স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-১৬

0
1071

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-১৬

ঝুমঝুমিয়ে বেগ বাড়তে থাকে কান্নার। পায়রা মুখ চেপে কাঁদতে থাকে। শরীর শান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ে ঝকঝকে টাইলের উপরিভাগে। গাঁয়ের ধুলো-বালিতে
খচখচানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোট বাচ্চার মতো ঠোঁট উল্টে
হাত দিয়ে চোখ মুখ ডলে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে সে। ব্যাগ থেকে একটা জামা বের করে বাথরুমে ঢুকে।
এত বড় বাথরুমে এসে ভঁড়কে যায় পায়রা। কী দিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বেসিন, ঝর্ণা চিনলেও
বাথটাব দিয়ে কী করে মাথায় ধরে না। কাজের মেয়েটা কী কিছু বলেছিলো! মনে করার চেষ্টা করলেও সব কিছু এলোমেলো করে জট পাকিয়ে ফেলে। যা মনে ছিলো তাও ভুলে যায়। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বাথটাবকে অযথা সাজসজ্জার সরঞ্জাম হিসেবে ভেবে নেয়। হয়তো বড়লোকেরা বাথরুমকেও সাজায়। বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে ঝর্ণার দুটো ট্যাপ দেখে
আন্দাজে একটা ঘোরাতেই গরম পানির ধারা বইতে শুরু করলো। ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলো পায়রা। দরজা বন্ধ কেউ নেই সাহায্য করতে আসবে ভেবে অসহায় লাগে তার। মনে মনে নিজেকে অভয় দিয়ে দূর থেকেই হাতের দুই আঙুল দিয়ে বন্ধ করে। অন্য ট্যাপটা অন করতেই চোখ মুখ খিঁচে রাখে, এটা দিয়ে যদি বরফ বের হয়ে আসে! তখন কী করবে সে। অবুঝ মনেই কথা আওরায়। কিছুক্ষণ পর এক আঙুল দিয়ে পানি ছুঁয়ে ঠান্ডা স্বাভাবিক পানি দেখতেই মুখে ফোঁটে
উজ্জ্বল হাঁসি। দ্রুত স্নান করে বের হয়ে ঘরটা ভালো করে খেয়াল করে। তীক্ষ্ম রোদ ঘরের জানালায় উঁকি দিচ্ছে। কয়েক দিনের মেহমান হয়তো সে, কোনো কিছুকেই পায়রা ‘আমার নিজের ‘ বলে উঠতে পারে না। লম্বা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক মৃদু পবন টেনে সমাহিত করে প্রাণে। দূর দূরান্তে লম্বা স্তূপে ঘেরা ব্যস্ত নগরীতে একা লাগে তার। মনের অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি গুলো বাক্যে প্রকাশ করার একজন যে মানুষ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার তা পায়রার কিশোরী মনও টের পায়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শ্বাস বের হয়। আকাশের বিশাল আকারের মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
দরজা খোলার আওয়াজে ধ্যান ভাঙে। কেউ এসেছে বুঝে ঘরের দিকে এগোয়। নীলাংশের উপর দৃষ্টি পড়তেই চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করে। সুন্দর সাহেব এই ঘরে কেনো এলেন! কিছু বলতে? পায়রা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
নীলাংশ সদ্য স্নান করে এসেছে। প্রথমে একবার ভেবেছিলো কী দরকার মায়ের কথা অমান্য করে কথা বলার! মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়েছিলো বাড়িতে ফিরেই পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে যাবে। মোটা মলাটের বইটা খুলতে নিয়েও মন টানেনি। আনমনা হয়ে বসতেই। মন খারাপের আসল কারণটা বুঝতে পারে৷ পায়রাকে সবার সামনে তার মা এতগুলো কথা শোনানোতে নীলাংশের অবচেতন মনও হুড়মুড়িয়ে খারাপ হতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পায়চারি করেও ব্যর্থ হয়ে শেষমেষ ভাবলো, অল্প সময়ের জন্য একটু গেলে কিছু হবেনা। অবাধ্য মনকে জিতিয়ে খোশমেজাজে প্রবেশ করলো পায়রার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে।

পায়রা গ্রিলের ফাঁকে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন লজ্জার সঙ্গে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। অজানা কোনো কারণবশত সুন্দর সাহেবের পুরুষালী ঘ্রাণে হৃদয় কেঁপে উঠছে৷ চোখ তুলে তাকিয়ে বললো-

‘সুন্দর সাহেব,আপনে কিছু কইবেন?’

নীলাংশ পায়রার মিটমিটে চোখের পলকের দিকে অপলক তাকিয়ে ঘোরে পড়ে ছিলো। পায়রার হঠাৎ কথা বলায় খানিকটা চমকে উঠলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে হালকা কেঁশে বললো-

‘পিচ্চি, তোমার কোনো কিছুতে অসুবিধে হয়নিতো? ইউ ক্যান ফিল ফ্রি টু টেল মি৷ ‘

পায়রা প্রশ্নবোধক চাহনিতে বললো-
‘আপনেরা বাথরুমে এত বড় খাট লাগাইসেন ক্যান!’

নীলাংশ চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার জানামতে তাদের বাড়িতে কোনো বাথরুমেই খাট লাগানো নেই। তাহলে পায়রা কোথায় পেলো। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো পায়রা অনেক কিছুই এখনও জানেনা। বাথটাবকেই যে খাট বলে সম্বোধন করছে ভেবে জোড়ে হাসতে নিয়েও হাসলো না। পায়রার পাশে দাঁড়িয়ে বললো-

‘পিচ্চি ওটাকে খাট বলা হয় না। ওটাকে বলে বাথটাব।
ওখানে গোসল করা হয়। ‘

পায়রা হা করে তাকিয়ে বললো-
‘কীহ! এত বড় জায়গা শুধু গোসল করার জইন্য!’

বিস্ময়ে হা করে থাকা পায়রার মুখটা দেখে মৃদু হাঁসলো নীলাংশ। পায়রা লজ্জা পেলো এই ভেবে যে গোসল করার জায়গাটাকে শোয়ার মতো লম্বা দেখে খাট বলে ফেলেছে। এরকম আরও কতকিছু আছে যার সে কিছুই জানেনা। ধাপে ধাপে তাকে এভাবে লজ্জা পেতে হবে ভাবতেই পায়রা আকাশের নীল রঙের উড়তে থাকা উদ্দেশ্যহীন মেঘগুলোর দিকে আনমনে তাকিয়ে রইলো। নীলাংশ পায়রার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে বললো-

‘কারো কথা মনে পড়ছে পিচ্চি? ‘

পায়রা বিস্মিত হলো, সুন্দর সাহেব কী করে তার মনের খুটিনাটি জেনে যায়। সত্যিই নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে না পারলে পুরনো স্মৃতিগুলোই মনে পড়ে৷ পুরনো মানুষগুলোর অবয়ব চোখের পর্দায় হাজির হয়। মন খারাপের সাথে তাল মিলিয়ে পায়রা মনমরা গলায় বললো –
‘হু’

নীলাংশ দুই মিনিট নিরব থেকে বললো-

‘আচ্ছা পিচ্চি, তুমি জানো আকাশ ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় কী বলে? ‘

পায়রার কৌতুহলী মনের উপর থেকে তড়তড় করে মন খারাপের রেশ ধুলোয় উড়ে গেলো৷ উৎসাহিত গলায় বললো –
‘না তো! কী কয়? ‘

‘আলটোকিউমুলাস ‘

পায়রা বিরবির করে দুই তিন বার উচ্চারণ করলো।
আবারও আকাশের নীল মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আপনে কী জানেন, ঐ নীল মেঘগুলা ক্যান দেখা যায়? ‘

নীলাংশ মৃদু হেসে বললো –

‘একসাথে অনেক কিছু জানতে চাও পিচ্চি। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম, তাই আকাশে এই আলোর বিক্ষেপণ বেশি হয় এবং আকাশ নীল দেখায়। মেঘের অণু বেশ বড় হয় এবং তাই তা নীল ছাড়া অন্য আলোকেও বিক্ষেপিত করে। যার ফলে মেঘের বর্ণ অনেকটা সাদাটে হয়। ‘

পায়রার চোখ মুখ উজ্জ্বল আভায় হেঁসে ওঠে। মেঘের ভেলায় দেখতে পায় নিজের অজস্র স্বপ্ন। তার ছোটবেলার শখ সে পৃথিবীর অজানা রহস্য গুলো জানবে, শিখবে। মানুষকে জানাবে। নীলাংশের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো-

‘সুন্দর সাহেব, আপনে কী হইতে চান? ‘

নীলাংশের কোমল হাসির উপর নেমে এলো ঘন আঁধার। কেউ কী কখনো জানতে চেয়েছে? সে কী হতে চায়! তারও যে ইচ্ছে ছিলো পৃথিবীর বুকের সৌন্দর্য নিজের ছোট্ট ক্যামেরাতে বন্দী করতে। একজন ফটোগ্রাফার হয়ে দেশ বিদেশের সৌন্দর্যে চোখ জুড়াতে৷ কিন্তু তার ক্যামেরা মা ছোটকাল থেকেই দূর করে রাখে। এত বড় হওয়ার পরও খাঁচার পাখির মতো আটকে রাখে৷ পরিবারের বড় ছেলে হয়ে সে পারিবারিক ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই তার মায়ের ইচ্ছে। মাঝে মাঝে এতো ধন-দৌলত, প্রাচুর্যে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। কথায় বলে –

“টাকা থাকলেই সুখ পাওয়া যায় না,
কারণ সুখ জিনিসটাতে টাকার কোনো স্থান নেই।
সুখ হচ্ছে সাদা কাকের মতোন দুর্লভ! ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here