“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব- ১০
‘এই যে মিস! আপনার হাতটা সিট থেকে সরান। ‘
ঘুমন্ত পায়রার কানে হালকা হয়ে কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। চোখ খুলে
উঠে পাশে তাকালো সে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখতেই অপ্রস্তুত বোধ করলো সে। নিজের গায়ের জামা কাপড় টেনে ঠিকঠাক করে নিলো ৷ ছেলেটি ভ্রু কুচকে বললো-
‘ক্যান আই সিট হেয়ার? ‘
পায়রা নবমের ছাত্রী। অশুদ্ধ বাক্যগঠন হলেও ইংরেজি বেশ ভালো পারে। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে ছেলেটা তার পাশেই বসতে চায়। নিজের হাতটা সিট থেকে সরিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে চঞ্চলচিত্তে বসে পড়লো নীলাংশ। তার বন্ধুরা আগে পিছে করে বসেছে। একমাত্র তমাল পাশের সারিতে বসতে পেরেছে। আর বাকি সবাই এলোমেলো হয়ে বসেছে ৷ প্ল্যানিং মতো গাড়ি না পাওয়ায় এই দশা।
নীলাংশ নিজের কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিলো। এইরকম ঠাসাঠাসি করে মানুষের ভীড়ে আগে কোনোদিন যায় নি সে। তার মা ছোটবেলা থেকেই বড়ো আদরের হাতে করে মানুষ করেছে। মায়ের অতিরিক্ত দেখভালে সে কোনো উচ্চবাচ্য না করলে তার বন্ধু- বান্ধবরা বেশ হাসিঠাট্টা করে। এতে নীলাংশের খুব একটা যায় আসে না। তার মতে, তার মা ভালোর জন্যই এসব করেন, ক্ষতি তো হয়নি কখনো। কিন্তু এবার, তার আবদার মা ফেলতে পারেনি। এই পর্যন্ত কোনো রকম ট্যুরে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তার মায়ের কড়া নিষেধে। তেইশ বছর বয়সে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়েও সে মায়ের আদেশ নিষেধ ছাড়া কোথাও যায়নি, শুনলে অনেকেই প্রথমে অবাক হয়ে তাকায়। এমন করেই সবার আদরে আগলে বড় হয়েছে। মা তাই বন্ধুদের সঙ্গে ট্যুরে যেতে দিতে রাজি হয়েছে। অবশ্য নীলাংশ বেশি দিন থাকতেও পারেনি। মা ফোন দিয়ে প্রতিটি বিস্তারিত শুনেছেন। প্রথমবার ভ্রমণে বেশ উৎফুল্ল হয়ে আছে। বাসের হর্ণ, এই ঠেলাঠেলি করে বাসে বসা, এমনকি মাঝে মাঝে ধাক্কাটাও তার বড়ই আনন্দের মনে হচ্ছে। ইশ, সবার জীবনটা কত উপভোগ্যকর! সে কেনো এমন মধ্যবিত্ত শ্রেণির হলো না! ভাবে নীলাংশ। আশেপাশে পরিচিত কাউকে না পেয়ে মুড খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। পাশে তাকাতেই মুখ ঢাকা মেয়েটা নজরে এলো। আচ্ছা, এই গরমে মেয়েটা মুখ ঢেকে বসে আছে কেনো! যেখানে পাতলা আরামদায়ক টিশার্টেই তার পিঠ ভিজে একাকার সেখানে মেয়েটা চুপচাপ মুখ ঢেকে জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে। দেখে তো কম বয়সীই মনে হয়। তাহলে এমন চুপ কেনো! টিনএজার মেয়েরা সাধারনত চটপটে হয়। কৌতুহলবশত উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো-
‘হেই গার্ল, হোয়াই আর ইউ কভারিং ইওর ফেস ইন দিস হিট? ‘
পায়রার চোখ আঁটকে ছিলো জানালার বাহিরের এক অপার্থিব সৌন্দর্যে৷ বাসটা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে সেখানের দুই পাশে গাছগাছালীতে পরিপূর্ণ। নাম না জানা হাজারও রকম গাছ পায়রার মনে অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ দিচ্ছিলো। মন চাইছিলো, এই একটুকরো সৌন্দর্যে বিলীন হতে। জানালার পাশে হুহু করে উত্তাল হাওয়া স্পর্শ করে দিচ্ছে শরীরের কোণে কোণে। তার যে খেয়ালই ছিলো না পাশে একজন মানুষ বসেছে৷ হঠাৎ ডাকে প্রকৃতির রূপের সাথে দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তার৷ এই বিচ্ছেদে বেশ বিরক্তই হলো পায়রা। তার প্রকৃতিপ্রেম যে বহুকালের। মাঝের এই বাঁধায় সে তো বিরক্ত হবে নাই বা কেনো! ঘার ঘুরিয়ে তাকাতেই প্রথম চোখ আটকে গেলো খাড়া নাকের ডগায় গাঢ় তিলে। কাটা কাটা চোয়ালে হাসলে থুতনির নিচে ভাজ ফুটে ওঠে৷ চোখ সরিয়ে নিলো সে। ধ্যাত! অপরিচিত কারো দিকে এভাবে তাকানো কী ঠিক? মোটেও না।
চোখ নিচু করে হালকা স্বরে বললো –
‘ আমারে কইলেন? ‘
অদ্ভুত! মেয়েটা ছাড়া এদিকে তো আর কেউ বসেনি তাহলে অন্য আর কাকে বলবে! মনে মনে ভাবলো নীলাংশ।
‘হ্যা, আপনাকেই বললাম। এই গরমে মুখ ঢেকে রেখেছেন কেনো? ‘
আচমকা চোখের কোণে জল জমলো পায়রার ৷ সত্যি বলতে নিয়েও বললো না, কী দরকার এসব বলার!
গম্ভীর গলায় বললো –
‘এমনেতেই। ‘
নীলাংশ উত্তরের জন্য মুখ এ পাশে ফিরিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু এমন নির্লিপ্ত কণ্ঠে সে বুঝতে পারলো মেয়েটা ইচ্ছে করে বেশি কথা বলছে না। তাই সেও সোজা হয়ে বসলো ৷ চঞ্চল হলেও সে বাঁচাল নয়। সেঁধে সেঁধে কথা বলে না। নেহাৎই আশেপাশে তেমন কেউ নেই। পাশের সাড়ির তমাল হা করে ঘুমাচ্ছে। নাকও ডাকছে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর। এবার সেও সিটে মাথা লাগিয়ে চোখ বুজে নিলো। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে হয়তো। ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে পড়লো। ঘুম ভেঙে গেলো কারো হাত ঝাঁকানোতে। তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে নিলো। পাশের মেয়েটা হাত ঝাঁকাচ্ছে। কিন্তু এমন করে কেনো!
এখন সম্ভবত পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে। যারা বাসে উঠেছে তাদের সবার সাথেই মোটামুটি পরিমাণে খাবার আছে। কিন্তু, পায়রা নিজের সঙ্গে কোনো খাবার আনেনি৷ এতটা পথ যে বাসে কাটাতে হবে তাতো সে ভাবেইনি। আশেপাশে কোনো দোকান না থাকায় জামেল চেয়েও কিছু কিনতে পারেনি। অপেক্ষা করতে করতে তিনিও সবার মতো ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কিন্তুু পায়রার হঠাৎ ক্ষুধায় পেট ব্যাথা শুরু হলো। তার সাথে বমিও পেয়ে যাচ্ছে ৷ অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখলেও এবার আর সহ্য করা যাচ্ছে না, তাই আর কোনো কূলকিনারা না পেয়ে পাশে বসা ছেলেটাকেই ডাকতে শুরু করলো। ছেলেটা উঠতেই পায়রা অস্থির ভাবে বললো –
‘গাড়িটা থামাইতে বলেন না! ‘
মেয়েটা কী পাগল হয়ে গেছে! এই ভরসন্ধ্যায় এমন অন্ধকার রাস্তায় বাস থামানোর কোনো মানে আছে!
চাইছেটা কী! বিরক্ত হওয়ার মতো করে বললো –
‘কী হয়েছে? গাড়ি থামানোর কী প্রয়োজন? ‘
‘আমার বমি আসতেছে, আর আটকাইয়া রাখতে পারতেসি না। ‘
ভরকে গেল নীলাংশ। সর্বনাশ! এখন যদি মেয়েটা তার উপরে বমি করে দেয়! মুখ ঢেকে থাকায় জ্বলজ্বল করে থাকা চোখ দুটো বাদে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। বাসের জানালা দিয়ে সবাই বমি করতে পারে না। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বাসের ড্রাইভারকে গাড়িটা থামাতে বললো। ড্রাইভার প্রথমে না করলেও বমির কথা শুনে সাইড করে বাস থামালো। নীলাংশ, পেছনের দিকে এসে মেয়েটার দিকে ঝুঁকে বললো-
‘বাস থেমেছে, আপনি আসুন। ‘
আরেকটু হলেই পায়রা সব ভাসিয়ে দিতো বমি করে। নাহ, ছেলেটা খারাপ না। নাহলে, তাকে এভাবে সাহায্য করতো না। চুপচাপ উঠে বাস থেকে নামলো সে।
নীলাংশ, পানির বোতল নিয়ে নামতে গিয়ে থেমে গেলো৷ মেয়েটা কী বিব্রতবোধ করবে, সে পাশে দাঁড়ালে। কিন্তু, এই অন্ধকারে ঢেকে থাকা রাস্তায় মেয়েটা ভয় পাবে না! দুই সিট সামনে তেজসীকে দেখতেই ডাকতে শুরু করলো। সে ছেলে হলেও তেজসী তো মেয়ে। মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। তেজসী উঠেই গমগমে গলায় বললো –
‘হোয়াট আর ইউ ডুইং! আমার ঘুম ভেঙে দিলি কেনো?’
‘আর ঘুমাতে হবে না। ওঠ দ্রুত। ‘
‘আমরা কী পৌঁছে গেছি?’
‘উফ, না তুই ওঠ। ‘
‘কী হয়েছে, বলবি তো আগে! ‘
নীলাংশ তার পাশের মেয়েটা অসুস্থ কথাটা বলতেই তেজসী প্রথমে যেতে রাজি হলো না। কিন্তু নীলাংশ জোড় করে টেনে নিচে নামিয়ে নিলো। তেজসী ফসফস করতে করতে সামনে এগোতেই দেখলো একটা মেয়ে গাছ ধরে ঝুঁকে বমি করছে। গা গুলিয়ে আসলেও মানবতার খাতিরে এগিয়ে গেলো। নাহলে, নীলাংশ তাকে আরও জ্বালাবে। ধ্যাৎ, কোন গাইয়া মেয়েকে সাহায্য করতে হবে এখন!
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখলো। পায়রা লম্বা হওয়ায় বয়সটা ধরা যাচ্ছে না পেছন থেকে। বমি করায় মুখ থেকে কাপড় সরে গেছিলো। কেউ কাঁধে হাত রাখায় পেছনে ফিরলো সে। সঙ্গে সঙ্গে তেজসী গগনচুম্বী চিৎকার করে বললো –
‘ভূত! ‘
আবছা আলোয় পায়রা একপাশে মুখের দাগটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। তেজসীর এমন করায় হঠাৎই কান্না পেয়ে গেলো তার। মুখ দেখে শেষমেষ ভূত মনে হলো।
তেজসী এক দৌড়ে বাসে ঢুকে বসে পড়লো। নীলাংশ যেনো তাজ্জব বনে গেলো। মেয়েটাকে দেখে তেজসীর এমন রিয়াকশন সে আশা করেনি। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে এগিয়ে গেলো সে। মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। এবার সে বুঝেছে কেনো মেয়েটা মুখ ঢেকে বসে ছিলো। ওহ গড! মেয়েটা তো এসিড ভিক্টিম। তেজসী এমন আচরণ করায় যে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পেরে নিচু স্বরে বললো –
‘ওর পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি, ও বুঝতে পারেনি। ‘
কিন্তু পায়রা কিছু বলার আগেই নুইয়ে পড়লো গাছের দিকে। বমি, সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর খারাপ হয়ে গেছে। নিচে পড়ে যেতে নিতেই নীলাংশ নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো নরম মোমের শরীরটা।
তার একটুও ঘৃণা লাগলো না বমির কথা ভেবে। বরং মায়া হলো। আলতো করে মাথায় হাত রেখে বললো –
‘আপনি ঠিক আছেন? ‘
পায়রা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেও পারলোনা। সামনে দাঁড়ানো অচেনা ভরসার মানুষটার উপর ভর ছেড়ে দিলো।
চলবে…