স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৮

0
1147

‘স্বপ্নচূড়ার আহ্বান’
পর্ব-৮

আচমকা চোখ মেলে তাকাতেই চমকপ্রদ হয়ে উঠলো পায়রা। চোখের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বুকের ধরপর আওয়াজ বেড়েছে। মাথায় কাপড়টা আলতো করে মুখের উপর টেনে নেয় পায়রা৷ দেখতে পায় সামনেই দাঁড়িয়ে স্কুল মাস্টার জামেল । ভয়ে কথা জড়িয়ে আসে তার। মাস্টারের সামনে সে ভয়ে মুখ খুলতে পারেনা। জামেল অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছেন পায়রার মুখের দিকে। এত সুন্দর মুখমন্ডলের এই দশা দেখে নিজেকে সামলাতে পারছেন না সে৷ জামেল ভেজা ঠান্ডা গলায় বললেন –

‘পায়রারে! তোর এই অবস্থা হলো কী করে! ‘

পায়রা প্রথমে জামেলের নরম কথায় চমকে উঠলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো, এখন সে আর আগের পায়রাটি নেই। এখনের পায়রাকে কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে অথবা করুণার।
পায়রা ধাতস্থ হয়ে বললো-

‘স্যার, আপনে শোনেন নাই? তাঁরা বুবু আর আমার সাথে কী হইসে?’

‘তাঁরার মৃত্যুর খবর শুনেছি আমি। এই কম বয়সে যে মেয়েটা এভাবে মারা যাবে কল্পনাও ভাবিনি। কিন্তু তোর সাথে কী হয়েছে তা তো শুনিনি! ‘

পায়রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সবটা জানায় তাকে। জামেলের বুক ভারী হয়ে আসে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলেন-

‘তোর মা বাপ, নিষ্ঠুরের মতো তোরে কীভাবে বের করলো! ‘

‘আব্বা আটাকাইসিলো, কিন্তু আম্মা শোনে নাই ‘

‘শোন পায়রা, তোর বাপে হলো গাঁ ছাড়া মানুষ। তোর মা পুরো গ্রামের পাষাণ মহিলার একজন। সে টাকা ছাড়া কিছু বোঝেনা। তোর বাপ যদি সত্যি তোরে স্নেহ করতো, তাহলে কখনো বের করতে দিতো না। ‘

কিছুক্ষণ পরই চাপা শ্বাস ফেলে বললো-
‘তুই চিন্তা করিস না। চল আমার বাড়ি। ওখানেই থাকবি তুই। ‘

পায়রা শঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। জামেল স্যার কেনো তাকে তার বাড়ি নিতে চাইছে! জামেল বোধ হয়
পায়রার মনের প্রশ্নটা বুঝে ফেললেন। তাই, পায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘আমি তোর বাবার মতো। আমাকে ভরসা করতে পারিস। এই সন্তান হীন বাবাটাকে বাবা হওয়ার একটা সুযোগ দে মা। সেই ছোট্ট দেখে আসছি তোকে। মন থেকে মেয়েই মেনে আসছি। আজ থেকে না হয় এই পাগলা মাস্টাররে একটাবার বাবা মান ‘

পায়রার চোখ অতিরিক্ত স্নেহে টলমল করে ওঠে। তাঁরা বুবুর পর কেউ এমন করে ভালোবাসে না তাকে৷
মা বাবা দুজনেই বড়ই স্বার্থপর। সকল মানুষ যেমন এক হয় না। ঠিক তেমনই, সব মা বাবাও এক নয়।
জামেল স্যারের অশ্রু ভেজা চোখে ভরসার স্থান দেখতে পেলো পায়রা। জামেল স্যারের বাসায় যেতে রাজি হলো। জামেল খুশিতে অধর ছড়িয়ে হাসলেন। রওনা হলেন পায়রাকে নিজের বাড়িতে।

টিনের বেড়া দেয়া ছিমছাম একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পায়রা। পাশে একটা বড়ই গাছ। নিচু ডালটায় দুটো পাখি বাসা বেঁধেছে সেখানে। খুব সম্ভবত সেটা ময়না পাখির বাসা। এমনটাই মনে হলো পায়রার৷ কাঠের শক্ত দরজায় কড়া নাড়লেন জামেল।
তিন বারের সময় খুলে দরজা খুলে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মুখে আধঁচিবানো পানের ছাবা। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। চিকন চাকন দেখতে। জামেল কিছু বলার আগেই মহিলা বাজখাঁই গলায় বললেন-

‘এত দেরি লাগে আইতে! মাস্টারি কইরা গেরামের ছাওয়াল পাওয়ালরে শিক্ষিত বানাইতাছো। কী পাইলা! ‘
জামেলের পাশে দাঁড়ানো মুখ ঢাকা মেয়েটা নজরে আসতেই ভ্রু কুচকে বললেন-

‘ওই মাইয়া কেডা?কোন ফকির মিসকিন জুটায় আনছো আবার ! হুনো, আইজ ঘরে অত খাবারের জিনিস নাই। রাস্তার ফকির রাস্তায় দিয়ে আইয়ো যাও’

পায়রার মন খারাপ হয়ে আসে। নিজের গ্রামেই তাকে ফকির মিসকিন হয়ে মানুষের বাড়িতে হাজির হতে হচ্ছে। এই দিনও বুঝি দেখার ছিলো! পনেরো বছরের কিশোরীর মন তলিয়ে যায় বিষন্নতায়। চোখে ইতিমধ্যেই জল জমেছে। মুখের উপরের ওরনাটা টেনে চোখের অশ্রুকণা মুছে নেয় সে।
জামেল কটমট করে তাকিয়ে আছে দোলোনা খাতুনের দিকে। আগে এমন ছিলেন না তিনি। সাংসারিক অশান্তি, সন্তান না হওয়ার বেদনা আর টানাপোড়েনে বদলে গেছে সে। আগে ফকির মিসকিনকে নিজের ঘরের বিছানায় আসন পেতে দিতেন। কিন্তু, সন্তান না হওয়ার ক্ষোভ ধীরে ধীরে দোলোনার মনকে অসুস্থ করে তুলেছে।
“মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতাই সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ,যার মন ক্লান্ত সেই সবচেয়ে অসুখী। ‘

জামেল দোলোনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। নরম স্বরে বললেন-
‘দোলা! এই মেয়েটা আমার স্কুলের বহু পুরনো ছাত্রী। খুব ভালো মেধাবীও। একটা দুর্ঘটনায় আজ চেহারার এই করুণ দশা। আমার মেয়ে থাকলে তো আজ এত বড়ই থাকতো। খুব ক্ষতি হবে? যদি আমাদের মেয়ের মতো আমাদের বাড়িতে থাকে?’

দোলোনা খাতুন পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারতেই হিসহিসিয়ে ওঠেন। এত বড় সাহস! বাড়িতে অচেনা এক মেয়ে উঠিয়ে বলে কিনা মেয়ে বানাবে। পায়রাকে কটুবাক্য ছুড়ে দেয়ার আগেই জামেল তার হাত চেপে ধরে। ফিসফিস করে বলেন-

‘এখন আর কিছু বলোনা দোলা। মেয়েটা কয়েক দিন এই বাড়িতে থাকুক। তারপর অন্য একটা ব্যবস্থা করবো। তোমাকে কিছু করতে হবে না তুমি ঘরে যাও ‘

দোলোনা খাতুন দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করেন।
তিনি কিছুতেই এই মেয়েকে বেশি দিন বাড়িতে ঠাঁই দেবেন না। কী দরকার তার আপদ বাড়ি আনার! এমনিতেই ঘরে টাকা পয়সার অভাব। আরেকজন এনে কেনো টাকা খরচ করবেন! টাকা কী গাছে ধরে!
ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরে ঢুকে গেলেন।

জামেল পায়রার দিকে ফিরতেই পায়রা কান্না স্বরে বললো –

‘স্যার, আমি এই বাড়িতে উঠুম না। আমি নাইলে মা বাপের পায়ে ধইরা বাড়িতে ফিরমু। ‘

জামেল আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-

‘যেখানে তোর আত্মসম্মান নেই, সেখানে কখনো ফিরে যাবি না পায়রা। আত্মসম্মান হলো প্রতিটি মানুষের বস্তুু স্বরুপ। এটা খুলে ফেললেই সর্বনাশ। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসের একটি। ‘

পায়রা অবুঝ মনে পাল্টা প্রশ্ন করে –

‘ তাইলে এইখানে থাকনও আমার জইন্য পাপ! ‘

জামেল হাসলেন। তিনি বরাবরই জানেন,পায়রা প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। পায়রার দিকে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বললেন –

‘দুর্দশা কী চিরকাল থাকেরে! তুই কয়েকটা দিন এখানে থাক। পরের চিন্তা তোর এই মাস্টার বাবার। এতটুকু বিশ্বাস রাখবি, তোকে এমন কোনো জায়গায় পাঠাবো না যেখানে তোর মানহানি হবে। ‘

পায়রা নিজেকে আস্বস্ত করে। যার কেউ নেই তার উপরওয়ালা আছে। এসব ভেবে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
দুই রুমের ছোটখাটো বসতি। দরজার পাশে বারান্দার মতো একটা জায়গা। শহুরে ভাষায় তা ড্রইং রুম। জামেল তাকে পাশের বড় রুমে থাকতে বলে। জামা কাপড় না থাকায় হাত মুখ ধুয়ে খাটে পা তুলে সাপের মতো শরীর পেচিয়ে বসলো। জামেল এক ঘন্টা পর দুটো নতুন জামা এনে দিলেন৷ পায়রার হাতে দিয়ে কিছুটা নুইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলেন –
‘মাসের শেষের দিকে তো, তাই হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই। স্কুলে বেতন পেলে আরও এনে দেবো। ‘

পায়রার মন এই দুঃসময়েও আনন্দে ছলকে আসে।
কত মমতা মিশিয়ে কথাটা বললো তার মাস্টার বাবা!
সে তো মাঝে মধ্যে এই রাগী মাস্টারকে গালমন্দও করতো। অথচ, সময়ের পরিক্রমায় এই রাগী মাস্টারই তাকে স্নেহময় বৃক্ষছায়ায় নিয়ে আসলেন। এই ঋণ যদি নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও চুকাতে হয় সে তাই করবে বলে মনে মনে আওড়ায় পায়রা। পায়রাকে কাঁদতে দেখে জামেল উত্তেজিত কন্ঠে বললেন-

‘কিরে মা! জামা পছন্দ হয়নি! থাক থাক, আমি অন্য জামা নিয়ে আসবো। তাও কান্না করিসনা মা। ‘

পায়রা জামেলের এক হাত নিজের মাথায় রেখে বললো –

‘মাস্টার বাবা! আপনে অনেক ভালা। আমার আব্বা কহনো আমারে এমন কইরা জামা কাপড় আইনা দেয়নাই। আপনে আমার সত্যিকারের বাবা হইলেন না কেন! ‘

জামেলেরও ইচ্ছে করে সারাজীবনের জন্য এই ছোট মেয়েটাকে নিজের পিতৃস্নেহের ছায়ার তলে রেখে দিতে। কিন্তু, ভবিতব্য অন্য কিছু চায়। কিছুক্ষণ পায়রার কাছে থেকে বাহিরে চলে গেলেন। পায়রা জামা দুটোকে নিয়ে স্বযত্নে খাটের পাশে কাঠের তাকে ঝুলিয়ে রাখলো। ঘরে কোনো আয়না নেই৷ নিজের মুখটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে তার। জানতে ইচ্ছে করে, তার মুখশ্রী কী এতটাই বাজে হয়ে গেছে যে তার গর্ভধারিণী মাও তাকে ঘরছাড়া করলো। তারপরও সে বাঁচতে চায়। তার গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছাতে চায়। অমন পাষাণ মা বাবার জন্য সে আর দুঃখ করে না। তাঁরা বুবু কেই একমাত্র চাইতো সে। সেই একজনই তাকে বড় আদর দিয়ে আগলে রেখেছিলো।
পায়রা শক্ত খাটের উপর নিজেকে এলিয়ে দেয়। পিঠে অনুভূত হয় চিনচিনে ব্যথা। তা পাত্তা বা দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের পাতায় ভেসে ওঠে শৈশবের রঙিন স্মৃতিতে পরিপূরক এক উজ্জ্বল সকাল।

_____________

‘উফ! একটা ছবিও ভালো উঠেনি আমার ‘

কপালে ভাজ ফুটে উঠলো তেজসীর। মন মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বোকা বোকা চোখের ছেলেটার মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরে ইচ্ছেমতো টানতে শুরু করলো তেজসী। ছেলেটা নাক মুখ কুচকে আহত ভঙ্গিতে বললো –

‘এই এইজন্যই আমি রাক্ষসীর ছবি তুলতে চাইনি। মুখটা নিজেই তোতাপাখির মতো ছোট করে, আর ছবিতে তা উঠলেই আমার চুলের উপর হামলা! ‘

পরমুহূর্তেই চিৎকার করে বললো –
‘ছাড় আমাকে তেজী মহিলা! ‘

তেজসী ফসফস করতে করতে চুল ছাড়লো। ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো –

‘নিশু! কক্সবাজারে আসার পথেও আমার ছবিগুলো ভালো করে তুলিসনি। কেউ তুলতে পারেনি, আমি এফবিতে কী আপ দিবো তাহলে! ‘

শেষের কথাটা চেঁচিয়ে বললো তেজসী। নিশান ক্যামেরা হাতে দৌড়ে চলে গেলো বন্ধুদের আড্ডাস্থলে। এই মেয়ের কাছে থাকলে কান আর কান থাকবে না। কক্সবাজারে এসেছে আজ প্রথম দিন। বন্ধুরা সবাই মিলে আড্ডা দিবে , তা না করে এফবিতে কোন ছবি আপলোড দিবে এই নিয়ে চিন্তিত মেয়েটা। বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে নিশান ৷ এক বস্তা বিরক্তি নিয়ে বন্ধুদের পাশে বসলো ৷ পাশে থাকা তিতিক্ষা নিশানের থমথমে মুখটা দেখে আন্দাজ করে রসিকতা ভঙ্গিতে বললো –

‘কিরে নিশু? চুল টানাটানি খেয়ে তৃপ্তি হয়েছে তো! ‘

নিশান হতাশ হয়ে গাল ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। সামনে বসে থাকা তিতিক্ষা, কারীমা, তমাল, প্রবীরের উৎসুক দৃষ্টি তখন নিশানের দিকে৷ নিশান কাঁদো কাঁদো মুখে বললো –
‘ভাল্লাগে না ভাই, আন্টি কী খেয়ে তেজসীকে পয়দা করেছে বল তো! ‘

প্রবীর দাঁত কেলিয়ে হাসলো৷ নিশানের কাঁধে হাত রেখে ভর দিয়ে বললো-

‘এই তেজসীকেই আপনি চারবার ঘটা করে প্রপোজ করেছেন। পঞ্চম বার আপনার প্যানপ্যান সহ্য করতে না পেরে এক্সেপ্ট করে রিলেশনশিপে জড়িয়েছে। ‘

নিশান মুখ গোমড়া করে গালে হাত রাখলো। আশেপাশে কাউকে খুঁজে দেখার ভঙ্গিতে বললো-

‘নিলাংশ কই! ‘

কারীমা ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললো-

‘তিনি সমুদ্র বিলাসে ব্যস্ত। আমাদের এভাবে বসে থাকতে দেখেও তো কম কথা শোনায়নি। শুধু তার একটাই কথা -‘ যদি কক্সবাজার এসে এভাবে বসে থাকলে লাভটা কী হলো! ‘

তমাল সমুদ্র স্নানে ব্যস্ত সুদর্শন যুবকটির দিকে দূর থেকে তাকিয়ে বললো-

‘ভ্রমণ প্রিয় মানুষ, দ্বিতীয়ত ওর মা ওকে নিয়ে যে পজেসিভ! পুরাই মাম্মাস বয় টাইপ ‘

প্রবীর তুড়ি বাজিয়ে বললো-
‘একদিন দেখবি, নিলাংশ বাবা হওয়ার আগেও ওর মাকে জিজ্ঞেস করে নিবে! ওর বউয়ের কপালেও ভুগন্তি আছে । ‘

তেজসী পেছনে থেকে হেঁটে আসছে আর বিরবির করে নিশানকে বকছে। ওদের সবাইকে আড্ডা দিতে দেখে চিল্লাতে চিল্লাতে বললো-

‘নিশুর বাচ্চা! আমার মেক আপ বক্স তোর হাতে ছিলো। সেটা ভাঙলো কী করে! ‘

নিশান বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো-
‘তেজী মহিলা! ‘

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here