সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৪৬

0
1566

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪৬
.
মাঝরাস্তায় রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সকাল। এখনো হালকা জ্বর আছে শরীরে। আখিকে অনেক বুঝিয়ে খুব কষ্টে রাজি করিয়ে তারপর ও বের হয়েছে বাসা থেকে। গাড়ি নিয়েই বের হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে যাওয়ায় এখন রিকশার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে যেয়ে আগে আফির আম্মুকে দেখতে চায় ও। ফোন বের করে সময় দেখে নিলো। রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি আসছে ফুল স্পিডে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সকাল। এত জোরে কেউ গাড়ি চালায়? কথাটা ভাবতে না ভাবতেই গাড়িটা ওর সামনে এসে থামলো। গাড়ির ভেতর থেকে দু’জন লোক বেরিয়ে এসে জোর করে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল তারা। সকালের চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের লোকজন সবাই শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়িটা চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে লাগলো।

অনেকটা পথ অনন্যার গাড়িটাকে অনুসরণ করে মাঝপথে হারিয়ে ফেলেছে মিহু। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর। এভাবে হাতের নাগালে টিলি ওরফে অনন্যাকে পেয়ে হারিয়ে ফেললো? কিছুটা সামনে চোখ যেতেই একটা ছোটখাটো ভিড় দেখে গাড়ি থামালো মিহু। গাড়ি থেকে নেমে ভিড়ের সামনে যেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে এখানে?”
-“একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এখানে। হঠাৎ দ্রুত বেগে একটা গাড়ি এসে মেয়েটার সামনে থেমে মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটা অনেক চিৎকার করছিল।”
-“হোয়াট! আপনারা সবাই কি করছিলেন তখন! ওদের আটকাতে পারেন নি!”
-“আরে ম্যাডাম আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় কে পড়তে চায় বলুন!”
-“যেদিন মাঝরাস্তা থেকে ঠিক একইভাবে আপনার বোন, বউ বা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে সেদিনও কি এই কথাই বলবেন আপনি? আপনাদের মানবতা দেখলে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে এই দেশে জন্ম নেওয়ার জন্য।”

মিহু আর কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে আরো চারজন অফিসার আছে।

-“ম্যাম টিলির লোকেশন পেয়ে গিয়েছি। ওর গাড়ি এখান থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে যেয়ে থেমেছে।”
-“তাহলে দেরি কেন! গাড়ির স্পিড বাড়াও। আর হেডকোয়ার্টারে ফোন করে বাকি অফিসারদের ডেকে নাও। না জানি সেখানে কি বিপদ অপেক্ষা করছে। আর অন্য অফিসারদের খবর দাও একটা মেয়েকে পেছনের রোড থেকে অপহরণ করা হয়েছে। তাকে যেন খুঁজে বের করে।”
-“ম্যাম আমার মনে হয় এটা টিলির কাজ। ও নিজের সেফটির জন্য মেয়েটাকে কিডন্যাপ করেছে।”
-“হতেও পারে ঠিক নেই। চলো তাড়াতাড়ি।”

লোকেশন অনুযায়ী এসে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো মিহু আর অফিসাররা। সামনেই একটা পুরোনো ভাঙা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেখানে যথেষ্ট কড়া পাহাড়া দেওয়া। মিহুরা একপাশে লুকিয়ে পড়লো।

-“তার মানে টিলি এখানেই আছে।”
-“ম্যাম দেখুন এখানে একটা ব্যাগ পেয়েছি।”
-“কার ব্যাগ এটা? চেক করে দেখো কিছু ক্লু পাও কি-না!”

সম্পূর্ণ ব্যাগ খুঁজে একটা আইডি কার্ড পেলো। সেটা মিহুকে এগিয়ে দিল। আইডি কার্ডটা দেখে অবাক হয়ে গেল মিহু। দ্রুত ফোন বের করে মেঘকে কল দিল ও। হঠাৎ মিহুর কল দেখে অনেকটাই অবাক হলো মেঘ। ফোন রিসিভ করতেই মিহু বললো,
-“মেঘ কোথায় আছো আপনি?”
-“অফিস থেকে টিম নিয়ে বের হচ্ছি আপনার দেওয়া লোকেশনে আসার জন্য। খবরদার আমি না আসা পর্যন্ত ভেতরে ঢুকবেন না।”
-“আপনি আমার বস না। আমি আপনার বস। তাই আমাকে হুকুম দেওয়া বন্ধ করুন। যাই হোক! আপনার বন্ধু ডক্টর স্নিগ্ধর ফিয়ন্সে সকালকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।”
-“কিহ! কখন, কীভাবে? কে করেছে আর আপনি কীভাবে জানলেন?”
-“প্রশ্ন করবেন ভালো কথা। তাই বলে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে! আচ্ছা শুনুন! টিলি ওরফে অনন্যা মানে স্নিগ্ধর কাজিনই সকালকে মাঝরাস্তা থেকে অপহরণ করেছে। কথাটা স্নিগ্ধকে জানান আর দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি আসুন। বাংলা সিনেমার মতো সবকিছু শেষ হওয়ার পর আসবেন না।”
-“পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো।”
-“এতটাও দ্রুত গাড়ি চালাবেন না যাতে সময়ের আগেই উপরের টিকিট হাতে পেয়ে যান।”

মিহু ফোনটা কেটে দিয়ে পেছন থেকে রিভলবার বের করে আবারও সেই পুরোনো বাড়িটার দিকে তাকালো।

চোখের সামনে সব ঝাপসা ঝাপসা দেখছে সকাল। ভালো করে চোখ মেলতেই নিজেকে একটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় পেলো। ওর মনে পড়ে গেল ওকে রাস্তা থেকে কারা যেন অপহরণ করে নিয়ে এসেছে। কারা যেন কেন বলছে! ও স্পষ্ট দেখেছে গাড়ির ভেতরে অনন্যা বসে ছিল। কিন্তু অনন্যা ওকে কেন অপহরণ করবে? ভেবে পেলো না সকাল। চিল্লিয়ে “কেউ আছেন” বলে ডাকতে লাগলো ও। কিছুক্ষণ বাদেই রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো অনন্যা। তাকে দেখে সকাল রেগে গেল।

-“এসব কি অনন্যা আপু! তুমি আমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছো কেন? আর আমাকে অপহরণই বা কেন করেছো?”
-“আমি তো তোকে অপহরণ করতে চাই নি। আমার লোকেরা গাড়ি চালাচ্ছিল আর আমি পেছনের সিটে আরাম করে বসে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মাঝরাস্তায় তোকে দেখে একা ছেড়ে আসতে মন চাইলো না। তাই তুলে নিয়ে এসেছি।”
-“কিন্তু কেন?”
-“কারণ তুই আমার জানের দিকে হাত বাড়িয়েছিস। স্নিগ্ধকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেয়ার চেষ্টা করছিস তুই। খুব ভুল করেছিস। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়ে অনেক বড় ভুল করেছিস। স্নিগ্ধ শুধু আমার। ও আর আমার মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকতে চাইলে আমি তাকে ছাড়বো না। শেষ করে দিব তাকে। পথের কাটাদের কি করে উপ্রে ফেলতে হয় তা আমার জানা আছে।”
-“তুমি মনে হয় জানো না যে ডাক্তার সাহেব আমাকে ভালোবাসে না। উনি নীলাম নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসেন।”
-“জানবো না আবার! নীলাম তো আমারই বোন ছিল। আমার ছোট বোন ছিল নীলাম।”
-“কিহ! তোমার বোন? এখন কোথায় সে?”
-“তাকে তো আমি অনেক আগেই সরিয়ে দিয়েছি স্নিগ্ধর জীবন থেকে। এবার তোর পালা।”
-“সরিয়ে দিয়েছো মানে?”
-“মানে!”

সকালের দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে সামনের টেবিল থেকে একটা ধারালো ছুরি তুলে নিয়ে সেটা সামনের পুতুলের গায়ে গেঁথে দিল। সকাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অনন্যার দিকে। হঠাৎই অনন্যা হু হা করে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। হাসিটা কোনো স্বাভাবিক হাসি নয়। এ যেন এক পৈশাচিক হাসি।

লোকেশন অনুযায়ী গাড়ি এসে থামতেই স্নিগ্ধ একপ্রকার দৌড়ে বের হলো গাড়ি থেকে। মিহু স্নিগ্ধকে অবাক হয়ে গেল। মেঘ গাড়ি থেকে বের হতেই ভ্রু কুঁচকে মিহু বললো,
-“স্নিগ্ধ এখানে কি করছে?”
-“আসলে স্নিগ্ধকে সকালের ব্যাপারটা জানাতেই ও অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছে। হাজার বারন করা স্বত্বেও ওকে বোঝানো যাচ্ছিল না। বলা চলে, একপ্রকার জোর করেই এসেছে ও আমাদের সাথে।”
-“এখন কথা বলে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। ভেতরে যেতে হবে। তা-ও খুব সাবধানে।”
-“হুম।”
-“আর স্নিগ্ধ আপনি এখানে একজন অফিসারের সাথে থাকুন। আগে আমরা জায়গাটা ক্লিয়ার করে নিই তারপর আপনি ভেতরে আসবেন।”

স্নিগ্ধ প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু পরে মিহু আর মেঘের অনেক বোঝানোর পর রাজি হয়েছে।

অনন্যা একটা চেয়ারে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। এতগুলো বছর নিজের আসল চেহারাটা সবার কাছ থেকে গোপন রেখেছে ও। সব সময় ছদ্মবেশে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছে, কথা বলেছে। এমনকি আরিফুল ইসলামও আজ পর্যন্ত ওর আসল চেহারা দেখেনি। হাত গোনা দু’জন লোকই শুধু ওর আসল পরিচয় জানতো। কিন্তু তারা তো জীবনে মরে গেলেও কখনো ওর পরিচয় ফাঁস করবে না। তাহলে সিআইডিরা খবর কি করে পেলো যে ও-ই আসলে টিলি! আজকের পর থেকে ওর পরিবারের লোকজনের সাথেও দেখা করতে পারবে না ও। ওকে এখন থেকে সবাই মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল বলেই চিনবে। ওর স্নিগ্ধর কি হবে! স্নিগ্ধকে কখনোই ও নিজের করে পাবে না সেটা ও জানতো। কিন্তু তাই বলে এতদিন যে চোখের দেখাটুকু দেখতো এখন কি তা-ও পারবে না! এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসলো ওর কানে। চোখ মেলে বিরবির করে বললো,
-“এই সিআইডি অফিসারগুলো আমাকে আর শান্তি দিল না। এখানেও কুকুরের মতো শুঁকতে শুঁকতে চলে এসেছে। ধ্যাত!”

চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল অনন্যা। এখন ওকে এই জায়গা ছাড়তে হবে।

সম্পূর্ণ বাড়ির সকল গার্ডদের মেরে ভেতরে ঢুকে দেখে কেউ নেই। মিহু অনেক অবাক হলো। টিলি আর সকালের তো এখানেই থাকার কথা। তাহলে কোথায় গেল ওরা? বাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো টিলি পেছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাথে দু’জন গার্ড আছে। আর দু’জন গার্ডের সাথে দুটো মেয়ে রয়েছে। মেয়ে দুটোর মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। দুটো মেয়ের মধ্যে যে একটা সকাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মিহু সাথে সাথেই কিছুটা জোরে চেঁচিয়ে বাকি অফিসারদের উদ্দেশ্যে অনন্যাকে ধরতে বললো। নিজেও দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

হেলিকপ্টারের সামনে এসে গুলির শব্দ পেয়ে থেমে গেল অনন্যা ওরফে টিলি। পেছন থেকে মেঘ, মিহু আর বাকি অফিসাররা দৌড়ে আসছে। সাথে আছে স্নিগ্ধ। অনন্যা স্নিগ্ধকে দেখে হেসে দিয়ে বললো,
-“বাহ! প্রেমিকার টানে এখানেও চলে এসেছো?”
-“অনন্যা তুমি কিন্তু ভুল করছো। ছেড়ে দাও সকালকে। ও তোমার কোনো ক্ষতি করে নি।”
-“ও আমার ক্ষতি করে নি। কিন্তু করার চেষ্টা তো করেছে! ও আমার কাছ থেকে তোমাকে কেঁড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। এটাই তো আমার ক্ষতি করা হয়ে গেল।”
-“আমি কোনোদিনও তোমার ছিলাম না অনন্যা। তুমি নিজের মনে ভুল ধারণা তৈরি করেছো। সকালকে ছেড়ে দাও বলছি। নাহলে কিন্তু তোমাকে অনেক বেশি পস্তাতে হবে।”
-“ইশশ! কি প্রেম! আমাকেও যদি এইভাবে একটু ভালোবাসতে! তবে যাই বলো না কেন এই মেয়েকে তো তার শাস্তি পেতেই হবে।”
-“সকালকে কিচ্ছু করবে না তুমি। ও নির্দোষ, নিষ্পাপ। ও কোনো ভুল বা অন্যায় করে নি। ও শুধু আমাকে ভালোবেসেছে। আর এটা কোনো অন্যায় নয়।”
-“আচ্ছা স্নিগ্ধ এখন যদি আমি তোমাকে বলি সকাল অথবা নীলামের ভেতরে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে তাহলে তুমি কাকে বেছে নিবে?”
-“নীলাম বেঁচে নেই, সকাল আছে। আর আমার সকালকেই লাগবে।”
-“যদি বলি নীলাম এখনো বেঁচে আছে তখন!”
-“মানে?”

অনন্যা একজন গার্ডকে ইশারা করতেই সে-ই গার্ড তার সাথে থাকা মেয়েটার মুখের উপর থেকে কালো কাপড় সরিয়ে দিল। কাপড়টা সরতেই স্নিগ্ধ ‘থ’ হয়ে গেল। স্নিগ্ধর সাথে মেঘও প্রচন্ড অবাক হলো। এটা তো…

-“নীলাম!”
-“হ্যা নীলাম।”
-“কিক..কিন্তু ও তো…
-“গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল তাই তো!”
-“হ্যা।”
-“আচ্ছা বুঝলাম। তা তোমরা ওর লাশ খুঁজে পেয়েছিলে?”
-“(….)”
-“পাওনি তাই না! পাবে কি করে ও তো এখনো বেঁচে আছে।”
-“তার মানে তুমি!”
-“হ্যা আমি। আমি অনন্যা ওরফে টিলিই তোমার নীলামকে তোমার জীবন থেকে সরিয়েছি। ও আমার কাছ থেকে তোমাকে কেঁড়ে নিতে চেয়েছিল। আমি তো এত সহজে ওকে ছেড়ে দিতাম না।”
-“ও তোমার বোন অনন্যা।”
-“আই ডোন্ট কেয়ার। যে মেয়েই তোমার দিকে হাত বাড়াবে তাকেই খুব ভয়ানকভাবে ভুগতে হবে।”

স্নিগ্ধ টলমল চোখে নীলামের দিকে তাকালো। কতদিন পর এই চেহারাটা সামনা-সামনি দেখছে। মেয়েটার চেহারার কি অবস্থা হয়েছে! চোখের নিচে দেবে গিয়ে গাঢ় কালচে দাগ পড়েছে। চেহারাটা কেমন যেন জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেছে। শরীর অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ঠিক মতো তাকাতেও পারছে না। দেখে মনে হচ্ছে ওকে ড্রাগস দেয়া হতো। স্নিগ্ধর একদিক দিয়ে এটা ভেবেই ভালো লাগছে যে নীলাম এখনো বেঁচে আছে। অন্যদিকে অনন্যার উপর রাগটা তরতর করে বেড়ে চলেছে। এই অনন্যা মেয়েটা এত জঘন্য! স্নিগ্ধর সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন নীলামের দিকে। নীলামকে দেখে ও নিজের আশেপাশের সবকিছুর কথা একদম ভুলতে বসেছে।

মিহু অনন্যার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
-“যে নিজের বোনকে পর্যন্ত ছাড় দেয় না সে অন্য মেয়েদের উপর দয়া করবে কি করে! অনন্যা তুমি তো একটা মেয়ে! তুমি কি করে অন্য মেয়েদের জীবনগুলো নষ্ট করেছো? তারা তো কোনো অন্যায় করে নি।”
-“অন্যদের দিয়ে আমার কি! আমি শুধু নিজেরটা বুঝি। আমি খুশি তো সব জায়েয।”

মেঘ বাঁকা হেসে বললো,
-“তোমার এই ভুল ধারণাকে ভাঙতেই আমরা এসেছি। জেল তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা তোমাকে সেখানে অর্থাৎ তোমার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি। আর বাকি অফিসাররা তোমাকে বরণ করার জন্য বসে আছে।”
-“তোমরা এসেছো বলেই কি আমাকে যেতে হবে? ভুলে যেওনা আমি টিলি। এতদিন একা হাতে এত বড় নারী পাচার আর ড্রাগস পাচারের ব্যবসা সামলে এসেছি। আর সেই আমি কি-না এত সহজে তোমাদের হাতে নিজেকে সপে দিব! এই কথা ভাবলে কি করে?”
-“এখান থেকে পালানোর কোনো পথ খোলা নেই। তাই ভালো এটাই হবে, নিজেকে আমাদের হাতে সপে দাও।”
-“স্যরি অফিসার। আমি এত তাড়াতাড়ি তোমাদের হাতের নাগালে আসছি না।”

অনন্যা শয়তানি হাসি দিল। হেলিকপ্টারের তীব্র শব্দে সবাই আকাশের দিকে তাকালো। এত নিচে হেলিকপ্টার দেখে অবাক হলো সবাই। হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে একজন লোক দড়ি ফালালো নিচে। অনন্যা ইশারা করতেই যে গার্ড সকালকে ধরে রেখেছিল, সেই গার্ড একহাতে সকালকে ধরে অন্য হাতে শক্ত করে দড়ি ধরলো। সাথে সাথেই হেলিকপ্টার সেখান থেকে উড়ে আরও উপরে চলে গেল। হেলিকপ্টারের ভেতরে থাকা লোকগুলো দড়ি টেনে গার্ডসহ সকালকে উপরে তুলে নিলো।

-“ওহ শিট! অনন্যা এটা কি করলে? সকালকে ওখানে কেন পাঠালে?”

মিহুর প্রশ্নে শব্দ করে হেসে ফেললো অনন্যা। বললো,
-“তোমরা তো আমাকে এত সহজে এখান থেকে যেতে দিতে না। তাই ওকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে হলো। এখন ভালো মানুষের মতো আমাকে এখান থেকে যেতে দাও নয়তো সকালকে সারাজীবনের মতো ওপরে পাঠিয়ে দিবে ওরা।”
-“তোমাকে আমি…

মিহু রেগে অনন্যার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে মেঘ ধরে ফেললো ওকে। মিহু অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। ওর দৃষ্টি উপেক্ষা করে মেঘ বললো,
-“পাগলামি করতে যাবেন না। সকালকে বাঁচাতে হবে আমাদের। তার জন্য অনন্যার কথা এই মুহূর্তে শোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

মিহু কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেল। হঠাৎই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অনন্যা মিহুকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। মেঘও বাঁকা হাসছে।

-“ওয়েল অনন্যা ওরফে টিলি! তোমার খেল খতম।”

মিহুর কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই পেছন থেকে কে যেন অনন্যার মাথায় রিভলবার ধরলো। অনন্যা চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তানিশা দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে গেল অনন্যা। বললো,
-“তুমি! তোমাকে তো আমি শ্যুট করেছিলাম।”
-“উফফো টিলি! তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ আমরা কারা! এরকম একটা দুটো গুলি আমাদের হাতে-পায়ে লাগতেই পারে। তাই বলে তো আমরা দিনের পর দিন হসপিটালে পরে থাকব না তাই না! এরকম অনেক গুলিই খেয়েছি। তা-ও তোমাদের মতো অমানুষদের ছেড়ে দিইনি কখনো।”

তানিশার কথা শেষ হতেই দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইলো অনন্যা ওর দিকে। ভেতরে ভেতরে অনেকটা ভয় কাজ করছে। কিন্তু তা চেহারায় প্রকাশ করছে না। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে পড়ছে ওর। একবার ওপরে হেলিকপ্টারে থাকা সকালের দিকে তাকালো। আরেকবার পাশে থাকা নীলামের দিকে তাকালো। মিহু নীলামের কাছে এগিয়ে যেতে গেলেই অনন্যা গার্ডকে চোখে চোখে ইশারা করলো। নীলামকে ধরতে গেলেই পেছন থেকে একটা রড বের করে মিহুর মাথায় জোরে বারি দিল গার্ড। মিহু চিৎকার করে মাথায় হাত দিয়ে নিচে বসে পড়লো। তা দেখে চমকে উঠলো মেঘ। তানিশাও ভয় পেয়ে মিহুর দিকে তাকালো। সুযোগ বুঝে অনন্যা তানিশার হাত মোচড় দিয়ে রিভলবার ফেলে দিয়ে দৌড় দিল। গার্ডও নীলামকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে অনন্যার পেছন পেছন দৌড় লাগালো। মেঘ দৌড়ে মিহুর কাছে আসতে আসতে পেছন থেকেই অনন্যাকে শ্যুট করে দিল। তানিশা রিভলবার উঠিয়ে সেই গার্ডকে শ্যুট করে দিল।

স্নিগ্ধ দৌড়ে এসে নীলামকে ধরলো। মেঘ মিহুকে ধরতেই ওর বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। মাথার একপাশ পুরো ভিজে গেছে রক্তে। মিহুর একহাত লাল হয়ে গেছে রক্ত লেগে। তানিশাও ততক্ষণে এসে মিহুকে ধরে ফেলেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে মিহুর। পানি পড়ছে চোখ থেকে। এর মাঝে হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে সবটা দেখে লোকগুলো সকালকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। নিচে নদী থাকায় সকাল সোজা নদীতে গিয়ে পড়লো। স্নিগ্ধর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। ও নীলামকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছে। মিহু মাথায় একহাত চেপে ধরে খুব কষ্টে বললো,
-“মেঘ! সকালকে বাঁচান। আমার সাথে তানিশা আছে। আমার কিছু হবে না।”

মেঘ একবার না করতে চেয়েও পারলো না। আসলেই সকালকে এখন বাঁচাতে হবে। মেয়েটার হাত যে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। মেঘ কিছু না বলে মিহুর দিকে তাকিয়ে প্রায় সাথে সাথেই জ্যাকেট খুলে রেখে পানিতে ঝাঁপ দিল।

চলবে….

নোটঃ ইনশাআল্লাহ আজ সন্ধ্যা সাতটায় পেইজ থেকে অডিও লাইভে থাকব আড্ডা দেয়ার জন্য। আশা করি আপনারা সবাই থাকবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here