“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-২৮
পায়রা ক্লাসরুমে প্রবেশ করলো। নিঃশব্দে বেঞ্চে বসে বই খাতা বের করে নিলো। সবার উচ্ছল দৃষ্টি তখন তার দিকে। পায়রা কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে পুরনো পড়াগুলো মনে করতে থাকলো। কাল রাতে বেশ ভালো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলো। বইয়ের প্রতি তার অনেক ভালোবাসা কাজ করে।
তাসনুভা গোমড়া মুখে ক্লাসে আসলেন। বেশ নামি-দামি স্কুল এটি। মাস শেষে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা বেতন পাওয়া যায়। খুব বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে না। তাই ইচ্ছে হলেই চাকরি ছেড়ে দেয়া সম্ভব না। আর আভাস বোস বেশ গম্ভীর ধাঁচের মানব।
তার মুখের সামনে বেশি কথা বললে চাকরি শেষ। তাসনুভা হায়ার ম্যাথ বইটি বের করে ছয়টি অংক করতে দিলেন। সবাই নিজেদের খাতা বের করে করা শুরু করলো। পায়রা নিজমনে অংক করছে। সবাইকে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে দিয়ে সে ছয় মিনিটের মাথায় দাঁড়িয়ে বললো তার অংক করা শেষ। তাসনুভা কন্ঠের আওয়াজে পিছনে ফিরলেন। পায়রার কথায় তিনি ভ্রু কুচকে এগিয়ে আসলেন। তাচ্ছিল্য করে হেঁসে খাতা হাতে নিলেন। হয়ত ভুলভাল অংক করে দাঁড়িয়ে গেছে। বেশ অবহেলা নিয়েই খাতায় দৃষ্টি দিলেন। কিন্তু সবগুলো চেক করে তাকাতেই বোঝা গেলো তিনি ঝটকা খেয়ে চোখ মুখ হা করে রয়েছেন। বেশ বড় অংক এগুলো। ক্লাসের সবাই সর্বোচ্চ তিনটি করেছে বড়োজোর। পায়রার দৃষ্টি জানালার দিকে। সেখানে দুটো দোয়েল পাখি সুমিষ্ট সুর তুলছে। তাসনুভা চরম মাপের অবাক হয়েই খাতায় রাইট দিয়ে বেঞ্চে রেখে দিলেন,ইশারায় বললেন বসতে। পায়রা একইভাবে বসলো । তাসনুভা ক্লাস শেষে বাসার পড়া দিয়ে চলে গেলেন। পরের প্রতিটি ক্লাসই এভাবেই কেটে গেলো। তাসনুভা বাদে সব টিচারই যথেষ্ট সহমর্মি স্বভাবের ।
কথায় আছে, এক জায়গায় সবাই খারাপ হয়না। ভালো মন্দ মিলিয়েই তো পৃথিবী। টিফিন টাইমও শেষ হলো। পায়রার দৃষ্টি শান্ত। কোনো রাগ ক্ষোভ তার চোখে মুখে নেই ৷ বাদ বাকি সবাই ভেতরে ভেতরে মেয়েটার সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী। তবে কেউ-ই সাহস করে এগিয়ে আসেনি। ক্লাস শেষে ছুটির বেল বাজলো। সবাই ধীরে ধীরে বের হয়ে গেলো। পায়রা বের হলো৷ পিঠ পুড়ানো রোদ উঠেছে। কিছু দূর বের হাঁটতেই দেখলো নীল রঙের গাড়িটায় হেলান দিয়ে
দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷ মেয়েটার গায়ে সাদা কালো টপস। চোখে একটা বাদামী চশমা।
নীলাংশের হাতের মুঠোয় একটা লাল মলাটের বই ঝুলছে। নীলাংশ বইটির দিকে তাকিয়েই কথা বলছে। দুই একবার রোদে লাল হওয়া মুখটা বাম হাতের টিস্যুতে ঘষে নিচ্ছে। পায়রা নিচের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসলো। নীলাংশ আশপাশে চোখ দিয়ে পায়রাকেই খুঁজছিলো। তার ক্লাস আছে একটা। পায়রাকে বাসায় দিয়ে তারপরই যাবে। পায়রাকে মাথা নিচু করে আসতে দেখে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেলো। পায়রার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসলো।
প্রতুত্তরে পায়রা অধর হালকা প্রসারিত করে তাকালো। মলিন হাসি বিষন্নতায় পরিপূর্ণ মুখ। নীলাংশ মুহুর্তেই বুঝতে পারলো কোনো অজানা কারণবশত তার পিচ্চির মনটা খুব খারাপ। সে মন খারাপের কারণ জানতে চেয়ে আর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইলো না। নিঃশব্দে পায়রার কাঁধ থেকে বইখাতার ব্যাগটা নিজ হাতে তুলে নিয়ে গাড়ির ব্যাক সিটে রেখে দিলো। পায়রা নতমুখেই
গাড়ির ভেতর গিয়ে বসলো। গাড়ির উইন্ডো খোলা।
বাহিরে এখনো মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। নীলাংশ গিয়ে বললো-
‘নিনিকা, চ্যাপ্টারটা নিয়ে আমরা কাল ডিসকাস করবো ৷ ‘
‘দেটস ওকে, কিন্তু তুমি বাড়ি যাচ্ছো! লাস্ট ক্লাসটা করবে না?’
‘করবো, পিচ্চিকে বাড়ি দিয়ে এসে তারপর। ‘
নিনিকা একবার গাড়ির ভেতর থাকা মেয়েটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ৷ অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে থাকায় চেহারা দেখা যায় না। সে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো –
‘আই সি, তোমার বোন তাই না? আগে কখনো বললে না আপন বোন আছে! ‘
নীলাংশ চলে যাওয়ার জন্য বাড়িয়ে দেয়া পা টা গুটিয়ে নিলো৷ আচমকা মাথা গরম হয়ে গেলো তার। সচরাচর নয় বরং যা সে কখনোই করেনা। ঠিক তাই করলো৷ রাগী স্বরে বললো –
‘বোন না! ‘
নিনিকা ভড়কে গেলো। এখানে রেগে যাওয়ার কী হলো সে বুঝতে পারছেনা। মিনমিন করে বললো –
‘তাহলে কী কাজিন?’
নীলাংশ আরও ক্ষেপে যাওয়া গলায় বললো –
‘আমি কী তা বলেছি?দূর হও তো ৷ তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। ‘
নিনিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। নীলাংশকে সে মনে মনে খুব পছন্দ করে। তাই তো ক্লাসের কোনো ছেলের সাথে কথা না বললেও নীলাংশের সাথে যেচে বলে। যত খারাপ পরিস্থিতিই হোক, নীলাংশ সবসময় রেগে গেলেও মুচকি হেঁসে কথা বলে। শান্ত স্বভাবের নীলাংশ এতো সামান্য একটি কারণে রেগে গেলো! বিষয়টি হজম করতেও মাথা চক্কর দিচ্ছে। বারবার মনে একটা প্রশ্নই উদয় হচ্ছে, ‘কে এই মেয়ে? যার ব্যাপারে একটা ভুল ধারণাতেও নীলাংশ রেগে যায়!’
___________________
পুরো রাস্তায় পায়রা কোনো কথা বলেনি। নীলাংশও চুপ করে ছিলো। কিন্তু তার পিচ্চির খেয়াল রাখতে ভুলেনি ৷ যেমন, সিট বেল্ট লাগিয়েছে কিনা বারবার চেক করেছে, মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে ফ্রাইড রাইস প্যাক করে এনেছে, এসি অন করে মিডিয়াম করে রেখেছে, স্লো ভয়েসের ক্লাসিকাল একটা গান প্লে করে দিয়েছে। সবই নিশ্চুপ থেকে। এ যেনো আড়ালের এক নির্মল স্নিগ্ধ যত্ন। যা একদমই অপ্রকাশিত। যে যত্নের পরিধি সীমাহীন তবুও অদৃশ্য।
সবই চলছে নিয়মমাফিক। সময় চলছে সময়ের মতো।
গত হয়েছে এক মাস। এর মধ্যে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। পায়রা প্রতি স্কুলে আসা যাওয়া করছে। সব জায়গায় সবাইকে মানিয়ে চলা সম্ভব না। পায়রাও তাই করেছে। প্রথম দিকে তার যতটা উৎসাহ ছিলো। এখন সেসবের কিছুই নেই ৷ সে একাই ভালো আছে।
তার নিজের মতো ক্লাসে আসে, পড়া শেষ হলে চলে যায়। ক্লাসের একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এই এক মাসে অনেকটাই সাহায্য করে তাকে৷ ক্লাসের ফার্স্ট বয়
প্রদীপ ও আরেকটা মেয়ে মধু৷ দুজনেই বেশ সৌহার্দপূর্ণ। কাউকে ছোট বড় করে দেখে না। পায়রা যে খুব বেশি কথা বলে তাও না৷ প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া হায় হেলো ব্যস এটুকুই। কিন্তু ক্লাসের বাকি সবার মাঝে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। তা হলো, তারা পায়রার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায়। দারুণ রকমের উৎসাহ থাকলেও পায়রার কাঠিন্যতায় মোড়ানো চাহনিতে তাকাতেও দুইবার ভাবে। এমন হওয়ার অবশ্য কারণ আছে, নতুন আসা মেয়েটাকে এখন স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী সবাই চিনে। এই এক মাসে পায়রা সবার চেয়ে পড়ায় এগিয়ে। যেকোনো কঠিন অংকই যেনো তার বাম হাতের খেল। ধাপে ধাপে অবাকের চূড়ায় সবাই। কারো চোখেই এখন সে আর কোনো এসিড ভিক্টিম নেই। কেউ তাকে অংকের চ্যাম্পিয়ন নামে চেনে তো কেউ আবার ফার্স্ট গার্ল। সবাইকে যেনো সে দেখিয়ে দিলো, চেহারা নয় কর্মই আসল ৷ এখন কেউ তাকে দেখে দূরছাই করার সাহস করে না ৷ করবে কী করে!
তার সাথে প্রিন্সিপাল আভাস বোসের সখ্যতা। পায়রাকে মাঝে মাঝেই এসে নানান রকম প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে বলে যান৷ এটি অবশ্য সবাই কানাঘুষা করে। সত্যিটা ভিন্ন। আভাস বোস নিজের উদ্যেগেই আসেন, পায়রা মেধাবী শিক্ষার্থী। এদেরকে আরেকটু পথ এগিয়ে দিলেই দেশ ও পৃথিবীর জন্য দারুণ কিছু এনে দিতে পারে। তাই যতটুকু সম্ভব করেন।
পায়রা এখন বসে আছে ঠিক আভাস বোসের সামনের সিটটায়। আভাস বোসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পায়রার হাতের দিকে। পায়রা টেবিলের অমিলিত কিউবটি মেলানোর চেষ্টা করছে। দশ মিনিটের সময় কিউবটি মিলে গেলো। মুখে ফুটে উঠলো প্রস্ফুটিত হাসি। আভাস বোস নিগুঢ় চাহনিতে সেই হাসি দেখলেন। সামনের ম্যাগাজিনটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বাঁকা হেসে বললেন –
‘মিস.ইন্টেলিজেন্ট। আপনি কী নিয়ে পড়তে চান? ‘
পায়রা এক পলক তাকালো৷ কোনো কিছু না ভেবেই বললো-
‘এস্ট্রোনমি নিয়ে।’
এক মাসে পায়রার মুখে সবসময়ই শুদ্ধ ভাষা শোনা যায়। অতিরিক্ত মাত্রায় খুশি হলেই একমাত্র অশুদ্ধ বলে সে। সে মাঝে মাঝে ভেবে পায়না, আভাস বোস তাকে নিয়ে এতটা কনসার্ন কেনো? মাঝে মাঝেই পড়াশোনার ফাঁকে তাকে জ্ঞান বিষয়ক নানা প্রশ্ন করে। প্রথম দিনই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, পায়রা কোন বিষয়ে বেশি আগ্রহী? পায়রা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অজানা জিনিস সম্পর্কে জানতে চায়। পৃথিবীর বাহিরের সৌন্দর্য গুলো উপভোগ করতে চায়।
এই উত্তরই সে দিয়েছে।
আভাস বোস উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন-
‘ইন্টারেস্টিং, কিন্তু ভবিষ্যতে কী হতে চাও? ‘
আরও একবার পায়রার নির্লিপ্ত উত্তর –
‘এস্ট্রোনাট। ‘
চলবে….