাতে যাবে তখন আলিয়া খাতুন বললেন, কাপড় নিয়ে আয় বুশরা। আসার সময় সবাই একটা সি.এন.জি করে চলে আসিস। আর আমি কিছু খাবার দিচ্ছি। খিদে লাগলে খেয়ে নিস তোরা।
.
মা এর এমন নরমস্বর আশা করেনি তায়শা। সে মা কে জড়িয়ে ধরে বলল, ধন্যবাদ মা।
-হু। মা তো বেশি খারাপ৷ আয় বুশরা। খাবার দিই তোকে।
.
বুশরাও খুশি হয়। এমন কিছু সে আশা করেনি। ইচ্ছে করছে তায়শার মতো সেও জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিক আলিয়া খাতুন কে। কিন্তু সেই অধিকার হয়তো তার নেই! যা রয়েছে কেবলই তায়শা ও নাফিশার।
আলিয়ার সাথে রান্নাঘরে এসে খাবার নেয় বুশরা। এরপর নিজের রুমের দিকে চলে যায়। যাওয়ার আগে তাকে বলল, কোনো কাজ করে দিতে হবে? তাড়াতাড়ি করে নাহয় ওদের সাথে যাই।
-একটা জায়গায় যাচ্ছিস ওখানে যা। করতে হবে না কিছু এখন।
.
বুশরা চলে গেলে আলিয়া খাতুনের এক আত্মীয়া এসে বললেন, কাল থেকে মেয়েটাকে দেখছি। বেশ ভালো মেয়ে। যদি কিছু মনে না করো আলিয়া, একটা প্রস্তাব দিই?
.
আলিয়া খাতুন হকচকিয়ে বললেন, জি বলেন?
-আমার ছেলেটা সরকারি চাকরি করে৷ এমন একটা ঘরোয়া মেয়ে আমার ভীষণ দরকার। জানোই তো প্রায়ই অসুস্থ থাকি আমি। এমন একটা মেয়ে পেলে সংসারটা গোছানো থাকবে আমার। বুশরাকে দেবে আমার ছেলের বউ করে?
.
আলিয়া খাতুন চিন্তিত হয়ে বললেন, বিয়ে সাদির বিষয় তো আর হুট করে বলা যায় না। আমি ওর ফুফা আর বাবার সাথে কথা বলে জানাব।
-আচ্ছা।
.
আলিয়া খাতুন তাদের ভালো করেই চেনেন। বুশরার জন্য এমন একটা প্রস্তাব সাত কপাল বলা যায়। বিয়ে দিয়ে দিলে তার মাথা থেকেও বোঝা কমবে।
এই ভেবে তার স্বামীকে সবটা খুলে বলেন তিনি।
আকবর আলী এসব শুনে বললেন, এর আগে তো কখনো বিয়ে দেওয়ার কথা বলোনাই ওর?
-আগে বলিনাই তাতে কি সারাজীবনেও বলব না? মেয়ে মানুষ যখন বিয়ে তো দিতেই হবে। তাছাড়া ওর জন্যে সব ভালো ঘর আসে। পরে বয়স হলে যদি না আসে?
-না আসলে এখানেই থাকবে। সে তো আর বিয়ে করতে চায়ছে না।
-মানে কি?
-ওরে বোকা, ওর বিয়ে হয়ে গেলে মাসে মাসে যে টাকা ওর বাপের কাছ থেকে পাই সেটা কি পাব? তাছাড়া ঘরের সব কাজও সে করে।
.
আলিয়া খাতুনের মেজাজ খারাপ হয়। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আকবর আলীকে। বিয়ের আগে নানা স্বপ্ন দেখালেও বিয়ের পর জেনেছে কতটা ছোটলোক সে। নিজের তো কিছুই নাই, কাজ অবধি করতে চাইতো না কোনো। বস্তিতে গিয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতো। আলিয়া খাতুন বাবার তরফ থেকে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন সেটাও ব্যবসা করবে বলে নষ্ট করেন আকবর আলী।
পরে তার ভাই বোনের কথা ভেবে একটা মুদি দোকানে বসিয়ে দেন আকবর আলীকে। তখন তার সংসারে অশান্তি দূর হয়। ভাই বিদেশ যাওয়ার আগে নিজের বাড়িটাও দিয়ে যায়। নাহয় সেই বস্তিতেই তাদের থাকতে হত। ভাই এর এত উপকার সে ভুলতে পারে না। মা যেমনই হোক, মেয়েটার দায়িত্ব তাকে দিয়েছে। তায়শার বিয়েটা যেহেতু হয়ে যাচ্ছে এরপর বুশরারও ব্যবস্থা করবেন তিনি। এ নিয়ে আর আকবর আলীর সাথে কথা বাড়ালেন না আলিয়া খাতুন। সিদ্ধান্ত নিলেন পরবর্তীতে ভাই এর সাথেই কথা বলবেন।
.
.
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মাত্রই তায়শাকে সাজাতে শুরু করা হয়েছে। নাফিশা ও বুশরাকে আগে সাজানো হয়। বুশরাকে লাল রঙের সালোয়ার কামিজে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। শ্যাম বর্ণের মেয়েদের সাজলে না কি বেশ ভালো লাগে। বুশরা তা আজ আরেকবার প্রমাণ করলো। ভারী গহনাও পরেছে সে তায়শার জোরাজোরি তে। তায়শা তাকে দেখে বলল, ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে তোকে আপি। বউ তো তোকেই মনে হচ্ছে।
-কি যে বলিস না!
.
তায়শা কে সাজানো শুরু হয়। বুশরা নিজেকে আয়নায় দেখতে ব্যস্ত। আজ প্রথম সে এইভাবে সেজেছে। নিজেকে যেন নিজেই চিনতে পারছে না। নওয়াজ কে মনে পড়ছে ভীষণ। তায়শার থেকে ফোন নিয়ে তাকে ভিডিও কল দেয় বুশরা। নওয়াজ কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আচমকা বুশরা কে এভাবে দেখে চমকে যায় সে। একপাশে এসে বলল, লাল পরী মনে হচ্ছে।
-সত্যি?
-হু৷ পাশে থাকলে এখন…
.
এই বলে থেমে যায় নওয়াজ। বুশরা হাসলো। কিন্তু বেশিক্ষণ আর কথা বলতে পারলো না। পার্লারের এক মহিলা এসে বলল, তায়শা কে আপনাদের মধ্যে? একজন পুরুষ দেখা করতে এসেছে।
.
তায়শা মাত্রই মেকআপ করতে বসেছে। তাছাড়া তার জামা-কাপড়ও ঠিক নেই। পেটিকোট ও ব্লাউজ পড়ে আছে সে। তাই সে বুশরাকে বলল, বুশরা আপি? একটু গিয়ে দেখ না কে এসেছে।
.
সে নওয়াজকে বিদায় জানিয়ে তায়শার কাছে তার ফোন দিয়ে দেয়। ওদিকে নাফিশাকে সাথে ডাকলে সে বলল, আমি টিকটক করছি! বাসায় গিয়ে মানুষের ভিড়ে পারব না। তুমি যাওনা আপি।
.
বুশরা চিন্তিত হয়ে বলল, কে এসেছে!
.
তায়শা বলল, আমি আমার কালিরা চুড়ি গুলো আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। মা কে ফোনে বলেছি কাউকে দিয়ে পাঠাতে। মা পাঠিয়েছে হয়তো।
.
একটুর জন্য বুশরার মনে হয়েছে হয়তো নিখিল এসেছে! কিন্তু তায়শা এ কথা বলাতে নিশ্চিত হয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না বুশরা। এদিক ওদিক ফিরতে থাকে। হঠাৎ এক বয়স্ক লোক তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, একটু কথা ছিল তোমার সাথে।
-চুড়ি দিতে এসেছেন? ফুফু আম্মা পাঠিয়েছে আপনাকে? কিন্তু আপনাকে আমি চিনলাম না।
.
লোকটি আর কেউ নয়। তিনি হলেন খালেকুজ্জামান। পার্লারের আশেপাশে দোকান থাকায় এখান থেকে কিডন্যাপ করাটা কষ্ট হত তার জন্য। এখন ভালোই কারণ তিনি পেয়ে গেছেন। মেয়েটা নেহাতই সহজ সরল। দেখতেও মনে হচ্ছে না কাউকে এইভাবে ঠকাতে পারে!
তিনি বললেন, জি মা। আমি বিয়ের ডেকোরেশন এর লোক। আপা বলল তোমাকে এটা দিয়ে দিতে৷ তাই দিলাম।
-হু, দিন না?
-এই রে! আমি তা গাড়িতেই রেখে এসেছি। আমার সাথে এসো৷ তোমাকে দিয়ে দিই। আমি গাড়িতে উঠে চলে যাব।
-গাড়ি কই?
-ওদিকটায় রেখেছি। আসলে সঠিক ঠিকানা বুঝছিলাম না। আমরা ছেলে মানুষরা কি আর পার্লারের খোঁজ খবর রাখি? তাই নেমে খুঁজছিলাম।
-সমস্যা নেই। চলুন।
.
এই বলে পার্লারের এক পাশে নির্জনে বুশরাকে নিয়ে আসে খালেকুজ্জামান। বুশরা কার দেখে অবাক হয়। ডেকোরেশন এর লোক কার করে এসেছে?
সে কিছু বলতে যাবে তখনি খালেকুজ্জামান তার মুখে রুমাল চেপে ধরে। মুহুর্তেই চারপাশ ঝাপসা দেখতে শুরু করলো বুশরা। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে গেছে। কিছু বলতেও পারছে না সে। কেবল অনুভব করছে স্যুট পরা একজন লোক এসে কোলে তুলে নেয় তাকে৷ এরপর গাড়ির পেছনের সিটে তাকে শুইয়ে গাড়ি চলাতে শুরু করে। আস্তে আস্তে সবকিছু অন্ধকার দেখছে বুশরা। চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে যায় তার। এরপর আর কিছু উপলব্ধি করতে পারে না সে। অতঃপর সে জ্ঞান হারায়।
এদিকে নিহিরের পাশে বসা খালেকুজ্জামান বললেন, রুমালটায় বেহুশ হওয়ার মেডিসিন ছিল? কোনো ক্ষতি হবে না তো?
-নাহ হবে না। নিখিলকে ফোন করে শেরওয়ানি পরে অফিসে আসতে বলো। ওদের বিয়েটা ওখানেই হবে।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here