সেলাই মেশিন
(১০)
————-
দাদার মৃত্যুর পর থেকে অনার্স শেষ করা পর্যন্ত একবারও বাবার কাছে গিয়ে থাকেনি মৌরি। ইচ্ছাই হয়নি। কাজ আর পড়ার মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল। বাবা অবশ্য দুইবার ঢাকায় এসে ওকে দেখে গেছেন। কিন্তু গ্রাজুয়েশনের পরেই বাবা ভীষণভাবে চাপ দিতে শুরু করলেন। মৌরি ঢাকায় থেকে চাকরির চেষ্টা করতে চাচ্ছিলো। ততদিনে হল ছেড়ে দিয়েছে, দাদির কাছে ফুফুর বাসায় এক মাস ছিল। কিন্তু কোথাও চাকরি পাকা হচ্ছিলো না, বুঝতে পারছিলো সময় লাগবে। দাদিও ফুফুর বাসায় একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। প্রতিদিন সকালে উঠেই এক কথা বলতেন, বাড়িতে যাবেন। এদিকে ফুফুও মৌরিকে বেশিদিন নিজের কাছে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে সবদিক বিবেচনা করে কিছুদিনের জন্য বাবার কাছে গিয়ে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো মৌরি।
মৌরি দাদিকে নিয়ে বাবার কাছে পৌঁছে গেলো। বাবার চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। আরো বড় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। রুনু ঝুনু খুব ভালো ভাবে পড়ালেখা করছে। আগের মতো অভাবের প্রকট ছাপ নেই সংসারে। শাহেদা বেশ সামলে নিয়েছে বলা যায়। তবে মৌরিকে এতদিন পরে দেখেও তার শীতল কাঠিন্য দূর হলো না। অথচ মৌরির জন্য প্রতিদিন ভালো মন্দ রান্না ঠিকই করছে সে। নতুন জামা কাপড়ও কিনে দিলো। আবার অন্যদিকে মৌরির পড়ালেখা, ভবিষ্যৎ চিন্তা নিয়ে শাহেদা বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো না। চুপচাপ নিজের কাজ করতো, খাবার সময় হলে খেতে ডাকতো। টিভি দেখার সমৌ মৌরি এলে উঠে চলে যেত।
রুনু তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী, ঝুনু ক্লাস এইটে পড়ে। মৌরি ওদের থেকে দূরেই থাকে, ওরাও তাই। দাদি আর মৌরিকে একটা ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল। মৌরি নিজের ঘরেই থাকতো বেশিরভাগ সময়। ও চাইতো ঘরের কাজে শাহেদকে সাহায্য করতে কিন্তু ওর মনে হতো শাহেদা সেটা পছন্দ করবে না। ওদের সাথে অতিথির মতো আচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো শাহেদা। মৌরি নিজের মতো অনলাইনে চাকরি খুঁজতো, ইমেইল চেক করতো ইন্টারভিউতে ডাকের আশায়। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখতো। চাকরির একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেই এই বাসা ছেড়ে নিজেরমতো অন্য কোথাও থাকবে।
একদিন বাসায় হঠাৎ করেই শাহেদার কোনো দুঃসম্পর্কের ভাই আর তার পরিবার বেড়াতে আসবে বলে জানালো। মেহমান আপ্যায়নের তেমন আয়োজন বাসায় ছিল না। কাজের সহকর্মী মেয়েটি সেদিন আসেনি বলে রান্না আর ঘর গোছানো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলো শাহেদা। তার ব্লাড প্রেসারের সমস্যা, রান্নার মাঝামাঝি পর্যায়ে অসুস্থ বোধ করায় নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মৌরি নিজে থেকেই গিয়ে জানতে চাইলো কোনো সাহায্য দরকার কিনা। শাহেদা চোখ বন্ধ রেখেই বললো মৌরি যেন পোলাও রান্না করে ফেলে।
রান্নায় মৌরি খুব একটা পটু না। দাদিকে গিয়ে বললো কিভাবে পোলাও রান্না করবে যেন বলে দেয়। । দাদি বললো, “পাকের ঘরে একটা চেয়ার নিয়া রাখ, আমি সামনে থেইকা তোরে দেখায় দেই কেমনে পোলাও রান্দে।” মৌরি একটা চেয়ার নিয়ে রান্নাঘরে রাখলো আর দাদি সেটায় বসে তাকে পোলাও রান্নার নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।
যেহেতু এই রান্না ঘরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা মৌরির নেই তাই কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলো না , দাদিও কিছু জানে না। এদিকে শাহেদা ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার ঘরের দরজা বন্ধ, রুনু ঝুনু স্কুলে। মৌরি এদিক ওদিক খুঁজে সব বের করছিলো। শেষে ঘি খুঁজে না পেয়ে ফ্রিজ খুলে দেখলো। ঘি পাওয়া গেলো সেই সাথে বের করলো একটা পঁচা শশা আর চুপসে যাওয়া লেবুর টুকরা। ওসব বের করে ফেলে দিয়ে নজরে পড়লো ফ্রিজের ভেতরের দিকে একটা পুরোনো প্লাস্টিকের বাক্সে কী জানি রাখা। খুলতেই বিশ্রী গন্ধ ভক করে বেরিয়ে এলো, বমি আসার জোগাড়। দেখে মনে হলো তরকারির ঝোল, হয়তো অনেকদিন ধরে ফ্রিজে পড়ে আছে, শাহেদার খবর নেই।
দাদি বললো, “তাড়াতাড়ি ফালায় ওই বক্স। কী বিষ জমায় রাখছে, কে জানে।”
মৌরি তাড়াতাড়ি ময়লার বালতিতে ফেলে দিলো ওটা।
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে গোসলে ঢোকার আগে ফ্রিজ খুলে সেই বাক্স না পেয়ে আচমকা ভীষণ চিৎকার শুরু করলো রুনু।
“আমার ফেসপ্যাক কই? কে ধরছে ওইটা?”
মৌরি চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো,” কী হইছে রুনু? এইভাবে চিল্লাও ক্যান?”
“চিল্লাবো না তো কী করবো? ফ্রিজে একটা বাক্সের মধ্যে আমার ফেসপ্যাক ছিল, ব্রণের জন্য ব্যবহার করতাম, ওইটা কই?
“ওইটা তোমার ফেসপ্যাক? আমি তো ছাতা পড়া তরকারির ঝোল মনে কইরা ফালায় দিলাম।”
কথাটা শুনে রুনু হঠাৎ অস্বাভাবিক ভাবে রেগে গেলো। চিৎকার করে বললো, “তোমারে কে বলছে পাকনামি করতে? আমাদের ফ্রিজের জিনিস তুমি ধরার কে? ওইটা হারবাল ওষুধ ছিল, ওইরকম গন্ধ হইতেই পারে। তুমি কাউরে জিজ্ঞেস না কইরা ফেলছো ক্যান?”
মৌরি পুরোপুরি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এতো জঘন্য ভাবে রুনু চিৎকার করতে পারে, ও ভাবতেও পারে না। নিজেকে সামলে নিয়ে চড়া গলায় বললো, “এভাবে চিল্লাইতেছো ক্যান? আমার জানা ছিল না তাই ফেলে দিছি তাই বলে এইভাবে অভদ্রের মতো কথা বলবা বড় বোনের সাথে?”
“কে বড় বোন? তুমি? এত বছর কই ছিলা যে এখন ফাল দিয়া আইসা আমাদের মাথার উপরে বইসা বড় বোনগিরি দেখাইতেছো? কই ছিলা আমাদের বিপদের সময়? নিজেরটা নিয়াই তো ব্যস্ত ছিলা। এখন ইউনিভার্সিটিতে পইড়া আইসা নিজেরে খুব সেয়ানা মনে করছো?”
চিৎকার শুনে ততক্ষনে দাদি ছুটে এসেছেন। অবাক হয়ে তিনি বললেন, “এইসব কী রকম ব্যবহার রুনু? তুই মানস না মানস, মৌরি তোর বড় বোন। সে ঠিকই আসছিলো তোদের সাথে থাকার লাইগা কিন্তু তোদের সমস্যার কথা চিন্তা কইরারই সে দূরে থাকছে।”
“আপনে আর এর হইয়া গান গাইতে আইসেন না। আমাদের খবর নিছেন কয় বার? খালি মৌরি মৌরি।” দাদির উদ্দেশ্যে কুৎসিত ভঙ্গিতে বললো রুনু। পেছনে শাহেদা এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষনে। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে সে বললো, “রুনু, চুপ কর। এইসব কেমন অসভ্যতা? যা নিজের ঘরে গিয়া কাপড় বদলায় নে। সারাদিন ওই ফেসপ্যাক লাগায় কোন দেশি হুর পড়ি হইয়া গেসোস যে একটু ফেসপ্যাকের জন্য এইভাবে চিল্লাইতেসোস? আইনা দিবোনে আরো ফেসপ্যাক, দেখবো কত মুখে ঘষতে পারোস।”
“থাক, আর লাগবো না। কত যে আইনা দিবা, খুব ভালো জানা আছে। এই বাড়িতে কিছু লাগলেই খালি শুনতে হয়, নাই নাই নাই ……” গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো রুনু।
মৌরি আর কোনো কথা না বলে ওর রুমে চলে এলো। রাগে ওর গা কাঁপছে। এত অপমান গায়ে লাগাতে ওর কী বয়েই গেছে? বাইরে দাদি আর শাহেদা কথা বলে যাচ্ছে। শুনতে পেলো শাহেদা বলছে, “কাউরে না জিজ্ঞেস কইরা ফ্রিজের জিনিস ফালায় দেয়া মৌরির ঠিক হয় নাই।”
মৌরির ইচ্ছা হলো এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এভাবে ভাবলেই তো হয় না, ওর না আছে চাকরি, না আছে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা। চাইলে কোনো বান্ধবীর বাসায় হয়তো কিছুদিনের জন্য গিয়ে থাকতে পারবে কিন্তু সেটা তো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান না। ঢাকায় বেশ কয়েকটা চাকরির আবেদন করেছে কিন্তু এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে একটা জায়গায় তার ডিপার্টমেন্টের হেডের রেফারেন্স আছে, যখন থেকে ডাক আসার সম্ভাবনা প্রবল। সব মিলিয়ে খুবই অনিশ্চিত দশা। এইভাবে অনাহুত অতিথির মতো নিজের বাবার বাসায় থাকার যন্ত্রনা আর মেনে নিতে পারছিলো না মৌরি।
ঠিক তখন ছোট ফুফু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন।
(ক্রমশ)