#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৫
.
নীলাম ধাক্কা দিয়ে স্নিগ্ধকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ধরলো। স্নিগ্ধ কিছু বললো না, অন্য দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
সকাল মেডিকেলে ঢুকতেই পরশ দৌড়ে সকালের কাছে এসে দু’হাত হাঁটুতে রেখে হাঁপাতে লাগলো। তা দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরশের দিকে একবার তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে গেলেই পরশ সকালের হাত ধরে ফেললো। সকাল পেছন ঘুরে চোখ বড় বড় করে পরশের দিকে তাকিয়ে হাত ঝারা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বললো,
-“এসব কি পরশ?”
-“আ’ম.. আ’ম স্যরি। সকাল প্লিজ তুমি রাগ করো না। আসলে গতকালকে বন্ধুদের সাথে ছিলাম। তখনি এক বন্ধুর কাছ থেকে তার ছোট বোনের এক দূর্ঘটনার কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে আবার তুমিও কল রিসিভ করছিলে না। তাই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেজন্যই গতকালকে বলেছিলাম যে কোথায় গেলে এখন থেকে আমাকে জানিয়ে যাবে। প্লিজ তুমি মাইন্ড করো না।”
-“ওহ আচ্ছা আচ্ছা। আমি এবার বুঝেছি। ইট’স ওকে বন্ধু। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অকারণে আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করছো। সেই কারনেই তো আমি রেগে গিয়েছিলাম।”
-“প্লিজ এবার আর রাগ করে থেকো না। তোমাকে রেগে থাকলে ভালো লাগে না।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। এবার চলো ক্লাসে যাই। কিন্তু আফি কোথায়? আসে নি আজকে না-কি!”
-“ওকে তো আমি দেখি নি আজকে।”
-“ঠিক আছে তুমি সামনে এগোও। আমি আফিকে কল করে আসছি।”
-“আচ্ছা।”
পরশ কিছুদূর যেয়ে পেছন ঘুরে সকালের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা কি কোনোদিন ওকে বুঝবে? কোনোদিন কি ওর অনুভূতি গুলোকে বুঝবে? ও যে কেন এত চিন্তা করে সকালকে নিয়ে সেটা বুঝবে? আর পরশ নিজেও কি কোনোদিন সকালের সামনে নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারবে? হয়তো একদিন পারবে। এসব ভেবে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সকালের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। সকাল আফিকে ৩-৪ বারের মতো কল দিল। কিন্তু আফি রিসিভ করলো না। শেষে সকাল চিন্তিত হয়ে ফোনটা ব্যাগে রেখে ক্লাসে চলে গেল।
স্নিগ্ধ একটা ক্যাফেতে বসে আছে। বারবার ঘড়ি দেখছে আর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। এমন সময় একজন ক্যাফের সামনে বাইক থামিয়ে মাথা থেকে হেলমেটটা খুলতে খুলতে ক্যাফের ভেতরে ঢুকলো। ছেলেটা এসেই স্নিগ্ধকে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি স্নিগ্ধ?”
-“জ্বি।”
সকাল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চুপচাপ মেডিকেল থেকে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। মনটা খারাপ হয়ে আছে। না আফির সাথে আজ দেখা হলো, আর না দেখা হলো স্নিগ্ধর সাথে। গাড়ি হঠাৎ থেমে যাওয়ায় সকাল ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো ওরা জ্যামে আটকে আছে। সকাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আশেপাশে তাকাতেই ওর চোখ আটকে গেল কাঁচের দেয়ালের ওপাশে বসে থাকা একটা চেনা মুখের ওপর। সে আর কেউ না সকালের ডাক্তার সাহেব স্নিগ্ধ। যে বর্তমানে ক্যাফের ভেতরে বসে একটি ছেলেটার সাথে কফি খাচ্ছে আর কথা বলছে। সকাল ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু করে সেদিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধকে কল দিল। কিন্তু স্নিগ্ধ কলটা কেটে দিল যা সকালের চোখ এড়ালো না। ও আবারও কল দিল। কিন্তু এবার স্নিগ্ধ ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল। সকাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ঠিক সে সময়ই রাস্তার জ্যাম ছেড়ে যাওয়ায় গাড়ি চলতে শুরু করলো। সকাল বোঝার চেষ্টা করছে যে আসলে ওই ছেলেটা কে ছিল স্নিগ্ধর সাথে। ছেলেটাকে অনেক চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে পরছে না ছেলেটাকে কোথায় দেখেছে সকাল।
-“তোমাকে এখানে আসতে বারন করেছিলাম না আমি?”
-“আসতে বাধ্য হয়েছি আমি। আমার সম্পূর্ণ মাল সিআইডি টিম সিজ করে নিয়েছে। আর আমি চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো?”
-“সিআইডি টিমের সাথে কথা বলার জন্য আমি আমার বিশ্বস্ত লোককে পাঠাবো। সে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে মালগুলো। তুমি প্লিজ এখান থেকে যাও। তোমার খবর যদি সিআইডি ভুলেও পায়, তাহলে কিন্তু আমাদের এত কষ্ট করে তৈরি এই এত বড় সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।”
-“মালগুলো ফিরিয়ে আনবেন কি করে আপনি? আপনি তো দেখছি কোনো কিছুরই খোঁজ রাখেন না। পাচার করার জন্য যে মেয়েদেরকে আমরা কিডন্যাপ করেছিলাম, সিআইডি সেই সব মেয়েদের উদ্ধার করে ছেড়ে দিয়েছে। আর রইলো বাকি ড্রাগস এর কথা! সেগুলো সব হেডকোয়ার্টারে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে কিভাবে বের করবো ওগুলো?”
-“তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি কি করা যায়।”
-“দেখছি না। যে করেই হোক ওই মেয়েগুলো আর ড্রাগসগুলো আমার ফ্যাক্টরিতে চাই আমি। সময় দিলাম আপনাকে। যে করেই হোক উদ্ধার করুন সেগুলো সিআইডি এর হাত থেকে। নাহলে আমার পুরো পঞ্চাশ কোটি টাকার লস হয়ে যাবে। যদি আপনি উদ্ধার করতে না পারেন তাহলে কিন্তু আপনার কপালে অনেক খারাপ কিছু লেখা আছে।”
-“প্লিজ শান্ত হও তুমি। আম..আমি বলছি তো আমি ফিরিয়ে আনবো মালগুলো আর মেয়েগুলোকেও।”
-“গুড ফর ইউ।”
বাসায় এসে স্টাডিরুম পাড় হয়ে যেতে গেলে ভেতর থেকে কিছু আওয়াজ শুনে থেমে যায় সকাল। উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে উল্টো দিক ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। আর সকালের বাবা মেয়েটির সাথে কথা বলছে। সকাল ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে স্টাডিরুমের ভেতরে ঢুকে গেল। “পাপা” বলে ডাকতেই আরিফুল ইসলাম চমকে উঠলো। সামনে নিজের মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন উনি। সকাল বললো,
-“পাপা তুমি এই সময় এখানে কি করছো?”
-“কিছু না মামনি। ওই বিজ…বিজনেস! হ্যা, বিজনেসের ব্যাপারে ওর সাথে একটু কথা বলছিলাম।”
-“আপুটা তোমার অফিসে কাজ করে?”
-“হ্যা।”
সকাল এবার মেয়েটিকে দেখলো। মেয়েটি মুচকি হেসে সকালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। সকাল হালকা হেসে হাত মিলিয়ে বললো,
-“হ্যালো আপু।”
-“হ্যালো।”
আরিফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
-“এটা আপনার মেয়ে?”
আরিফুল ইসলাম জোরপূর্বক হেসে বললেন,
-“হ্যা।”
-“খুব কিউট।”
সকাল মিষ্টি হেসে বললো,
-“থ্যাংক ইউ আপু। তুমিও সুন্দর।”
-“ধন্যবাদ।”
আরিফুল ইসলাম এখনো ভয়ে আছেন। সকাল কিছু শুনে ফেলে নি তো! কিছু শুনে থাকলে তো উনার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। উনি নিজেকে স্বাভাবিক করে জোর পূর্বক মুখে হাসি টেনে সকালকে জিজ্ঞেস করলো,
-“মামনি তুমি হঠাৎ এখানে? তোমার তো এখন মেডিকেলে থাকার কথা ছিল।”
-“হ্যা। আমি মেডিকেল থেকেই বাসায় ফিরলাম মাত্র। রুমের দিকেই যাচ্ছিলাম। তখন মনে হলো তোমার কথার আওয়াজ শুনলাম। তাই এদিকে আসলাম।”
-“তুমি কি কিছু শুনেছো?”
-“না তো। কেন কি হয়েছে?”
-“না না কিছু না। তুমি এখন তোমার রুমে যাও মামনি। আমি তোমার এই আপুটার সাথে বিজনেসের ব্যাপারে আরও কিছু কথা বলবো।”
-“ওহ আচ্ছা। আমি যাচ্ছি তাহলে।”
-“হুমম।”
সকাল চলে যেতেই এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আরিফুল ইসলাম। এতক্ষণ যেন উনার গলাটা কেউ চেপে ধরেছিল এমন লাগছিল। মেয়েটি রাগী চোখে আরিফুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনি কি চান আমার পরিচয় সবাই জেনে যাক!”
-“না।”
-“তাহলে রুমের দরজা খুলে রেখেছিলেন কেন?”
-“আ’ম স্যরি। আমি বুঝতে পারি নি মামনি এভাবে হুট করে রুমে চলে আসবে।”
-“যাই হোক, আমার সম্পূর্ণ মাল ফেরত চাই। কথাটা মাথায় রাখবেন। এখন আমি আসছি।”
-“ঠিক আছে।”
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আরিফুল ফোন হাতে নিয়ে নিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক রিয়াজকে কল করলেন। ফোন রিসিভ হতেই আরিফুল বললেন,
-“সিআইডি টিম যে মালগুলো সিজ করেছে সেই মালগুলো যে-কোনো মতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করো। সাথে মেয়েগুলোকেও ফিরিয়ে আনবে। নাহলে আমাদের কাউকে কিন্তু বাঁচতে দিবে না ও।”
-“স্যার আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়।”
-“দেখছি না রিয়াজ। কাজটা হওয়াই চাই।”
-“ওকে স্যার।”
-“আর শোনো, আমি কাল বা পরশু দেশের বাইরে যাচ্ছি। যাতে এই কাজে কেউ আমাকে না সন্দেহ করতে পারে।”
-“ঠিক আছে স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
বেশ কিছুদিন কেটে গেল এর মধ্যে। স্নিগ্ধ আবারও আগের মতোই সকালের সাথে টাইম স্পেন্ড করে। সব সময় সকালকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করে। সকালও বেশ খুশি স্নিগ্ধর আচরণে। সকাল আর স্নিগ্ধ একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। ওরা মূলত লাঞ্চ করার জন্য এসেছে। সকাল মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। খাওয়ার মাঝে টুকিটাকি কথাবার্তা বলছে দু’জনেই। স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা মিস বিকাল!”
-“সকাল।”
-“ওই হলো একটা।”
-“হুহ!”
-“তোমার পাপাকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না!”
-“অনেক বেশি। হি ইজ ওয়ার্ল্ড বেস্ট ফাদার।”
-“তোমার পাপাও তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”
-“হ্যা।”
-“আচ্ছা তোমার বাবা কি করেন?”
-“উনি বিজনেসম্যান। বিখ্যাত বিজনেসম্যান আরিফুল ইসলামের নাম তো শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
-“হ্যা। উনাকে কে না চিনে?”
-“আমি উনারই মেয়ে।”
-“ওহ আচ্ছা। তা তোমার বাবার তো নিশ্চয়ই কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়!”
-“হ্যা। এইতো গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে নিউইয়র্কে গিয়েছেন উনি বিজনেসের কাজে। এখনো ওখানেই আছেন।”
স্নিগ্ধ আর কিছু বললো না। চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিল। সকালও অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে খাওয়া শেষ করলো। স্নিগ্ধ সকালের দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। স্নিগ্ধ বুঝতে পেরে হেসে এক ওয়েটারকে ডেকে আইসক্রিম দিয়ে যেতে বললো। সকালও তাতে দাঁত বের করে হেসে দিল।
চলবে….