সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-১৮

0
6705

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:১৮

আহসান ভিলার সব মানুষের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। শুধু অস্থিরতা না একধরনের আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে।সবাই বোবার মতো চুপ করে আছে কারণ সোফায় খুব শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে শাহেদ আহসান। আজ সন্ধ্যায় ফিরেছে শাহেদ আহসান।

তিনদিন আগে কল দিয়ে লুৎফাকে জানায় বাইরের কাজটা শেষ হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি তারা ফিরবে কিন্তু কখন ফিরবে সেটা স্পেসিফিক বলে নি।এ নিয়ে বাসার সবাই মোটামুটি উত্তেজিত ছিল।সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত ছিল লুৎফা আর মেহু।কারণ লুৎফা যতই গৃহকর্ত্রী হোক স্বামীর ক্ষেত্রে সে অনেকটা ভীত ধরনের।তাছাড়া ছেলের বিয়ের বিষয়ে সে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো অথচ স্বামীকে জানানোর মতো সাহস হলো না।এখন ভাবছে সে যখন সবটা জানবে তখন কি হবে?

আর মেহু তো ভেতরেই শেষ হয়ে গেছে। এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটাকে ভয় পায় সেটা হলো শাহেদ আহসানকে।কারণ এ বাড়িতে আসার পর থেকে মেহুর সাথে সবার কম বেশি আলাপ বা কথা হলেও একদম কথা হয় নি এ মানুষটার সাথে। তিনি খুব বেশি গম্ভীর আর শান্ত ছিলেন। বকবক করা মানুষের সাথে কথা বলে তাকে জানা যায় কিন্তু শান্ত আর গম্ভীর মানুষের সাথে আলাপ না হওয়াতে বোঝা যায় না সে মানুষটার ভেতরের খবর কেমন? খাবার টেবিল ছাড়া শাহেদ আহসানকে মেহু কখনো বাড়ির অন্য কোনো আলোচনায় দেখে নি। সারাদিন অফিসের কাজ,বাসায়ও অফিস নিয়ে আলোচনা এসবে তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন। মেহুর বুকটায় হাতুড়ি পড়ার আওয়াজ হচ্ছে কি জানি কি হয়?

তিনদিন সবার কাছে তিন যুগ মনে হচ্ছিল সবাই প্রত্যাশা করছিল যাতে সময়টা আরেকটু কম হোক কিন্তু আল্লাহ সেটা চাইলেন না।তিনদিনের কথা বলে হঠাৎ করে একদিনের মাথায় শাহেদ আহসান হাজির হয়।বাসায় ঢুকতেই তিনি আমেনাকে ডাক দেন ঠান্ডা পানির জন্য। মেহু রান্নাঘরেই ছিল শাহেদের গলার আওয়াজ শুনে সে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে।আমেনার মধ্যেও যেন কোনো প্রাণ নেই। আমেনা তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে দৌড়ে যায়। শাহেদ পানিটা পান করতেই উপর থেকে লুৎফা নেমে আসে। এক এক করে বাসার বাকিরাও হাজির হয় ড্রয়িং রুমে। শাহেদ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সবার সাথে ব্যবসার কাজের বিষয় গুলো সবাইকে বলে কিন্তু সবার ভেতর অন্য চিন্তা হামাগুড়ি দিচ্ছিলো।সবার শান্ত অবস্থা দেখে তিনি কেমন জানি সরু চোখে তাকান।

“কি ব্যাপার সবাই এমন চুপচাপ কেনো?মনে হচ্ছে এতদিন পর আমাদের দেখে কারো মনে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি।কি হয়েছে বলো তো,কোনো সমস্যা? ”

শাহেদ আহসানের এ কথায় এবার সবার ভেতর আরো উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।ঐদিকে মেহু এখনো রান্নাঘর থেকে বের হয় নি তার অবস্থা মর্মর। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড গলা দিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। মেহুর ক্ষমতা থাকলে সে এক্ষুনি কাজটা করতো কিন্তু আফসোস সেটার কোনো সুযোগ নেই।সে কান আলগা করে আছে বাইরের ঘটনা বোঝার জন্য।

কাউকে তো কিছু বলতে হবে কিন্তু কেউ মুখ খুলতে পারছেনা।মনে হচ্ছে আঠা দিয়ে সবার মুখ আটকে দেওয়া হয়েছে। শাহেদ আহসান এবার শিউর হয়ে নিলেন যে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছেই কিন্তু সেটা কি?

“কি সমস্যা সবার?একসাথে সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো নাকি?কেউ কিছু বলছো না কেনো?”

সুজাতা অনেক কাচুমাচু করে অবশেষে বলেই ফেললো,

“ভাইজান আসলে অনেক বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আপনার তো আসার কথা ছিল দুদিন পর আপনি এত তাড়াতাড়ি এলেন যে?”

“আমি কখন আসবো না আসবো সেটা কি আগে থেকে ঠিক করে রাখতে হবে।তাছাড়া আগে আসি বা পরে আমার বাড়িতে আসতে কি আমাকে দিন গুণে আসতে হবে।কেউ যখন কিছু বলছে না তাহলে সুজাতা তুমিই বলো ঘটনা কি?”

সুজাতা এবার ভয় পেয়ে যায়। মনে মনে গালি দিচ্ছে কেনো সে মুখ খুলতে গেলো?এবার তো কিছু না বলেও থাকা যাবে না নাহলে শাহেদ জিজ্ঞেস করতে করতে হয়রান করে ফেলবে।তাই মুখটা আরো ছোট করে বলে,

“আসলে ভাইজান আপনাকে জানানো হয়নি হঠাৎ করে আদ্যর বিয়ে হয়ে গেছে। ”

শাহেদ আহসান হকচকিয়ে যায়। আদ্যর বিয়ে হয়েছে অথচ বাবা হিসেবে সে জানেই না।সে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“কি বলছো এসব,আদ্যর বিয়ে হয়েছে, কখন কিভাবে আর কার সাথে? ”

“আসলে ভাইজান সেটা অনেক লম্বা ঘটনা।তবে আপনি শান্ত হোন।বিয়ে হয়েছে আমাদের এ বাড়ির কাজের মেয়ে মর্জিনার সাথে। ”

শাহেদ আহসান হতভম্ব হয়ে যায়। কি বলে সুজাতা?মর্জিনা নামের ঐ কালো মেয়েকে আদ্য বিয়ে করেছে তাও আবার একটা কাজের মেয়েকে?শাহেদ আহসান নিম্ন স্বরে পানির কথা বলে,সাথে সাথে মেহু দৌড়ে তার কাছে পানি নিয়ে যায়। আড়াল থেকে মেহু বাইরের অবস্থা দেখছিল কিন্তু যেই না দেখলো শাহেদ আহসান কেমন জানি অসুস্থ স্বরে পানির আহ্বান করেছে ওমনি মেহু পানি নিয়ে গেলো।শাহেদ সোফায় বসে পানিটা পান করতেই মেহুকে তার নজরে আসে।সে চোখ দিয়ে অন্য দের দিকে তাকায় যার অর্থ কে এই মেয়ে? সুজাতা আগ বাড়িয়ে এসে জানায় এই হচ্ছে মর্জিনা যার সাথে আদ্যর বিয়ে হয়েছে। শাহেদ আহসান তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলে।তার বুকের বা পাশটা খানিকটা ব্যাথা করছে।সে চোখ বন্ধ করে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেললো।

আদ্য বাড়িতে ছিল না।অফিসে কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ কলে জানায় শাহেদ আহসান বাসায় চলে এসেছে। শুনেই আদ্য আরকিছু বলতে পারলো না।রিসিভারটা রেখেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ উঠে এলো।

শাহেদ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার নড়চড় নেই। মনে হচ্ছে অধিক শোকে সে পাথর বনে গেছে। লুৎফা বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করে।তাতে শাহেদের কোনো ভাবান্তর হয় না। সে দুই হাতে ভর দিয়ে নিরব দর্শকের মতো শুনতে থাকে।শেষে লুৎফা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,

“দেখো আমি তোমাকে শুরু থেকে সবটা বলেছি।ঘটনার বিশদ বর্ণনা শোনার পর তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি?”

শাহেদ শান্ত চোখে লুৎফার দিকে তাকাতেই লুৎফার কলজে শুকিয়ে যায়। কারণ লুৎফা জানে এ দৃষ্টি যতটা শান্ত দেখাচ্ছে মুলত ততটা শান্ত নয়।এ দৃষ্টিতে রয়েছে অনেক ক্ষোভ যা যে কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারে।শাহেদ উত্তর দেয়,

“এত কিছু করার পর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছো তুমি কোনো ভুল করেছো কিনা?আসলে ভুল তো তোমার না ভুল আমার আমি তোমাকে বুদ্ধিমতী মনে করতাম আর এতটাই বিশ্বাস করতাম যে তোমার সবকিছুর ওপর ভরসা ছিল।শেষ পর্যন্ত তুমি আমার কথা, আমার সম্মানের কথা চিন্তা না করে আমার ছেলের জীবন নিয়ে কাহিনি করলে! আসলে মেয়েজাতটাকে যতটা বুদ্ধির ভাড় মনে হয় তারা তার চেয়ে আরো নিম্ন স্তরে।আমি বাইরে ছিলাম তবে এতটা তো দূরে নয় যে আমাকে জানানোর সুযোগ ছিল না।তাছাড়া বর্তমান টেলিফোনের যুগে তুমি তো আমাকে কল করে বিষয়টা জানাতে পারতে।তা না করে তুমি সামান্য একটা অচেনা মেয়েকে বাঁচাতে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছো তাও আবার যে কিনা এ বাড়ির কাজের লোক ছিলো।এতটা সাহস তুমি পাও কি করে?”

শাহেদ আহসান খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা গুলো বলতে থাকে।শেষের দিকের কথা গুলো অনেক চেচিয়ে বলে যার কারণ তার হাঁপানি দেখা দেয়।লুৎফা ভড়কে যায় স্বামীর আচরণে।

“তুমি আমার কথাটা শোনো প্লিজ একটু বো…….”

“কি বলবে তুমি কি বলবে?অপারগ হয়ে কাজটা করেছো কেন ওদের বিদায় করে মেয়েটাকে অন্য জায়গায় পার করে দিলে কি হতো বা পুলিশের সাহায্য চাইলে কি হতো? নিশ্চয়ই দেশে আইন বলে কিছু আছে তাই না?দেশে তো কতো মানুষের বিপদ কতো মেয়ে অসহায় তাই বলে সবাইকে এনে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিবে এসবের মানে কি?তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছি বলে তুমি…”

শাহেদ আর কিছু বলতে পারলো না।বুক চাপা দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। লুৎফা দৌড়ে যেতে শাহেদ হাত দিয়ে আটকে দিলো।লুৎফা থম মেরে যায়। শরীফ আরিফ সহ বাকিরা শাহেদকে ধরাধরি করে রুমে নিয়ে যায়। লুৎফা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে থাকে।

আদ্য বাবার পাশে বসে আছে। স্বামীর অন্য হাত ধরে বসে আছে লুৎফা।নিরব আছেই ঠিকই তবে চোখের জল স্থির নয়।ক্রমাগত বাঁধ ভাঙা নদীর মতো টপটপ করে জল পড়ছে। আদ্য কয়েকবার মাকে কান্না থামাতে অনুরোধ করেছে কিন্তু সেটা পারছেনা লুৎফা।কীভাবে করবে শুধু মাত্র তার জন্য আজ শাহেদের এ অবস্থা। নিজের কাজ আর সিদ্ধান্ত দুই এর জন্য লুৎফা নিজেকে অপরাধী ভাবছে কিন্তু ভেবেই কি হবে? পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিল আর সেটাকে সামাল দিতেই তাকে এ সিদ্ধান্তে আসতে হলো।

আদ্য মাকে আর কিছু বলার সাহস পেলো না সেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বাইরে আসতেই চোখে পড়ে মেহুকে।এ অল্প সময়ে মেয়েটা কেঁদে কেটে একাকার হয়ে গেছে। আদ্য বুঝতে পারছে না কাকে সামাল দিবে।একদিকে মা বাবা অন্য দিকে মেহু।আদ্যর মাথাটা ভার হয়ে এলো।এতো ধকল একসাথে নেওয়াটা নিশ্চয়ই সোজা নয়।

শাহেদকে রুমে নিতেই পারিবারিক ডাক্তার আসাদকে কল করে আনা হলো।তিনি চেকআপ করেই জানান অতিরিক্ত হৃদের চাপে তার হার্টবিটে রক্ত চলাচলে সমস্যা দেখা দিয়েছে।এ মুহুর্তে যদি তাকে রেস্টে রাখা না হয় তবে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।ডাক্তারের কথাটা শোনার পর থেকে লুৎফা নিষ্প্রাণ পাথরের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।কারো সাথে কথা নেই শুধু কান্না ঝরছে তার চোখ থেকে। আদ্য অফিস থেকে এসে সবটা শোনার পর মায়ের কাছে যায়। মাকে সাত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ নেই তবুও কিছুক্ষণ বসে রইলো।আর এখন মেহুকে দেখে তার আরো খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই মেহুর ভেতর অনুশোচনা বোধ বারবার তাকে আহত করছে।মেহু অপরাধী দৃষ্টি নিয়ে আদ্যকে চেয়ে আছে হয়তো তার থেকে সামান্য সহানুভূতি প্রত্যাশা করছে কিন্তু আদ্যর মনে কোনো কথায় আসছে না মেহুকে বলার মতো।সে আহত দৃষ্টি নিয়ে মেহুকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে।আদ্যর পাশ কাটানো যেনো মেহুর কষ্টটা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।মেহু কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে যায়।
,
,
,
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here