“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-১৮
____________________
নীলাংশের এত আগ্রহী হয়ে পায়রাকে নিজহাতে খাইয়ে দেয়ার ব্যাপারটায় অল্প নয় অনেক বেশিই অবাক হলো সবাই। বিশেষ করে তানজিমা। তিনি অগ্নিদৃষ্টিতে পায়রার দিকে একবার তাকিয়ে চাপা ক্ষোভে বললেন –
‘নীল! হোয়াটস রং উইথ ইউ? তুমি নিজে না খেয়ে একটা ইউজলেস মেয়ের জন্য হাত নষ্ট করছো! ‘
নীলাংশের টনক নড়লো৷ সে নিজের উপর কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুণ্ন হলো। এভাবে খাইয়ে দেয়ার ব্যাপারটা কেউ সহজ ভাবে নিবে না তা তার আগেই খেয়াল রাখার প্রয়োজন ছিলো ৷ কিন্তু এখন খাওয়ার মাঝামাঝি থামলে পিচ্চিটা না খেয়েই থাকবে। তার কোমল মন এটি কিছুতেই মানতে পারবে না। সে তো অন্য কিছু ভেবে এটা করেনি। তার বাড়িতে কোনো মেহমান না খেয়ে ক্ষুধার্ত পেটে থাকবে এমন মনমানসিকতা নিয়ে তো সে বড় হয়নি৷ কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে নীলাংশের খারাপ লাগে৷ নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করে সামনের মানুষের দুঃখ লাঘবের। ছোটবেলায় দাদুর কাছে শুনেছিলো সে নাকি তার বাবা আয়মান সোহরাবের মতো হয়েছে। আচ্ছা, আট দশটা স্বাভাবিক মানুষের থেকে তার আচরণ কী একটু ভিন্ন লাগছে? কোথায়! নীলাংশ তো শুধু মাত্র একজন মানুষ হিসেবেই যত্নবান ব্যবহার করতে চাইলো৷ নাহ, সে বোধ হয় সত্যিই একটু বেশি করে ফেলছে৷ এতে মাও রাগ হচ্ছে। সে চায়না কোন কিছুতেই তার মায়ের তার উপর অসন্তোষ সৃষ্টি হোক ৷ নিজের কিছুক্ষণের অদ্ভুত অনুভূতিগুলোকে দূরছাই করে তাড়িয়ে দিলো নীলাংশ। পায়রার মুখে শেষ লোকমা তুলে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হেঁসে বললো –
‘কী বলছো মম! পিচ্চি নতুন মেহমান। তাই ওকে একটু
হেল্প করছি ৷ তাছাড়া, একটু খাইয়ে দিলে তো আর হাত নষ্ট হয়না রাইট?মানবিকতার খাতিরে এতটুকু তো করতেই পারি। ‘
নীলাংশ হাত ধুয়ে পাশের প্লেটের অমলেট স্যান্ডউইচ
খেতে শুরু করলো। তানজিমা তেমন কিছু বললেন না। বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকুক, সে আর কিছুই বলবেন না বলেই ঠিক করলেন। কিন্তু মেয়েটাকে আগেই শাসন করে দেবে যাতে পরিবারের কারো কাছে না ঘেঁষে। ব্যস তাহলেই হয়ে গেলো। কাউকেই আর কিছু বলতে হবে না!
পায়রা নিঃশব্দে পানিটুকু পান করে উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু ছন্দপতনে রুমে চলে গেলো। নীলাংশ একবার ডাকতে নিয়েও চুপ রইলো ৷ কেউ তেমন কিছুই বুঝতে পারলো না। আয়মান সাহেব সহ সবাই খাওয়া শেষ করে নিজেদের রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে আয়মান সাহেব হাসপাতালের জরুরি কিছু কাজে বেরিয়ে গেলেন। নীলাংশ স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের দরজা চাপিয়ে পরীক্ষার প্রেপারেশন নিতে শুরু করলো। সব ধ্যান জ্ঞান শুধু মাত্র পড়াশোনা। ছোট থেকেই ব্রিলিয়ান্টের খাতায় নাম উঠেছে তার। প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। স্পোর্টস, বিতর্ক, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে সমান ভাবে এগিয়ে। মায়ের কথায় প্রতিটি পদক্ষেপে সে সুফল পেয়েছে। মা যেদিন বলেছে, আজ সারা রাত পড়তে হবে সে পড়েছে। যেদিন বলেছে, পছন্দের তেলের খাবারটা একেবারে বাদ দিয়ে দিতে, সে তাই করেছে। বইয়ের পাতা একের পর উল্টাতে উল্টাতে তার মনে পড়লো, তার বন্ধুরা প্রায়ই হাসাহাসি করে বলে ‘নিজের সবচেয়ে বেশি পছন্দের মানুষকেও যদি বলে ফিরেও না দেখতে, তাহলে সে কী করবে? ‘
সে হাসিমুখেই সর্বদা উত্তর দিয়েছে -‘জীবনের খাতায় আমি যা কিছু লিখেছি সব পেন্সিলের খোঁচায়, এতটাই আলতো করে। যদি মায়ের কোনো জিনিস সেই খাতার পছন্দ না হয়, তৎক্ষনাৎ রাবার দিয়ে মুছে ফেলবো। তার একবিন্দু রেশও যাতে না থাকে। ‘
তার বন্ধুরা তারপরও হাঁসে ৷ নীলাংশের মতো ঠান্ডা মাথার মানুষও রেগে যেতো এই ভেবে, যে এরকম বেহুদা হাঁসার কোনো মানে হয়? সে যদি নিজের পছন্দের খাবারটা, প্রফেশন, পড়াশোনার সাবজেক্ট,
এমনকি নিজের পোশাক আশাকও বদলে ফেলতে পারে সেখানে মানুষ আর কী জিনিস? তাই নয় কী?
ভবিষ্যতেও সে এমনই থাকবে। মায়ের কড়া ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করে বড় হওয়া নীলাংশ সোহরাব তো কখনো বদলাবে না। নিজমনে হেঁসে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। এ যেনো নিজেকে নিজের কাছে লুকিয়ে নেয়ার এক মজার খেলা। যেখানে সর্বদাই কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থাকে৷ সেখানের জানালা দরজা সব বন্ধ। প্রয়োজন ব্যতীত সকল কিছুর প্রবেশ নিষেধ। তার কোনো পছন্দ নেই তাইনা? নিজের সঙ্গেই বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয় কয়েক মুহূর্তের জন্য।
_____________
জানালার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে পায়রা।
হাঁটু ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে। এখন আর কান্না পায়না তার। অবহেলা তো সে বয়েই আসছে। মা বাবা কাছের কি’বা দূরের সবাই-ই তো অপমান, অবহেলা করেছে। এত স্নেহ করে খাইয়ে যখন হুট করেই নীলাংশ শুধু মানবিকতার খাতিরে কথাটা বললো। তখন বুকের কোথাও একটা জ্বলতে শুরু করলো। দাউদাউ করে রাক্ষসী আগুন তার উত্তাপে পায়রার ছোট্ট মনটাকে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দিতে চাইলো। পায়রা হয়ে পড়েছিলো অনুভূতিহীন, আবেগহীন। রুমে এসে চুপচাপ বসে আছে সে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। থমথমে নীরব হয়ে আছে মন মস্তিষ্ক। চোখ বন্ধ করে যখন পায়রা নিস্তব্ধতায় ভাসছে। ঠিক তখন সামনে বারান্দায় দুটো গম্ভীর চোখ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সে স্বপ্নিল আরাজ। এক ঘন্টা আগেই বাড়ি ফিরলো। নিজের হাতে কফি বানিয়ে বাতাস গায়ে মাখাতে মাখাতে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো। পায়রার দিকে মৃদু উচ্চস্বরে বললো –
‘ হেই গার্ল ‘
পায়রা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ভাবলো লোকটার সাথে আবারও দেখা হলো এবং এবারও তার মন খারাপ। আচ্ছা এই লোকটার সাথে কী কোনো ভাবে তার কুফা লেগে আছে। খারাপ কিছু হওয়ার আগে বা পরে দেখা হয় কেনো! পায়রার তিক্ত রাগ গিয়ে জমলো সামনের মানুষটার উপর। ঠাস করে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে সটানভাবে শুয়ে পড়লো। তার মন খারাপের সময় কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে না।
স্বপ্নিল হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে খুবই বিরক্তিকর কন্ঠে বললো –
‘নিজেকে কী মনে করে! এঞ্জেলিনা জলি? বেয়াদব মেয়ে মানুষ কোথাকার!’
চলবে..
[বিঃদ্রঃ এখন থেকে আর ছবি ব্যবহৃত হবে না। ]