স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-১৭

0
1150

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-১৭

দরজায় অনবরত ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভাঙে পায়রার। লম্বা হাই তুলে উঠে বসে৷ নীলাংশ কিছুক্ষণ পরই চলে গেছিলো৷ গরমে প্রায় সিদ্ধ হওয়া শরীরে ঠান্ডা পানির স্পর্শ লাগায় ঘুম চোখের পাতায় ভীড় করলো৷ শেষমেষ বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে গেছিলো। এই ঘরে কোনো ঘড়ি নেই৷ সময় ঠাওর করতে পারলো না সে। মুখে ওরনা টেনে ঘরের দরজাটা খুলে দিলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার টপস আর প্লাজুতে সুন্দর মতোন একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মুখে সৌজন্যেমূলক হাসি৷ সবকিছুই যেনো স্কেল দিয়ে মেপে মেপে বসিয়ে দেয়া হয়েছে৷ মেয়েটি বলার কারণ, পায়রা এখনও সুশ্রী রূপের মেয়েটির নাম জানেনা। বয়সে অনেকটাই বড় হবে হয়তো৷ মেয়েটি নিজের মুখের হাসিটি আরেকটু বিস্তৃত করে মানব যন্ত্রের মতো বললো-

‘তোমাকে ডাকতে এলাম৷ চলো দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে ৷ এর পরে কেউ খায়না। ‘

কৃত্রিমতার মাঝেই একটা ভালো মানুষের আবছা আলোর রেশ দেখতে পেলো পায়রার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা৷ পায়রা মৃদু হেসে বললো –

‘তোমার নাম ? ‘

মেয়েটি উজ্জ্বল স্বরে বললো –

‘রায়ানা। সবাই রায়া বলে, তুমিও তাই ডেকো। ‘

পায়রার মিশে যাওয়ার দারুণ ক্ষমতা। অচেনা মানুষের সাথেও সহজে মিশে যায়। সে চোখ মুখে হেঁসে বললো –

‘ঠিক আছে রায়াবু। ‘

রায়ানা হা করে তাকিয়ে বললো-

‘রায়াবু! ‘

পায়রা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করলো৷ মন খারাপ হয়ে গেলো তার। তাঁরা বুবুর কথা মনে পড়লো। মলিন হেঁসে বললো –
‘আসলে, আমার বড় বোনরে তো এডাই কইতাম তাই..’

রায়ানা তো পায়রার ব্যাপারে কিছু জানেনা। সে শুধু শুনেছে বড়বাবার বন্ধুর মেয়ে এই বাড়িতে থাকবে। তার তেমন কোনো আগ্রহবোধ ছিলো না বলেই জানতে পারেনি। মেয়েটা হয়তো বড় বোনকে মিস করছে ভেবে মায়াবী কন্ঠে বললো-

‘ওহ, তাহলে তুমি রায়াবুই ডেকো। আমার কোনো বোন নেই ৷ আমারও ভালো লাগবে। ‘

রায়ানার পেছন পেছন পায়রা ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত হলো। আয়মান সাহেব টেবিলের বড় চেয়ারটায় তার পাশে তানজিমা বসেছেন৷ চোখ মুখ থমথমে। পায়রা আঁচ করে সম্ভবত তার কারণেই ভদ্র মহিলা রেগে আছেন৷ কেমন একটা সংকোচ বোধ করে পায়রা। বসতে নিয়েও থেমে দাঁড়িয়ে থাকে। আয়মান সাহেব নরম হেঁসে বললেন-

‘কী হয়েছে মা? বসে পড়ো। খাবার ঠান্ডা হলে মুখে রুচবে না। ‘

পায়রা মনে মনে দ্বিধার পাহাড় নিয়ে বসলো৷ সামনেই একটা খাবার রাখা। কিন্তু খাবারটার নাম ও খাওয়ার পদ্ধতিটা একদমই জানেনা। সবাই কী সুন্দর চামচ দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে খাচ্ছে! অথচ চামচ ধরে নাড়তেই হাত থেকে ছুটে পড়ে গেলো পায়রার। এভাবে যে চামচটা হাত থেকে ফসকে যাবে চিন্তাও করেনি। তানজিমা কর্কশ গলায় বললেন-

‘ ম্যানারলেস গার্ল! আদব কায়দা কিছু শেখায়নি মা বাবা? খাবারের জায়গায় তামাশা দেখাচ্ছো! ‘

কিছুক্ষণ আগের রাগটাও যেনো ঝেড়ে নিলেন তিনি।
পায়রার লজ্জায় চোখ ফুঁড়ে জল গড়িয়ে পড়লো। এভাবে অপমান হতে হবে কল্পনায়ও ভাবেনি সে। ছিঃ
কী বিচ্ছিরি একটা কান্ড ঘটে গেলো! ঠিকই তো তাকে তো শহুরে আদব কায়দার কিছু জানেনা। ঠোঁট চেপে কান্না আঁটকে রাখলো৷ আয়মান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে রাগী স্বরে বললেন-

‘একজন মানুষের সাথে এসব কী ধরনের আচরণ তানজিমা! খাওয়ার সময় হাত থেকে পড়ে যেতেই পারে । ওভার রিয়েক্ট করছো কেনো? ‘

তানজিমা ক্ষেপা বাঘিনীর মতো করে বললেন-

‘হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! আমার কোনো কথারই কোনো মূল্যই নেই এখন। দুই দিনের মেয়েটাই সব! ‘

আয়মান সাহেব উচ্চস্বরে কিছু বলার আগেই পেছনে থেকে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসলো নীলাংশ। ঠোঁটে সবসময়কার মনকাড়া হাঁসি। কিন্তু খাবার ঘরের এমন পরিস্থিতি দেখে হাঁসি বিলীন হয়ে গাম্ভীর্যতা লেপ্টে গেলো৷ পায়রাকে মুখ নিচু করে কাঁদতে দেখে বুকের পাশটায় চিনচিনে ব্যাথায় ভরে উঠলো ৷ আচ্ছা মেয়েটা কী জানে, ইদানীং তার মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে হুটহাট কেঁদে যে দমবন্ধকর ব্যাথায় তাকে ব্যাথাতুর করে তুললো! মায়ের রাগান্বিত মুখটা দেখেই সবটা আন্দাজ করে নিলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাকে বললো-

‘মম, তুমি এমন আচরণে করছো কেনো? ইটস হার্টিং মি। তুমিতো এমন নও। তুমি তো সবসময়ই সবাইকে হেল্প করো। তাহলে, একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কীসের সমস্যা! ‘

তানজিমা নিজের অহেতুক রাগকে দমন করলেন। ছেলের সামনে সে কখনোই এমন আচরণ করেন না।যথাসম্ভব রাগকে আয়ত্ত্ব করে মৃদু কন্ঠে বললেন-

‘ঠিক আছে এসব থাক। লেট ইট গো। ‘

নীলাংশ মনে মনে হাঁসলো। তার মায়ের দূর্বল জায়গা হচ্ছে প্রশংসা। নারীরা নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। দুই একজন ব্যাতিক্রমী হতে পারে। কিন্তু নিজের মাকে দেখলেই উক্তিটি সম্পূর্ণ সঠিক মনে হয়। সে ইচ্ছে করেই কথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। যাক মাকে তো শান্ত করা গেলো! পায়রার নিচু করা মুখটা দেখে ভীষণ খারাপ লাগলো তার৷ আহারে! পিচ্চি মেয়েটাকে মম নিশ্চয়ই একটু বেশি কথা বলেছে ৷ সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জোরপূর্বক হাঁসলো। চেয়ারে বসতে বসতে বললো –

‘সবাই কী এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে? ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। বসো তো৷ এই পিচ্চি তোমাকে কী ইনভাইটেশন দিতে হবে! বসো। ‘

পায়রা ভাঙাচোরা গলায় বললো –

‘সুন্দর সাহেব, আমার ক্ষিধে নাই৷ আমি ঘরে যাই বরং’

সবাই টেবিলে ইতিমধ্যে বসে পড়েছে। নীলাংশ পায়রার কথায় কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে হাত টেনে পায়রাকে নিজের বামপাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো। সামনে থাকা চায়নিজ ডিশটা সরিয়ে দিয়ে ফ্রাইড রাইসের প্লেটটা হাতের কাছে এনে। কালো শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলো ৷ স্মার্ট নীলাংশ যে কিনা কোনো দিন চামচ ছাড়া খাবারে হাত রাখে না সে প্রথম বার নিঃসংকোচে লোকমা বানাতে শুরু করলো। পুরো প্লেটে দশ থেকে বারোটা গোলাকারের লোকমা বানিয়ে
হাসতে হাসতে বললো-

‘পিচ্চি, এই দেখো এটা তোমার বুবুর, এটা তোমার মাস্টার বাবার, এটা তোমার ডাক্তার কাকার আর এটা আমার পক্ষের। এখন না খেলে সবাই রাগ হয়ে যাবে! ‘

হাজারো মন খারাপের ভীড়ে একগাল হেঁসে থাকা সুন্দর সাহেবের বাচ্চাদের মতো কাজটায় খুব হাঁসি পেলো পায়রার। নীলাংশের সামনে বাড়ানো হাতটা থেকে লোকমাটা মুখে পুড়ে খেতে খেতে সে ভাবলো –

‘শুধু আইজ না সুন্দর সাহেব! এত যত্ন কইরা ভাত দিলে আমি সারাজীবন বইসা থাকবো শুধু একখানা লোকমার জইন্য! ‘

নীলাংশের চোখে হঠাৎই পায়রার খাওয়ার সাধারণ দৃশ্যটাও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ঠেকলো। আচ্ছা, সে তো এমন নয়! তাহলে উদ্ভট আচরণ করছে কেনো?
দুই সেকেন্ডের জন্য চোখ সরালেও পরমুহূর্তে আবারও
পাখির মতো টুকুর টুকুর করে মুখ নাড়ানো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দিনদুনিয়া ভুলে নিজমনেই ভাবলো –

‘আমি কী এই ছোট পুতুলটাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পেতে পারিনা? সারাজীবন মেয়েটাকে নিজের সামনে বসিয়ে খাবার মুখে তুলে দেবো, তার একমাত্র কর্ম হবে শুধু খাওয়া ‘

উফ কীসব চিন্তা! আচ্ছা সে কী পাগল হয়ে গেলো!

চলবে…

(গালি খাওয়ার শখ নাই ভাই। স্বপ্নচূড়ার আহ্বানের পাঠকরা ক্ষেপেছে ৷ শান্ত হও বাবারা, এটা শেষ হলে তবেই নতুনটা আনবো। শুধু দেখতে চাইছিলাম উপন্যাসটা কয়জন পড়ছে । যাক, এখন যারা পড়ছো তারা জানাও৷)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here