সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-১২

0
7132

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:১২

আহসান ভিলা নিত্যদিনের মতো তাদের জীবন পার করছে।কোথাও কোনো কষ্ট নেই। সবাই আনন্দময় সময় পার করছে।বাড়ির ছেলেরা তাদের কর্মজীবনে নিয়ে ব্যস্ত আর বাড়ির মেয়েরা সংসার নিয়ে। সংসারের দিকটা বলতে গেলে লুৎফা, আমেনা দেখে, সুজাতা আসে ধমকা ধমকি করে আবার চলে যায়। সুজাতার আড়ালে সবাই হাসাহাসি করে।সুচী তো মাকে নিয়ে অভিনয় করতে খুব মজা পায়।একবার তো মায়ের ভূমিকা করতে গিয়ে সে ধরাই পড়ে গিয়েছিল সেদিন ভাগ্য জোরে বেঁচে গিয়েছিল।

মেহু সেদিনের পর থেকে অনেকটা ভয়ে থাকত কখন কি হয়ে যায়? কিন্তু আদ্য এমন একটা ভঙ্গিমা করতো যেন সে কিছুই জানে না।সহজভাবে সবার সাথে কথা বলে,মেহুকে আগের মতো হালকা পাতলা বকা দেয় এটা ওটা নিয়ে। তবে মেহু বুঝতে পারে এ সবকিছু আদ্য তাকে সহজ হওয়ার জন্য ইশারা করে।মেহুও এখন তেমন একটা ভয় পায় না,সবসময় চেষ্টা করে কীভাবে এ বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলা যায়। অন্তত তার পরীক্ষা অবধি তাকে ভাব নিয়ে চলতে হবে সবার সাথে।

আদ্য চলে যাওয়ার পর মেহু অনেকটা বিস্ময় নিয়ে বসে ছিল।সারাদিন আর নিচে যায় নি।খাওয়া দাওয়াও করেনি।এত বড় একটা চমক পেলো তাতে নিজেকে স্থির রাখা সহজ বিষয় না।আদ্য মেহুর ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সবটা শুরু থেকে ভাবতে থাকে।আর ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সন্ধ্যার দিকে ঘুম ভাঙতে আদ্যর মাথাটা ভার হয়ে যায়। আদ্য মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। এ মুহুর্তে কড়া এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু বলবে কাকে? আদ্য অনেক কষ্টে ঘর থেকে বের হয়।ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলা নেই তার মানে এখনো মেহু নিচে আসেনি। আদ্য সিড়ির কাছে গিয়ে থেমে যায় উপরে উঠবে কি উঠবে না ভেবে।যদি দেখে মেহু ঘরে নেই তাহলে কি হবে?

আদ্য মনের মধ্যে অনেকটা চিন্তা নিয়ে ছাদে যায়। ছাদের আলোও জ্বলানো হয়নি।ঘরের সামনে দাঁড়াতে দেখে ঘর অন্ধকার। আদ্যর বুকটা ধ্বক করে উঠে।আদ্য পা টেনে টেনে ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বলাতেই তার হাত কাঁপতে থাকে।মেহু মেঝেতে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। তার কাপড়চোপড় বেসামাল।আদ্য কোনোরকমে চোখটা সড়িয়ে মেহুর কাছে চলে যায়। পাঁজাকোল করে মেহুকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।গায়ে হাত দিতেই বুঝতে পারলো আগুনের মতো জ্বর। আদ্য ভয় পেয়ে যায়। নিশ্চয়ই দুপুরে ওভাবে বৃষ্টিতে ভেজায় তার জ্বর উঠে গেছে আর অজ্ঞান হয়ে গেছে। আদ্য কি করবে ভেবে পেলো না।সে চট করে বালতি ভর্তি পানি এনে মেহুর মাথায় ঢালতে লাগলো।মেহু তখনো অবচেতন অবস্থায়।প্রায় অনেক্ক্ষণ পর মেহুর শরীর ঠান্ডা হয়ে এলে আদ্য তার মাকে কল দেয়। কিন্তু রিসিভ হয় না।পরপর বাকিদেরকেও কল দেয় কিন্তু নেট সমস্যা জানায়।আদ্য কি করবে ভেবে পেলো না।চাইলে ডাক্তার ডাকা যায় কিন্তু এ ফাঁকা বাড়িতে ডাক্তার আসার পর যদি মেহুকে দেখে নেয় আর কোনোভাবে কথা টা বাবা মার কানে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।তাই এ মুহুর্তে কোনোরূপ রিস্ক নিবে না।

ধীরে ধীরে চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছে দেয়। এরপর নিজেই চলে যায় চা আর দুধ গরম করতে।এরমধ্যেও কল করে কিন্তু নেট সমস্যা জানায়।শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিয়ে সে রান্নাঘরে চলে যায়। এক ঘন্টা পর মেহুর হুঁশ আসে আর তখনি বোঝার চেষ্টা করে ঘটনা কি?মাথার মধ্যে টাওয়াল আর বিছানার পাশে বালতি দেখে বুঝে নেয় কেউ তার ঘরে এসেছে। মেহু বিছানা ছেড়ে নামতে যায় কিন্তু শক্তিতে পারে না।বুঝতে পারে সারা শরীর ভার হয়ে গেছে জ্বরে।তাই অনিচ্ছায় শুয়ে পড়ে।

আদ্য দুধ আর চা নিয়ে মেহুর ঘরে আসে।দেখে মেহু জেগে উঠেছে।আদ্য দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কি অবস্থা? শরীর এখন কেমন”?

মেহু মাথা নিচু করে জবাব দেয়।

“তুমি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।আকাশ পাতাল জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেছিলে।আমি তো রুমে এসে তোমাকে দেখে আঁতকে উঠলাম।তাড়াতাড়ি করে পানি দিলাম।ডাক্তার ডাকতে গিয়েও ডাকিনি তখন আবার কি না কি হয়?

শোনো দুধটা খেয়ে নাও।মনে হচ্ছে রাতে জ্বর আসতে পারে।তাই আমি হোটেল থেকে খাবার আনব সাথে তোমার জন্য কিছু ঔষধ। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।মনে হয় আজ কেউ আসবে না কারণ যেখানে গেছে সেখানে নেট সমস্যা বলছে।তাছাড়া আসার হলে চলে আসতো।বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই সমস্যা হয়ে গেছে।তুমি আপাতত ঘুমাও বাকিটা আমি দেখে নিবো।আর হ্যাঁ যা হয়েছে তা নিয়ে ভাববে না,সবটা ভুলে যাও। কোনো দরকার পরলে আমাকে বলবে।”

আদ্য আরো কিছু বলতে চায় কিন্তু মনে হচ্ছে মেহুর সেসবে মন নেই তাই একটা শ্বাস ফেলে সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আদ্য বের হতেই মেহুর চোখ জোড়া বুজে আসে।

পরদিন ভোরে আদ্যর ঘুম ভেঙে যায় দরজার আওয়াজে।বুঝতে পারে সদস্যরা ফিরে এসেছে। আদ্য চোখ কচলিয়ে দরজা খুলে দেয়।বাইরের সবার অবস্থা দেখে আদ্য অবাক হয়ে যায়। সবার যাচ্ছে তাই অবস্থা। মনে হচ্ছে এক দিন নয় বরং একযুগ বাইরে ছিল সবাই। লুৎফা জানায় তারা মূল স্পটে পৌঁছানোর পরই হড়বড় করে বৃষ্টি নামে।সবাই কোনোরকমে আশ্রয় নিলেও কোনোভাবে বৃষ্টি থামার নাম নেই। রাত হওয়ার পর যখন বৃষ্টির বেগ সামান্য কমলো তখন গাড়িতে উঠতেই খবর পায় রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ পানি আর রাস্তার অবস্থা খারাপ। দূর্ঘটনা হওয়ার সম্ভবনা আছে তাই শেষ মেষ আগের জায়গায় পৌঁছে সারারাত নির্ঘুমে পার করলো।ভোরের আলো ফুটতে রওনা হলো।রাস্তা ফাঁকা থাকায় তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারলো।কেউ আর কিছু বলার অপেক্ষায় রইলো না। সবাই যার যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলো কারণ দাঁড়িয়ে থাকার সামর্থ্য কারো নেই। সবাই চলে যেতে আদ্য আমেনা খালার কাছে গেলো।

“খালা কাল মেহু জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো তাই ঔষধ খাইয়ে ওকে ঘুমাতে বলেছি।তোমার সময় হলে একটু দেখে এসো।”

আমেনা খালা আদ্যর কথায় চোখ বড় করে ফেলে।এতক্ষণ যে ক্লান্তি ছিল সেটাও উধাও। কারণ মেহু নামটা আমেনা ছাড়া আর কেউ জানে না।এদিকে আদ্য অনায়াসে মেহু বললো,তার ওপর নাকি ওর জ্বর। আমেনা খালা বুঝতে পারলো তাদের অনুপস্থিতিতে এখানে কিছু একটা হয়েছে। আমেনা খালা তৎক্ষনাৎ ছাদে গেলো।দরজা টোকা দিতেই দরজা খুলে গেলো।তার মানে দরজা ভেজানো ছিলো। আমেনা খালা ঢুকতেই চক্ষু চড়ক গাছ।মেহু স্বাভাবিক হয়ে ঘুমচ্ছে তার মুখে কোনো প্রলেপ নেই তার মানে আমেনা যা ভেবেছে তাই। ঘটনা কিছু ঘটেছে কিন্তু সেটা কি?

মেহু নিজের বিষয়ে সবটা বলার পর এটা জানায় যে আমেনা খালা তার বিষয়ে সব জানে এবং তিনি তাকে সাহায্য করেছেন তাই আদ্য খুব সহজ ভঙ্গিতে আমেনা খালাকে মেহুর কথা জানায়।কিন্তু খালা তো জানতো না আদ্য সব জেনে গেছে তাই সে হতভম্ব হয়ে যায়। এখন মেহুর উঠার পালা তাহলে আমেনা সবটা জানতে পারবে।

আদ্য মেহুকে এডমিশনের জন্য বিভিন্ন বই কিনে দিয়েছে। তার পড়াশোনার কাজে আদ্য সাহায্য করে তবে সেটা সবাই ঘুমানোর পর।এতো সেদিন রাতে মেহু পড়ছিল আদ্য রীতিমতো ছাদে গেলেই টের পায় সেটা।তাই নিজেই দরজা বাড়ি দেয়।আওয়াজ শুনে মেহু স্বাভাবিক হয়ে বসে থাকে।কারণ সে কথার ছলে বলেছিল যদি কখনো আদ্য তার ঘরের দরজা বাড়ি দেয় তবে যেন তিনবার শব্দ করে। এতে মেহু বুঝতে পারবে দরজার বাইরে অন্য কেউ নয় আদ্যই আছে।তিনবার শব্দ হওয়ার পর মেহু উঠতেই আবারও শব্দ হয়।মেহু না এগিয়ে থেমে যায় কারণ চারটা বাড়ি পড়েছে এর অর্থ কি?আদ্য নাকি অন্য কেউ? মেহু সামনে না গিয়ে একি জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।তখনি বাহির থেকে গলা খাকড়ির আওয়াজ শোনা যায়। গলার স্বরে বোঝা যায় এটা আদ্য।মেহু দরজা খুলতে আদ্য হাসি হাসি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“কি হলো ভয় পেয়ে গেছো নাকি?আসলে তোমার কথা মতো তিনবার বাড়ি দেওয়ার পর হঠাৎ ইচ্ছে হলো আরেকবার বাড়ি দিয়ে তোমাকে ভয় পাইয়ে দিলে কেমন হয়?তুমি কি সত্যি ভয় পেয়েছো,তোমার চেহারায় তো ভয়টা দেখা দিচ্ছে?

আদ্য কথা শেষ করে হেসে উঠে। মেহু ভয় পেলেও আদ্যর শেষের কথায় কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকায়।

“বুঝলাম আমাকে ভয় দেখাতে আপনি বেশ মজা পান।তা এ সময় আপনি এখানে কি করছেন?ঘুমাবেন না?”

“ঘুমাব কিন্তু এখন ঘুম আসছেনা।তা কি করছো পড়ছো নাকি? ”

“জ্বি! ”

“ওহো কি পড়ছো?কোথাও সমস্যা হচ্ছে? ”

“জ্বি না।তেমন সমস্যা হচ্ছে না।কোচিং এর স্যাররা খুব ভালো করে পড়ান।তাছাড়া আপনি তো বেশকিছু সমাধান করে দিয়েছেন। ”

“হুমম।তা কোন কোন ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিচ্ছো মানে শুধু কি ঢাকায় নাকি ঢাকার বাইরেও?”

“না অতদূর পর্যন্ত ভাবিনি।তবে ঢাকায় যে তিনটা ভার্সিটি আছে সেগুলোতে দিব ইনশাআল্লাহ বাকিটা আল্লাহর হাতে। ”

“পরীক্ষা কখন হবে? কোনদিন কতো তারিখ সব লিস্ট করে আমাকে জানাবে।আমিই তোমাকে নিয়ে যাব ঠিক আছে? ”

আদ্যর কথায় মেহু হা করে ফেলে।আদ্য ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলে,

“এত বড় হা করো না মাছি ঢুকবে।তাছাড়া কাউকে না কাউকে তো তোমার লাগত তাই ভাবলাম আমিই করি।আর এসব পাবলিক পরীক্ষায় অনেক সময় মেনে চলতে হয় নাহলে সামান্য দেরীতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। তাই আমাকে সবটা বলবে আমি ম্যানেজ করে নিব।যাও ঘুমিয়ে পড়ো।স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার নাহলে দেখবে পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়বে।যাও ঘুমোতে!”

আদ্য উদাস ভঙ্গিতে চলে যায় আর মেহু সে যাওয়ার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে।
,
,
,
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here