স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৯

0
967

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান ”
পর্ব-৯

ময়না পাখির কলকলালির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো পায়রার। শক্ত বিছানায় শুয়ে পিঠজুড়ে ব্যাথার আভাস। আড়মোড়া ভেঙে মাথায় কাপড় মুখের উপর টেনে বসলো। ঘরটায় সূর্যের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে
আছে। আলোর দল তরতর বেগে ঘর দুয়ার জুড়ে নিয়েছে। উপরে ঘ্যারঘ্যার আওয়াজে টানা পাখা চলছে৷ যদিও এটা গ্রাম কিন্তু এই আধুনিক যুগে গরীব মানুষ ছাড়া এটা দেখা যায় না। পায়রা উপলব্ধি করে, জামেল স্যারের মতো শক্তপোক্ত মানুষটারও আছে অভাব। হবে নাই বা কেন! এখানের মাস্টাররা তো নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানটুকুই ঠিকঠাক পেয়ে ওঠে না তাহলে মাইনে পাওয়ার মাত্রাটাও তো স্বল্প।

হাই তুলে বিছানা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। কোমড় ছুঁই ছুঁই ঘন কালো চুলগুলো পেছনে খোঁপা করে নেয়।
কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসে। বাহিরে বেরোতেই দেখে উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ঝাড়ছে দোলনা খাতুন। নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
জামেল কিছুক্ষণ পরই বাজার থেকে ফিরে এলো। দোলোনা খাতুনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-

‘দোলা, এই দেখো বাজার থেকে টাটকা কই মাছ নিয়ে এসেছি। পুইশাক, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি। আর এই যে, মিষ্টি দই। ‘

দোলোনা খাতুন দাঁত খিঁচে মুখ খিটমিট করছে। সারা অঙ্গ জ্বলে উঠছে এই আদিক্ষ্যেতা দেখে। এই লোক, এত রঙঢঙ পায় কোথা থেকে! বাজারের ব্যাগটা ঠাস করে নিচে ফেলে দিলো। জামেল হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো-

‘দোলা! খাবারের ব্যাগটা ফেললে কেনো? ‘

দোলোনা কিড়মিড় করে বললো –

‘ফেলবো না তো কী করাম! মাস শেষ হইয়া আইসে। কাইলকাই ওই মাইয়ারে দুইখান জামা আইনা দিলা। আজ হরেক পদের খাবার লইয়া আইসো! এহনো এক সপ্তাহ বাকি মাস শেষ হইতে। ‘

জামেল রাগী স্বরে বললো-

‘একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ কী করে করো তুমি! ছিঃ ছিঃ দোলা! আমি যদি জানতাম তুমি এমন ধরনের মনের মানুষ কখনোই তোমাকে বিয়ে করতাম না। ‘

দোলোনা খাতুন আরও ক্ষেপে গেলেন৷ কোথাকার কোন মেয়ের জন্য কিনা তাকে খোঁটা দেয়া! এই লোককে উচিত শিক্ষা দিবে সে। কিছুক্ষণ সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলেন –

‘এত বড় কথা ! এই বাইশ বচ্চরের(বছরের) সংসারে এমন খোঁচা দিয়ে কথা কইলা তুমি এই মাইয়ার লাইগা! অনেক ভালা। যতদিন এই মাইয়া এই বাড়িতে থাকবো, আমি অন্নের এক দানাও মুখে তুলুম না। এ আমি কয়ে দেলাম। হয় এই মাইয়া বাইর হইবো নাইলে আমি না খাইয়া মরুম। ‘

জামেল রাগের মাথায় ব্যাগ উঠাতে উঠাতে বললেন –

‘না খাও। কোনো দরকার নেই তোমার খাওয়ার। যা ইচ্ছে করো। পায়রা এখানেই থাকবে। ‘

দোলোনা খাতুন আঁচলে মুখ গুজে বিলাপ করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়লেন। রাতের বেলাও বের হলেন না খেতে। জামেল কী খাবে! এটা ভেবে পায়রাই নিজ হাতে মাছ, সবজি, ভাত রান্না করলো। নিজের মুখে তুলতে পারলো না। অন্য কারো বাড়িতে এসে এভাবে ঝামেলা করে কীভাবে শান্তি মতো খাবে সে। এভাবেই দুই দিন কাটলো। পায়রার আর ভালো লাগছে না এসব। রোজকার অশান্তিতে মানসিক ভাবে ভেঙে যাচ্ছে। শেষমেষ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো সে।

জামেল দুপুরে নামাজ পড়ে ফিরতেই পায়রা দ্রুত গেলো। জামেলের পায়ের কাছে বসে পড়লো। সে কিছু বলার আগেই পায়রা বললো-

‘মাস্টার বাবা, আমি আর এহানে থাকুম না। আমি চইলা যাইতে চাই ‘

জামেল পায়রার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো-

‘কই যাবে মা? ‘

‘যেহানেই পারুম, চইলা যামু। কিন্তু চাচীর না খাইয়া থাকা আর সইয্য হইতাসে না। এমন বোঝা হইয়া থাকতে ইচ্ছা করে না আমার। ‘

জামেল কিছু একটা ভাবলেন। তারপরে পায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোথাও একটা বের হলেন। পায়রা শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।

তখন সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে ৷ জামেল টুপি মাথায় বাড়ি ফিরলেন, নামাজ শেষ করে। পায়রা নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। জামেল জুতোজোড়া বাহিরে ঝেড়ে রেখে খাটে বসলেন। পায়রা দৌড়ে পানি নিয়ে আসলো। মুখ এখনও কাপড়ে ঢাকা। ফর্সা হাত পা গুলো জাম রঙের জামায় ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ফুটে আছে। দেহের গড়নও বেশ পরিপাটি। পায়রার হাতে থেকে পানিটা খেয়ে পাশে রাখলেন৷ পায়রার উৎসুক দৃষ্টি তার দিকেই। তিনি পায়রাকে বসতে বললেন। পায়রা স্বপ্রতিভ হয়ে পাশে বসলো। তিনি কথা সাজিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বললেন-

‘ পায়রা মা, ঢাকায় যাবি তুই? ‘

পায়রা হতবাক হলো। শব্দহীন হয়ে বসে রইলো। একটু
সময় পর বললো-

‘ঢাকা তো মেলা দূরে তাইনে মাস্টার বাবা! ‘

‘হ্যা অনেক দূরে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বহু মানুষ পাড়ি দেয়। ‘

পায়রা কিছু একটা মনে মনে কষলো। চোখে মুখে কৌতুহল মেখে বললো-

‘মাস্টার বাবা! একখান প্রশ্ন করি? ‘

জামেল হাসলেন। পায়রা যে কোনো না কোনো প্রশ্ন করবে তিনি জানতেন। তাই বিস্মিত হলেন না।

‘একটা কেনো দশটা কর! ‘

পায়রা ঠোঁট ভিতরে চেপে খানিকটা ভিজিয়ে নিলো।
অর্থাৎ, এখন সে প্রশ্নের ঝুলি খুলবে।

‘ঢাকা! অদ্ভুদ লাগে না! বাংলাদেশের রাজধানীর নাম ঢাকা না রাইখা অন্যকিছুও রাখতে পারতো। এইডাই কেন রাখলো? ‘

প্রতি বারের মতো জামেল উৎসাহের সঙ্গেই বললেন –

‘জানিস তো, ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কথিত আছে যে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো, তাই রাজা, মন্দিরের নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে।

আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন; তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ শহরে “ঢাক” বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই শহরের নাম ঢাকা হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মোঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু সময় ঢাকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিলো।
-তথ্য গুগোল

তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না কোনটা সঠিক। ‘

পায়রা ঠোঁট কামড়ে পুরো কথা শুনলো। মনে মনে ইচ্ছে জাগলো যেখানের নাম নিয়েই এত বড় ইতিহাস আছে।সেই জায়গাটা নিজ চোখে পরিদর্শন করতে। সেখানের মানুষগুলো সম্পর্কে একটু জানতে। আচ্ছা, তারা কী এখানের মানুষের মতোই? নাকি তাদের জীবনপ্রনালী ভিন্ন? আব্বা একবার তাকে বলেছিলো
সেখানের মানুষ নাকি খুব ব্যস্ত। ওখানে টাকা না থাকলে টেকা যায় না। হঠাৎ, পায়রার মনে পড়লো তার কাছে তো টাকা নেই তাহলে সে ওখানে কী করে থাকবে। জামেলের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘সবই বুজলাম, কিন্তুু আমি তো চাকরি বাকরি করিনে।তাইলে ওইহানে কেমনে থাকমু? ‘

জামেল মলিন মুখে বললেন –

‘তোর কী মনে হয় আমি তোকে এমন কোথাও পাঠাবো যেখানে তোর এই বয়সে খেঁটে খেতে হবে! ‘

পায়রা প্রশ্নবিদ্ধ তাকিয়ে রইলো। জামেল মৃদু হেসে বললেন –

‘দুপুরে আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে। শহরেই থাকে পরিবার নিয়ে। এই তো কয়েক দিন আগেও এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে এসেছিলো। দুইদিন আগেই ফিরে গেছে। এখানে দেখা হয়েছিলো তখন।
আজ ফোনে তোর কথা বললাম , ও বললো যে তোকে ওখানে নিয়ে যেতে। একটা ব্যবস্থা হবেই।’

পায়রা চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো। ঢাকার মতো অচেনা জায়গায় কীভাবে থাকবে সে! তাঁরা বুবুর সঙ্গে বেড়ে ওঠার মধুর স্মৃতিগুলো তো এই গ্রামেই। ঢাকার মতো ব্যাস্ত, অচেনা শহরে চাইলেই কী আসা যাবে এই স্মৃতিতে ভরা গ্রামে!

পরদিন সকালেই একটা ব্যাগে নিজের জামাগুলো গুছিয়ে নিলো সে। আর বোঝা হয়ে থাকবেনা অন্যের বাড়িতে। তাই, চলে যাবে বহুদূর। এই গ্রাম, গ্রামের অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি, কত মানুষ, চেনা অচেনা সবাইকে ছেড়ে। কান্না পায় তার। তাকেই কেনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো! পড়লেও তাঁরা বুবুকে কেনো উপরওয়ালা আগেই নিয়ে গেলো৷ সে জানেনা! খুব অভিমান হয় তার। সবার উপরই। তাঁরা বুবুকে ছাড়া সে যে বড্ড অচল, অসহায়। মনের কথাগুলো শোনার মতো যে এখন কেউ না। কাপড় – চোপড় গুছিয়ে নিয়ে জামেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। জামেল
বাহিরেই বসে ছিলেন। পায়রাকে ব্যাগ হাতে বের হতে দেখে অসহায় মুখে বললেন-

‘আজ না, কাল তোকে দিয়ে আসবো। ‘

পায়রা অনুরোধ মেশানো কন্ঠে বললো-

‘মাস্টার বাবা, আমি আইজই যাইতে চাই ৷ চাচী আপনের লগে এই দুইদিনে একবারও কথা কয়নি। আমার ভাল্লাগতেসে না। সবাই আমার জইন্য কষ্ট পাইতেছে। ‘

জামেল নিশ্চুপ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পায়রাকে নিয়ে রওনা হলেন। ভ্যানে পুরোটা রাস্তায় তিনি পায়রাকে ঢাকার মানুষ, চালচলন, কাজকর্ম সম্পর্কে বললেন।
বাস স্টপে পৌঁছাতেই পায়রাকে বাসের একটা সিটে বসিয়ে দিলেন। পাশের সিটটা খালি না থাকায় তিনি আরও সামনের দিকের একটা সিটে গিয়ে বসলেন।
পায়রা জানালার কাচ খুলে দিলো। মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায়
শীতল হয়ে গেলো শরীর। চোখ আরামে বুজে গেলো।

_________________

‘ট্রলিটা আমাকে দে। ‘

নিশান উত্তরের অপেক্ষা না করে তেজসীর হাত থেকে নিয়ে নিলো ভারী ট্রলিটা। আজ সব বন্ধুদের কক্সবাজার ট্রিপ শেষ। কক্সবাজার থেকে সরাসরি যাওয়ার বাসটা ৬ টায় ছিলো। কিন্তু, তারা সবাই লেট। তাই বাসও মিস হয়েছে। এখানে থেকে আরেকটা বাস আসবে যার গন্তব্যও ঢাকায়। তিতিক্ষা মনে মনে খুশিই হলো। নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে আয়না বের করে মনের সুখে চুল ঠিকঠাক করতে থাকলো। কারীমা বাসস্ট্যান্ডের একপাশে বসে নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাট করছে। তমাল ফোন হাতে নিয়ে বসলেও ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে হাই তুলছে ৷ আর প্রবীর নিশানের সাথে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায়। ঠান্ডা পরিবেশকে ভেঙে
দিয়ে আগমণ হলো সুদর্শন এক যুবকের। মুখে সামান্য
মানানসই হাসি। খারা নাকে গাঢ় তিল। শান্ত মুখভঙ্গি।
কাঁধে ম্যাক্সের একটা স্টাইলিশ ব্যাগ। দ্রুত হেঁটে এগিয়ে আসলো সে। সবার নজর গেলো সেদিকে।
প্রবীর মুখ লটকে বললো-

‘ তোর কথাই ঠিক ছিলো। বাস মিস যখন হয়েছেই তখন এইখানে এত তাড়াতাড়ি আসা উচিত হয়নি। ‘

যুবক অমায়িক হাসলো। হালকা রোদেই ঝিলিক দিয়ে উঠলো দুই পাশের প্রি-মোলার দাঁত। পকেটে হাত গুঁজে নিয়ে আশেপাশে দেখে বললো-

‘এখন আর আফসোস করে লাভ আছে? আগেই মনে রাখা উচিত ছিলো, এই নিলাংশ সোহরাব কখনো এমনি এমনি কিছু বলেনা। ‘

প্রবীর সেলুট দেয়ার মতো হাত কপালে রেখে বললো –

‘একদম, দি পার্ফেক্ট নিলাংশ সোহরাব ইজ অলওয়েজ রাইট। ‘

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here