সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-১

0
11947

কালো সেজে,কাজের মেয়ের রূপে নিজেকে সাজাতে কার বা মন চায় কিন্তু নিরূপায় হয়ে মাঝে মধ্যে ভালো ঘরের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির জন্য অনেকে রূপ পরিবর্তন করে। একিদশা হয়েছে মেহুর।যে বাড়িতে সে আশ্রয় নিয়েছে সে বাড়িতে তার পরিচয় একজন সামান্য কাজের মেয়ে।নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে মর্জিনা।নিজেকে আড়াল করতে ব্যবহার করেছে কালো রং।

আল্লাহ পৃথিবীতে সুন্দর শব্দটা সবার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ ব্যবহার করেন নি।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ সৌন্দর্যটা হয় অভিশাপ যা মেহুর জীবনে একদম প্রমাণিত। নিজের জীবনকে বাঁচাতে সে এমন এক জায়গা থেকে পালিয়ে এসেছে যেখানের কোনো পরিচয় সে রাখতে চায় না।মা সবসময় বলতো,

“মেহু তুই বড় হো,শিক্ষিত হো।মনে রাখিস তোর বাবা তোকে মেয়ে নয় একজন ছেলে হিসেবে মনে করতেন।কখনো মেয়ে বলে তোকে পিছিয়ে পড়তে দেয় নি।সর্বত্র চেষ্টা করেছে তোকে একজন ছেলের সমবয়সী করে তোলার।ওনি মেয়ে হিসেবে তোকে নিয়ে কখনো আফসোস করেন নি।তাই তোর বাবার সকল স্বপ্ন তোকে পূরণ করতে হবে।এ গ্রামের প্রতিটি মানুষকে তোর শিক্ষিত করার চেষ্টা করতে হবে।তবেই তোর বাবা আখিরাতে শান্তি পাবে।”

মা তার এতো উৎসাহ মূলক কথা বলে একা রেখে চলে গেলেন।জীবনের এমন সব পরিস্থিতিতে মেহুকে পড়তে হবে মেহু তা ভাবতে পারে নি।এখন তাকে তার মা বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।অনেক বড় হতে হবে।অনেক পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।তার জন্য যা যা করার দরকার সব করবে মেহু।যদি প্রয়োজন পড়ে রাস্তা ঝাড় দিবে তবুও তার বাবা মার কথা রাখবে।কিন্তু পারবে কি সব প্রতিকূল পেরোতে?

আয়নায় বারবার নিজেকে খুঁতিয়ে দেখছে মেহু।না কোথাও তার রং বোঝা যাচ্ছে না।তাকে যাতে সহজে বোঝা না যায় তাই পুরো হাতা কামিজ পড়ে আর বড় ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে রেখেছে।মুখ দেখলে যে কেউ বুঝবে মেহু কালো।তাছাড়া কাজ করতে গেলে গ্লাভস পরে যাতে তার হাতে পানি লাগলেও হাত বোঝা না যায়। মোটামুটি নিজেকে ভালো করে সাজিয়েছে।জীবনের অভিনয়টাতে সে তেমন পারদর্শী নয় তবুও তাকে চেষ্টা চালাতে হবে।এ অচেনা শহরে,অচেনা মানুষের মাঝে তাকে বেঁচে থাকতে হলে এ রূপে তাকে প্রদর্শন করতে হবে।একবার তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে বরাবরের মতো সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। তার আগে তাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে।
আয়নায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সে।বাইরে থেকে হাঁক আসলো,

“মর্জিনা আরে এই মর্জিনা কই তুই? তাড়াতাড়ি চায়ের ব্যবস্থা কর।ভাইজান আর শরীফ অফিসে বের হবে।কই গেলি তুই? ”

“এতো ছোট খালাম্মা আসতাছি।এদিহের কামটা সাইরাই আসতাছি।”

না ভাষাটা পুরোপুরি আয়ত্তে আসে নি।১৫ দিন হলো এ বাড়িতে এসেছে এখনো পুরো ভাষাটা পরিষ্কার করে বলতে পারছেনা।কীভাবে পারবে অতীতে তো কখনো এ ভাষায় কথা বলেনি।তবে গ্রামের সবাই বললেও মেহু কখনো এ ভাষা বলতো না কারণ তার মা তাকে শুদ্ধ কথা বলতে আদেশ দিতেন।তবে শোনা কথায় যতটা মনে ছিলো প্রয়োগ করছে নাহলে আবার এ বাড়ির মানুষের ধারণা হবে মর্জিনা মেয়েটা শিক্ষিত কিন্তু মর্জিনা চায় না কেউ তার অতীত জানুক।সবকিছু ছেড়ে তার মনে হয়েছে কাজের মেয়ের পেশাটা নিরাপদ। অন্তত মাথার ওপর একটা ছাদ পাওয়া যাবে সাথে মাস শেষে খরচ চালানোর একটা অর্থ। যা দিয়ে সে দিব্যি চলতে পারবে।

তাড়াহুড়ো করে মর্জিনা রান্নাঘরে গেলো।আর যেতেই আমেনা খালা গজগজ শুরু করলো।

“কি গো মাইয়া এতটা কাম চোর হইলে হইবো।বড়সাহেবরা অহন অফিসে যাইবো আর তুমি কিনা ঘরের কোণে লুকাইয়া আছো।যাও তো জলদি যাও।নইলে ছোট আপা ঘাড় ধইরা খেদাইয়া দিব।”

“ও আমেনা খালা রাগ করো ক্যান?এইতো চটচট কইরা কাম করমু। আর ওনারা এহনো নিচে আসে নাই। ততক্ষণে দেখবা আমার কাম শেষ।তোমার নাস্তা বানানো হইছে।হইলে দাও আমি লইয়া যাই?”

হো তোমার কাম হইতাছে আমি তৈয়ার করমু তুমি লইয়া যাইবা।কই কি হাতে হাতে তো একটু শিখবার পারো।বিয়ে হইলে তহোন কি করবা?মাইয়া হইয়া জন্মাইছো তহোন তো তোমারেই এসব করোন লাগবো তাই না?”

“হো খালা ঠিক কইছো। তহোন দেখা যাইবো।অহোন দাও তো কি কি করছো?দাও স্যাররা আসার আগেই আমি লইয়া যাই নইলে তো আবার ছোট খালাম্মা চিৎকার মারবো তহোন ভূমিকম্প হইবো।হি হি হি।”

“মুখপুড়ি থাম আপা আইয়া হুনলে চুল সব ছিড়বো।এ নে যা তাড়াতাড়ি খাওন গুলো দিয়া আয়।আবার দুপুরের খাওনের তৈয়ার করতে হইবো।”

মর্জিনা খাবারগুলো নিয়ে টেবিলে সাজাতে থাকে।আর আমেনা খালা রান্নাঘরে মর্জিনার কাজ নিয়ে বকবক করতে থাকে।আমেনা খালা,মানুষটা ওপরে দেখতে রাগী হলেও যথেষ্ট ভালো। মর্জিনা আসার সাথে সাথে কতো সহজে আপন করে নিয়েছে।নিজের মেয়ের মতো আদর করে।তবে রাগটা একটু বেশি মনটা বেশ ভালো।

এ বাড়ির বড় কর্তা যার নাম শাহেদ আহসান।আর তার ছোট ভাই শরীফ আহসান।দুই ভাই মিলে একটা ব্যবসা করে।তাদের ব্যবসার প্রফিট বেশ ভালো।তাছাড়া দু’জনেই একছাদের নিচে বসবাস করে।তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। বোঝায় যায় না তারা কাজিন নাকি সবাই আপন ভাই বোন।বড় ভাই থেকে তিনটা ছেলে,ছোট ভাই থেকে একটা ছেলে একটা মেয়ে। সবাই স্কুল গন্ডি পেরিয়েছে।কেউ কেউ ভার্সিটিও শেষ। শাহেদ আহসানের বড় ছেলে আর মেজ ছেলে তার সাথে বিজনেস দেখা শোনা করে ছোট ছেলে এবার অনার্সে উঠলো।শরীফের বড় মেয়েও বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে অনার্সে।আর ছেলেটা ইন্টারে।মোটামুটি সবাই একটা ভালো আর উন্নত জায়গায় অবস্থান করছে।

মর্জিনা আসার পর থেকে এখনো অবধি মেজ ছেলেকে দেখে নি।কি নাকি ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে। তাছাড়া সবাইকে দেখেছে।বড় ভাই আরাফ সারাদিন অফিসে থাকে,ছোট ছেলে আরাকান বাইরে এটা ওটা করে।আর ছোট চাচার বড় মেয়ে বিউটিশিয়ান।বিভিন্ন মেকআপ নিয়ে গবেষণা। বড় ছেলে আরাফ বিবাহিত।বউটা মাশাল্লাহ যেমন সুন্দর তেমনি গুণী। মেহুর সাথে অল্প সময়ে খাতির জমিয়েছে।

আর এ বাড়ির বড় গিন্নি যার কথা না বললেই নয়,লুৎফা আহসান আল্লাহর সৃষ্টি মোমের পুতুল।আল্লাহ যেন তার ভান্ডারের সকল দয়া এ মহিলাকে দিয়েছেন। এতো মিষ্টভাষী মহিলা মর্জিনা আগে দেখে নি।আর ছোট চাচি সুজাতা, চেহারাটা দেখলেই মনে হয় রাগের ঝুলির সাথে তার বেশ সখ্যতা।যখন যাকে পায় তাকে ঝাড়ি।১৫ দিনে মর্জিনা ১৫০০ ঝাড়ি খেয়েছে। তাই সহজে তার সামনে পড়তে চাই না আর পড়লেও আড়ালে লুকায়।তবুও রক্ষা নাই। এ পরিবারটাতে এসেই মর্জিনা অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেও বেশিরভাগ ভয়ে থাকে।কখন না ধরা পড়ে যায়। তবে সব মিলিয়ে বেশ ভালো একটা পরিবার।ছোট চাচি ছাড়া বাকি সবাই মর্জিনাকে দেখতে পারে।

আর হ্যা নামটাও মেহু থেকে মর্জিনা করার কারণ আছে। যদি তার নামটা মেহু হতো তাহলে হয়তো অনেকের কাছে কেমন মডার্ন লাগতো।কাজের মেয়ে যখন সেজেছে তখন একেবারে কাজের মেয়ের মতো একটা নামই ভালো।তাই মেহু থেকে মর্জিনা।কাজের মেয়ে মর্জিনা।

এ বাড়িতে আসার সূত্রপাত হয়েছে শাহেদ আহসানের হাত ধরে। তবে বলা যাক ১৫ দিন আগে মেহু থেকে মর্জিনা হওয়ার শুরুটা!

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here