সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৪৩

0
1430

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪৩_দ্বিতীয়_অংশ
.
হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আফিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সকাল। আফি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। সকালের চোখ বেয়েও পানি ঝরে পড়ছে। পরশ দৌড়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আন্টি কেমন আছে এখন?”

পরশকে দেখেই আফি পরশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো আফিকে নিজের সাথে।

-“হুঁশ কান্না করে না। তুমি যদি এভাবে কান্না করো তাহলে আন্টি কষ্ট পাবে না বলো! কিচ্ছু হবে না আন্টির। উনি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
-“আম..আম্মুর কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবো না পরশ।”
-“বললাম তো কিছু হবে না। তুমি শান্ত হও প্লিজ।”

পরশ আফিকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। সকাল ওদের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। ওর চোখ বেয়ে সমানে পানি গড়িয়ে পড়ছে। স্নিগ্ধর এত বড় একটা লুকিয়ে রাখা সত্যি কথা ও জানতে পারলো আজ, যা ওর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। তার ওপর আফির আম্মুর অসুস্থতা। দুটো দিক মিলেই সকাল পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছে। আফির আম্মুকে ছোটবেলা থেকেই নিজের আরেকটা আম্মু ভেবে এসেছে সকাল। উনার প্রতি আলাদা একটা টান আছে সকালের। তাই যখনি উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন তখনি সকাল নিজেও ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে যখন স্নিগ্ধর আম্মু ওকে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল, ঠিক সেই সময় আফি কল দিয়ে জানায় ওর আম্মু হঠাৎ করে স্ট্রোক করেছে। কথাটা শোনা মাত্রই তড়িঘড়ি করে হসপিটালে ছুটে এসেছে সকাল। আফির আম্মুকে অপারেশনের জন্য পাঠিয়ে অপারেশনের জন্য যত টাকার প্রয়োজন ছিল, সেসব টাকা রিসেপশনে যেয়ে জমা দিয়ে এসেছে সকাল। এই মুহূর্তে আফির কাছে টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না, তাছাড়া এত টাকা আফির কাছে নেই জেনেই ও নিজে টাকাটা জমা দিয়েছে।

সকাল হসপিটালের দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো। হাঁটুর ভেতরে মুখ গুঁজে কিছুটা জোরেই কেঁদে ফেললো সে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। স্নিগ্ধকে অনেক বিশ্বাস করেছিল, ভরশা করেছিল। অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে ও স্নিগ্ধকে। এত বড় ধোঁকা ও কখনোই আশা করে নি নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে। হ্যা অতীত মানুষের থাকতেই পারে। স্নিগ্ধরও নাহয় ছিল। কিন্তু স্নিগ্ধ কথাটা ওর কাছ থেকে লুকিয়ে গিয়েছে। এই বিষয়টা ওকে সব থেকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। ও ভাবতেই পারছে না স্নিগ্ধ ওকে ভালোবাসে না। আসলেই তো কথাটা কখনো মাথায় আসেনি সকালের। স্নিগ্ধ কখনো ওকে ভালোবাসি বলেনি। তবে ও কি করে ভাবতে পারলো যে স্নিগ্ধ ওকে ভালোবাসে? যে স্নিগ্ধর জীবনে নেই এখনো স্নিগ্ধ তাকেই ভালোবাসে, সেই নীলামকে ভালোবাসে। তাহলে কেন ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে স্নিগ্ধ! এতদিন স্নিগ্ধর করা যে কেয়ারিং-কে ও নিজের প্রতি স্নিগ্ধর অনুভূতি ভাবতো, আজ সে জানতে পারলো সেই কেয়ারিংগুলো শুধু বাধ্যবাধকতা ছিল। শুধু মাত্র আসমা বেগমের জন্য ওকে মেনে নিয়েছে স্নিগ্ধ, কথাটা যেন ওর বিশ্বাস হতে চাইছে না। কিন্তু তবুও তো এটাই সত্যি। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে সকালের।

স্নিগ্ধ ফোন হাতে বসে আছে প্রায় একঘন্টা হয়ে গেছে। আজ সারাদিনে না সকালের সাথে দেখা হয়েছে আর না কথা হয়েছে, এজন্য বেশ মন খারাপ তার। কিছুটা চিন্তায়ও আছে। মেডিকেলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন সকালের দেখা পেলো না তখন থেকে সকালের ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু সকাল কোনোবারই তার কল রিসিভ করে নি। মেয়েটার অভিমান কি এখনো একটুও কমে নি! এসব ভেবেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল স্নিগ্ধ। গাড়ি নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। বাসায় ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলেই আসমা বেগম পেছন থেকে স্নিগ্ধকে ডাক দিলেন।

-“কিরে এখন কি খবর আফির মায়ের?”
-“আফির মায়ের কি খবর মানে? তুমি আফিকে কি করে চিনো?”
-“বউমা এসেছিল সকালে আমার সাথে দেখা করতে। তখন হঠাৎ ওর একটা ফোন এলো। আর আমাকে বললো যে ওর বান্ধবী আফির আম্মু না-কি স্ট্রোক করেছে। তাই আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে গেল।”
-“মিস বিকাল এসেছিল! হঠাৎ কি মনে করে? আর আফির মা যে স্ট্রোক করেছে আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।”
-“কিছু মনে করে আসার কি আছে? দু’দিন পর তো এটা ওরই বাড়ি হবে। তাই আসতেই পারে।”
-“না মা আমি সেভাবে বলিনি।”
-“তুই কীভাবে বলেছিস শুনতে চাইনি। যা ফ্রেস হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি।”
-“আচ্ছা।”

রুমে ঢুকতে ঢুকতে স্নিগ্ধ আবারও সকালের নম্বরে কল দিল। কিন্তু একাই কল কেটে গেল কিছুক্ষণ পর। তার মানে এই বারও কল ধরেনি সকাল। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে পেছন ঘুরতেই চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। নীলামের ছবির উপর থেকে পর্দা সরানো দেখে অবাক হয়ে গেল ও। কিন্তু পর্দাটা সরালো কে? মা নয় তো! নাহ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। আবারও টেবিল থেকে ফোন নিয়ে স্নিগ্ধ নিচে গিয়ে চিল্লিয়ে ওর মা আসমা বেগমকে ডাকতে লাগলো। ছেলের চেঁচামেচি শুনে হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আসমা বেগম।

-“কি হয়েছে! চেঁচাচ্ছিস কেন?”
-“তুমি কি আজ আমার রুমে গিয়েছিলে?”
-“না তো কেন?”
-“তাহলে নীলামের ছবির উপর থেকে পর্দা সরিয়েছে কে?”
-“আমি তো জানি না। আজ সারাদিনে আমি একবারও ওমুখো হইনি।”
-“আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও ঠিক ছিল পর্দা।”
-“দাঁড়া জামিলাকে জিজ্ঞেস করি। জামিলা!”

জামিলাকে দু-তিনবার ডাকতেই তিনি উপস্থিত হলেন। আসমা বেগম রাগী চোখে জামিলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“তুই কি স্নিগ্ধর রুমে যেয়ে নীলামের ছবির উপর থেকে পর্দা সরিয়েছিলি?”
-“এ্যামা না না… আমি এরাম কোনো কাম করি নাই। আমারে তো আপনে স্নিগ্ধ বাবার রুমে পাঠাইছিলেন সকালে। ওই মাইয়াটা আইছিল না! ওয় ঠিক রুমে গেছে কি-না হেইডা দেখোনের লাইগা।”
-“সকাল!”
-“হয় হেতিই। তো আমি যহন রুমে ঢুকছি তহন দেহি হেতি নীলাম মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ায় আছে। চোক্ষে পানি ছিল হের। আমারে দেইখা জিগাইলো ছবিডা কার। আমি শুধু কইছি এইডা নীলাম মা। আর কিছু কই নাই। তহনি আপার ডাকে আমি চইলা আইছি রুম থিকা।”

আসমা বেগম আর স্নিগ্ধ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে ভীত চোখে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে আছে স্নিগ্ধর। ও কম্পিত কণ্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“মা! মি..মিস বিকাল কিছু জেনে যায়নি তো!”
-“আমিও তো বুঝতে পারছি না। মেয়েটার আচরণ বেশ অস্বাভাবিক লাগছিল যখন ও এসেছিল।”
-“ও যদি কিছু জেনে থাকে তাহলে নিজেকে সামলাতে পারবে না মা। এসব জেনে সহ্য করার মতো ক্ষমতা ওর নেই। আমি নীলামের ব্যাপারটা চাইলেই ওকে বলতে পারতাম। কিন্তু ও প্রচন্ড কষ্ট পেতো এইসব শুনে। সহ্য করতে পারতো না। তাই আমি ওর কাছ থেকে লুকিয়ে গিয়েছি।”
-“কি যা তা বলছিস! ও জানবে কীভাবে? নীলাম কে বা কি ছিল তা কি ও জানে না-কি! ও শুধু শুনেছে ছবিটা নীলামের।”
-“তুমি জামিলা খালার কথা শুনো নি! উনি বলেছেন! মিস বিকালের চোখে পানি ছিল। এর মানে ও নিশ্চয়ই কিছু জানতে পেরেছে। নাহলে এভাবে হুট করে বাসায় আসতো না। আর এসে থাকলেও আমার রুমে যেয়ে নীলামের ছবির উপর থেকে পর্দা সরাতো না। ছবিটা খুব ভালো ভাবে পর্দা দিয়ে ঢাকা ছিল। কেউ দেখলেও বুঝতে পারবে না যে ওখানে কোনো ফটোফ্রেম আছে। নিশ্চিত ও কিছু শুনেছে বা জানতে পেরেছে। তাই এসেছিল এখানে।”
-“(….)”
-“আমাকে এখনি ওর সাথে দেখা করতে হবে মা। ও এখন কি অবস্থায় আছে আমি জানি না। ওকে সামলাতে হবে এখন। বুঝিয়ে বলতে হবে সবটা। মা আমি আসছি।”

স্নিগ্ধ একদৌড়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। আসমা বেগম পেছন থেকে ভীত চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের যাওয়ার দিকে। ওইটুকু একটা মেয়ে এসব সত্যিই সহ্য করতে পারবে না। আসমা বেগম নিজেও দেখেছেন মেয়েটা তার ছেলের জন্য কি পরিমাণ পাগল। স্নিগ্ধর একটু বকাতেই চোখে পানি চলে আসে সকালের। এমনটা সাধারণত তখন হয় যখন খুব আপন কেউ বকা দেয়। সকালের ক্ষেত্রেও তার বিপরীত নয়। সকাল স্নিগ্ধকে নিজের আপন ভাবে তা ওর কথাবার্তা শুনলেই বুঝা যায়। আসমা বেগম এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে পড়লেন। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তার সকালের জন্য।

স্নিগ্ধ গাড়িতে বসতে বসতে আখিকে কল দিল। তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো আখি। স্নিগ্ধ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“মিস বিকাল কোথায় আখি?”
-“ও তো হসপিটালে। আফির আম্মু না-কি খুব অসুস্থ। তাই সারাদিন সেখানেই আছে ও। পলক আর মা-ও কিছুক্ষণ আগে গিয়েছে সেখানে। নয়ন ঘুমোচ্ছিল বলে আমি যেতে পারিনি।”
-“কোন হসপিটালে আছে? আমাকে অ্যাড্রেস পাঠা তাড়াতাড়ি।”
-“আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কি হয়েছে স্নিগ্ধ! তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। ভীষণ চিন্তায় আছিস মনে হচ্ছে।”
-“এখন এতকিছু বলার সময় নেই। শুধু এতটুকু জেনে রাখ মিস বিকাল হয়তো নীলাম আর আমার ব্যাপারে সবটা জেনে গিয়েছে।”
-“কিহ! কীভাবে? কে বলেছে ওকে?”
-“আমি জানি না কে বলেছে বা কীভাবে জেনেছে। এখন ও মানসিকভাবে ঠিক নেই এটাই জানি আমি। ওর আমাকে দরকার এখন। সব বুঝিয়ে বলতে হবে ওকে। রাখছি এখন আমি। তুই তাড়াতাড়ি হসপিটালের ঠিকানা পাঠা।”

স্নিগ্ধ ফোন কেটেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

কয়েকটা ফাইল হাতে নিয়ে বসে আছে মিহু। টিলি আর আরিফুল ইসলামের বায়োডাটাগুলো আরও একবার ভালো করে দেখছে ও।

-“আরিফুল ইসলাম পেশায় নামকরা একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু উনার এই মুখোশের আড়ালে উনি অন্যকিছু। অন্যের পরিবারের আনন্দ-উল্লাস কেঁড়ে নিয়ে এখানে নিজের পরিবারের সাথে আনন্দ-উল্লাসে দিন কাটাচ্ছেন উনি। যত ফূর্তি করার করে নিন মিস্টার আরিফুল ইসলাম। আপনার দিন ঘনিয়ে এসেছে।”

মিহু আপন মনে কথাগুলো বলছিল। ঠিক সেই সময় তানিশা ওর কেবিনে নক করলো। ভেতরে আসার অনুমতি দিতেই ভেতরে এসে তানিশা একটা ফাইল এগিয়ে দিল মিহুর দিকে। মিহু ফাইলটা হাতে নিয়ে তানিশার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে তানিশা বললো,
-“বাচ্চাদের যে গাড়িতে কিডন্যাপ করা হয়েছিল সেই গাড়িটা যিনি ভাড়া করেছিলেন তার ব্যাপারে সমস্ত ডিটেইলস এই ফাইলে আছে।”
-“ভ্যেরি গুড তানিশা।”
-“থ্যাংক ইউ ম্যাম।”

ফাইল খুলে সব ডিটেইলস পড়ে শেষ করতেই একটা ছবি পেলো শেষে। মিহু ছবিটা হাতে নিয়ে তানিশার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এইটাই কিডন্যাপারের ছবি?”
-“জ্বি ম্যাম।”

ছবিটা একটু ভালো করে দেখতেই চমকে উঠলো মিহু। তাড়াতাড়ি ছবিটা নামিয়ে রেখে অন্য একটা ফাইল খুঁজতে লাগলো ও। তানিশা মিহুর এমন হন্তদন্ত অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে ম্যাম আপনি এরকম করছেন কেন?”

মিহু ফাইলটা খুঁজতে খুঁজতে বললো,
-“ভয় পেয়ো না। আমি একটা ফাইল খুঁজছি। খুব জরুরি।”
-“আমি সাহায্য করবো?”
-“না লাগবে না। তুমি বসো, আমি দেখছি।”

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর ফাইলটা পেলো মিহু। ফাইলের ভেতর থেকে ঘেঁটেঘুঁটে একটা ছবি বের করলো। তারপর তানিশার দেওয়া ফাইল থেকে যেই ছবিটা পেয়েছিল সেই ছবির সাথে ছবিটা মিলিয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মিহু। তানিশা মিহুর কর্মকাণ্ড বুঝতে না পেরে চুপ করে বসে রইলো। মিহু ছবি দুটো একসাথে নিয়ে ভালো করে দেখতে দেখতে বললো,
-“তানিশা একটা পেন্সিল দাও তো!”

মিহুর দিকে পেন্সিল এগিয়ে দিতেই মিহু ছবি দুটো নিয়ে কিছু একটা করতে গিয়েও থেমে গেল। তানিশার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ছবি দুটোর এক্সট্রা কপি আছে তো!”
-“জ্বি ম্যাম আমার কাছে আছে।”
-“ওকে।”

মনোযোগ দিয়ে পেন্সিল দিয়ে এক ছবি দেখে আরেক ছবিতে আঁকাআকি করতে লাগলো মিহু। কিছুক্ষণ পরেই ছবি দুটো দেখে বাঁকা হাসলো ও। তানিশার দিকে ছবি দুটো এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“দেখো তো ছবি দুটো এক লাগছে কি-না!”

তানিশা ছবি দুটো দেখে অবাক হয়ে গেল। বিস্মিত চোখে মিহুর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ম্যাম! তার মানে এরা দু’জন একজনই?”
-“হুম। টিলি! এতদিন টিলি আমাদের দেশে থেকেই আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত টিলির আসল চেহারা কেউ দেখেনি। কিন্তু আজ ওর আসল চেহারা আমার হাতের মুঠোয়। এবার হাজার চাইলেও পালাতে পারবে না ও। তানিশা!”
-“ইয়েস ম্যাম। খোঁজ নাও ওর। দেখো এখন কোথায় আছে। শ্বশুরবাড়িতে বরণ করে নিয়ে আসতে যেতে হবে তো!”
-“জ্বি ম্যাম আমি এক্ষুণি খোঁজ নিচ্ছি। তার মানে ম্যাম আমরা বর্তমানে যে দুটো কেস নিয়ে কাজ করছিলাম আসলে কেস দুটো একটাই?”
-“হ্যা। যাও এখন খোঁজ নাও এই মহীয়সী নারীর। তিনি কোন সাপের গর্তে লুকিয়ে আছে আমরাও তো একটু জানি।”
-“ওকে ম্যাম।”

হসপিটালের তিনতলার করিডরে এসে থেমে গেল স্নিগ্ধ। আফি আর পরশ পাশাপাশি বসে আছে। আফির পাশেই রেহেনা বেগম বসে আছেন। বর্তমানে আফি তাকে জড়িয়ে ধরেই বসে আছে। পলক দাঁড়িয়ে আছে একপাশে দেয়াল ঘেঁষে। কিন্তু এখানে কোথাও সকালকে দেখতে পাচ্ছে না ও। ভয়ে বুক কাঁপছে স্নিগ্ধর। ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই পরশ দাঁড়িয়ে সালাম দিল। স্নিগ্ধ সালামের জবাব দিল। পলক এগিয়ে এসে স্নিগ্ধর কাঁধে হাত রাখলো।

-“তুমি এখানে!”
-“আখির কাছ থেকে শুনলাম আফির আম্মু না-কি অসুস্থ। তাই চলে এসেছি।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“এখন কেমন আছেন উনি?”
-“কিছু বলা যাচ্ছে না। আইসিইউ-তে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে উনাকে।”
-“ওহ!

স্নিগ্ধ পাশে তাকিয়ে আফির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আফি এখনো ফোঁপাচ্ছে। স্নিগ্ধ মাথায় হাত রাখতেই চোখ বুঁজে নিলো সে।

-“চিন্তা করো না। আন্টি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”

প্রতিত্তোরে আফি শুধু মাথা নাড়ালো। স্নিগ্ধ পলকের দিকে তাকালে পলক হালকা হাসলো। কারণ সে বুঝতে পেরেছে স্নিগ্ধ সকালকে খুঁজছে। পলক চোখের ইশারায় বেঞ্চের পাশে দেখিয়ে দিল। স্নিগ্ধ কপাল কুঁচকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখতেই বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো ওর। সকাল এখনো বেঞ্চের পাশে দেয়াল ঘেঁষে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে।

স্নিগ্ধ এগিয়ে এসে কিছুটা ভয় নিয়েই সকালের মাথায় হাত রাখলো। সকাল কিছু না বলে সেভাবেই বসে রইলো। স্নিগ্ধ ভেবেছিল সকাল ঝাড়া দিয়ে ওর হাত ফেলে দিবে। কিন্তু এমন কিছুই না হওয়ায় ও যেন খুশি হলো। হাঁটু মুড়ে সকালের সামনে বসে একহাত দিয়ে সকালের চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে অন্য হাত দিয়ে মুখ তুললো। সকালের চেহারা দেখেই আঁতকে উঠলো স্নিগ্ধ। চোখ-মুখ অস্বাভাবিক ফুলে আছে। চেহারা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা মানুষের এই এক সমস্যা। একটু ব্যাথা পেলে বা একটু কান্না করলেই চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। সকাল কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার সামনে যে স্নিগ্ধ বসে আছে সেটা জেনেই সে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এই মুহূর্তে স্নিগ্ধকে দেখলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

-“মিস বিকাল!”
-“(….)”
-“চোখ খুলো। দেখো আমি তোমার ডাক্তার সাহেব।”
-“(….)”
-“নিচে বসে আছো কেন তুমি? শরীর তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা লেগে যাবে তো! কিছুদিন আগেই জ্বর থেকে উঠেছো।”
-“(….)”
-“উঠো। আসো আমার সাথে। মুখের অবস্থা দেখেছো কি করেছো তুমি!”
-“(….)”
-“কথা বলছো না কেন? খারাপ লাগছে?”
-(….)”

পলক আর রেহেনা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন সকালের দিকে। মেয়েটার এমন অবস্থা তারা বুঝতেই পারেন নি। কিন্তু সকাল কথা বলছে না দেখে উনারা আরও বেশি অবাক হলেন। স্নিগ্ধ ওদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ওরা ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না। তাই তাড়াতাড়ি সকালের হাত ধরে ওকে উঠিয়ে বললো,
-“ওর বিশ্রাম প্রয়োজন। আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি ওকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।”

পলক সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধকে বললো,
-“হ্যা আমারও তাই মনে হয়। ওকে এখন বাসায় নিয়ে যাও। আমি আর মাম্মা এখানে আছি। একটু দেখে রেখো ওকে স্নিগ্ধ।”
-“চিন্তা করো না। আমি আছি।”

স্নিগ্ধ সকালকে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যেতে লাগলো। সকালও কোনো প্রকার কথা না বলে চুপচাপ যেতে লাগলো স্নিগ্ধর সাথে। যেন সে একটা রোবট। গাড়ির কাছে এসে সকাল দাঁড়িয়ে গেল। এই মুহূর্তে ওর শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। মাথাটা ভনভন করছে। চোখের সামনে আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে গেল ওর। ঢলে পড়লো স্নিগ্ধর বুকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here