স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-২৯

0
860

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-২৯

রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুংটাং শব্দ। অনবরত চামচ নেড়ে নেড়ে কফি বানিয়ে নিলো পায়রা। কয়েক দিন আগেই কাজের মহিলার থেকে শিখে নিয়েছে।
ইদানীং পড়াশোনার পাশাপাশি রান্নাও সময় দিচ্ছে সে। নতুন নতুন খাবারের নাম জানছে। সময়গুলো ভালো ভাবেই কাটছে৷ নীলাংশের মা তানজিমা অবশ্য পায়রার সাথে কোনো কথাবার্তা বলেন না৷ কিছু না বলেই বুঝিয়ে দেন ‘তোমাকে আমার একদম পছন্দ না’
। যেচে কথা বলতে যায়নি পায়রাও। কিন্তু বাকি সবাই পায়রাকে বর্তমানে খুব পছন্দ করে। ছোট চাচী রূপসার সেদিন শরীর খুব খারাপ ছিলো। রায়ানার পরীক্ষা থাকায় খুব একটা সময় দিতে পারছিলো না। আর তানজিমা সবার প্রতি অতো কেয়ারিং না। পরিবারের দায়িত্ববান মানুষ হলেও যত্নের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। পায়রার তখন পরীক্ষা শেষ হয়েছে সাত দিন। তাই হাতে সময় থাকায় রূপসাকে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত জেগে পাশে সেবা শুশ্রূষা করে গেছে। রায়ানার বাবাও সেদিন ঢাকার বাহিরে। পায়রা হাসিমুখে সেবা করছিলো। রূপসা এমনিতেই আবেগী নরম মনের। তিনি তারপর থেকে পায়রাকে আপন মেয়ের মতো আদর করেন। এক কথায় চোখে হারান।
কয়েক দিন আগেই পায়রার আবদারে নিজহাতে কেক, নুডুলস, বিকেলের সামান্য কয়েক ধরনের নাস্তা বানানো শিখিয়েছে। এই বাড়িতে আরও একজন তাকে খুব পছন্দ করে। তা হলো অপূর্ব। ক্লাস থ্রি থেকে এবার ফোরে উঠেছে। যখন নতুন পায়রা এ বাড়ি এসেছিলো তখন অপূর্ব তার মামা বাড়ি বেড়াতে গেছিলো। মামা বাড়ি থেকে যখন আসলো তখন পায়রার দিকে সন্দেহভাজক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।পায়রা যখন খেতে বসতো তখন অপূর্ব চোখ ছোট ছোট করে তাকাতো। পায়রা প্রথম প্রথম অবাকই হতো, এই ছোট ছেলেটা তাকে সন্দেহ করে! গায়ের রং লালচে ফর্সা। গোলগাল মুখে গোল চশমাটাও মানিয়ে যায়। চলাফেরা বড়দের মতো। এমনকি কথা বলেও আলাদাভাবে। চোখ দিয়ে এমন ভাবে তাকায় সামনের মানুষটা না চাইলেও ঘাবড়ে যায়। পায়রার তো মনে হয় এটা নীলাংশের জিরক্স কপি৷ শুধু নীলাংশ সবার সাথে সহজ, স্বাভাবিক। আর অপূর্ব তার উল্টো স্বভাবের।
নীলাংশের পরীক্ষা চলছে। রাতদিন ঘরের ভেতরে বসে একনাগাড়ে গুণগুণ করে পড়তে থাকে। খাওয়া দাওয়া মাঝে মাঝে ভুলে যায়। তাই পায়রা নিজে থেকেই হরেক পদের খাবার নিয়ে হাজির হয় নীলাংশের দ্বারপ্রান্তে। চুলার পারে থাকায় চোখ মুখ ঘেমে আছে। ওভেন থেকে গরম গরম কাপকেক নামিয়ে কফি নিয়ে ট্রে তে করে পা বাড়ালো নীলাংশের রুমের দিকে। হঠাৎ-ই কেউ তার পিছে পিছে আসছে মনে হতেই তাকালো পেছনে৷ কিন্তু কেউ নেই। মাথা ঝাকিয়ে মনের ভ্রম ভেবে এগিয়ে গেলো। দুই পা এগোতেই কে যেনো তার ওরনা টেনে ধরলো। মনে অবাঞ্চিত ভয় ঢুকে গেলো। ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখলো অপূর্ব। বড় একটা শ্বাস ফেললো সে। অপূর্ব হাসছে। পায়রাও হেঁসে ফেললো। হাঁটা শুরু করতে করতে বললো –

‘অপু, তুমি খুব দুষ্ট হয়ে গেছো! ‘

অপূর্বর হাতে পায়রার ওরনার কোণাটা তর্জনী আঙুলে পেঁচানো৷ খেলার মতো করে ওরনাটা একবার খুলছে আবার পেঁচাচ্ছে। ইদানীং খুব সখ্যতা পায়রার সাথে। অধিকাংশ সময়ই অপূর্ব পায়রার সাথেই থাকে।
হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বললো –

‘মোটেও না, আই এম অলওয়েজ গুড বয়। ‘

পায়রা হাসলো৷ অপূর্ব আবারও বললো-

‘কফি আর কাপকেক নিয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছো? ‘

পায়রা পুলকিত কন্ঠে বললো-

‘সুন্দর সাহেবের ঘরে যাচ্ছি। ‘

অপূর্ব টুপ করে প্লেট থেকে একটা কাপকেক উঠিয়ে নিলো। পায়রা হা করে তাকিয়ে বললো-

‘একি! ওটা তো তোমার ভাইয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম’

অপূর্ব কাপ কেকে কামড় বসিয়ে বললো-

‘দিস ইজ ইয়োর পানিশমেন্ট। তুমি আমার জন্য বানাওনি কেনো? তাই এখন নীল ভাইয়ুও একটা খাবে। ‘

পায়রা ফিক করে হেঁসে, এক হাত নিজের কানে ছুঁইয়ে
রসিকতার ছলে বললো-

‘একদম ভুল হয়েছে। তোমার জন্য স্পেশাল কাপকেক বানিয়ে দিবো কাল। ‘

অপূর্ব বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বললো-

‘মনে যেনো থাকে!’

পায়রা ভয় পাওয়ার মতো মুখ করে বললো –

‘খুব থাকবে। ‘

পরমুহূর্তেই হেঁসে অপূর্ব প্রস্থান করলো। পায়রাও হাসি মুখে নীলাংশের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নক করলো।
তিন বার নকের পর নীলাংশ দরজার লকটা খুলে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। পায়রা অতশত না ভেবে হাতের ট্রে টেবিলে রাখলো৷ আশেপাশে তাকাতেই চক্ষু চরকগাছ। যে নিজের ঘরে একটা সুতো পর্যন্ত গুছিয়ে রাখে সে পুরো এলোমেলো করে রেখেছে। নীলাংশ তার দিকে একবারও তাকায়নি। পায়রা নিজে থেকেই বললো-

‘সুন্দর সাহেব, ঘরের এই অবস্থা কেনো? ‘

নীলাংশ কোনো প্রকার সাড়া শব্দ করলোই না। বরং পড়ার গতি বাড়িয়ে দিলো। পায়রা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। কয়েক দিন ধরে পায়রার মনে হয় নীলাংশ তাকে এড়িয়ে চলছে। হু হা ছাড়া কোনো কথাই বলেনা। পায়রা ভেবেছিলো পরীক্ষার চাপে হয়তো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার ধারণা ভুল ছিলো। নীলাংশ অন্য কোনো কারণে তার উপর ক্ষুব্ধ। চোখ মুখের বেহাল অবস্থা। চুলগুলো আগের তুলনায় বড় হয়েছে।
খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি জন্মেছে মসৃণ গালে। গায়ে পাতলা টিশার্ট, শর্ট টাউজার। দেখে মনে হচ্ছে নিজের কোনো যত্নই সে নেয়নি। পায়রা নিজেই বিছানা ঝেড়ে ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিপাটি করে দিলো৷ লম্বা কারপেটটা ঝাড়া দিয়ে বিছিয়ে দিলো। টেবিলের উপর থেকে ধুলো গুলো মুছে দিয়ে পাশে দাঁড়ালো। নীলাংশের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আপনার কী হয়েছে? ‘

‘তুমি যাও পিচ্চি। ‘

গম্ভীর ঠান্ডা কন্ঠ। পায়রার সঙ্গে কখনোই নীলাংশ এমন করে কথা বলেনা। আচ্ছা, সে কী কোনো ভুল করেছে! মাথায় ঢুকলো না। কফিটা নিজের হাতে তুলে এগিয়ে বললো-

‘সুন্দর সাহেব, কফিটা খেয়ে নিন৷ চোখ মুখ ধুয়ে আসুন। ভালো লাগবে। ‘

নীলাংশ নিজমনে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। সামনে যেনো কেউই নেই তার ভাবখানা এমন। পায়রা আরেকটু কফি এগিয়ে ঝুঁকে বললো-

‘আমি কী করেছি সুন্দর সাহেব? কথা বলছেন না কেনো?’

নীলাংশ আচমকা কফির কাপটায় স্বজোড়ে আঘাত করলো। কফির অর্ধেকটাই পড়লো পায়রার পায়ের পাতায়। কাপটা ভেঙে ফ্লোরে লুটিপুটি খাচ্ছে। পায়রা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে। নীলাংশ হিংস্র বাঘের মতো হুংকার দিয়ে বললো-

‘কে বলেছে এসে আমাকে এতো আদিক্ষ্যেতা দেখাতে! আমি বলেছি আমার জন্য কফি নিয়ে আসো! ঢং শুরু করেছো আমার সঙ্গে! মম ঠিকই বলে
তোমরা বড়লোক ছেলে দেখলেই ফাঁসানোর চেষ্টায় থাকো। একটা না পেলে আরেকটা, আরেকটা না হলে
আবার অন্য কেউ! ‘

চোখে মুখে হিংস্রতা উপচে পড়ছে নীলাংশের। পায়রা হতভম্ব হয়ে গেছে। এ কোন নীলাংশ! এটা তো তার সুন্দর সাহেব হতেই পারে না। তার সুন্দর সাহেব কখনো এমন ব্যবহার করতেই পারে না। বহুদিন পর আবারও চোখের কার্ণিশ গড়িয়ে উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তারপরও আরেকবার করুণ স্বরে বললো-

‘ আমার দোষটা কী? সুন্দর সাহেব?’

নীলাংশ নিজের বইখাতা ফ্লোরে নিক্ষেপ করে চোখ মুখ খিঁচে বললো-

‘আউট! গেট আউট ফ্রম হেয়ার। আই জাস্ট হেট ইউ।’

পায়রা নিজের বিস্ময় সামলে ব্যাথিত হৃদয় নিয়ে মুহুর্তেই প্রস্থান করলো। আর থাকবে না সে এখানে।
শেষমেষ সুন্দর সাহেবও তাকে এমন করে অপমান করলো। সুন্দর সাহেব কী একটুও বোঝেনি এ কয়েক দিনে তার জন্য এক অন্য রকমের অনুভূতি তৈরি হয়েছে! সে কী জানেনা, এই হিংস্র কথাগুলো তার মনে কতোটা প্রভাব ফেললো!
নিজমনে আওড়াতে আওড়াতে বেরিয়ে গেলো। অথচ পেছনে ফিরলেই দেখতো তার সুন্দর সাহেব কথাগুলো তাকে বলে ঠিক শতগুণ বেশি কষ্ট জর্জরিত হয়েছে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here