সেলাই মেশিন —- (১৪)

সেলাই মেশিন
—-
(১৪)
————-
রুনু তুলকালাম কান্ডই শুরু করলো!

প্রথমে চিৎকার করে শাহেদাকে ডাকাডাকি করলো। শাহেদা হতভম্ব হয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই রুনু চড়া গলায় বললো, “মা, তোমার তো কোনো খবরই নাই। আব্বা মৌরি আপারে সোনার চেইন দিছে আর আপা সেইটা লুকাইয়া রাখছে। আমি আমি সেইদিন বললাম ঈদে আমারে একটা লেহেঙ্গা কিননা দাও, দিলো না, অনেক নাকি দাম, তার কাছে এত টাকা নাই। তাইলে সোনার চেইন কিনার টাকা আসে কই থেকে? আমারে আর ঝুনুরে আব্বা নাকি ওই মৌরি আপার মতো সমান ভাবে দেখে, কই, আজকে এইটা কী হইলো? স্বর্ণের চেইন তো বহুত পরের কথা, আমার কলেজে যাওয়ার নতুন জুতাও আব্বা কিনতে চায় নাই।”

রুনুর চেঁচামেচি শুনে বাবাও এলেন। তখন বেশ রাত, সবাই যার যার ঘরে ঘুমানোর আয়োজন করছিলো। রুনু দাদির ঘরে গিয়েছিলো মশার কয়েল খুঁজতে। গিয়েই মৌরি আর দাদির কথোপকথন শুনে ফেলে।

বাবা অবাক হয়ে বললেন, “এমন ভাবে চিল্লাস কেন রুনু? কী হইছে?”

শাহেদা পাশে পাথর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, রুনুকে থামতে বলছে না। মৌরি আর দাদিও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুনুর ভয়ানক রূপ দেখছে। বাবাকে দেখে রুনু যেন আরো জ্বলে উঠলো। খেঁকিয়ে বললো, “কী হইছে আপনে জানেন না? আপনে আমাদের সবাইরে না জানাইয়া মৌরি আপারে স্বর্ণের চেইন কিননা দিছেন ক্যান? আপনার কী টাকা বেশি হইছে? মৌরি আপার তো অনেক বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়া হইছে, এমন চেইন তো সে অনেক পাইবো। তারপরেও আপনে আমাদের দুই বোনরে না দিয়া ওরেই দিলেন?”
“চুপ কর রুনু। সময় হইলে তোরাও পাবি।” বাবা ধমক দিয়ে বললেন।
“কবে সময় হইবো? আপনার ওই মেয়ে কয়দিন পরপর বিদেশ থেইকা আসবো আর আপনে আমাদের ঠকাইয়া ওরে সব দিয়া দিবেন। আমরা সেইটা মানবো ক্যান?আমাদের যা দেওয়ার আজকেই দিবেন। এক্ষনি দিবেন। ”

বাবা অসহায় ভঙ্গিতে শাহেদার দিকে তাকালেন, যেন রুনুকে সে থামায়। কিন্তু শাহেদাও কিচ্ছু বললো না, মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। মৌরির বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিলো। আগামীকাল ঈদ, অথচ এখন এসব কী হচ্ছে?

বাবা আবারও বললেন, “বললাম তো, তোদেরও চেইন দিবো। এখন চুপ কর।” দাদি এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাচ্ছিলো, মৌরি দাদির হাত চেপে ইশারা করে নীরব থাকতে বললো। এই অবস্থায় কিছু বললে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে।

“না চুপ করবো না। আপনে আমাদের দুই বইনরে চেইন দিবেন তারপর আমি চুপ করমু। আপনার এইসব ঠকবাজি আর চলবো না।”

রুনুর উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখে বাবা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। এগিয়ে এসে রুনুর পিঠে গালে কয়েক ঘা মেরে দিলেন। শাহেদা এবার তেড়ে এসে রুনুকে জাপটে ধরে বাবার রোষানল থেকে বাঁচাতে চাইলো। কটমট করে বললে, “ঠিকই তো বলছে। তিন মেয়েরে আপনে সমান ভাবে দেখবেন, সেইটা না কইরা সাধের মেয়ের জন্য পলাইয়া পলাইয়া সোনার চেইন আইনা দিছেন। এখন আবার আমার মেয়েরা মারতেছেন? রুনু যদি মনের দুঃখে এখন কিছু করে?”

রুনু চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো আর মুখে যা আছে তা বলে গেলো। একসময় মৌরির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “এই বেটি আইসা আমাদের পরিবারে অশান্তি তৈরী করছে। আব্বারে কোনোদিন আমার আব্বা হইতে দেয় নাই, আব্বা আমাদের সব সময় দূরে দূরে রাখছে। তার মুখে খালি মৌরি মৌরি, আমাদের কথা তার মনেই থাকে না। আজকে এর জন্য আব্বা আমারে মারলো।”

রুনুকে শাহেদা টেনে নিয়ে গেলো রুমে। ঝুনু দূর থেকে ভয়ে ভয়ে সব দেখছিলো। শাহেদা সে রাতটা রুনু ঝুনুর ঘরেই কাটালো। বাবা অনেক্ষন বসার ঘরে বসে থাকলো মাথা নিচু করে। মৌরির এত কষ্ট লাগছিলো যে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো! ও ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে বসে বললো, “আমি কাউরে ওইটা দেখাইতে চাই নাই, রুনু হঠাৎ ঘরে ঢুইকা দেইখা ফেলছে।”
বাবা নিচু গলায় বললেন, “এখন আর এইসব বইলা কী হইবো? যা, ঘুমাইতে যা।”

মৌরি এসে নিজের খাটে শুয়ে পড়লো,দাদি অনেকক্ষন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কিচ্ছু বললেন না। দাদি বুঝতে পারছিলেন, মৌরি নিঃশব্দে কাঁদছে। এই বাড়িতে এতটাই অবাঞ্ছিত সে?

সে ঈদে বাসায় কোনো রান্না হলো না। সকালে শাহেদা রুনু ঝুনুর রুম থেকে বের হলো না। মৌরির নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছিলো। কাল রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে চেইনটা দাদিকে দেখলেই হতো, তাহলে আজকে এমন তুফান আসতো না।

ঈদের নামাজ পরে এসে বাবা চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকলেন। মৌরি রান্না ঘরে গিয়ে সেমাই বানিয়ে বাবাকে দিলো। বাবা সেটা ছুঁয়েও দেখলেন না। মৌরি কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। দুপুর হয়ে যাচ্ছে, ঈদের রান্নার কোনো আয়োজন নেই। রুনু ঝুনু বা শাহেদাও সকাল থেকে কিছুই খায়নি। শেষে মৌরি গিয়ে রুনুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলো। মা মা বলে কয়েকবার ডাকার পরে শাহেদা এসে দরজা খুললো। তার মুখ থমথম করছে, চোখ ফোলা আর লাল। হয়তো রাতে ঘুমায়নি। মাথার চুল এলোমেলো। মৌরি অপরাধীর ভঙ্গিতে বললো, “আপনারা তো কিছুই খান নাই। একটু সেমাই বানাইছি, দেই?”
“আমি কিছু খাবো না মৌরি, পেটে গ্যাস হইছে।”
“অন্য কিছু বানায় দেই ? রুনু ঝুনু খাইবো না?”
রুনু ভেতর থেকে হুংকার দিয়ে বললো, “আব্বা আমাদের দুই বোনরে চেইন না দিলে আমি কিছুই খাবো না।”

মৌরি বুঝে গেলো, রুনু খাবে না বলে শাহেদাও খাবে না।
ঝুনু অবশ্য বেরিয়ে এসে সেমাই খেলো। দুপুরে বাড়ির কেউ কিছু খেলো না। দাদি শুধু আগের দিনের বাসি ভাত তরকারি দিয়ে একটু খেয়ে নিলেন, মৌরিকেও খুব সাধাসাধি করলেন, কিন্তু মৌরির গলা বেয়ে খাবার নামবে না এখন। বাসার সবাই আজ ঈদের দিনে না খেয়ে আছে, মৌরি একা কিভাবে খায়? দুপুরে পাশের বাসা থেকে পোলাও রোস্ট পাঠালো। মৌরি ঝুনুকে ডেকে খাওয়ালো, বাবাকে অনেক সাধলো, বাবা খেলেন না। এত মন খারাপ করা ঈদের দিন কখনও পার করেনি মৌরি। দাদি অবশ্য গলা নামিয়ে বললেন, “তুই মন খারাপ করিস না। রুনু এইরকম অনেক নাটক করে। একটু পরেই দেখবি সব ঠিক হইয়া গেছে।”

কিন্তু কিছুই ঠিক হচ্ছিলো না। বাসায় থমথমে পরিবেশ। মৌরির সামনে একটাই উপায় ছিল। ও রুনুর রুমে দিয়ে চেইনটা রুনুর গলায় পরিয়ে দিলো। বাবার দেয়া অমূল্য উপহারটা ও রাখতে পারলো না। চেইন পেয়ে রুনু চোখ মুছে উঠে এলো, শাহেদা রান্নাঘরে ঢুকে রান্নার আয়োজন শুরু করলো। বাবা কিছুই বললো না আর। বাসার পরিবেশ স্বাভাবিক হচ্ছে বলে বাবাকেও অনেকটা নির্ভার মনে হলো। কিন্তু মৌরি মনে মনে ঠিক করে ফেললো, এই বাড়িতে আর কোনোদিন আসবে না। কোনোদিন না।

ঈদের কয়দিন পরেও মৌরি সুইডেনে ফিরে এলো। বিদায় নেয়ার সময় বাবা বললেন, “তোরে আরেকটা চেইন কিননা দিবো মা, মন খারাপ করিস না। রুনুর বয়স কম, কিছু হইলেই উল্টাপাল্টা কথা বলে , সুইসাইডের ভয় দেখায়। এই আরেক যন্ত্রনা। চেইন দিয়া ওরে ঠান্ডা করসস, এইটা খুব বুদ্ধির কাজ হইছে।”
মৌরির তবুও মন খারাপ হয়। রুনুর গলায় সোনার চেইন ঝলমল করে, মৌরির মনের ভেতর অন্ধকার যন্ত্রনা কেউ অনুভব করতে পারে না। মন ভার করে ফিরে এলো আদনানের কাছে।

দাদির কাছে বিদায় নেয়ার সময় দাদি খুব কাঁদলেন। ফিসফিস করে বললেন, “তুই আর কোনোদিন আইবি না, ঠিক না? ”
দাদির প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো মৌরি। দাদি কিভাবে যেন টের পেয়েছেন মৌরি আর এই বাড়িতে আসতে চায় না। দাদি সবই উপলব্ধি করেন, তবুও মৌকে হাতছাড়া করতে একটুও ইচ্ছা করে না তার।
মৌরি দায়সারা ভাবে বললো, “আসবো তো দাদি, আগে আপনে সুস্থ হন , প্লেনে উইঠা আমাদের ওইখানে যাইতে হইবো।”

“নারে মৌরি পাখি। আমার আর বিদেশ যাওয়া লাগবো না। তবে আমি মরলে একবার আসিস বইন। আমার কবরটা দেইখা যাইস।”
“এইসব কী কথা দাদি? আপনে মরলে ক্যামনে চলবো? আমার ওইখানে আসবেন, তারপর মরলে মরেন।”
মৌরির বলার ভঙ্গি দেখে দাদির দুঃখ মাখা মুখটা কেমন হাসি হাসি হয়ে এলো। বিদায় নেয়ার আগে দাদির সেই মুখটা এখনও চোখের সামনে উজ্জ্বল। দাদিকে ফেলে এক বুক কষ্ট নিয়ে আদনানের কাছে ফিরে এলো। বারবার মনে হচ্ছিলো দাদির সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। সত্যিই তা-ই হলো। মৌরি অবশ্য দাদির অনুরোধ রেখেছে, দাদির কবর দেখেছে।
_____
রুনুর কাছে মৌলি যা শুনলো তার সারমর্ম হচ্ছে, মৃত্যুর আগে দাদি যখন খুব অসুস্হ ছিল তখন দুই ফুফু নিয়মিত দাদিকে দেখতে আসতো, চাচিও মাঝে মাঝে আসতো। মৃত্যুর সময় দাদির পাশে বড় ফুফু ছিল। দাদি চলে যাওয়ার চারদিন পরে যখন দাদির সব গয়না আর শাড়ির ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছিলো, তখন দেখা গেলো সোনার বালা জোড়া গায়েব। ছোট ফুফু বড় ফুফুকে জিজ্ঞেস করলেন বালা কোথায় কারণ আগের দিনও দাদির হাতে বালা ছিল, মৃত্যুর পরে সেটা কোথায় যাবে? অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও যখন বালা খুঁজে পাওয়া গেলো না তখন একজন আরেকজনকে দোষারোপ শুরু করলো। ছোট ফুফু বললেন একমাত্র বড় ফুফু যেহেতু মৃত্যুর সময় ছিলেন, তিনিই বালা নিয়েছেন। তাছাড়া বড় ফুফুর আর্থিক অবস্থায় খারাপ, নাতির চিকিৎসার জন্য তার টাকার দরকার ছিল। ওদিকে বড় ফুফু দোষ দিয়েছে ছোট ফুফু আর শাহেদার ওপর। সবাই যখন লাশ নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন ওদের মাঝে একজন নিশ্চয়ই বালা সরিয়ে ফেলেছে।

অভিযুক্ত তিনজনের মাঝে কার কব্জায় যে আছে দাদির সেই বালা জোড়া, কেউ বুঝতে পারছে না।
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here