সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৫০

0
2935

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৫০
.
দুই আঙুলের মাঝে সকালের আংটি নিয়ে একধ্যানে আংটির দিকে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধ। সকালের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ওর সাথে এই পর্যন্ত যত স্মৃতি ছিল সব এক এক করে মনে পড়ছে ওর। মেয়েটা দিনরাত ওর পেছনে দৌড়েছে শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। কিন্তু স্নিগ্ধ সেটুকুও দিতে পারেনি সকালকে। যেই মেয়েটা কখনো কষ্টের সাথে পরিচিত ছিল না, আজ সেই মেয়ের কষ্টের কারণ একমাত্র স্নিগ্ধ।

-“তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো তা প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে বুঝিয়ে গেছো। কিন্তু আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা একবারও জানার প্রয়োজন মনে করলে না! এতটুকু বিশ্বাস কি আমি অর্জন করতে পারিনি তোমার কাছ থেকে মিস বিকাল? একটু বিশ্বাস করতে আমাকে। তোমার ডাক্তার সাহেব কখনো নিজের কথার খেলাপ করে না জানো না তুমি! সে যখন একবার তোমায় কথা দিয়েছিল যে সে তোমার আছে আর ভবিষ্যতেও তোমার থাকবে তখন তোমার উচিৎ ছিল তাকে একটু বিশ্বাস করা। তুমি তো পারতে আমার কাছে এসে কথা বলে সবটা ক্লিয়ার করে নিতে! কিন্তু তুমি তা না করে আমাকে একদম নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেলে। তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে ভালোবেসে তোমার মন আমায় দিয়ে দিয়েছো। যদি কখনো আমি তোমার থেকে দূরে চলে যাই তাহলে তোমার মনটাও না-কি আমার সাথে চলে যাবে। কিন্তু উল্টো তুমি নিজেই আমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়ে তোমার সাথে আমার মনটাকে নিয়ে গেলে। কেন সবসময় আমিই নিঃস্ব হয়ে যাই বলতে পারো! প্রথমে নীলামকে ভালোবাসলাম। তারপর ও দূরে সরে গেল আমাকে একা করে দিয়ে। আমি তখন অর্ধমৃত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি আমার জীবনে কোনো এক সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টির মতো নেমে এলে। নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দিলে আমাকে। আমার জীবনের সকল যন্ত্রণাকে ভুলতে সাহায্য করলে। আমাকে আবারও ভালোবাসতে বাধ্য করলে তোমাকে। কিন্তু এখন তুমিও আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেল। গেলে তো গেলে! একদম ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেলে আমাকে। আমি জানি আমি তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আর কখনো আমি তোমাকে কষ্ট দিব না। কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে। প্লিজ ফিরে আসো মিস বিকাল। তোমার ডাক্তার সাহেব ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে মিস বিকাল। প্লিজ ফিরে আসো।”

চোখ বন্ধ করে দেয়ালের সাথে মাথা হেলিয়ে দিল স্নিগ্ধ। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে। নীলাম ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর দিকে। ওর চোখে পানি টলমল করছে স্নিগ্ধর অবস্থা দেখে। স্নিগ্ধর এই অবস্থা আজ নতুন নয়।

দু’মাস আগে যখন স্নিগ্ধ জানতে পারে যে সকাল কানাডা চলে গেছে তখন ও ভরা এয়ারপোর্টে সবার সামনে হাঁটু ভেঙে নিচে বসে চিৎকার করে কেঁদেছিল। পলক আর আখি অনেক চেষ্টা করেছিল ওর কান্না থামানোর। একসময় স্নিগ্ধ কান্না থামিয়ে কোনো কথা না বলে চুপচাপ উঠে গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে আসে। এরপর পুরো তিনদিন সে নিজের রুম থেকে বের হয়নি। আসমা বেগম, স্নিগ্ধর বাবা আর আখি এসে শত চেষ্টা করেও দরজা খোলাতে পারেনি স্নিগ্ধর রুমের। তিনদিন পর স্নিগ্ধ একাই রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল। একদম স্বাভাবিক লাগছিল তাকে দেখতে। সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও শুধু সে নিজেই জানতো তার ভেতরে ঠিক কি চলছে। সেদিন সবার আগে স্নিগ্ধ হসপিটালে গিয়ে নীলামের কেবিনে ঢুকে কোনো কথা না বলে পরপর দুটো থাপ্পড় মেরেছিল নীলামকে। কারণ স্নিগ্ধ নীলামের চালটা বুঝতে পেরেছিল। আজ শুধু মাত্র নীলামের জন্য সে সকালকে হারিয়েছে। আসমা বেগম যখন বলেছিলেন সকাল হসপিটালে নীলামকে আর ওকে একসাথে দেখেছে তখনি ও বুঝে গিয়েছিল যে এটা নীলামের চাল ছিল। সেদিন নীলামকে অনেক বকেছিল স্নিগ্ধ। ওর সাথে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিদিন স্নিগ্ধর ডেইলি রুটিন ছিল আগের মতোই বাসা থেকে কলেজ আর সেখান থেকে হসপিটাল। তারপর প্রতিদিন রাতেরবেলা এই ছাদে এসে বসে সকালের সাথে কাটানো স্মৃতি মনে করে সকালের আংটির দিকে তাকিয়ে একা একা কথা বলে স্নিগ্ধ।

নীলাম প্রায় প্রায়ই আসে এখানে। আর যখনি আসে, স্নিগ্ধকে এই ছাদে বসে থাকতে দেখে আর সকালকে বলা স্নিগ্ধর প্রত্যেকটা কথা শুনে কাঁদে ও। কিন্তু স্নিগ্ধ ওর সাথে একটাও কথা বলে না। নীলাম নিজেও নিজের করা ভুলটা বুঝতে পারে। সে নিজেও মনে মনে প্রার্থনা করে যাতে সকাল আবার ফিরে স্নিগ্ধর জীবনে। স্নিগ্ধর এমন অবস্থা আর দেখতে পারছে না নীলাম। কি হাল বানিয়েছে স্নিগ্ধ নিজের। স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টি শুরু হলো। টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্নিগ্ধকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। স্নিগ্ধ চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো। এই বৃষ্টির ভেতরেও স্নিগ্ধকে ঠায় ওখানে বসে থাকতে অবাক হলো। মুহূর্তেই স্নিগ্ধর কণ্ঠে গান শুনে ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। গানের প্রতিটা কথা যে সকালকে ঘিরে বলছে স্নিগ্ধ তা বুঝতে পারছে নীলাম।

এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি নেই বলে,
সময় আমার কাটে না
চাঁদ কেনো আলো দেয় না
পাখি কেনো গান গায় না
তারা কেনো পথ দেখায় না
তুমি কেনো কাছে আসো না?

এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি নেই বলে,
সময় আমার কাটে না
চাঁদ কেনো আলো দেয় না
পাখি কেনো গান গায় না
তারা কেনো পথ দেখায় না
তুমি কেনো কাছে আসো না?

সমুদ্রের ঝড়ো হাওয়া বলে
তারা তোমাকে চায়, তারা তোমাকে চায়
পাখি মৃদু কন্ঠে বলে
তারা তোমাকে চায়, তারা তোমাকে চায়

এই শরতেরই সন্ধ্যায় তুমি নেই বলে
সময় আমার কাটে না
কাশফুল কেনো ফুটে না, ছুয়ে ছুয়ে যায় না
মেঘের ভেলায় ভাসেনা
ভেসে তুমি কেনো আসো না?

ঝরে যাওয়া সব অশ্রু বলে
তারা তোমাকে চায়, তারা তোমাকে চায়
হৃদয়ের যত অনুভুতি আছে
তারা তোমাকে চায়, তারা তোমাকে চায়

এই বসন্তেরই সন্ধ্যায় তুমি নেই বলে
সময় আমার কাটে না
ফুলগুলো কেনো হাসেনা, হৃদয়ে দোলা দেয়না
আবেশেতে জড়ায়না
তুমি কেনো কাছে আসোনা?

এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি নেই বলে
সময় আমার কাটে না
চাঁদ কেনো আলো দেয় না
পাখি কেনো গান গায় না
তারা কেনো পথ দেখায় না
তুমি কেনো কাছে আসো না?

এলার্মের শব্দে কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে হাতরে ঘড়িটা খুঁজে এলার্ম বন্ধ করে দিল সকাল। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা বাজতে চললো অথচ এখনো সকালকে নিচে নামতে না দেখে অনুভবের বুঝতে বাকি রইলো না যে মেয়েটা এখনো ঘুমোচ্ছে। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে উপরে সকালের রুমে চলে এলো অনুভব। নিজেকে পুরো কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছে সে। হাসলো অনুভব। এই মেয়েটা কি কোনোদিনও বড় হবে না! এত বড় ডাক্তার হয়ে গেল অথচ কাজকর্ম এখনো বাচ্চাদের মতো। অনুভব বিছানার পাশে বসে সকালের মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে দিল। মুখে আলো পড়ায় কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো সকাল।

অনুভব একধ্যানে তাকিয়ে রইলো সকালের ওই চেহারার দিকে। মনে মনে বললো, “এই মেয়েটা নিজের অজান্তেই যে আমাকে নিজের মায়ায় বেঁধে ফেলেছে তা কি ও জানে! এই যে প্রতিদিন তার এই ঘুমন্ত মুখটার মায়ায় পড়েছি আমি। কোনো কাজ উল্টো পাল্টা হলেই ঠোঁট দুটো উল্টে কান্না কান্না ভাব এনে ফেলে মুখে, আমি সেই মুখের মায়ায় পড়েছি। যখন ও খুশি হয়ে নিজের মিষ্টি হাসিটা দেয় তখন আমি ওর সেই মিষ্টি হাসিটার মায়ায় পড়ি। মেয়েটা যখন পুরেনো কথাগুলো ভেবে কান্না করে তখন আমি ওর কান্না মাখা মুখটার মায়ায় পড়ি। মোট কথা ও নিজের সব রকম রূপের মায়ায় আমাকে আটকে ফেলেছে। কিন্তু কখনো কি আমার মনের কথাটা ও বুঝতে পারবে? আমি যে ওকে এই কয় বছরে কতটা ভালোবেসে ফেলেছি তা কি ও বুঝতে পারবে? আর যদি আমি বলে দিই তাহলে কি ও পারবে আমায় মেনে নিয়ে আমাকে ভালোবাসতে? ও কি আমার ভাগ্যে লেখা আছে? না-কি অন্য কারো ভাগ্যে লেখা আছে?”

অনুভবের ভাবনার মাঝেই চোখ মেললো সকাল। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই অনুভবকে নিজের সামনে বসে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে বসলো সকাল। অনুভব নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল সকালের চিৎকারে। ও সকালের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পেরে সকাল একাই থেমে গেল। চোখ মেলে জোর করে হাসার চেষ্টা করতেই দেখলো অনুভব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সকাল ঢোক গিলে বললো,
-“না মানে আসলে… আসলে ঘুম ভাঙতেই তোমাকে হঠাৎ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
-“আমার চেহারাটা কি খুবই বাজে যে তুমি আমায় দেখে ভয় পেয়ে গেলে?”
-“আরে নাহ! তা নয়।”
-“তাহলে ভয় পাও কেন?”
-“কি জানি!”
-“তুমি মানে আসলেই একটা…
-“একটা?”

সকালের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হেসে ফেললো অনুভব। হাত দিয়ে সকালের মাথার চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আসো। তোমাকে হসপিটালে যেতে হবে। নাহলে তোমার রোগীরা বলবে, এ কেমন ডাক্তার যে নিজে কি-না হসপিটালে আসে দেরি করে?”
-“উফফ… তুমি না একটা যা তা। আমার লেগ পুল না করলে কি তোমার ভালো লাগে না?”
-“একদম নাহ!”
-“এই তুমি যাও তো! আমি ফ্রেস হয়ে, তৈরি হয়ে আসছি।”
-“ঠিক আছে।”

অনুভব চলে যেতেই সকাল তাড়াতাড়ি নিজের বিছানা গুছিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেস হয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হলো একেবারে। চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিলো। তাড়াতাড়ি করে তৈরি হয়ে হাতে অ্যাপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ নিয়ে হাত ঘড়ি পড়তে পড়তে নিচে নেমে এলো। অনুভব সকালকে দেখে হাসলো। সকালও বিনিময়ে নিজের মিষ্টি হাসিটা দিল। চেয়ার টেনে দিল অনুভব সকালকে বসার জন্য। সকাল চেয়ারে বসে কোনোমতে ব্রেকফাস্ট করে উঠে পড়লো। অনুভবও উঠে পড়লো সকালের সাথে।

গাড়িতে উঠতে উঠতে সকাল অনুভবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“কি দরকার তোমার প্রতিদিন আমাকে হসপিটালে পৌঁছে দেওয়ার? আমি একাই তো গাড়ি নিয়ে যেতে পারি।”
-“আমিও জানি যে তুমি একাই যেতে পারো। কিন্তু আমি যাই তোমাকে দেখে শুনে সাবধানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তুমি তো বাচ্চা মেয়ে। বলা তো যায় না যদি কেউ তুলে নিয়ে যায়!”
-“হ্যা আমি তো খেলনা যে, যে কেউ আমাকে এসেই তুলে নিয়ে চলে যাবে। এত সোজা না-কি!”
-“তোমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া শুধু সোজা না, অনেক সোজা।”
-“এই তুমি এত ঝগড়ুটে কেন বলোতো? সারাক্ষণ খালি আমার পেছনেই লেগে থাকো কেন? আর কাউকে পাওনা জ্বালানোর জন্য?”
-“নাহ! তুমি ছাড়া আর কে-ই বা আছে আমার এত কাছের? আমি তোমাকে জ্বালিয়ে যতটা মজা পাই অন্য কাউকে জ্বালিয়ে এতটা মজা পাওয়া যাবে না।”
-“হুম বুঝেছি। এবার সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাও।”

হসপিটালের সামনে আসতেই সকাল অনুভবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল ভেতরে। অনুভব নিজেও মুচকি হেসে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। সকাল নিজের কেবিনে এসে বসে সব কিছু ঠিকঠাক করে একটা ফাইল নিয়ে বসলো। একটু পরেই ওর একটা সার্জারি আছে। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে নামিয়ে রাখতে গেলেই ফোনের ওয়ালপেপারে থাকা ছবিটার দিকে চোখ গেল ওর। মুহূর্তেই মনে পরে গেল কিছু পুরোনো স্মৃতি। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। স্নিগ্ধর সেই মনোমুগ্ধকর মুচকি হাসি দেওয়া একটা ছবিই সকাল নিজের ওয়ালপেপারে সেট করে রেখেছে। ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সুইচ অফ করে দিল ফোন। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। পুরোনো কথা ভেবে সার্জারিতে কোনো গন্ডগোল করতে চায় না ও। তাছাড়া মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই নীলামকে নিয়ে সুখে আছে স্নিগ্ধ! আচ্ছা ওদের কি কোনো বেবি হয়েছে? ভাবছে সকাল। ওর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে কেবিনে একজন নার্স ঢুকলো। সকাল ফাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল সার্জারির উদ্দেশ্যে।

সার্জারি শেষ করে ফ্রেস হয়ে নিজের কেবিনে অনুভবকে বসে থাকতে দেখে অনেক অবাক হলো সকাল। এই তো সাড়ে তিনঘন্টা আগেই দিয়ে গেল ওকে হসপিটালে। তাহলে এখন আবার কেন এসেছে অনুভব? সকাল অনুভবের সামনে এসে চেয়ারে বসলো।

-“তুমি হঠাৎ এখানে!”
-“আজকেই বাংলাদেশ যেতে হবে আমাদের।”
-“বাংলাদেশ! কিন্তু কেন?”
-“চাচীমনি ভীষণ অসুস্থ।”
-“কিহ! কি হয়েছে মাম্মার?”
-“হার্ট অ্যাটাক করেছেন। আমি টিকিট বুক করে ফেলেছি। এখন তোমাকে নিতে এসেছি। ঘন্টাখানেক পরেই আমাদের ফ্লাইট।”
-“(….)”

অনুভব বুঝতে পারলো সকালের মনের অবস্থাটা। ও সকালের কাছে এসে সকালের গালে হাত রেখে বললো,
-“চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। চাচীমনির কিছু হবে না। উনি সুস্থ হয়ে যাবেন। হুম!”
-“হুম।”
-“চলো এখন।”

সকাল অনুভবের সাথে বাসায় ফিরে গেল। প্যাকিং শেষ করে সোজা এয়ারপোর্টে চলে গেল। এয়ারপোর্টে এসেই অনুভবের বাবা অর্থাৎ সকালের চাচ্চুর সাথে দেখা হয়ে গেল ওদের। উনি ওদের সাথে বাংলাদেশ যাবেন। দেরি না করে ভেতরে চলে গেলেন উনারা।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাইরের পরিবেশ দেখছে সকাল। আজ কত বছর পর দেশে ফিরে এলো। সবকিছু অন্যরকম লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে এখানকার অনেক কিছুই বদলে গেছে। তার নিজের জীবনটাই তো বদলে গেছে। সেখানে এসব বদলানো তো কিছুই না। বাসার সামনে গাড়ি থামতেই অনুভব গাড়ি থেকে নেমে সকালের জন্য ডোর খুলে দিল। সকাল হালকা হেসে নেমে গেল। বাসার সামনে এসে বেল চাপার দু-তিন মিনিটের মাথায় এক কাজের লোক এসে বাসার দরজা খুলে দিল। সকালকে দেখে চিনতে সময় লাগলো না তার। উনি একগাল হেসে সরে গেলেন দরজার সামনে থেকে। সকাল ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চারিপাশটা একবার দেখে নিলো।

-“মাম্মা, ভাইয়া, ভাবী ওরা সবাই কোথায় আন্টি?”
-“আপা হের রুমে। পলক বাবা আর আখি মা ওইহানেই আছে।”
-“নয়ন কোথায়?”
-“বাবু তো ইস্কুলে গেছে।”
-“আচ্ছা আমি মাম্মার রুমে যাচ্ছি। তুমি এখানে দাঁড়াও। চাচ্চু আর অনুভব বাইরে আছে। চলে আসবে এখুনি।”
-“আচ্ছা মা।”

সকাল মুচকি হেসে উপরে রেহেনা বেগমের রুমে চলে এলো। রুমের দরজা খোলা রয়েছে। ভেতরে পলক আর আখিকে দেখা যাচ্ছে। রেহেনা বেগম শুয়ে আছে বিছানায়। সকালের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো এতদিন পরে সবাইকে সামনা-সামনি দেখে। ও রুমের ভেতরে ঢুকে আস্তে করে ‘মাম্মা’ বলে ডেকে উঠতেই সবাই ওর দিকে তাকালো। সকালকে দেখে পলকের চোখে পানি এসে গেল।

আখি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। এটাই কি সেই সকাল! এতটা পরিবর্তন হয়েছে ওর! লম্বা চুলগুলো কেটে কাঁধ পর্যন্ত করে ফেলেছে। কালো চুলগুলোকে কালার করে ব্রাউন কালার করে ফেলেছে। পোশাক-আশাকেও যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। এই সকালকে চিনতে পারছে না আখি।

পলক কোনো কথা না বলে সকালকে জড়িয়ে ধরলো। সকাল নিঃশব্দে কেঁদে দিল ভাইকে জড়িয়ে ধরে। রেহেনা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসেছেন মেয়েকে দেখে। মেয়েটা তার কত বড় হয়ে গেছে। উনার চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পড়ছে। পলক বোনের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“কেমন আছে আমার বাচ্চাটা?”
-“ভালো। তোমরা সবাই কেমন আছো?”
-“তুই না থাকলে কি করে ভালো থাকি বল? তোর চিন্তায় চিন্তায় মাম্মা হার্ট অ্যাটাক করেছে।”
-“এত চিন্তা কেন করো তোমরা আমাকে নিয়ে? পড়াশোনা শেষ আমার। আমি এখন ডাক্তার। এখন আর সেই ছোট বাচ্চা নেই আমি। তারপরও তোমরা আমার সাথে এমন ব্যবহার করো যেন আমি কোনো দুধের শিশু।”
-“তুই আমাদের কাছে আমাদের সেই ছোট্ট সকালই আছিস বুঝলি!”
-“হুম।”
-“তুই একা এসেছিস?”
-“নাহ! অনুভব আর চাচ্চু এসেছে সাথে। ওরা নিচে আছে। লাগেজ নিয়ে আসছে সম্ভবত।”
-“আচ্ছা আমি তাহলে নিচে যাচ্ছি।”

পলক নিচে চলে যেতেই সকাল আখির কাছে এসে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন আছো ভাবী?”
-“ভালো আছি। তুমি ভালো আছো?”
-“হ্যা। শুনলাম নয়ন না-কি স্কুলে গেছে?”
-“হুম। চলে আসবে একটু পরে। তুমি অনেক বদলে গেছো পিচ্চি।”
-“বদলে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি! কম ধাক্কা তো খাইনি জীবনে। ধাক্কা খেতে খেতে বদলে ফেলেছি নিজেকে।”
-“(….)”
-“মাম্মা এখন কেমন আছো?”

রেহেনা বেগমের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো সকাল। সকালের গালে হাত রেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন উনি। মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে গালে চুমু দিল সকাল। রেহেনা বেগম কান্নার মাঝেও হেসে উঠলেন। দু’হাতে সকালের মুখ ধরে কপালে চুমু দিলেন উনি।

নিজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আশেপাশের সবকিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেও সকাল আলাদা কিছু পেলো না। এখানকার সব জিনিস আগের মতোই আছে। রুমে এসে টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিতে গেলে চোখ পড়লো ফুলদানির দিকে। এত বছর পরেও আজও এই ফুলদানি স্নিগ্ধর দেওয়া অর্কিড ফুলগুলো দেখে পুরোনো ক্ষতগুলো নাড়া দিয়ে উঠলো ওর মনে। ফুলগুলো অবশ্য আর ফুল নেই। শুকিয়ে পঁচে গেছে বললেই চলে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে সকাল বললো,
-“পুরোনো ফুল শুকিয়ে একসময় পঁচে যায়। কিন্তু পুরোনো অনুভূতিগুলো কেন পঁচে যায় না?”

চোখ বন্ধ করে দুটো বড় বড় শ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিয়ে সকাল নিচে নেমে গেল। অনুভবকে সোফায় বসে থাকতে দেখে বললো,
-“অনুভব চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি। বাসায় ভালো লাগছে না।”

আখি অনুভবের দিকে তাকিয়ে সকালের দিকে তাকালো। বললো,
-“অনুভব তোমার বড় না বয়সে!”
-“হ্যা। কিন্তু ওকে আমার নাম ধরে ডাকতেই ভালো লাগে। কারণ ও শুধু আমার কাজিন নয়, আমার বেস্টফ্রেন্ড। কানাডায় থাকতে ও সবসময় আমাকে সাপোর্ট করেছে। প্রত্যেকটা মুহূর্তে যখনি হোঁচট খেয়েছি ও আমাকে সামলেছে। যাকে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল আমার সে তো ওই সময়ে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু অনুভব কখনো আমার হাত ছাড়েনি। একটা বাচ্চার মতো করে আগলে রেখেছে আমাকে।”

আখি বুঝলো এই কথার মাঝে সকাল স্নিগ্ধকে খোঁচা মেরে বুঝালো যে প্রয়োজনের সময় স্নিগ্ধ ওর হাত ছেড়ে দিয়েছিল। আখি আর কিছু বলতে পারলো না। মাথা নিচু করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনুভব সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“আমার প্রশংসা শেষ হয়ে থাকলে এবার বাইরে যাওয়া যাক!”
-“হ্যা অবশ্যই। চলো চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here