সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-২

0
9419

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:২

৩/৪ টা মানুষ নেড়ি কুকুরের ন্যায় একটা যুবতী মেয়েকে তাড়া করছে।মানুষের ন্যায় হলেও আচরণগত দিক দিয়ে তারা কুকুর আর উন্মাদ ছিল।তাদের উদ্দেশ্য ছিল যুবতী মেয়েটাকে পেলে তার শরীরটাকে খুবলে খাওয়া।আর মেয়েটা চাইছে এসব মানুষ নামের কুকুর থেকে নিজেকে বাচাতে। তাই আপ্রাণ চেষ্টা করছে দৌড়ানোর।কিন্তু মেয়ের শক্তি পুরুষের কাছে হার মানে।যুবতীরও তাই অবস্থা। সে দৌড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু মনে হচ্ছে এ বুঝি পড়ে যাবে।এখনি হয়তো লোকগুলো তাকে ধরে ফেলবে।একহাতে কান্না মুছছে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াচ্ছে।আর মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ছে।

পুরো রাস্তা ফাঁকা। কাউকে নজরে আসছে না।রাত কতো কে জানে?মেহু বুঝতে পারছে এটা লোকালয়ের জায়গা হলেও মানুষের আসা যাওয়া কম।ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকা গুলো সন্ধ্যার পর কেমন জানি মিইয়ে যায়। তখন যার যার ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে।তাছাড়া রাতও নিশ্চয়ই বেড়েছে।কেউ তো আর জানে না এতো রাতে একটা মেয়ে রাস্তায় প্রাণপণে ছুটছে নিজেকে বাঁচাতে?জানলে হয়তো কেউ না কেউ তাকে বাঁচাতে চলে আসতো।কিন্তু এখন কি হবে?কে বাঁচাবে তাকে, আদৌ বাঁচবে তো?

রাস্তায় একা একা হাটছিল মেহু।যাওয়ার জায়গা না থাকাতে সে ভাবছিলো কীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে?ঠিক তখনি রাস্তার একপাশে কতোগুলো ছেলেকে দেখতে পায়।ভেবেছিলো তাদের থেকে হেল্প নিবে।কিন্তু ছেলেগুলোর কাছে যাওয়ার আগেই ছেলেগুলো তার দিকে এগিয়ে আসে।আর তাদের হাঁটার অবস্থা দেখে মেহু বুঝে যায় এরা সুবিধার নয়।তাই আর সামনে না এগিয়ে সোজা পেছনে হাঁটা শুরু করে।

একটু পর বুঝতে পারে ছেলেগুলো তার পেছন পেছন আসছে।প্রথমে আস্তে হাটলেও পরে মেহু দৌড়াতে শুরু করে।আর সাথে সাথে ছেলেগুলো। এতক্ষণ দৌড়ানোর পরও ছেলেগুলো তাকে তাড়া করছে। একজন তো অশ্লীল ভাষায় গালিও দিলো মেহুকে।শুনে মেহুর কান্না চলে আসলো তবুও দূর্বল না হয়ে দৌড়াচ্ছে।জানে না কতক্ষণ পারবে তবুও সে দৌড়াবে।আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে এসব মানুষ রূপী জানোয়ারদের হাতে ছেড়ে দিবে না!

হঠাৎ কোত্থেকে একটা গাড়ি চলে আসে।আর মেহু হুট করে গাড়ির সামনে এসে পড়ে। সাময়িকের জন্য তার প্রাণ রক্ষা পেলো।পেছনে ফিরে দেখে লোকগুলো থেমে গেছে। মেহু চট করে গাড়ির দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কাতে শুরু করে।গাড়ির ভেতর থেকে একটা আধবয়সী লোক বের হয়ে আসে।মেহুর সেদিকে দেখার সময় নেই সে তাড়াতাড়ি করে পেছনে তাকাতে দেখে লোকগুলো চলে গেছে। মেহু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। শাহেদ আহসান মেয়েটাকে শান্ত হতে বলে।

“রিল্যাক্স! ওরা চলে গেছে। কে তুমি আর এতো রাতে রাস্তায় একা একা কি করছো?”

মেহু কিছু বলতে পারে না শুধু কাঁদছে।লোকটা মেহুকে গাড়িতে উঠতে বলে।মেহু দৌড়ে গাড়িতে ঢুকে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে।প্রায় অনেক্ক্ষণ পর তারা একটা বাড়ির সামনে এসে পড়ে।শাহেদ আহসান মেহুকে গাড়ি থেকে নামতে বলে।মেহু গাড়ি থেকে নামতেই তাকে অনুসরণ করে। বাড়িতে ঢুকতে দেখে প্রায় অন্ধকার। মেহু এবার আরো ভয় পেয়ে যায়। রাস্তার গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে সে আবার ভুল জায়গায় চলে এলো না তো?এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মেহু কিন্তু কাউকে নজরে এলো না।চোখে একটা দেয়াল ঘড়ি পড়তে দেখলো ঘড়িতে প্রায় দুটো বাজে।তার মানে মেহু এত রাত অবধি বাইরে ছিলো।অবিশ্যি তার যাওয়ার জায়গায় বা ছিলো কোথায়?

অন্ধকারে শাহেদ আহসান আমেনা বলে ডাক দেয়। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠতে দেখে একটা আধবয়সী মহিলা চোখ ডলতে ডলতে এগিয়ে আসছে।মেহু তাকে ভালো করে দেখে নেয়।একটু খাটো,মোটা, ঠোঁট গুলো লালচে।মনে হয় পান খায় বেশি।

“বড় সাহেব আইছেন।আফনের লাইগা বইসা থাকতে থাকতে ঝিমুনি চইলা আইছে।আফনে বসেন আপনার লাইগা খাওন দিতাছি।”

“না আমেনা আমি খেয়ে এসেছি।এ মেয়েটাকে তোমার সাথে রাখো।কাল ওর সাথে কথা হবে।এখন খুব ক্লান্ত। এ মেয়ে তোমার নাম কি?”

মেহু ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে।

“বাদ দাও কাল জেনে নিবো।আমেনা ওকে নিয়ে যাও খাওয়ার থাকলে খাইয়ে দাও বাকিটা কাল দেখবো।”

কথাটা বলে শাহেদ আহসান উপরে চলে যায়। আমেনা মেহুর দিকে ভ্রু কুচকিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে,

“আহো আমার লগে।আগে খাইয়া লও তয় আমার লগে ঘুমাবা।দেইখা তো চোর ডাকাত লাগতাছে না কিন্তু অহোন চোররাও মডারণ হয়ে গেছে তাই কেডা ভালা কেডা চোর বোঝা যায় না।তা নাম কি তোমার?”

“জ্বি মেহেরুন্নেসা জান্নাত।”

“ওমা নাম ডা তো সুন্দর আছে। তা বোরকাটা এভাবে জড়াইয়া রাখছো ক্যান?এহোন তো কেউ নাই। এবার তুমি খুলতে পারবা।যাও ওদিকে গোসলখানা আছে। মুখডা ধুইয়া লও আমি খাওন আনি।”

আমেনা মেহুকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়ে খাবার আনতে যায়। ১০ মিনিট পর খাবার এনে টেবিলে রাখতেই চোখ পড়ে মেহুর দিকে।হা হয়ে তাকিয়ে থাকে আমেনা।মেহু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এভাবে কেউ তাকালে যে কেউ বিরক্ত হয় তবে অস্বস্তি বেশি করে।আমেনা এগিয়ে এসে মেহুর গায়ে থু থু দিয়ে বলে,

“মাশাল্লাহ! এই মাইয়া এতো রূপ পাইলা কই?আল্লাহর ভান্ডারের সব রূপ কি তুমি নিইয়া আইছো।মাশাল্লাহ আমার লাগতাছে আমারই নজর লাইগা যাইবো।কি গো মাইয়া কও তো ঘটনা কি?এতো সুন্দর মাইয়া এতো রাইতে বাইরে ঘুরতাছে? উঁহু ব্যাপার তো ভালা না।আগে আসো খাইয়া লও মনে হইতাছে সারাদিন কিছু খাও নাই।খাইয়া হুনমু ঘটনা কি?”

মেহু খেতে বসে আর আমেনা তার পাশে বসে তার খাওয়া দেখে। সারাদিন পানি ছাড়া কিছু পড়ে নি পেটে তাই খাবারটা বড়ই তৃপ্তির সাথে খেলো মেহু।আমেনা সবটা গুছিয়ে তার কাছে আসে।

“লও মাইয়া এবার কও ঘটনা কি?মনে হইতাছে গোলমাল একটা আছে? বাড়ি কই?মা বাপের নাম কি? এতো রাতে বাইরে ক্যান?”

মেহু কিছুক্ষণ আমেনার দিকে তাকিয়ে থাকে।ভাবছে একে সব বলা যায় কিনা?কারণ এ মুহূর্তে এমন কাউকে দরকার যে তাকে সাহায্য করতে পারে।তাই বিশ্বাস করে সবটা জানাতে থাকে মেহু।

একে একে সবটা শুনে আমেনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

“কি সর্বনাশের কথা? তুমি বিয়ের আসর থেইকা পলায় আইছো।থানা পুলিশ হয় নাই?”

“জানিনা তবে আমি আর সেখানে ফিরবো না।আপনি আমাকে বাঁচান।আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। আমার মাথার ওপর একটা ছাদ লাগবে যাতে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।যদি আমি ভালো একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা পাই তবে আমি হোস্টেলে চলে যাবো।আপাতত আমার একটা থাকার জায়গা চাই। ”

“হো মাইয়া সব তো শুনলাম।কিন্তু তোমার লাইগা কি করতে পারি?এ বাড়িতে অনেক জোয়ান পোলা আছে। সবাই ভালা তবুও কন তো যায় না কার মাঝে কি মতলব?তার ওপর তোমার যে রূপ? আমার তো মনে হয় না তুমি টিকতে পারবা?”

“খালা আমি পারব আমি সব পারব।আপনি শুধু আমাকে সাহায্য করুন।যা করতে হয় সব করব।”

“এ বাড়িতে কাম করবা?’

“মানে?”

“মানে হইতাছে গিয়া তুমি এ বাড়িতে কাম করলে থাকা খাওয়া ফ্রী। আর বড় আপা মাস শেষে কিছু টেহা দিবো।সেটা লইয়া তোমার বাকি কাম সারবা।আর তোমার পড়ার বিষয়টা না হয় আমি দেখমু।তবে তোমারে কাজের মাইয়ার মতো আচরণ করতে হইবো নইলে তো তুমি থাকতে পারবা না।আর তোমারে এমন বেশ ধরতে হইবো যাতে তোমারে কেউ চিনতেই না পারে তাহলে দেখবা ঐ শয়তান ব্যাটাগুলো তোমারে খুইজা পাইবো না।কি বলো করবা তো?”

“খালা আপনি চিন্তা করবেন না। যা করার দরকার সব করবো আমি।আর আমার এ রূপ নিয়ে সমস্যা তো?দরকার হলে এ রূপ কালো করে ফেলবো।আমার স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছাতে যা যা দরকার সবটা আমি করবো।শুধু আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।”

“হো মা আমি তোমার পাশে আছি।তুমি চিন্তা কইরো না।”

শাহেদ আহসান রুমে ঢুকতে আলো জ্বলে উঠে। দেখেন সহধর্মিণী জেগে আছেন।তাকে দেখে মিষ্টি হাসে লুৎফা।

“কি হলো ঘুমাও নি?”

“তুমি বাইরে, কীভাবে ঘুমায়?’

“আমি তো শরীফ আর আরাফকে বলেছি আসতে দেরী হবে তাহলে রাত জাগার মানে কি?”

“তবুও জাগলাম।খেয়েছো?’

“হুমম।খেয়ে এলাম আর কাজও সারলাম।ও হ্যাঁ একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছি।মেয়েটার পরিচয় জানি না।মুখও দেখি নি বোরকা ছিলো।রাস্তায় গুন্ডারা তাড়া করে।গাড়ির সামনে পড়লে দেখি ভয় পেয়েছে তাই নিয়ে এসেছি। আমেনাকে বলেছি খাবার খাওয়ানোর পর তার সাথে রাখতে।কাল কথা বলবো।”

“তাই নাকি।ইশশ বেচারি মনে হয় খুব ভয় পেয়েছে।যাই দেখে আসি।”

“তোমার এসব কাজ একদম ভালো লাগে না।বললাম ওমনি যেতে হবে।হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।কাল দেখা করো।এখন ঘুমাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

লুৎফা আহসান স্বামীর কথাকে সায় দিয়ে নিজেই বিছানায় শুয়ে পড়ে।না কালই যাবে মেয়েটার সাথে আলাপ করতে।

ভোর হতেই লুৎফার আর বিছানায় পিঠ লাগে না।তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটা শুরু করেন।তারপর বাসায় এসে আমেনাকে নাস্তার জন্য তাড়া লাগান।কারণ সকাল দশটা হলেই ছেলেরা অফিসের জন্য বের হয় তাই আগে থেকে খাবার টেবিলে সাজানোর দরকার পড়ে।সেই হিসার মতে তিনি আমেনার ঘরে গেলেন তাকে ডাকতে।দরজা বারি দিতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে।মেয়েটাকে দেখেই তড়ক খায় লুৎফা।কারণ তার মনেই ছিলো না গতকাল শাহেদ তাকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলো তার মানে এই সেই মেয়ে!

লুৎফা ভালো করে দেখছিলো মেহুকে।তারপর জিজ্ঞেস করলো,

” তুমিই কি সেই মেয়ে যে গতকাল এ বাড়িতে এসেছো?”
“জ্বি”
“কি নাম তোমার?”
“জ্বি মর্জিনা!”
“ওহ।তোমার বাড়ি কোথায়? ”
“জ্বি কুষ্টিয়া। ”
“তা কোথায় যাবে এখন?আর মেয়ে হয়ে গতকালই বা বাইরে ছিলে কেন?জানো কতো রাত ছিলো?”
“জ্বি খালাম্মা। আসলে আমি যে বাড়িতে কাম করতাম হেরা চইলা গেছে তাই কাম না পাইয়া এদিক ওদিক ঘুরতাছিলাম।এত রাত হইছে আমি জানতামও না।কিছু বেডা আমার পেছনে আসে আর পলাইতা গিয়া স্যারের লগে দেহা।স্যার খুব ভালা মানুষ আমারে এহানে লইয়া আইছে।”

“সব তো শুনলাম আসল কথা বলো।এখন কি করবে?”
“এখন আর কি করমু খালাম্মা। আমারে এ বাড়িতে একটু জায়গা দেন।আমি আপনা গো সব কাম করমু।আমারে শুধু একটু থাকা খাওনের জায়গা দেন।”

কথাগুলো বলেই মর্জিনা লুৎফার পা জড়িয়ে ধরে।

“কি করছো কি?ছাড়ো তো।যাও কাজে রেখে দিলাম তবে ফাঁকি দেওয়া চলবে না ঠিক আছে?”
“জ্বি খালাম্মা! ”

মর্জিনা যেতে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে,

“খালাম্মা চা খাইবেন দিমু?”

লুৎফা না বলতে গিয়ে কি মনে করে সম্মত জানালো চায়ের।মর্জিনা খুশি মনে চা বানাতে চলে যায়!!

আর এভাবে একে একে সবার সাথে আলাপ করে মেহু থেকে মর্জিনা হলো।আর ঘরের কাজে পারদর্শী হয়ে উঠলো।
,
,
,
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here