সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৪৭Extra_Part

0
1649

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#Extra_Part
.
প্রতিটা নার্স বেশ সাবধানে কাজ করছে। কিছুক্ষণ আগে স্নিগ্ধর ঝারি খেয়ে সবাই তটস্থ হয়ে গেছে। নীলামের পাশে বসে আছে স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে নীলামের। মাঝখানে হঠাৎ ওর শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল জেনে নার্সদের ধমকিয়ে একাকার করে ফেলেছিল স্নিগ্ধ।

নীলাম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর দিকে। কিন্তু স্নিগ্ধর দৃষ্টি ওর হাতে থাকা নীলামের রিপোর্টের দিকে। কতদিন পর স্নিগ্ধকে দেখছে নীলাম। ছেলেটা আগের থেকে বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। কিছুটা শুকিয়ে গেছে অবশ্য কিন্তু তা-ও খারাপ লাগছে না দেখতে। রিপোর্ট দেখে ফাইল বন্ধ করে নীলামের দিকে তাকালো স্নিগ্ধ। একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছে ওর।

-“এখন কেমন লাগছে?”
-“ভালো।”
-“ঠিক আছে। তাহলে তুমি বিশ্রাম করো।”
-“কেমন আছো তুমি?”
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমাকে দেখে আরও ভালো লাগছে।”
-“(….)”
-“এখন এত কথা বলা ঠিক হবে না তোমার। তুমি বিশ্রাম নাও। আমি আসছি।”
-“(….)”

স্নিগ্ধ নীলামের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ও যদি একবার পেছন ফিরে তাকাতো তাহলে বিস্মিত চোখে নীলামের অবাক হওয়া চেহারাটা হয়তো দেখতে পেতো। স্নিগ্ধর ব্যবহার খুবই অদ্ভুত লাগলো নীলামের কাছে। কেন যেন মনে হলো ওর প্রতি স্নিগ্ধর যে অনুভূতিগুলো ছিল তা এখন আর নেই।

-“আমার কেন মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ আমাকে উপেক্ষা করে চলে গেল? আচ্ছা ও কি আমাকে এখন আর ভালোবাসে না? সময়ের সাথে সাথে কি আমার প্রতি ওর ভালোবাসাটাও ওর জীবন থেকে মুছে গেছে?”

নীলামের মনে এরকম আরও অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। এখনো নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না নীলাম।

কেবিনে এসে বসতেই একজন নার্স ওর কেবিনের দরজায় নক করলো। স্নিগ্ধ তাকে ভেতরে আসতে বলে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে।

-“স্যার ডক্টর পাভেল একটা জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছেন। উনি বলেছিলেন উনার একজন পেশেন্ট আসবেন। তার রিপোর্টগুলো যাতে আপনি একটু দেখে দেন।”
-“আচ্ছা। পেশেন্ট এসেছে?”
-“জ্বি। বাহিরে অপেক্ষা করছে।”
-“পাঠিয়ে দিন।”

স্নিগ্ধ নীলামের রিপোর্টটা ড্রয়্যারে রেখে দিল। পেশেন্ট কেবিনে নক করে ভেতরে প্রবেশ করলো। স্নিগ্ধ তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কারণ লোকটি নীলামের অফিসের বস। যাকে এতদিন নীলামের মৃত্যুর কারণ ভাবতো স্নিগ্ধ। এই মুহূর্তে খুব খারাপ লাগছে স্নিগ্ধর। অকারণে একজনকে এতদিন মনে মনে দোষারোপ করে গেছে ও। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে উনাকে সালাম দিল।

-“আরে তুমি!”
-“জ্বি আঙ্কেল আমি। আসুন বসুন এখানে।”
-“ডক্টর পাভেল তোমার কথাই বলেছিল তাহলে!”
-“জ্বি।”
-“তা কেমন আছো বলো!”
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালে আছি। আপনি কেমন আছেন?”
-“ভালো। এই যে এই রিপোর্টগুলো দেখাতেই এসেছি আমি।”
-“আঙ্কেল আসলে আমার আপনাকে স্যরি বলার ছিল।”
-“কেন?”
-“এতদিন আমি ভাবতাম আপনি নীলামকে লাস্ট যে নিউজটা করতে দিয়েছিলেন, সেই নিউজটা করার জন্যই ও মারা গিয়েছে। এই জন্য আপনার প্রতি আমার একটা চাপা রাগ ছিল মনে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।”

হাসলেন উনি। বললেন,
-“তা তোমার এই ভুল ধারণাটা ভাঙলো কি করে?”
-“নীলাম বেঁচে আছে। আর ওকে এতদিন কিডন্যাপ করে রাখা হয়েছিল। ওরই মেজো বোন করেছিল কাজটা।”
-“কিহ!”
-“জ্বি।”

নীলামের আম্মু নীলামের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তার মেজো মেয়েটা যে এতটা খারাপ, তা উনি কল্পনাও করতে পারেন নি। বুকের ভেতরে পাথর চেপে অনন্যাকে ভুলে আছেন। নীলামকে ফিরে পেয়ে একদিকে যেমন খুশি তিনি, অন্যদিকে অনন্যাকে হারিয়ে ঠিক ততটাই কষ্ট পাচ্ছেন।

-“বাবা, নিপা আপু আর শিহাব কোথায় মা?”
-“তোর বাবা রাজশাহী গিয়েছেন। তোর খবর পেয়ে তিনি দেরি না করে বাসে উঠে পড়েছেন। এখন রাস্তায় আছে। চলে আসবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে। আর শিহাবের পরীক্ষা ছিল। তাই ওকে ভার্সিটি পাঠিয়ে দিয়েছি জোর করে।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“হুম।”
-“আচ্ছা মা! ফুপিমনি আর স্নিগ্ধকে একটু অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে। মানে ওরা আমার সাথে কেমন যেন ছন্নছাড়া ব্যবহার করছেন। কি হয়েছে মা? ওরা আমার সাথে এমন কেন করছে?”
-“স্নিগ্ধর সাথে বেশি কথা বলিস না।”
-“কেন?”

প্রচন্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো নীলাম। ওর মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-“স্নিগ্ধর বাগদান হয়ে গেছে।”
-“কিহ! মজা করছো তুমি আমার সাথে?”
-“না। এটাই সত্যি। আসমা আপা নিজে পছন্দ করেছেন মেয়েকে। মেয়ের নাম সকাল। স্নিগ্ধ যে মেডিকেলে শিক্ষকতা করছে, সেই মেডিকেলেরই ছাত্রী ও। স্নিগ্ধ নিজেও মেয়েটাকে পছন্দ করে। ওকে দেখলেই বুঝা যায় ও অনেক দূর্বল সকালের উপর। তাই তোকে বলছি স্নিগ্ধর থেকে দূরে থাকিস।”
-“কখনো না মা। আমি ভালোবাসি ওকে। তাছাড়া স্নিগ্ধ নিজেও আমায় ভালোবাসে। আমি ছিলাম না বলে ও আমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাবে! আর এখন আমি ফিরে আসার পর তা হতে দিব? কখনো না। স্নিগ্ধ আগেও আমাকে ভালোবাসতো আর এখনো বাসে। ওই সকালের প্রতি ওর দূর্বলতা তৈরি হতে পারে না। ও শুধু আমার। আর আমাকেই ভালোবাসতে হবে ওর।”
-“এমন পাগলামি করিস না নীলাম। তুই এতগুলো বছর ছিলি না। তাই স্নিগ্ধর অন্য মেয়ের প্রতি দূর্বল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া ওর আচরণে প্রকাশ পায় ও মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তুই স্নিগ্ধর আশা ছেড়ে দে। আরও ভালো কাউকে পাবি তুই নিজের জন্য।”
-“মা আমার জেদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই তোমার ধারণা আছে! আমি এই জেদ দিয়েই একসময় স্নিগ্ধকে নিজের করেছিলাম। আর এখনো সেটাই করবো আমি।”
-“আমি তোর ভালোর জন্য বলছি নীলাম!”
-“ভালো মাই ফুট! চলে যাও এখান থেকে। তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে। তুমি আমার মা না-কি ওই সকালের মা? কে এই সকাল? ও কি দেখতে আমার থেকেও বেশি সুন্দর যে স্নিগ্ধ এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে ওই সকালের মায়ায় পড়ে গেল?”
-“মেয়েটা আসলেই ভয়াবহ সুন্দরী।”

নীলাম অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের মায়ের দিকে। ওর রাগ লাগছে প্রচুর।

স্নিগ্ধ হাসপাতালের কাজ শেষ করে নিজের বাসায় চলে গেল। নীলামের সাথে নীলামের মা আর শিহাব আছে। তাছাড়া কোনো সমস্যা হলে নার্স আর ডাক্তাররা তো আছেই। স্নিগ্ধ বাসায় ঢুকে নিজের রুমে যেতে গেলে পেছন থেকে আসমা বেগমের ডাকে থেমে যায় ও।

-“মা! এত রাতে তুমি এখনো জেগে আছো যে!”
-“যে মায়ের ছেলে ৪ দিন ধরে লাপাত্তা হয়ে থাকে, সেই মা কি করে ঘুমোতে পারে?”
-“আমি হাসপাতালে ছিলাম মা। নীলাম কত অসুস্থ ছিল জানোই তো তুমি!”
-“আর বউমা! বউমা যে কতটা অসুস্থ ছিল তা জানিস না তুই? একবারও খোঁজ নিয়েছিলি মেয়েটার? ও কেমন আছে জানতে চেয়েছিলি?”
-“আমি জানি আমার ভুল হয়েছে। আমার উচিৎ ছিল ওর খোঁজ নেয়া। কিন্তু মা আমি আসলেও ব্যস্ত ছিলাম। নাহলে আমি প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ নিতাম ওর।”
-“সত্যি করে বলতো স্নিগ্ধ! তুই কি আবারও নীলামের উপর দূর্বল হয়ে পড়ছিস?”
-“না মা। ওর উপর নতুন করে দূর্বল হওয়ার কিছু নেই। আমি আগে থেকেই ওর উপর দূর্বল তুমি জানো। আমি ওকে ভালোবেসেছি। কিন্তু আমাকে বুঝতে হবে যে ও আমার অতীত ছিল। বর্তমানে সকাল আছে আমার জীবনে। আর আমি নীলামের উপর যতটা না দূর্বল ছিলাম, তার থেকে দ্বিগুণ বেশি আমি সকালের উপর দূর্বল হয়ে পড়েছি মা। আমি নীলামকে আমার জীবনে ফিরিয়ে এনে সকালকে কষ্ট দিতে পারবো না। এতদিন তো নীলামকে ছাড়াই ছিলাম। তাহলে কি দরকার নীলামকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার? আমার বাকি জীবনটা আমি সকালের সাথেই কাটাতে চাই।”
-“তাহলে এই ক’দিন যে তুই নীলামের পেছনে এত দৌড়াদৌড়ি করলি সেটা কি ছিল?”
-“দায়িত্ব। আমি ওকে একসময় কথা দিয়েছিলাম ওর সকল বিপদে-আপদে আমি পাশে থাকবো। আর আমি সেই দায়িত্বটাই পালন করেছি। প্রথমবার যখন দেখলাম নীলাম বেঁচে আছে, তখন আমি একটু বেশিই আবেগি হয়ে গিয়েছিলাম যার কারণে সকালের দিকে খেয়াল করতে পারিনি সেদিন। আমি জানি এজন্য সকাল আমাকে ভুল বুঝেছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভুল বুঝাবুঝিটা বাড়তে দেয়া যাবে না। সকালের সাথে দেখা করে কথা বলে সবটা মিটিয়ে নিতে হবে।”
-“তোকে একটা কথা জানানো হয় নি স্নিগ্ধ।”
-“কি কথা?”
-“আরিফুল ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনন্যার বেআইনী ব্যবসার সাথে উনি জড়িত ছিলেন। যা উনার বাসার আর কেউ জানতো না।”
-“সকাল কেমন আছে?”
-“একদম চুপচাপ। প্রথমে অবশ্য অনেক কান্না করেছিল। কান্না করার মাঝেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।”
-“ওহ শিট! মা আমি আসছি।”
-“কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে?”
-“শ্বশুর বাড়ি।”
-“ধুর ছেলে! কয়টা বাজে দেখেছিস? এখন বাজে রাত ১ টা। যা নিজের রুমে যা। কাল সকালবেলা ওখানে যাবি।”
-“কিন্তু…
-“কোনো কিন্তু না স্নিগ্ধ। এই সময় ওই বাড়িতে যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
-“আচ্ছা তাহলে কাল সকালে যাবো।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here