সেই সন্ধ্যা পর্ব-৩০

0
1779

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩০
.
পরশ হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। অসহায় দৃষ্টিতে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। পায়ে প্লাস্টার করতে হবে ঠিকই ধরেছিল ও। আর ডাক্তার করেছেও তাই। আফি পাশের সোফায় বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পরশের দিকে। কেননা পরশ তাকে যেতে বারণ করেছে। শুধু বারণ করলেও সে চলে যেতো। কিন্তু পরশ ওকে ব্ল্যাকমেইল করছে বলে রয়ে গেছে আফি।
-“কি! আমাকে খেয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে। ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
আফি যেন মুহূর্তেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
-“আমার টেস্ট এতটাও খারাপ নয় যে আমি তোমাকে খাবো। বরং আমার তো মন চাচ্ছে তোমার ডান পা-টাও ভেঙে ফেলতে। তোমার সাহস কত বড় যে তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করো!”
-“আমার সাহস সম্পর্কে তোমার কোনো আন্দাজ নেই। কিন্তু তুমি যদি এখান থেকে এক পা-ও নড়ো তাহলে আমি তোমার সো কলড পলাশের ব্যাপারটা তোমার আম্মুকে জানিয়ে দিব।”
-“আম্মু পলাশকে চিনে না।”
-“তো কি হয়েছে! তোমার কিছু ছবি এডিট করে তোমার আম্মুকে দেখিয়ে বলবো ‘দেখুন আন্টি আপনার মেয়ে একটা ৪২০ টাইপের ছেলেকে ভালোবাসে।’ তারপর আর কি! তোমার আম্মু তোমার বিয়ে দিয়ে দিবে। ওয়াহ্! কেয়া বাত হে পরশ! ইউ আর গ্রেট।”
-“আমার আম্মু আমার অনুমতি না নিয়ে কিছু করবে না।”
-“এসব কথা সব মায়েরাই বলে থাকে। কিন্তু নিজের মেয়ের ভালো চিন্তা করে পলটি খেতে দ্বিতীয়বার ভাবে না তারা।”
-“তুমিহ্… তুমি একটা ইডিয়ট।”
-“ধন্যবাদ। তবুও তুমি কোথাও যাচ্ছো না।”

আফির মন চাইছে বেডের পাশে স্যালাইন ঝুলিয়ে রাখা স্ট্যান্ড দিয়ে পরশের মাথায় বারি দিতে। কি পেয়েছে পরশ ওকে! ও কি পরশের বুকিং দেয়া নার্স? যে ওকে এখন এই উজবুকটার সেবা করতে হবে! পরশের উপর রাগ প্রয়োগ করতে না পেরে হাত দিয়ে সোফায় থাপড়াতে লাগলো সে। পরশ বেডে আধশোয়া হয়ে হাসছে আফির কাণ্ড দেখে। বেশ মজা লাগছে তার আফিকে জব্দ করতে পেরে। একেই হয়তো সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বলে।

মনোযোগ সহকারে ক্লাস করছে সকাল। স্নিগ্ধ ক্লাস নেই আজ তাদের সাথে। তাই স্নিগ্ধ তাকে ছুটির পর মেডিকেলের মাঠে দাঁড়াতে বলেছে। ক্লাস শেষ হতেই ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সেদিনের মেয়েটা এসে সকালের সামনে দাঁড়ালো। তবে আজ সেই মেয়ে একা নয়। তার সাথে আরও দু’জন আছে। সকাল সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“রাস্তা আটকালে কেন?”
-“তোমাকে সেদিনও ভালো ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তুমি ত্যাড়ামি করে চলে গিয়েছিলে। আজ আর সেই সুযোগ নেই।”
-“দেখো অযথা প্যাঁচাল না পেরে যা বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলো। আমার তাড়া আছে।”
-“বাহ্! তা এত তাড়া কিসের! বয়ফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে বুঝি?”
-“সে কথার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবনা নিশ্চয়ই!”
-“স্নিগ্ধ স্যার কি হয় তোমার?”
-“কেন জানতে চাইছো?”
-“তাকে তো নিজের রূপের জালে বেশ ভালো ভাবেই ফাঁসিয়েছো যা দেখলাম।”
-“আচ্ছা তোমার নামটা কি জানতে পারি আমি!”
-“ইমি।”
-“ইমি! ওকে। শোনো ইমি! আমার রূপ আছে দেখে আমি ফাঁসিয়েছি। এতে কি তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? যদি সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে তুমিও ফাঁসাও, আমি তো না করিনি। কাউকে ফাঁসানোর মতো যোগ্যতা আমার আছে জেনে ভালো লাগলো। আর তোমাকেও ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না ব্যাপারটা আমাকে জানানোর জন্য।”
-“তুমি চূড়ান্ত পর্যায়ের একজন ঘাড়ত্যাড়া।”
-“আমি জানি সেটা। শোনো! আমাকে সবাই বাচ্চা ভাবে বলে, এই না যে আমি কারও কথার যোগ্য জবাব দিতে জানি না। আমার ঘাড়ত্যাড়ামি আরও না দেখতে চাইলে সাইড চাপো। তোমার চোখ যে ডাক্তার সাহেবের উপর পড়েছে তা আমি মেডিকেলে আসার প্রথমদিনেই বুঝতে পেরেছি। সেজন্যই তোমার সাথে এই ব্যবহারটা করা। কারণ লাথো কে ভূত বাতো ছে নেহি মানতে। ডাক্তার সাহেব নিজেও তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। সেজন্যই তোমাকে ক্লাসে সবার সামনে কিছুদিন আগে খোঁচা মেরে কথা বলে বুঝিয়ে দিয়েছিল যাতে তুমি তার আশা ছেড়ে দাও। কিন্তু তুমি এখনো তার পেছনে পড়ে আছো।”
-“তুমি তার পেছনে ঘুরতে পারো তা কিছু না। আর আমরা ঘুরলেই দোষ!”
-“আমি তো তা বলিনি। আমি উনার পেছনে ঘুরেছি তার কারণ আলাদা। আর তাছাড়া তুমি, আমি এক না। আমাকে তোমার পাল্লায় মাপতে যেওনা। এবার সরো। আমার কাজ আছে। তোমার মতো হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে নেই আমি।”

ইমি রেগে তাকিয়ে রইলো সকালের যাওয়ার দিকে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগলো। পরক্ষণেই কি যেন মনে পড়তেই বাঁকা হাসলো সে। তার রাগটা মূলত স্নিগ্ধর উপর। স্নিগ্ধ তাকে ক্লাসের সবার সামনে অপমান করেছে কিছুদিন আগে। আসলে সেটাকে ঠিক অপমান বলা চলে না। তবে তার মনে লেগেছে প্রচুর। সেই রাগটাই সকালের উপর ঝাড়তে চাচ্ছিল সে। কিন্তু সকাল উল্টো তার রাগে আগুনে ঘি ঢালার মতো করে ঘি ঢেলে চলে গেল। ফলে তার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।

স্নিগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পাশে বসে থাকা সকালের দিকে। মেয়েটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। গাড়িতে বসেও যে কেউ এত আরামে ঘুমোতে পারে তা জানা ছিল না তার। সকালকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আজ অনেক ক্লান্ত সে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশি পরিশ্রম গিয়েছে সকালের ল্যাব ক্লাসে। সেজন্যই ক্লান্ত সে। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে সকালের দিকে ঝুঁকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো তার চেহারার দিকে। মেয়েটা এত সুন্দর কেন? সাধারণত এত সুন্দর আর নিখুঁত কারও চেহারা হয় না। তবে সকাল কেন এত নিখুঁত? স্নিগ্ধ ফুঁ দিল সকালের মুখে। তাতে হালকা নড়েচড়ে উঠে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো সে। স্নিগ্ধ হেসে আলতো করে সকালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। হুট করে গালে হাত রেখে এক আঙুল দিয়ে সকালের ঠোঁটে স্লাইড করলো। যা ভেবেছিল ঠিক তা-ই। এই পর্যন্ত যত বার সকালের গাল আর হাত ধরেছে তাতে ও নিজেই অবাক হয়েছে। কারণ সকালের গাল আর হাত একদম তুলোর মতো নরম তুলতুলে। যে কয়বার সকালকে জড়িয়ে ধরেছে তাতে এ-ও বুঝে গিয়েছে যে ওর শরীরটাও গাল আর হাতের মতোই নরম। কিন্তু ঠোঁটের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারেনি সে। আজ ঠোঁট স্পর্শ করে বুঝে গেল যে সকাল একটা আস্ত আইসক্রিম। যেকোনো মুহূর্তে গলে পড়ে যেতে পারে এমন কোমলতা পেয়েছে সে। নিজের হাসি বজায় রেখেই স্নিগ্ধ সকালের ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

ঘুম ভেঙে সকাল নিজেকে গাড়িতেই পেলো। পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে এখন স্নিগ্ধর কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিন্তু সে-তো সিটে মাথা হেলিয়ে রেখেছিল! হয়তো তার ঘুমের ভেতরে স্নিগ্ধ ইচ্ছে করে তার মাথাটা নিজের কাঁধে রেখেছে। যাতে তার ঘাড় ব্যথা না হয়। সকাল মুচকি হেসে মাথাটা হালকা উঁচু করে দেখে স্নিগ্ধ ফোনে কাজ করছে। সকাল চুপচাপ আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো। দু’হাতে স্নিগ্ধর একহাতের বাহু জড়িয়ে ধরলো। স্নিগ্ধ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সকালের দিকে তাকালো। মুখে হাসি দেখে বুঝতে পারলো সে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। এখন নিজের আলসেমির কারণে তার হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“ম্যাডাম কি আজ উঠবেন না!”
-“উঁহু।”
-“প্রায় চারটা বাজতে চললো। এখনো লাঞ্চ করো নি তুমি। এখন আবার উঁহু বলছো কেন?”
-“একদিন লাঞ্চ না করলে কি হবে?”
-“আপনি আরও বেশি শুঁকিয়ে যাবেন না খেলে। এমনিতেই যা অবস্থা তোমার শরীরের! আর কিছুদিন গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না তোমাকে।”
-“হুহ্! আমি এমনই ঠিক আছি।”
-“জ্বি না! মোটেও ঠিক নেই। তুমি একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়ে কি করে নিজের এই শরীরকে ঠিক বলো?”
-“বকছেন কেন?”
-“বকা খাওয়ার মতো কাজ করলে বকা দিব না? তোমার বডি ফিটনেস পরে। আগে তোমার সুস্থতা জরুরি। তুমি বেশির ভাগ সময়ই অসুস্থ থাকো শুধু মাত্র নিজের প্রতি এই অবহেলা গুলোর কারণে।”
-“প্লিজ কন্টিনিউ।”
-“হোয়াট কন্টিনিউ! তুমি কি আমার কথাগুলো সিরিয়াসলি নিচ্ছ না?”

সকাল দাঁত কেলিয়ে হাসলো। যার অর্থ না। স্নিগ্ধ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও সকালের দিকে তাকালো। চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,
-“আগামীকাল আমি তোমার ডায়েট চার্ট নিয়ে আসবো। সে অনুযায়ী তুমি খাওয়া-দাওয়া করবে। আর যদি শুনেছি যে কোনো অনিয়ম করেছো তাহলে টানা এক সপ্তাহ আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না তুমি।”
-“আচ্ছা এক সপ্তাহে কতদিন হয়?”
-“গাঁধি! এক সপ্তাহ মানে সাতদিন।”
-“আমি গাঁধি হলে আপনি গাঁধা। হুহ্!”
-“এখন বাসায় যেয়ে ফ্রেস হয়ে সর্বপ্রথম খাবার খাবে। তারপর যা মন চায় করবে।”
-“আমরা তো এখন মেডিকেলে না। তাহলে এখানে কেন টিচারগিরি করছেন?”
-“যা বলেছি চুপচাপ তাই করবে। তা না হলে নেক্সট সাতদিন আমি কোনো যোগাযোগ করব না তোমার সাথে।”
-“আমি আপনার কথা শুনবো তো। এমন করেন কেন?”
-“গুড! এখন যাও। গত একঘন্টা ধরে তোমার বাসার সামনে বসে আছি।”
-“আচ্ছা যাচ্ছি তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেন?”
-“আমি তাড়িয়ে দেয়ার কে? যেখানে আমি মানুষটাই সম্পূর্ণ তোমার।”

সকাল হাসলো। হাসলো স্নিগ্ধও। বিদায় নিয়ে সকাল বাসার গেইটের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“সাবধানে গাড়ি চালাবেন। আর হ্যা! অবশ্যই হসপিটালে যেয়ে সবার আগে লাঞ্চ করে নিবেন। আর আমাকে টেক্সট করতে ভুলবেন না।”
-“ঠিক আছে। তুমিও যেয়ে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিয়ো।”
-“আচ্ছা।”
-“তুমি ভেতরে যাও আগে তারপর আমি যাবো। তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। যে কেউ তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে পারবে।”
-“হুহ্! আমি এতটাও বাচ্চা নই।”
-“হ্যা বুঝেছি। যাও এখন।”

সকাল মুখ বাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেল। স্নিগ্ধ হালকা হেসে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

আরিফুল ইসলাম চুপ করে বসে সামনে তাকিয়ে আছেন। আজ টিলির মেজাজ পুরোদমে খারাপ তা বোঝা যাচ্ছে। তাই তিনি আগ বাড়িয়ে ঝারি খাওয়ার মতো কোনো কাজ করতে চাইছেন না। উনি যে বয়সে টিলির বড় টিলি তা গ্রাহ্যই করে না রেগে গেলে। আরিফুল ইসলাম না চাইতেও দাঁতে দাঁত চেপে ওকে সহ্য করে। কারণ টিলি বয়সে ছোট হলেও এই ব্যবসায়ে প্রতিটা পদক্ষেপ যথেষ্ট চতুরতার সাথে ফেলে সে। খুব সুন্দর করে প্রত্যেকটা ডিল নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসার এক অসীম ক্ষমতা আছে টিলির মাঝে। খুব সহজেই সব ক্লায়েন্টদের সাথে নিজেকে এমন ভাবে মিশিয়ে নিতে পারে যে সকল ক্লায়েন্ট টিলির প্রতি আকর্ষিত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু টিলি তাদের পাত্তা দেয় না।
-“আরিফুল সাহেব!”
-“হ্যা বলো।”
-“শুনলাম আপনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে!”
-“হ্যা। ছেলেটা মামনিকে পছন্দ করে। তাছাড়া তার আচার-ব্যবহার খুবই অমায়িক। আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওকে। আমি সব সময়ই এমন ছেলে চাইতাম আমার মেয়ের জন্য।”
-“সব খোঁজ খবর নিয়েছেন ছেলের ব্যাপারে?”
-“হ্যা সব খোঁজ খবর নেয়া হয়ে গিয়েছে।”
-“ওহ আচ্ছা।”

টিলি এবার নিজের চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ফেললো। চেষ্টা করেও পারছে না নিজের মাইন্ড অন্য দিকে ডাইভার্ট করতে। এক গভীর চিন্তায় তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। তবে কথাটা কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে না সে।
আরিফুল ইসলাম বুঝলেন না হঠাৎ করে তার মেয়ে-জামাইয়ের খবর কেন নিলো টিলি? হয়ত টিলিকে ব্যাপারটা জানানো হয়নি বলে। একবার তিনি ভাবলেন টিলিকে জিজ্ঞেস করবেন যে কি কারণে তার মেজাজ খারাপ। পরক্ষণেই আবার ভাবলেন যদি তাকে অপমানিত হতে হয় তাহলে! তারপরও কিছুটা সাহস জুগিয়ে গলা ঝেড়ে নিলেন সে।
-“ঠিক কি কারণে তুমি রেগে আছো জানতে পারি!”
-“আপনি কি গত একঘন্টা যাবৎ এই চিন্তাই করছিলেন যে আমাকে আমার রেগে থাকার কারণটা জিজ্ঞেস করবেন কি-না!”
-“হ্যা মানে না… আসলে হ্যা।”
-“ব্যক্তিগত জীবনে কিছু সমস্যায় ভুগছি।”
-“কি সমস্যা?”

আরিফুল ইসলামের এই প্রশ্ন শুনে টিলি এমনভাবে তাকালো যে ভয়ে মুখটা চুপসে গেল তার। আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস দেখালেন না তিনি। টিলি আবারও তার চিন্তায় ডুব দিল।

পরশ ঘড়িতে সময় দেখে আফিকে ডাক দিল। আফি চোখ খুলে বিরক্ত হয়ে তাকালো। হালকা হেসে পরশ বললো,
-“তোমাকে তো ঘুমিয়ে থাকার জন্য এখানে রাখিনি আমি।”
-“তাহলে কেন রেখেছো হ্যা! আমি কি তোমার পার্সোনাল নার্স?”
-“ভুল বলোনি কিন্তু। আপাতত তুমি তা-ই।”
-“আমার তোমাকে কি করতে মন চাইছে তুমি জানো!”
-“না বললে জানবো কীভাবে?”
-“আমার মন চাইছে তোমার ডান পা-টা এবার এক বারি দিয়ে ভেঙে তারপর তোমাকে পার্মানেন্টলি পঙ্গু বানিয়ে এখানে শুইয়ে রাখতে।”
-“তো দেরি কেন! ভেঙে ফেলো।”

আফি কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না আর। এই ছেলের সাথে ঝগড়া করতে গেলে একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেয়না। ছেলেরা যে এত ঝগড়া করতে পারে তা তো পরশকে না দেখলে জানতেই পারতো না আফি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আফি পরশের দিকে।
-“কি ভাঙবে না?”
-“মুখে কিছু বিশ্রী গালি আসছে। মনে মনে আপাতত সেগুলোই দিচ্ছি তোমাকে।”
-“হুমম মনে মনেই দাও, মুখে দিয়ো না। নাহলে তোমার ওই মুখ ভেঙে ফেলবো একেবারে।”
-“হুহ্!”
-“আচ্ছা আমাকে তোলো এখান থেকে। বাসায় যাবো এখন। আর ভালো লাগছে না।”
-“এখন কি তোমাকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে আমার!”
-“অবশ্যই। তা না হলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখতাম না তোমাকে।”
-“অসহ্য!”

আফি রেগে আবারও সোফায় কতক্ষণ থাপড়িয়ে উঠে বাইরে চলে গেল ফর্মালিটিস পূরণ করতে। একটু পরে আবারও কেবিনে এসে পরশের কাছে গেল সে। হুইলচেয়ারটা ঠিক করে পরশকে খুব সাবধানে ধরে বেড থেকে উঠিয়ে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বেরিয়ে গেল হসপিটাল থেকে।
সিএনজি থেকে নেমে আফি আবারও পরশকে ধরে বের করে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিল। হুইলচেয়ার ঠেলে এপার্টমেন্টের ভেতরে যেতে যেতে আফি জিজ্ঞেস করলো,
-“কোন ফ্লোরে থাকো!”
-“সেভেন।”
-“সাত তলা! লিফট আছে?”
-“হ্যা।”
-“থ্যাংক গড।”

লিফটে উঠে সাত তলার বাটনে ক্লিক করে পরশের দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আফি বললো,
-“তোমার সাথে বন্ধুত্ব করব না বলে মেডিকেলে প্রথম যে ঝগড়াটা করেছিলাম তার বদলা আজ নিলে তাই না!”
-“যা ভাবো তুমি।”
-“নেহাৎ আমি ভালো মানুষ বলে এতকিছু করলাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে না এতক্ষণ তোমার বাকি হাত-পা গুলোতেও প্লাস্টার লেগে থাকতো।”
-“হয়েছে নিজের এত প্রশংসা করা ভালো না।”
-“আমি ভালো তাই নিজেকে ভালো বলে দাবি করি।”
-“হ্যা জানা আছে তুমি কত ভালো।”

লিফট নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলে আফি পরশের হুইলচেয়ার ঠেলে লিফট থেকে বের হলো। দুটো দরজা দেখে আফি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে পরশ তাকে ডান পাশের দরজাটা দেখিয়ে দেয়। আফি দরজার সামনে গিয়েই উড়াধুরা বেল দিল কতগুলো। পরশ নিজের বাম চোখের ভ্রু চুলকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি করছো তুমি!”
-“বেল দিচ্ছি। কেউ দরজা খুলছে না কেন?”
-“এখানে আর কেউ থাকলে তো দরজা খুলবে!”
-“মানে?”
-“মানে এই যে চাবি! দরজা খুলো।”

আফি গাল ফুলিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে পরশকে ভেতরে নিয়ে গেল। পরশ হাত দিয়ে নিজের বেডরুম দেখিয়ে দিতেই আফি হুইলচেয়ার ঠেলে সেদিকে নিয়ে গেল। পরশকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বালিশ ঠিক করে শুইয়ে দিল সে। এই মুহূর্তে বাসা যেহেতু খালি তার মানে পরশকে না খেয়ে থাকতে হবে এখন। এই ভেবে আফি নিজের ব্যাগটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখলো।
-“রান্নাঘর কোনদিকে?”
-“খিদে পেয়েছে তোমার!”
-“কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে তোমার! খিদে পাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়!”
-“ওহ স্যরি। রান্নাঘর এখান থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে ডান দিকে। ফ্রিজে দেখো কিছু পেলেও পেতে পারো। আর নয়তো রান্নাঘরের ভেতরে থাকা কেবিনেটগুলো চেক করতে পারো। সেখানেও আপাতত খাওয়ার মতো কিছু থাকতে পারে সম্ভবত।”
-“ঠিক আছে তুমি বসো আমি দেখছি।”
আফি রুম থেকে বের হতে গেলে পরশ আবার ডাক দিল তাকে।
-“কি!”
-“আমার একটু ফ্রেস হওয়া দরকার ছিল। সাহায্য করবে প্লিজ!”
-“জ্বি কেন নয় স্যার! আমি তো আপনার পার্সোনাল নার্স আপাতত তাই না!”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে ধাম ধুম করে পা ফেলে পরশকে আবার হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিল আফি। ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুইয়ে দিল। আলমারি থেকে গেঞ্জি আর ট্রাউজার বের করে বিছানায় নামিয়ে রেখে। তাওয়াল ভিজিয়ে নিয়ে এসে একপাশে রাখলো। পরশকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে অনেকটা ইতস্তত করেই পরশের গেঞ্জিটা খুললো আফি। এই মুহূর্তে বেশ লজ্জা লাগছে তার। চোখ নিচে নামিয়ে নিয়ে আবারও কি মনে হতেই পরশের দিকে তাকালো সে। পরশ মিটিমিটি হাসছে আফির অবস্থা দেখে। তা দেখে আফি রেগে পরশের চুল ধরে জোরে টান দিল। ব্যথা পেলেও তার মুখের হাসি আরও বড় হলো। হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে আজ সেই বাংলার প্রবাদটা প্রমাণিত হলো। রাগ নিয়েই পরশের শরীর ভেজা তাওয়াল দিয়ে মুছিয়ে দিল আফি। ভালো গেঞ্জিটা পড়িয়ে দিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“এখন কি প্যান্টটাও আমি বদলে দিব!”
পরশ থতমত খেয়ে গেল আফির প্রশ্নে। আমতা আমতা করে বললো,
-“আরে নাহ্! কি বলো এসব? প্যান্ট আমি নিজেই বদলে নিতে পারবো। তুমি রান্নাঘরে যেয়ে নিজের জন্য খাবার খুঁজো।”
-“ইডিয়ট একটা।”

সবকিছু গুছিয়ে রেখে আফি রান্নাঘরে চলে গেল। ফ্রিজ খুলে খাওয়ার মতো তেমন কিছু পেলো না আফি। কেবিনেট খুঁজে স্যুপ, পাস্তা আর নুডলস পেলো। সেগুলো বের করে নিলো। রান্নাঘরের বাইরে আরেকটা ফ্রিজ দেখে সেটা খুললো আফি। সেখানে ফ্রোজেন পরোটা, চিকেন, নাগেটস ইত্যাদি আরও অনেক কিছুি পেলো সে। সবকিছু বের করে চুলগুলো উঁচু করে হাত খোঁপা করে ওড়নাটা বুকে দিয়ে কোমড়ে গুঁজে নিয়ে রান্নার কাজে লেগে পড়লো আফি।
আধঘন্টার মধ্যে সবকিছু তৈরি করে ট্রলিতে করে সব খাবার নিয়ে পরশের রুমে এসে দেখে পরশ ট্রাউজার চেঞ্জ করে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। আফিকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করতে গেলে হাতে ব্যথা পেয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো সে। আফি তাড়াতাড়ি গিয়ে পরশকে উঠিয়ে বসিয়ে দিল।
-“ব্যথা বেশি পেয়েছো?”
-“না ঠিক আছি।”
-“সাবধানে চলাফেরা করতে পারো না! তুমি এখন অসুস্থ তোমাকে সেটা বুঝতে হবে পরশ।”
-“আচ্ছা বুঝেছি তো! সে সব কথা বাদ দাও। তুমি এগুলো কি নিয়ে এসেছো?”
-“দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”

আফি ট্রলিটা বেডের পাশে দাঁড় করিয়ে একে একে সবকিছুর উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দিল। পরশ হা করে তাকিয়ে আছে। স্যুপ, নুডলস, পাস্তা, পরোটা, চিকেন ফ্রাই, নাগেটস, অমলেট, জুস আর চিকেন রোল। এতকিছু দেখে পরশ আফির দিকে তাকালো। আফি ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি! তাকিয়ে আছো কেন এভাবে?”
-“এতকিছু কার জন্য?”
-“তোমার চৌদ্দ গুষ্টি আছে তো বাসায়! তাদের জন্য।”
-“আরে রাগ করো কেন!”
-“দুপুরে কিছু খাওনি তুমি। আর তাছাড়া বাসা কাউকে দেখতে পেলাম না অর্থাৎ বিকেলেও তোমায় না খেয়ে থাকতে হবে। তাই একেবারে এসব বানিয়ে এনেছি বেশি করে। এখন খাবে, বিকেলে খাবে আর রাতে খাবে। অবশ্য রাতে খেতে খেতে তো মনে হয় তোমার বাসার সবাই চলে আসবে। তা-ও বানিয়ে দিলাম।”

পরশ ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আফির দিকে। আজ প্রথমবার কেউ ওর এতটা যত্ন করছে। নিজের বাবা-মা যেখানে কখনো সময় পায়নি ওকে দেয়ার মতো। তারা তো তাদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সেই কোন সকালে তারা দু’জন বেরিয়ে যায়। আর বাসায় আসে রাত এগারোটার পর। সারাদিনে সে কিছু খেয়েছে কি-না বা কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনটুকু মনে করে না। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মন চাইলে একবার এসে দেখে যায় আর না মন চাইলে নেই।
আফি পরশের দৃষ্টি দেখে অবাক হয়ে গেল। পরশের পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই পরশ আফিকে জড়িয়ে ধরলো। আফি থতমত খেয়ে গেল। পরশকে সরানোর চেষ্টা করতেই পরশ ওকে জড়িয়ে ধরেই বললো,
-“থ্যাংক ইউ সো মাচ আফি। আজ প্রথমবার কেউ আমার কেয়ার করলো। আর সেটা তুমি। জানো আগে কখনো আমার এত যত্ন কেউ করে নি। এমনকি আমার বাবা-মা-ও না। তারা তো তাদের জীবনে ব্যস্ত। তারা মনে করে আমাকে জন্ম দিয়েই তারা তাদের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে ফেলেছে। কখনো আমার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে না উনারা। বাসায় এসে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না যে আমি কেমন আছি বা সারাদিনে কিছু খেয়েছি কি-না। আচ্ছা সব বাবা-মায়েরা কি এমন স্বার্থপর হয়! কোথায় তোমার মা তো এমন নয়। তাহলে আমার বাবা-মা এমন কেন? আমি সারাদিন বাসায় একা থাকি। মন চাইলে নিজে কিছু বানিয়ে খাই আর না মন চাইলে না খেয়ে থাকি। বেচিরভাগ সময়ই বাইরে থাকি যাতে একাকিত্ব ভাবটা কিছুটা হলেও ঘুচে যায়। আজ সারাদিন তুমি আমার সাথে ছিলে এর জন্য আমার একটুর জন্যও মনে হয়নি আমি একা আছি। এর জন্যি তোমাকে আটকে রেখেছিলাম কারণ তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগছিল। থ্যাংক ইউ আমাকে আজকের দিনটা সময় দেয়ার জন্য।”

না চাইতেও আফির চোখে পানি জমে গেল। একহাতে তা মুছে নিয়ে সে হাত পরশের পিঠে রেখে অন্য হাতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিল। পরশ কিছুক্ষণ বাদে সরে এসে মাথা নিচু করে “স্যরি” বললো আফিকে। আফি কিছু না বলে মুচকি হাসলো।
-“এবার ঝটপট খেয়ে নাও তো!”
পরশ আহ্লাদী কণ্ঠে আফির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“একটু খাইয়ে দিবে আমাকে?”

আফি কেন যেন না করতে পারলো না পরশের ওই মায়াভরা চোখ দুটো দেখে। হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে পরশকে খাইয়ে দিতে লাগলো। খাওয়া শেষ করে দু’জনে মিলে কিছু কথাবার্তার পাশাপাশি খুনসুটি ঝগড়া করে অনেকটা সময় পাড় করে দিল। রাত সাড়ে আটটার দিকে পরশের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো আফি। আজ সারাটা দিন পরশের সাথে তার ভালোই কেটেছে। পরশকে ও যেমনটা ভাবতো আসলে পরশ তেমন নয়। যথেষ্ট ভালো ছেলে পরশ। শুধু নিজের বাবা-মায়ের অবহেলার কারণে সে একটু ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে এই আর কি! আজকে পরশের ব্যাপারে থাকা তার আগের সকল ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত হলো। এতে অবশ্য ও খুশিই হয়েছে। কিন্তু কেন তা জানা নেই।

চলবে….

নোটঃ যারা মনে মনে চিন্তা করবা যে আদ্রিতা আপু আজকে গল্প ছোট করে দিসে তাদের সবার কপালে জল্লাদ জামাই বা জল্লাদ বউ জুটবে👿 কত্ত বড় করে লিখছি আজকে তা দেখে আমি নিজেই অবাক😱 পুরো ৩০০৫ টা শব্দ আছে এখান😒😏

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here