#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:১৭
বাড়িতে ঢুকতেই দেখে লুৎফা আহসান সোফায় বসে কি যেন করছেন।তাদের দুজনকে দেখে তিনি হেসে উঠেন।আদ্য আর মেহু লুৎফার কাছে গিয়ে বসে।তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হলো এতো দেরি করলে যে?আজ কি খুব ভীড় ছিলো?”
“না মা খুব বেশি ভীড় ছিলো না। মোটামুটি একটা অবস্থা ছিলো কিন্তু মেহুর বেশ কিছু কাগজপত্রের জন্য সহজ কাজটা কঠিন হয়ে গেলো। এ মেয়েটার কি কোনো দায়িত্ব জ্ঞান আছে। ”
কথাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আদ্য।ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে উপরে উঠে যায়। আদ্যর যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে মেহু।লুৎফা আহসান বুঝতে পেরে মেহুকে কাছে টেনে নেয়।
“মা জীবনটা অনেক কঠিন। সবকিছুতে হেলাফেলা করে লাভ নেই।তাছাড়া মনে রাখতে হবে তুমি আদ্য আহসানের স্ত্রী যার স্বামী কখনো আলস্যতা,অবহেলা আর অগোছালো কিছু পছন্দ করে না।বিয়ের পর স্ত্রীদের সবসময় স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে হবে।যে স্ত্রী যত বেশি স্বামীর মনমতো সাজবে সে তত আপন হবে।”
“মা আমি হয়তো কখনো আপনার ছেলের মনের মত হতে পারব না।তাছাড়া কেন ভুলে যাচ্ছেন পরিস্থিতির কারণে বিয়েটা হয়েছে। এখনো অনেক কিছু বাকি।হয়তো আমাকে ওনার জীবন থেকে চলে যেতেই হবে।তাছাড়া এখনো এ বাড়ির মূল কর্তা আসেন নি।আমার মনে হচ্ছে যখন এ বাড়ির বড় স্যার আসবেন তখন হয়তো আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে।অযথা কেন এতো বেশি ভাবছেন?”
মনের মাঝে এসব কথা বিচরণ ঘটে মেহুর।কিন্তু মুখের ওপর হাসিকে প্রশস্ত করে মেহু রুমের দিকে পা বাড়ায়।বড্ড ক্লান্ত আজ!
রুমে ঢুকেই কোথাও আদ্যকে চোখে পড়ে না মেহুর।তাই একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়ায়।বুঝতে পারে আদ্য ওয়াশরুমে।আদ্যকে ডাকতে গিয়ে আটকে যায় মেহু।কারণ পূর্বে মেহু স্যার বলে ডাকতো কিন্তু গতকাল থেকে তাকে একবারও কিছু ডাকে নি।ডাকার প্রয়োজন হয় নি।যা কথা হয়েছিল সবটা আদ্য নিজেই শুরু করেছিল তাই মেহুকে কোনোকিছু সম্বধোন করতে হয় নি।কিন্তু এখন তো তাকে ডাকতে হবে কি করে ডাকবে স্যার বলে নাকি..? না স্যার বলে ডাকায় ঠিক হবে।ভাবার সাথে সাথে ডাকতে শুরু করলো মেহু।
“স্যার, স্যার আপনার কি হয়েছে? ”
নিরবতা
“স্যার আপনি কি আছেন?আপনার কি হয়েছে, আর কতক্ষণ লাগবে স্যার? ”
কোনো উত্তর নেই। আসলে বিকেলের খাওয়াটা বেশি হওয়ায় পেটে চাপ পড়েছে। এদিকে ওয়াশরুম থেকে আদ্যর রেসপন্স নেই। যেই না দরজায় ধাক্কা দিবে ওমনি আদ্য দরজাটা টাস করে খুলে দিলো।আর মেহুর হাতের বারিটা গিয়ে পড়লো আদ্যর বুকে।
“আহহহ্!”
আদ্যর আর্তনাদে মেহু জমে যায়। সাথে সাথে বুক থেকে হাতটা সরিয়ে দু কদম পিছিয়ে যায়। এখন কি করবে?তার তো দোষ নেই। দরজায় বারি দিতে গিয়ে আদ্যর বুকে পড়েছে তার করণীয় কি?কিন্তু এখন এসব কে শুনবে?হয়তো কালকের উরাধুরা জমানো মারটা আজ মেহুর পিঠে পড়বে ভাবছে।তাই চট করে পেছন দিকে ফিরে যেই না দরজার কাছে আসবে সাথে সাথে আদ্য হাতটা চেপে ধরে। আদ্যর হাত চেপে ধরার ব্যাথার চেয়ে মেহুর বুকে উঠা ঝড়টা প্রকন্ড।এবার হয়তো তার কপালে দুঃখ আছেই!!
আল্লাহ আজ আমি শেষ! আল্লাহ এবারের মতো এ লোকটার হাত থেকে বাঁচাও।পরেরবার থেকে হুশিয়ার করে চলবো।আল্লাহ আজ তুমি ছাড়া কেউ নেই রক্ষা করার।বাঁচাও আল্লাহ বাঁচাও।
মেহু মনে মনে দোয়া ইউনুস জপতে থাকে আর কথাগুলো আওড়াতে থাকে।আদ্য চোখ মুখ শক্ত করে মেহুর হাতটা ধরে তার কাছাকাছি নিয়ে আসে।
“তুমি এভাবে আমাকে বুকে মারলে কেন?”
কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন করে আদ্য।এমনিতেই মেহু আদ্যর গলার স্বর শুনলেই ভয় পায় এখন যেভাবে কথা বলছে মনে হচ্ছে কথা নয়,পাহাড় ধসে পড়ছে।
“সরি স্যার আমি ইচ্ছে করে করি নি।আসলে আপনি অনেকক্ষণ হলো বের হচ্ছেন না তাই দরজা বারি দিচ্ছিলাম।কিন্তু আপনি হুট করে দরজা খুলবেন তা জানতাম না তাহলে হাত সামলাতাম।দেখুন না আমি এভাবে দরজাটা বারি দিচ্ছিলাম আর আপনি এভাবে দরজা খুলছেন আর ধুম করে বারিটা আপনার বুকে গিয়ে পড়ে। ”
“আহহ্!”
আবারও আদ্য আর্তনাদ করে উঠে। এবারের বারিটা আরও জোরে পরলো।মেহু নিজেকে বাচাতে পুরো ঘটনাটা অভিনয় করে দেখাতে গিয়ে আবারও আদ্যর বুকে ঘুষি বসিয়ে দেয়।আর আদ্য আওয়াজ করে বসে।এতক্ষণ বাঁচার যে চান্স ছিলো এবার সেটাও হারালো মেহু।ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে মেহু আগপিছ না দেখে সোজা দৌড় দিলো।আদ্য কিছু বুঝতে পারলো না।তখনও নিজের বুকে হাত দিয়ে মালিশ করছে।
“অসভ্য মেয়ে কি ভেবেছো আঘাত করে পালাবে?ঘুরেফিরে রাতে এ রুমেই আসতে হবে তখন দেখে নিবো।উহু, শুকনো হাড়ে এতো শক্তি। বুকটা ঝাঁজরা করে দিলো।উউহু!”
মেহু রাতে কিছুই খায় নি।বিকেলের খাবারটা এতো বেশি হয়েছিলো যে রাতের খাবারে অনীহা চলে আসে।আরাকান, লুৎফা নীলা সহ সবাই জোর করলেও আদ্য করেনি।সে নিজের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে। সবাইকে খাইয়ে দুই জা মিলে সবটা গুছিয়ে মেহু রুমে আসে।এবার ঘুমের বন্দোবস্তো করতে হবে।গতকাল তো শরীরের ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে পরেছিলো আদ্য হয়তো এতটা খেয়াল করে নি কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব না যদি এসেই দেখে মেহু বিছানায় তাহলে হয়তো রেগে যাবে।তারচেয়ে বরং মেঝে ভালো।কিন্তু মেঝেতে বিছানোর মতো তো কিছু চোখে পড়ছে না। কি করবে মেহু?হঠাৎ ডেস্ক থেকে একটা চাদর নিয়ে সেটা মেঝেতে বিছিয়ে নেয়।বালিশটা নিয়ে চাদরেের ওপর রাখে।কিন্তু শোয়ার পর মনে পড়লো গায়ে কি দিবে?মেহুর বাজে স্বভাব ঘুমোতে গেলে তার কাপড় ঠিক থাকে না।জড়িয়ে থাকা শাড়িটাকে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিলো।আরামসে তৈরি করা বিছানায় শুয়ে পরলো।
আদ্য মায়ের রুমে মায়ের মুখোমুখি বসে আছে। লুৎফা আহসান ছেলেকে দেখছেন আর আদ্য মুষ্টিবদ্ধ হাতে থুতনি রেখে কিছু একটা ভাবছে। মিসেস লুৎফা নিজেই প্রশ্ন করেন,
“আদ্য কি হয়েছে? এত চিন্তিত কেন?কি নিয়ে ভাবছো?”
“মা আমি ভাবছি বাবাকে নিয়ে। তুমি তো জানো বাবা কেমন স্বভাবের মানুষ? যখন এসে সব ঘটনা শুনবেন তখন কি মনে হয় তিনি মেহুর বিষয়টা স্বাভাবিক নজরে দেখবেন?মা তুমি তো জানো বাবাকে এ বাড়ির সবাই কতটা ভয় পায়।আমার তো মনে হচ্ছে কিছু একটা সামনে ঘটবে!”
“আদ্য তোমার কি মনে হয় আমি এসব নিয়ে ভাবছি না তবে যা হওয়ার সব হয়ে গেছে। কোনোকিছু পরিবর্তন সম্ভব নয়।সবাইকে সত্যের মুখে পড়তে হবে।তাই আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।তুমি চিন্তা করো না আমি ভাববো এ নিয়ে। বরং তুমি মেহুর পড়াশোনা আর এদিকের কাজগুলো দেখো বাকিটা আমি দেখছি।তা মেহুর ক্লাস শুরু হচ্ছে কখন?”
“সবে তো মা আজ ভর্তি হলো।সম্ভাব্য এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হবে।”
“ঠিক আছে তুমি একটু নজর রেখো।আর ওর যা যা লাগবে মানে খাতা বই সব এনে দিবে।আশা করি তুমি আমার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করবেনা।”
“তোমার কথাকে যদি এতটাই অমান্য করতাম তাহলে হয়তো আজ এক কথায় বিয়ে করতাম না।(মনে মনে)ঠিক আছে মা চিন্তা করো না।এখন তাহলে আসি!”
লুৎফা আহসান হেসে সম্মতি জানায়।আদ্য রুমে এসে দেখে মেহু ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাত।এ মেয়ে এত কিভাবে ঘুমাতে পারে আদ্যর জানা নেই। যেখানে মেহুকে বিয়ে করে আদ্যর আরামের ঘুম হারাম হয়ে গেছে সেখানে এ মেয়ে রাতের ঘুম দিনের ঘুম কোনোটাই বাদ দেয় না।কি মেয়েরা বাবা?তাছাড়া হঠাৎ মেহুকে নিচে দেখে আদ্য বিরক্ত হয়।কি এমন হলো যে সোজা মেঝেতে নেমে এলো?
“মেহু এই মেহু ! মেহু তুমি কি ঘুমিয়ে পরেছো?”
“হু”
“মেহু”
“হু”
“কি হু হু শুরু করলে জেগে থাকলে উঠে বসো না।”
“ডাকছেন কেন স্যার ঘুমাতে দিন?সারাদিন ঘুমাতে পারি নি আমি ক্লান্ত। ”
কথাটা অস্পষ্ট ভাবে শেষ করে মেহু আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আদ্য হা হয়ে যায় মেহুর কান্ডে।তাছাড়া আদ্য এতক্ষণে বুঝলো মেহু তাকে স্যার বলে ডাকছে।পুরনো অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারেনি।কিন্তু আদ্য নিজেও তো জানে না মেহু তাকে কি বলে ডাকবে?যাই হেক কাল এর ফয়সালা হবে।এখন ঘুমাতে হবে তাকে।বড় ভাই, বাবা,চাচা সবাই কাজের সুবাদে বাইরে তাই এদিকের সবটা আদ্যর ওপর।চাচা দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েটা আরাকানের সমান ছেলেটা ইন্টারে।তাদের ওপর তো আর কাজের চাপ দেওয়া সম্ভব নয়।যদিও আরাকানকে মাঝে মধ্যে কাজ সম্পর্কে বিভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়। সে এককানে শুনে তো অন্য কানে বাহির করে।কে শুনে কার কথা? তাই কাজের সবটা চাপ এখন আদ্যর ওপর।আরকিছু না ভেবে আদ্য বিছানায় শুতে যায়। মুখটা মেহু বরাবর রাখে।গুটিসুটি হয়ে কতটা আরামে ঘুমোচ্ছে। মেহুকে দেখতে দেখতে একসময় নিজেই ঘুমিয়ে পড়ে!
ক্লাস শুরু হয়ে গেছে মেহুর।প্রথম প্রথম হওয়ায় স্যাররা খুব একটা পড়ান না।নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে খোশগল্প করে।মেহু এ পর্যন্ত যতজন স্যারদের দেখলো সবাইকে তার ভালো লেগেছে কেমন জানি মমতাভরে কথা বলে!ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থী তারা কতো অনায়াসে একজন আরেকজনের সাথে আলাপ জমাচ্ছে শুধু মেহু ছাড়া। কারণ মেহু এর আগে কখনো এত সুন্দর ছেলেমেয়ে দেখেনি।অজপাড়া গা থেকে উঠে আসা মেহুর কখনো এত স্মার্ট মানুষের সাথে উঠবস হয় নি। তাই এদের সাথে মিশতে অস্বস্তি বোধ করছে সে। হঠাৎ কিছু মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে।ওদের দেখেই মেহু একটু জড়ে হয়ে বসে।মেয়েগুলোর মধ্যে শ্যামবর্ণের মেয়েটা আগে কথা বলে।
“হেই কেমন আছো?তুমি এভাবে জুবুথুবু হয়ে এককোণে বসে আছো কেন?আমরা সবাই নতুন তাই সবাই পরিচয় হচ্ছে কিন্তু তোমাকে দেখলাম এখানে চুপ করে বসে আছো।পরিচয় হতে ইচ্ছে করছেনা বুঝি?”
মেয়েটা কতো সুন্দর করে কথা বলছে আর মেহু সেটা দেখছে।
“না আসলে আমি তোমাদের মতো এত সহজ হতে পারছি না তাই। আর কিভাবে কথা বলবো মাথায় আসছে না তাই চুপ করে বসে আছি।”
মেয়েগুলো হেসে উঠে।
“আরে এতটা জড়তা থাকলে হবে।এসো আমরা পরিচিত হয়।আমার নাম সিমরান আর ও হচ্ছে নিপা,সাঝি।তুমি?”
মেহু নিজের পরিচয়টা দেয়।অল্প সময়ের ব্যবধানে খুব খাতির হয়ে যায় চারজনি।তন্মধ্যে সিমরানের সাথে মেহুর ভাব জমে যায়। প্রথম দিন ক্যাম্পাসটা তার কাছে খুব আনন্দদায়ক মনে হলো।ভাবছে সবার সাথে এভাবে মিশতে পারলে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা একাকিত্ব সে সহজে ঘুচতে পারবে।আনন্দের হাসি জাগলো তার চোখে মুখে!
বাসায় আসতেই মেহুর হাসিমাখা মুখটা দেখে সুজাতা ভ্রু কুঁচকায়।
“কি হে এতো খুশি কেন?মনে হচ্ছে গুপ্তধন পেয়েছো।”
চাচির কথায় মেহুর মুখটা লম্বাটে হয়ে যায়।মেহু জানতই না চাচি এ সময় বসার রুমে থাকবে।মেহুর চুপ থাকায় চাচি কিছুটা হুংকার ছাড়েন। মেহু ভয় পায়।
“চাচি আজকে ওর ভার্সিটির অরিয়েন্টেশন ক্লাস ছিলো তাই অনেক নতুন মুখের সাথে আলাপ হয়েছে। সেই খুশিতে হয়তো হাসছে।তাই না মেহু?”
মেহু ভীতি মাখা মুখে জবাব দেয়।কোনোরকমে নীলা মেহুকে নিয়ে চাচির সামনে থেকে কেটে পড়ে।দুজনের ফাঁকি বাজি টের পেয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে সুজাতা।
এ দুটোকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।আগে ভাইয়া আর শরীফ আসুক তারপর কিভাবে আকাশে উড়া পাখিকে জমিনে নামাতে হয় তা আমার জানা আছে!
মনে মনে এমন কুচক্রী কথা ভেবে ডেভিল হাসি দেয় সুজাতা!
,
,
,
চলবে……