স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-১৫

0
1129

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান ”
পর্ব-১৫

প্রভাতীর আলোকিত মিষ্টি রোদের মতো মিষ্টি হাসলো নীলাংশ। সে খুশি হলো। পায়রা তার নিজ বাড়িতে কীভাবে এলো মনে প্রশ্ন আসতেই তার মা তানজিমার দিকে তাকালো। তানজিমা সব ভুলে ছেলের কাছে এগোলেন। সবকিছু পরেই হবে ভেবে মাথা ঠান্ডা করলেন৷ ছেলের সামনে রুঢ় আচরণ করতে চাইলেন না। নীলাংশের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মুখটা স্নেহময় হাতে মুছিয়ে দিলেন। চিন্তিত গলায় বললেন-

‘ কত করে বললাম , যেতে হবে না। দেখো কেমন কালো হয়ে গেছো রোদে তুমি! ‘

নীলাংশ স্মিত হেঁসে বললো –

‘ওও মাই সুইট মম, ডোন্ট ওয়ারি। তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি তো। ‘

তানজিমা দ্রুত একজন কাজের লোক ডেকে ব্যাগটা ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন। আর নীলাংশকেও হাত মুখ ধুয়ে আসতে। নীলাংশ পায়রার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে বললো-

‘মম, ও এই বাড়িতে!’

তানজিমা ঘৃণার ভঙ্গিতে পায়রাকে একবার দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে বললেন-

‘ ইউ নো, তোমার বাবা কত মহান হৃদয়ের। কদিন পরপরই রাস্তা থেকে গরীব মানুষজন উঠিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। একেও কোথা থেকে যেনো নিয়ে এসেছেন। ‘

পরমুহূর্তেই তাড়া দিয়ে বললেন –

‘তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি ঘরে যাও। ‘

নীলাংশ হতবিহ্বল হয়ে গেলো। এসব কী বলছে মা!

আয়মান সাহেব বেশ রেগে গেলেন। তানজিমার এই অহংকার বোধে অনেকটাই বিরক্ত তিনি। উচ্চস্বরে বললেন –

‘স্যাট আপ তানজিমা। আমি পায়রাকে এখানে এনেছি নিজের মেয়ের রূপে। ওর একটু অপমানও আমি সহ্য করবো না। ‘

তানজিমা রেগে বললেন –

‘এমন অজপাড়া গাঁয়ের মেয়েকে তুমি নিজের মেয়ে বানিয়ে বাড়িতে রাখবে! ‘

আয়মান কঠোরতার সঙ্গে বললেন –

‘হ্যা রাখবো৷ মানুষের পরিচয় তার কর্মগুণে। কখনোই পোশাক দেখে তাকে মূল্যায়ন করা যায় না। পায়রার
মধ্যে যেসব ক্ষমতা আছে, মেধা আছে তা-ই তার শীর্ষে পৌঁছানোর সিঁড়ি হবে। আমি আর একটা কথাও কারো শুনবো না। ‘

পায়রার ইচ্ছে করছে মরে যেয়ে সকল কিছুর অবসান ঘটিয়ে দিতে। ঠিকই করেছে তাঁরা বুবু। মৃত মানুষকে তো এসব সহ্য করতে হয়না। বেঁচে থেকে সবার বোঝা হয়ে গেছে সে। কিশোরী বয়সের আঘাত গুলো বোধ হয় একটু বেশিই বিঁধে। এসময় বিবেগ থেকে আবেগের বশে বেশী কাজ করে মানুষ। পায়রার মন গ্রাস করছে অসহনীয় যন্ত্রণা। কান্না চেপে কোনোরকমে বললো-

‘ডাক্তার কাকা, আপনেরে ঝামেলায় ফালায় দিলাম।
আমার এখানে থাকন লাগবো না। আমি অন্য কোন..’

আয়মান পায়রাকে থামালেন। নরম কন্ঠে বললেন-

‘শোনো মা, দুঃসময়ে পাশে কেউ থাকে না। আর কেউ থাকতে চাইলেও আশেপাশের মানুষের জন্য পারে না।
এই দুঃসময়টায় নিজেকে যতটা শক্ত করা সম্ভব করবে। কতবার কতজন এসে ভেঙে দিবে! উঠে দাঁড়িয়ে দেখানো তোমার জয়। তারপরের বার এমন করে গড়বে যাতে ভাঙার কেউ সাহস না করে। আমি সার্ভেন্ট ডেকে দিচ্ছি। তোমার রুমে সব ঠিক করাই আছে। যাও বিশ্রাম করো। ‘

সার্ভেন্ট এসে পায়রাকে নিচের রুমে নিয়ে গেলো। পায়রা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের সাথে ভারাক্রান্ত মনটাকেও দমিয়ে নিয়ে গেলো৷ আজ যদি আয়মান সাহেব এত করে না বললে পায়রা কখনোই থাকতো না। বয়সে এত বড় একজনের আকুতি ফেলতে পারলো না।

নীলাংশ তার মায়ের এহেন আচরণে অনেকটা অবাক হলো। মায়ের কোমল আচরণেই অভ্যস্ত সে। ছোট মেয়েটাকে এভাবে কথা বলায় খুব খারাপ লাগলো তার। পায়রার জন্য প্রগাঢ় কোনো কিছু অনুভব না করলেও স্নেহের চোখে দেখে। সহ্য করতে না পেরে কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ন গলায় বললো –

‘মম, তুমি এমন কীভাবে করতে পারো একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে! ‘

তানজিমা নীলাংশের সঙ্গে কোনোরকম বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হতে চাইলেন না। সব উচ্ছন্ন যাক। একমাত্র ছেলেকে সে নিজের মতোই নিয়ন্ত্রণ করবেন। শুধু শান্ত গলায় বললেন-

‘আমি আগেও বলেছি, ওই মেয়ের প্রসঙ্গে কোনো কথা তুমি বলবে না। ওই মেয়ের সঙ্গে দুরত্ব বজায় রাখবে। এসব ছোটলোককে তুমি চেনোনা নীল। এরা বড়লোক বাড়িতে ঢুকে টাকা হাতানোর ধান্দায় থাকে। দুনিয়া দেখোনি তুমি। ‘

মায়ের চিন্তা ভাবনায় হতাশ হয় নীলাংশের কোমল হৃদয়। মাকেও কোনো কথায় দুঃখ দিতে চাইলো না।
তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ভদ্রতা বজায় রেখে চলে গেলো রুমে৷

সবার চিল্লাচিল্লিতে হাজির হলেন রূপসা। এই বাড়িতে আরও কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। আয়মান সাহেবের ছোট ভাই রায়ান, তার স্ত্রী রূপসা, বড় মেয়ে রায়া, আর ক্লাস থ্রিতে পড়া ছেলে অপূর্ব। সময়ের পরিক্রমায় দুইটি পরিবার হয়ে গেলেও, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় রাখতে আয়মান সাহেব দুটো ফ্ল্যাটকে একটি বড় ফ্ল্যাটে রুপান্তর করেছেন। ফ্ল্যাট হলেও ভেতরের রাজকীয় প্রচ্ছদে বোঝার উপায় নেই।

রূপসা নরম মনের মানুষ। এত চিৎকার চেচামেচিতে ভয় পেয়ে দৌড়ে এসেছেন৷ পরিস্থিতি বোধগম্য হতেই চেষ্টা করলেন তানজিমাকে শান্ত করতে।

_________________

কাজের মহিলা রেবেকা, পায়রাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। পায়রা কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েছে সবকিছুতে। মহিলা চলে যেতেই দরজা চাপিয়ে ডুকরে কাঁদে পায়রা। মুখের উপর থেকে টেনে ওরনা ছুড়ে মেঝেতে ফেলে। সবকিছু অসহ্য লাগে তার৷ এ জীবনের কঠিন বাস্তবতায় কী সে তবে হেরে যাচ্ছে! তাঁরা বুবুর মতোন!
তার পরিণতিও কী ঠিক তেমনই হবে! পায়রা কাঁদতে কাঁদতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চিরচেনা মুখে অচেনা ছাঁপ, মানতে পারে না। পুরোনো চেহারা চায় সে। যে চেহারায় থাকবে না কারো ঘৃণ্য দৃষ্টি। থাকবে না কারো অবহেলা । কিন্তু ভাগ্য তা ছিনিয়ে নিয়েছে তার কাছে থেকে। নাকি, এটা ভাগ্যের লিখন! হাঁটু মুড়ে গুমরে পড়ে বুক ভাসিয়ে কাঁদে সে। কারো স্নেহময় হাতের অভাবে কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গ৷ অথচ, নিয়তির খেলায় সে একা। কেউ নেই। একটা সাহায্যের হাত, যে বলবে –
‘চিন্তা নেই আমি আছি! ‘

কেঁদেকেটে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ব্যাগ থেকে তাঁরার দেয়া সাদা চিঠিটা বের করে সে৷ মাস্টারের বাবার বাড়িতে একবার পড়েছে। কিন্তু কী যেনো একটা চিঠিতে বারবার টানে তাকে। তাঁরা বুবুর যত্নে গড়া শব্দ গুলোই কী! হতে পারে। চিঠির ভাজ খুলে ঘ্রাণ টেনে নেয়। এইতো তার বুবুর ঘ্রাণ। নিজের চোখের অশ্রু গুলো সমর্পণ করে দেয় চিঠিতে। যেনো সেই ছোট বেলার পায়রা কাঁদছে আর তাঁরা বুবু দৌড়ে কোলে নিয়ে নিজের আঁচলে অশ্রু ভেজা চোখগুলো মুছে বলছে -‘ কাঁদে না পায়ু, বুবু আছে না! ‘

চিঠিতে লেখা বাক্য গুলো আবারও আওড়ায় সে। বারবার , শহস্রবার, হাজারবার!

আমার পায়ু,

তোর বুবু সত্যিই হেরেছেরে! তুই বলতি তো, ‘তুমি এতো বোকা কেনো বুবু? আমি তো বোকাই। তুই তো জানিস।
ছোটবেলায় আমাদের গেরামে যখন রোগে মানুষ মরতো। একটু একটু কইরা স্বপ্ন দেখলাম একদিন সাদা এপ্রোন পইড়া আমিও সেবা করুম। বাবারে অনেক কওয়ার পর মেট্রিক পাশ করার পর আরও পরার সুযোগ পাইলাম। নাইলে, আমার এমন কালা চেহারা দেইখা মা তো আরও আগেই বিয়া দিয়া দিতো।

মেট্রিক পাশের পর যহন একটা মাস্টারও মা রাখলো না। আমি তুষার ভাইরে কইলাম একটু পড়াগুলা দেখাই দিতে। তার বাড়িতে মাঝে মাঝে যাইয়া পড়া বুইঝা আসতাম৷ তুষার ভাই আমারে মজার ছলে পড়া এত সুন্দর কইরা বুঝাইতো আমি মুগ্ধ হইতে থাকলাম৷ তার আওয়াজ, কথার ভঙ্গি সবকিছুতেই আস্তে ধীরে আমি দুর্বল হইয়া গেলাম। নিজের মনরে নিয়ন্ত্রণ কইরা এড়ায় গেলাম।

কিন্তু তুষার ভাই যেদিন নিজের মনের কথাও কইলো। আমি আর পারি নাইরে। মনের কথা তারে বইলা দিলাম। ঠকবাজ মানুষ গুলা এভাবেই আসে পায়ু। নতুন স্বপ্ন দেখাইতে। তারপর হঠাৎ কইরাই বদলায় যায়। আর নিজেরে যখন ভালো রাখার জন্য একটু বদলাইতে চাইবি তারা আর সহ্য করতে পারবো না।

তোর সত্যি জানার অধিকার আছে। তোর জীবনটাও আমার ভুলের জন্য নষ্ট হইয়া গেলোরে। আমার মুখেই তুষার ভাই এসিড দিতে চাইসিলো। কিন্তু তোর উপর লাগসে। তুই আমার সামনে ঐ লম্বা বিছানাটায় অচেতন হইয়া পইড়া আসোস। আমি সহ্য করতে পারতেসি নারে। সন্তানের থিকাও বেশি ভালোবাসি তোরে। নিজের জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত তো নিতে পারলাম না। কিন্তু তোর এই হালের শাস্তি আমি দিবোই।
হাল ছাড়বি না পায়ু, স্বপ্ন ভাঙা জীবনে আমি বাঁচতে না পারলেও তোকে পারতে হবে। তোর স্বপ্ন পূরণ করিস। আমার স্বপ্ন চূড়ায় আমি পৌঁছাতে পারিনি।
তোর স্বপ্ন বড়। স্বপ্নচূড়ার আহ্বান তোকে তোর লক্ষ্যে পৌঁছাবে।
নিজেরে ভালো রাখিস পায়ু,
অন্য কারো উপর নির্ভরশীল হবিনা। নিজেকে নিজের উপর নির্ভরশীল করবি৷

তোর তাঁরা বুবু..

চলবে-
[আজকের পার্টটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্ব ছিলো। আবেগী মানুষের জন্য একটা বড় মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করেছি। নির্ভরশীল হলে সৃষ্টিকর্তা আর নিজের উপর করার চেষ্টা করুন। জীবন খুব সুন্দর না হলেও খারাপ হবেনা। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here