সেলাই মেশিন (১২)

সেলাই মেশিন
(১২)
————-
খুব সাধারণ বিয়ের অনুষ্ঠান হলো মৌরির। অনুষ্ঠান শেষে দাদিকে ছেড়ে যেতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। দাদি বারবার জানতে চাচ্ছিলেন, মৌরি আবার কবে আসবে।
মৌরির শাশুড়ি সুলতানা নতুন বৌকে আন্তরিক ভাবে বরণ করে নিলেন। বিয়ের পরে আদনানের সাথে জড়তা কাটাতে কিছুটা সময় লেগেছে মৌরির। তবে অল্প সময়ে স্বামীর বিশ্বাস অর্জন করে নিতে পেরেছে। আদনান মৌরির সাথে সহজ হয়ে এলো। মৌরীও চাচ্ছিলো স্বামীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে, সেটা হলো অবশ্য । কিন্তু মৌরি বুঝতে পারছিলো আদনানের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী করতে কিছুটা সময় লাগবে। সেই সময়টা পাওয়ার আগেই আদনান সুইডেনে ফেরত গেলো। তারপর মৌরির ভিসার চেষ্টা করতে লাগলো।

মাঝে মাঝে মৌরির দাদিকে দেখতে বাবার বাসায় চলে আসতো। প্রতিবার দাদি একই কথা জানতে চাইতো, মৌরি এরপর আবার কবে আসবে, বিদেশে চলে যাচ্ছে নাতো। মৌরির বিয়ের এক মাসের মাথায় দাদি বাবার বাসা থেকে চাচার বাসায় গেলেন , মৌরিকে কিছু জানিয়ে গেলেন না। দাদিকে দেখতে বাসায় গিয়ে দেখে দাদি নেই। শাহেদা জানালো দাদি নাকি এক জায়গায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন, তাই এখন থেকে সব ছেলে মেয়েদের বাসায় ঘুরে বেড়াবেন।
মৌরি চাচাকে ফোন করে দাদির সাথে কথা বললো। কয়েকদিনের মধ্যেই দাদিকে দেখতে চাচার বাসায় গেলো। দাদির সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো দাদি নিজের ইচ্ছায় এখানে চলে এসেছেন । মৌরির অনুপস্থিতিতে বাবার বাসায় তার নাকি দম বন্ধ লাগছিলো। নিজেকে তার নাকি ও বাড়িতে কেমন অবাঞ্ছিত লাগে। মৌরি সবই বোঝে। কত বছর সে দাদির সাথেই ছিল, এতদিন দাদি আশা করে ছিলেন মৌরির পড়া শেষ হলে আবার তারা একসাথেই থাকবেন।
মৌরিকে দেখে দাদি কেমন অবাক হয়ে থাকিয়ে থাকেন। নতুন শাড়ি পরে এসেছে মৌরি, হঠাৎ দেখে কেমো অচেনা লাগছে।
মৌরি দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এইটা কী কথা দাদি? ওইটা আপনার ছেলের বাড়ি। আপনি যতদিন খুশি থাকবেন। ক্যান চইলা আসলেন?”
“ছেলের বাড়ি, নিজের বাড়ি তো না। আমি কোনোদিন গ্রামের বাড়িত যাইতে পারবো না রে মৌরি?”

গ্রামের বাড়ির অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। যত্নের অভাবে বাড়িটা প্রায় ভেঙে পড়েছে। চাচা নাকি দাদিকে বলছেন ওই বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে। শুনে দাদি খুব রাগ করেছেন। কিন্তু ওই বাড়ি ঠিকঠাক মেরামত করে বাসযোগ্য করার মতো আর্থিক অবস্থা বা আগ্রহ কারোই নেই। অতএব ছেলেমেয়েদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে দাদির দিন পার করতে হবে। এই নির্মম সত্যি দাদিকে কেমন করে বোঝাবে ?
“আপনি এত চিন্তা কইরেন নাতো দাদি , আমি আমার কাছে আপনারে নিয়ে যাবো, বিদেশে।” মিথ্যা আশ্বাস দিলো মৌরি। ও নিজে কবে যাবে, সেটাই ঠিক হয়নি। ওখানে যাওয়ার পরে আরো কত ঝামেলা এসে ঘাড়ে পড়বে কে জানে। নিজের নতুন জীবন গোছাবে নাকি দাদির জন্য কিছু করবে? তবে মৌরি যদি একবার নিজের পায়ের নিচে মাটি শক্ত করে নিতে পারে তাহলে সে দাদিকে অবশ্যই নিজের কাছে নিয়ে রাখবে।

দাদিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেদিন বিদায় নিলো। চাচার বাসা তার শশুর বাড়ি থেকে অনেক দূর, বাসে আসতে দুই ঘন্টা লাগে। দাদিকে বলে এলো যে ও মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসবে কিন্তু আসলে ও এত ঘন ঘন আসা সম্ভব হবে না। প্রতিদিন শশুর বাড়িতে নতুন বৌ দেখতে মেহমান আসে, তাদের সময় দিতে হয়। ভিসার জন্য হাজার রকম কাগজ পত্র জোগাড় করতে ছুটোছুটিও করতে হচ্ছে। ব্যাংকের কাগজ, ইউনিভার্সিটির কাগজ, রেফারেন্স লেটার ইত্যাদি অনেক কিছু। অবশেষে বিয়ের ছয় মাস পরে মৌরির ভিসা হয়ে গেলো।

দেশ ছেড়ে আসার আগে দাদির কাছে একদিন ছিল মৌরি। দাদিকে কী যে অসহায় লাগছিলো। এই কয়দিনেই কেমন দুর্বল হয়ে গেছেন। মৌরি যাওয়ার পরেই নাকি চাচার বাসা থেকে আবার ছোট ফুফুর বাসায় যাবেন। মৌরির খুব কষ্ট লাগলো, এই মানুষটার এখন আর কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। বৃদ্ধ বয়সে একটা মানুষের কোন স্থায়ী ঠিকানা থাকবে না কেন? কেন এবাড়ি ওবাড়ি করে দিন কাটাতে হবে?

সুইডেনে এসে মৌরির জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হলো। স্টকহোমে অন্য এক বাংলাদেশী পরিবারের সাথে শেয়ার করা ফ্ল্যাটের একটা রুমে ওদের নতুন সংসার। ভালোবাসার উত্তাপ উপভোগ করার আগেই বৈষয়িক চিন্তা ওদের মাথায় চেপে বসলো। আদনান স্কলারশিপে মাস্টার্স করছিলো , ওই টাকায় দুইজনের সংসার চালানো বেশ কষ্ট। মৌরি তাই একটা গ্রোসারি শপে কাজ নিলো, নয়তো খরচ কুলাতে পারছিলো না। মৌরি কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সের জন্য আবেদন করলো। ওর সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ওকে স্টকহোমের কোনো ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেতে হবে কারণ আদনান এখানে পড়ছে তাই সুযোগ থাকলেও স্টকহোমের বাইরের কোনো ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করতে পারছে না। সেজন্য মৌরির জন্য খুব বেশি অপশন নেই। তাছাড়া স্কলারশিপের আবেদন করার পরে এই বছর আর সেটা পাওয়া যাবে না, পরের বছর ক্লাস শুরু করতে হবে।
নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার দৈনন্দিন যন্ত্রণার মাঝে হঠাৎ করেই বিরাট এক বিপদ এলো। একদিন সকালে উঠে আদনান বললো হাত কিছুতেই নাড়তে পারছে না। মৌরি প্রথমে ভাবলো এমনি হয়তো ব্যাথা হচ্ছে, ও অনেক চেষ্টা করলো আদনানের হাতে মালিশ করে ঠিক করতে, কিন্তু কিছুই হলো না। এদিকে মৌরির কাজের সময় হয়ে যাচ্ছিলো। আদনানকেও ইউনিভার্সিটি যেতে হবে , তার ফাইনাল প্রজেক্ট জমা দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। শেষে আদনানকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসা হলো।
সারাদিন হসপিটালের কাটলো সেদিন। ডাক্তার নানা রকম পরীক্ষা করে জানালেন আদনানের স্পেসটিক প্যারালাইসিস হয়েছে তবে সেটা স্থায়ী সমস্যা না। জেনেটিক ডিসঅর্ডার থেকে এমনটা হয়েছে বলে ডাক্তারদের ধারণা। এই সমস্যা এমনিতেই ভালো হবে তবে কিছু থেরাপি নিতে হবে। ডাক্তার থেরাপির রুটিন দিয়ে দিলেন। যতদিন হাত পুরোপুরি কর্মক্ষম হবে না ততদিন আদনান যেন বাসায় বিশ্রামে থাকে।

আদনানের হাত পুরোপুরি ঠিক হতে প্রায় ছয় মাস লেগে গেলো। ওরা দুইজন দুইজনের সাথে সময় কাটানোর জন্য সুযোগ পেলো। এর মাঝে আদনানের স্কলারশিপ বন্ধ থাকলো, মৌরির কাজ থেকে যা আয় হতো, সেটাই দিয়েই কোনোরকমে সুইডেনে টিকে ছিলো। আর আদনানের যত্ন নিতে নিতে একসময় লোকটার প্রতি প্রবল মায়ার সৃষ্টি হলো। আদনানেরও একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়ালো মৌরি। ওদের মাঝে ভালোবাসা তৈরী হয়েছিল সেই খারাপ সময়ে। এতদিন পরে মৌরির মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছা করেই হয়তো ওদের দুজনকে কাছাকাছি আনতে ওইসময় বিপদ ঘটিয়েছিলেন।

আদনান সুস্থ হয়ে এক বছর পরে মাস্টার্স শেষ করলো। ভালো একটা চাকরিও হয়ে গেলো ওর। মৌরি মাস্টার্স করার সুযোগ পেলো আংশিক স্কলারশিপে। ক্লাস শুরু হবার আগে আদনান একদিন বললো, “গত বছর আমাদের ওপর কত ঝড় ঝাপটা গেলো। তোমার একটু রিক্রিয়েশন দরকার। তুমি বরং এই বছর ঈদ দেশে করে এস মৌরি। ”
“আমি একা যাবো? কী যে বোলো।”
“একা না গেলে তো চলবে না। আমার নতুন চাকরি, ছুটি পাবো না। আর তোমার ক্লাস শুরু হয়ে গেলে তুমিও ব্যস্ত হয়ে যাবে। যায়, তোমার দাদিকে অন্তত দেখে এস। একজনের টিকেট আমরা ম্যানেজ করতে পারবো, দুইজন মিলে গেলে খরচ বেশি হয়ে যাবে।”

দাদির সাথে দেখা করতে মনটা একেবারে অস্থির ছিল মৌরির। ফোনে কথা বলে কী আর মন ভরে? দাদি কত কথা বলতে চায় , কিন্তু ফোনে বলতে পারে না। খালি জানতে চায় মৌরি কবে দেশে আসবে। দাদি এখনও চার ছেলে মেয়ের বাসায় ঘুরে ঘিরে দিন কাটাচ্ছে। দাদির কথা ভেবে শেষে মৌরি একাই ঈদ করতে দেশে এলো।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here