সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৪৪

0
1478

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪৪
.
বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে দুটো বেল দিতেই মেঘের আম্মু এসে দরজা খুলে দিল। মিহু একগাল হেসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মেঘের আম্মুও হেসে মিহুর কপালে চুমু দিলেন।

-“আচ্ছা মামনি আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”
-“কি গো নাতবউ! এত রাতে কোত্থিকা আইলা?”

মেঘের দীদার গলা শুনতেই চমকে উঠে পাশে তাকালো মিহু। মেঘের দীদাকে দেখে অনেকটাই অবাক হলো ও। সকালে যখন অফিসে গেল তখনো তো উনি ছিলেন না। তার মানে ও অফিসে যাওয়ার পর এসেছেন উনি। মিহু কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে সালাম দিল দীদাকে। উনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
-“কইলা না তো কোত্থিকা আইলা এত রাতে?”
-“এত রাত কোথায় দীদা? সবে তো মাত্র নয়টা বাজে।”
-“নয়টা রাত না! এই সময়ে আমাগো গ্রামে সবাই ঘুমায় যায়। আর তুমি কও এইটা রাত না!”
-“দীদা এটা ঢাকা শহর। এখানে রাত বারোটা বাজলেও রাস্তায় মানুষজনের অভাব হয় না।”
-“তুমি তো মাইয়া মানুষ। তুমি বাইরে থাকবা ক্যান? মাইয়া মানুষের অতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে নাই।”
-“আমি তো আর এমনি এমনি বাইরে থাকি না। আমি একজন সিআইডি অফিসার। আমার কাজ থাকে বলেই আমি বাইরে থাকি। তাছাড়া আমাদের মতো পুলিশ অফিসার বা সিআইডি অফিসারদের রাত-দিন বলতে কিছু থাকে না দীদা। যখনি কাজ থাকবে তখনি যেতে হবে বাইরে।”
-“মরণ! তুমি হইলা গিয়া এই বাড়ির বউ। বাড়ির বউ গো বাইরে কাম করন লাগবো ক্যান? ঘরে থাকবা, ঘর-সংসার সামলাইবা। এইটাই হলো তোমার কাম। বাইরে কাম করবো পুরুষ মাইনসেরা। এই তোমাগো মতো মাইয়াগো লইগাই আইজকাইল পুরুষ মাইনসে ঘরে বউ থুইয়াও বাইরে পেরেম-পিরিতি কইরা বেড়ায়। তখন তো তোমগো সহ্য হয় না। দোষ দাও পোলাগোরে। আগে নিজেগো দোষটা দেখবার শিখো বুজছো!”
-“কোন বইতে বা কোথায় লেখা আছে যে ঘরের বউরা বাইরে কাজ করতে পারবে না! নারী-পুরুষ সমান অধিকার। এই কথাটা সব জায়গায় লেখা আছে। তাছাড়া যেই সম্পর্কে ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান, মায়া থাকে না সেই সম্পর্ক এমনিতেও টিকে না। নাহলে যেসব মেয়েরা শুধু ঘরের কাজ করে, সংসার সামলায় তাদের কখনো তালাক হতো না। আবার অনেক মেয়ে আছে যারা বাইরে চাকরি করে কিন্তু এখনো তাদের সংসার টিকে আছে। কারণ তাদের সম্পর্কে ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান, মায়া সব আছে। যাই হোক এই নিয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাইছি না। যদি কিছু ভুল বলে থাকি তাহলে মাফ করে দিবেন দীদা। মা! আমি রুমে যাচ্ছি। একটা কেস নিয়ে খুব ব্যস্ত আমি। কাল বা পরশু এর ভেতরে আসামিকে ধরতে হবে। তাই আজ আর তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না।”
-“কোনো সমস্যা নেই মা। তুই ঘরে যা। ফ্রেস হয়ে কাজ কর। কিন্তু! রাতে খাবার না খেতে চাইলে মারবো ধরে বলে দিলাম।”
-“আচ্ছা সে দেখা যাবে তখন। এখন আমি গেলাম।”
-“মেঘ কোথায় রে!”
-“একটু পরেই চলে আসবে। আমি আসার সময় দেখলাম ফাইলপত্র গোছগাছ করছিল।”
-“ওহ আচ্ছা ঠিক আছে।”

মিহু রুমে ঢুকতে গেলেই দীদার কথা শুনে থেমে গেল।

-“আমার নাতিটারে এখনো পর্যন্ত একটা বাচ্চা-কাচ্চার মুখ দেখাইতে পারলো না, আইসে বাইরে কাম করতে। বলি তুমি বাইরে কাম করো আমার কোনো সমস্যা নাই। তয় আমার নাতিরে আগে মুক্তি দাও। আমি আবার ওর বিয়া দিমু। একটা সুন্দরী বউ আনুম যে আমার নাতীরে একটা বাচ্চা দিতে পারবো। তুমি তো এই বাড়িতে বিয়া কইরা আইছো দশ বছর পাড় হইয়া যায়গা। এখনো একটা বাচ্চা দিতে পারলা না। তার মানে তোমার বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। তোমার মতো অক্ষম বউ লাগতো না। আমার আদরের নাতিডা কি আজীবন বাচ্চা-কাচ্চা ছাড়া থাকবো না-কি! বংশের কি হইবো! বংশ বাড়ান লাগবো না?”
-“আহ মা! কি শুরু করলেন আপনি! মেয়েটা সবে মাত্র বাইরে থেকে এলো। তাছাড়া ওরা বাচ্চা-কাচ্চা নিবে কি নিবে না এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাচ্চা হচ্ছে না মানে এই না যে মিহু অক্ষম। ওরা এখন নিতে চাইছে না বাচ্চা তাই হচ্ছে না। আর যদি অক্ষমতার কথাই বলেন তাহলে শুধু মিহুর দিকেই কেন আঙুল তুলছেন! এমনও তো হতে পারে যে মেঘ অক্ষম। সব সময় মেয়েদের দিকে আঙুল তোলা বন্ধ করুন মা।”

মিহু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দীদার দিকে। কি নিচু চিন্তা ভাবনা মানুষের। ওর যখন বিয়ে হয়েছে তখন তো ওর বিয়ের বয়সই ছিল না। আর তাছাড়া ওর আর মেঘের সম্পর্ক তো আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক নয়। তাহলে বাচ্চাটা আসবে কোত্থেকে! আকাশ থেকে পরবে না-কি আজব! কিন্তু এই মহিলাকে এইসব বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। উনি যে কেমন মানুষ তা মিহুর জানা আছে। এতগুলো বছর ধরে মানুষটাকে দেখে আসছে ও। কখনো ওকে কটু কথা শোনাতে পিছপা হন না উনি। মিহু এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেঘের মাকে দীদা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিহু বললো,
-“দীদা কয়েকটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। আপনি যেভাবে কথা বলছেন মনে হচ্ছে ছেলের বউরা শুধু বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন। তার মানে নিশ্চয়ই আপনার শ্বাশুড়িও আপনাকে এভাবেই চাপ সৃষ্টি করতো বাচ্চা দেওয়ার জন্য। উনি আপনাকে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন ভাবতো বলেই তো আপনি মামনিকে তারপর আমাকেও বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন ভাবছেন। যাই হোক এই কথা বাদ দিই। আপনি আপনার আদরের নাতি আসলে তাকে বইলেন সে যেন আরও একটা বিয়ে করে। যদি সে রাজি হয় তাহলে আমি কিছুই বলবো না। করুক সে আরও একটা বিয়ে। এনে দিক আপনার কোলে তার বাচ্চা। ও যদি আমাকে তালাক দিতে চায় তাহলেও আমি কিছু বলবো না। কারণ আমার সতীনের ঘর করার কোনো ইচ্ছে নেই। ও বিয়ে করতে রাজি হওয়ার পর যদি নিজে থেকে আমাকে তালাক না-ও দেয় তাহলে আমি নিজেই ওকে তালাক দিয়ে দিব। কিন্তু! ও যদি বিয়ে করতে রাজি না হয় আর আমাকেও না ছাড়তে চায় তাহলে আমি কোথাও যাবো না। কথাটা ভালো করে শুনে রাখুন। আর দয়া করে এখানে যতদিন আছেন ততদিন আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না। কারণ আপনার কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। আর যদি আপনি আপনার মুখ বন্ধ রাখতে না পারেন তাহলে আমাকে বলে দিন। আমি হোটেলে রুম বুক করে নিবো। যতদিন আপনি এখানে থাকবেন ততদিন আমি হোটেলেই থাকবো।”

কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো মিহু। ওর ডান গাল জ্বলে যাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে চোখ মেলতেই মেঘকে দেখে অবাক হয়ে গেল ও। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছে। মেঘের দীদা এতক্ষণ রাগে ফুঁসছিলেন মিহুর কথা শুনে। হুট করে মেঘ এসে মিহুকে থাপ্পড় মারায় উনি বেশ খুশি হয়ে গেলেন। এখন আর তেমন একটা রাগ লাগছে না। মেঘ দু-চোখ ভরতি রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে মিহুর দিকে। মিহুকে এভাবে থাপ্পড় মারায় রেগে গেলেন মেঘের আম্মু। উনি মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন।

-“মেঘ! তুই ওকে মারলি কেন?”
-“ওর সাহস কত বড় মা! ও আমার দীদার সাথে খারাপ ব্যবহার করে! এতদিন কিছু বলিনি দেখে মাথায় উঠে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। আমি তোমাকে একদিন বলেছিলাম না! দেখো তোমার আদরের বউমাকে বেশি মাথায় উঠিও না নাহলে তোমাদের সম্মান করতে ভুলে যাবে। দেখলে তো আজ তার নমুনা। আসলে কি বলো তো! অনাথ মেয়ে তো, ওর বাবা-মা ছোটবেলায়ই মরে গেছে বলে কোনো শিক্ষা পায়নি ও। তাই আজ ওর এই অবস্থা।”
-“আমাকে যা বলার বলেছো। কিন্তু আমার মৃত বাবা-মাকে নিয়ে কিছু বললে তোমার জন্য ভালো হবে না মেঘ।”

অত্যন্ত শান্ত সুরে কথাগুলো বলে রুমে যেয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল মিহু। মেঘ রেগে পাশের টেবিলে লাথি মেরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। টেবিলটা কাঁচের হওয়ায় নিচে পরেই ভেঙে গেল। মেঘের মা রাগী চোখে নিজের শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে কিছু কথা শোনাতে চেয়েও চুপ করে গেলেন। এই মহিলার সাথে কথা বলা আর দেয়ালে মাথা ঠুকা একই ব্যাপার। এই ভেবে হনহনিয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন।

ঘন্টাখানেক পরে দরজায় টোকা পড়ায় দরজা খুললেন মেঘের আম্মু। মিহুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেক অবাক হলেন। মেয়েটা যে কান্না করেছে এতক্ষণ তা বুঝতে বাকি রইলো না উনার। মলিন একটা হাসি দিয়ে মিহু বললো,
-“মামনি আজ রাতে আমি তোমার সাথে ঘুমাই? বাবা তো বাসায় নেই। কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছে। সমস্যা হবে তোমার!”
-“নাহ! সমস্যা কেন হবে? আমার সাথে ঘুমাবি এতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে! সোজা আমার রুমে এসে শুয়ে পড়বি।”
-“কি বলো তো মামনি! আমি তো অনাথ। যতই তোমার ছেলের বউ হয়ে থাকি না কেন আমি জানি আমি এই বাড়ির আশ্রিতা, তোমাদের ঘাড়ের বোঝা।”
-“মারবো এক থাপ্পড়। কি বলছিস এসব তুই?”
-“মামনি আমি অন্য কোথাও পোস্টিং এর জন্য অ্যাপ্লাই করেছি। আমি… আমি এখানে আর থাকতে চাইছি না। যদি আমাকে কোনোদিন একটুও ভালোবেসে থাকো তাহলে তুমি আমাকে আটকাবে না। আর প্লিজ আপাতত এই কথাটা কাউকে জানিও না।”
-“মিহু! কি বলছিস তুই? তুই যদি চলে যাস তাহলে আমি থাকবো কি করে মা? তুই তো এই বাড়ির বউ। আমার ছেলের বউ।”
-“মেঘকে বলে দিও ও যেন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে ফেলে। আমাকে পেপার পাঠিয়ে দিলে আমি সাইন করে দিব। তারপর সুন্দর আর লক্ষ্মী দেখে একটা বউ নিয়ে এসো। আমি তো সারাদিন অফিসে থাকি। শুধু রাতের সময়টুকু তোমাকে দিতে পারি। আমি যাওয়ার পর এমন একটা বউ নিয়ে এসো তোমার ছেলের জন্য যে সারাদিন তোমার সাথে থেকে তোমাকে সঙ্গ দিতে পারবে।”
-“মা এসব বলিস না। আমি আর কাউকে তোর জায়গায় বসাতে পারবো না।”
-“আমার জায়গায় কেন বসাবে! সে নিজের জায়গা আলাদাভাবে তৈরি করে নিবে। এখন এসব কথা বাদ দাও তো। আসো আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে। অনেকদিন তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না।”

মেঘের আম্মুর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো মিহুর কথা শুনে। মিহুকে আজ পর্যন্ত কাঁদতে দেখেন নি উনি। যেদিন ওর বাবা-মা মারা গিয়েছিল সেদিনও কাঁদে নি মিহু। এতগুলো বছর পর উনারই ছেলের কারণে মেয়েটার চোখে পানি এসেছে। মিহু উনাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। মেঘের আম্মু অসহায় হয়ে মিহুর দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে স্নিগ্ধ। ওর সামনেই নয়নকে কোলে নিয়ে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত আখি। স্নিগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত সকালের দিকে। তখন সকাল হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল স্নিগ্ধ। একবার হসপিটালে নিতে চেয়েও পরে কি যেন ভেবে সকালকে কোলে তুলে গাড়িতে বসিয়ে সোজা সকালের বাসায় চলে এসেছে। বাসায় এসে চেকআপ করে বুঝতে পারলো সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে সকালের প্রেশার লো হয়ে গিয়েছে। আর বেশি চিন্তা করার কারণে ওর ব্রেইন সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে সকাল। বর্তমানে ঘুমোচ্ছে সে।

-“চিন্তা করিস না স্নিগ্ধ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না ও নীলামের ছবির কথা কীভাবে জানলো? কে বলতে পারে ওকে নীলামের কথা!”
-“এমন তো একজনই আছে যে চায় না তুই অন্য কাউকে বিয়ে করিস।”
-“কে?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবাক হয়ে আখির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“অনন্যা!”
-“ও ছাড়া আর কে!”
-“তার মানে অনন্যা ওকে নীলামের ব্যাপারে জানিয়েছে? এক মিনিট! ফোন কোথায় মিস বিকালের? একটু খুঁজে দে তো! নয়ন তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। ওকে শুইয়ে দে।”

আখি নয়নকে শুইয়ে দিয়ে সকালের ব্যাগ খুঁজে ওর ফোন বের করে দিল স্নিগ্ধকে। ফোনটা হাতে নিয়েই ভ্রু কুঁচকে তাকালো ঘুমন্ত সকালের দিকে।

-“কি হয়েছে?”
-“পাসওয়ার্ড চাচ্ছে লক খোলার জন্য।”
-“ওর পাসওয়ার্ড তো আমি জানি না।”

স্নিগ্ধ সকালের নাম দিয়ে চেষ্টা করে দেখলো, কিন্তু খুললো না। নয়নের নাম দিয়ে চেষ্টা করলো। তারপরও খুললো না। শেষে কি যেন মনে হতেই ডাক্তার সাহেব লিখলো। সাথে সাথেই লক খুলে গেল ফোনের। স্নিগ্ধ অবাক হয়ে সকালের দিকে তাকালো। মেয়েটা আসলেই পাগল। মৃদু হেসে ফোনের কল লিস্ট চেক করে দেখতে লাগলো। হঠাৎ একটা নাম্বারে চোখ আটকে গেল ওর। নিজের ফোনটা বের করে সেদিন অনন্যা যেই নতুন নম্বর থেকে কল দিয়েছিল ওকে সেই নম্বরের সাথে মিলিয়ে দেখতেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে নিমিষেই। আখি তা খেয়াল করে বললো,
-“কি হয়েছে?”
-“অনন্যাই ওকে কল করেছিল।”
-“দেখছিস! বলেছিলাম না ওই কুটনী ছাড়া আর কেউ হবে না।”
-“এই অনন্যাকে তো আমি…
-“আগে সকালের জ্ঞান ফিরুক! ওকে সব বুঝিয়ে বল। তারপর অনন্যার ব্যবস্থা করিস।”

স্নিগ্ধ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সকালের দিকে। কিছুক্ষণ বাদেই হালকা গোঙানির শব্দে চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। পাশে তাকিয়ে দেখলো সকাল কেমন যেন করছে। তাড়াতাড়ি ওর পাশে বসে গালে হাত রাখতেই আরেক দফা চমকে উঠলো ও। সকালের জ্বর এসেছে। কিছুদিন আগেই জ্বর থেকে উঠে এখন আবার জ্বর! চিন্তিত হয়ে আখিকে ডাকতে লাগলো স্নিগ্ধ।

-“কি হয়েছে ডাকছিস কেন?”
-“ওর তো আবার জ্বর এসেছে।”
-“কিহ! সেদিনই তো জ্বর সারলো ওর।”
-“তুই একটু মাথায় জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দে। আর কিচেনে গিয়ে গরম গরম স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আয়। সেটা খাইয়েই ওষুধ খাওয়াতে হবে ওকে।”
-“আচ্ছা।”

আখি জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেই স্নিগ্ধ সকালের পাশে বসে রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে লাগলো। আখি স্যুপ নিয়ে আসার পর স্নিগ্ধ সকালকে উঠিয়ে নিজের বুকের সাথে ধরে খুব কষ্টে একটু স্যুপ খাইয়ে দিল। তারপর ওষুধ খাইয়ে আবার শুইয়ে দিল।

-“আমার মনে হয় তোর এবার বাসায় যাওয়া উচিৎ। সারাদিন মেডিকেল আর হসপিটালে ছিলি। আবার এখানে সকালের সাথে ছিলি। এখন বাসায় যেয়ে বিশ্রাম কর। আবার কাল আসিস। আজ সকাল উঠবে বলে মনে হয় না। কাল সকাল সকাল এসে ওর সাথে কথা বলে নিস।”
-“কিন্তু…
-“কোনো কিন্তু না স্নিগ্ধ। তোর সত্যিই এখন বাসায় যাওয়া উচিৎ। আমি খেয়াল রাখবো তোর মিস বিকালের। আন্টি হয়তো বাসায় বসে চিন্তা করছে তোর জন্য। যা এখন।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়াল রাখিস ওর। আমি কাল আসবো।”

সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে কপালে গাঢ় চুমু খেলো স্নিগ্ধ। আখি হাসলো। এই ছেলে বলে সকালকে ভালোবাসে না। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সকালকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। স্নিগ্ধ আখির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো সকাল। কাল রাতে স্নিগ্ধর সাথে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ছিল। এরপর কি হয়েছিল কিছুই মনে নেই। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। শোয়া থেকে উঠে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইল খুঁজতে গেলে দেখে পাশের ছোট টেবিলের উপর মোবাইলটা নামানো রয়েছে। মোবাইলে সময় দেখে নিলো। এগারোটা বাজতে চললো প্রায়। সকাল আফিকে কল দিল।

-“হ্যালো আফি!”
-“হ্যা বল! ঠিক আছিস তুই?”
-“আমার আবার কি হবে? আমি ঠিক আছি। আন্টি কেমন আছে এখন?”
-“ভালো। আম্মুকে বেডে শিফট করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে দু-তিনদিন পর বাসায় নিয়ে যেতে পারবো।”

সকাল স্বস্তি পেলো কথাটা শুনে। পরক্ষণেই রেহেনা বেগম আর পলকের কথা মনে পড়তেই জিজ্ঞেস করলো,
-“মাম্মা আর ভাইয়া কোথায়? এখনো ওখানেই আছে না-কি!”
-“আন্টি আম্মুর কেবিনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর পলক ভাইয়া একটা কাজে বাইরে গেছে।”
-“মাম্মা সারারাত ঘুমায়নি নিশ্চয়ই! অসুস্থ হয়ে পড়বে এভাবে জেগে থাকলে। আমি আসছি একটু পরে। তুই মাম্মাকে বাসায় পাঠিয়ে দে।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। তুই ধীরেসুস্থে আয়। আমি আন্টিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
-“হুম।”

ফোন কেটে চোখ বন্ধ করে বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো সকাল। স্নিগ্ধর কথা মনে পরতেই চোখে পানি এসে গেল। এত ভালোবাসার বদলে এই ছিল ওর কপালে! বাম হাতে থাকা আংটির দিকে তাকালো সকাল। একা একাই বিরবির করে বললো,
-“আমি আপনাকে এই শর্তে ভালোবাসিনি যে আপনারও আমাকে ভালোবাসতে হবে। আপনি নীলামকেই ভালোবাসুন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু আপনি আমার হয়ে থাকলেই হবে। আপনাকে আমি হারাতে পারবো না ডাক্তার সাহেব। আপনি আমার জীবনে থেকেই আপনার নীলামকে ভালোবাসুন। আমি কিচ্ছু বলবো না। শুধু আমাকে ছেড়ে যাবেন না কখনো। নাহলে আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো। আমি যে আমার মনটা আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। মন ছাড়া তো মানুষ পাথর হয়ে যায়। আমি চাই না আপনি আমাকে পাথর বানিয়ে দিন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আপনি অন্য একজনকে ভালোবাসেন জানতে পেরে। কিন্তু তার থেকেও হাজার গুণ বেশি কষ্ট হবে যদি আপনি আমাকে আপনার জীবন থেকে বের করে দেন। আমি এই কষ্ট তো সহ্য করে নিবো। কিন্তু যদি কখনো আমাকে আপনি আপনার জীবন থেকে বের করে দেন তাহলে আমি সহ্য করতে পারবো না ডাক্তার সাহেব। আপনার মিস বিকাল সারাজীবনের জন্য আপনাকে নিজের পাশে চায়। ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব। নিজের থেকেও বেশি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here