স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৩৯

0
779

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৩৯

জানালা খুলে থাকায় বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। অদ্ভুত ভাবে রৌদ্রময় আকাশে ঘনঘটা বৃষ্টির প্রাদুর্ভাব। পায়রা বিস্মায়িত হয়ে দুই তিন পলক তাকিয়ে থাকে খাটের দিকে। নিজের গায়ে ওড়নার প্রয়োজন বোধ করে। হাতের গামছাটাই ওড়নার মতোন গলায় পেচিয়ে নেয়। খাটে পা টানটান করে বালিশ পেছনে দিয়ে মোবাইল টিপছে নীলাংশ। পায়রা এক পলক সেদিকে তাকায়। রোদের মিহি আলো এসে নীলাংশের ফর্সা মুখমন্ডলের উপর এসে পড়েছে। হালকা গোলাপি রঙের চকচকে ঠোঁটে রোদ পড়ে কমলা দেখাচ্ছে। পায়রা ঘড়ির দিকে তাকায়। এখম তো দেড়টা বাজে। এই সময় তো নীলাংশের আসার কথা না। এখন এখানে তাঁর ঘরে কী করছে! যদি আসতেই পারতো তাহলে কলেজ থেকে আনলো না কেনো!
অদ্ভুত তো! এক পলক তাকাচ্ছেও না। যেনো পুরো ঘরটায় নীলাংশ একা এবং ঘরটা নীলাংশেরই। শোয়াটা যে নতুন তা নয়। মাঝে মাঝেই পায়রা যখন টেবিলে পড়তে বসে তখন নীলাংশ গম্ভীর গলায় আদেশের পর আদেশ দিয়ে পশরা সাজিয়ে রাখে। কিন্তু যখন পায়রা বিছানায় শুয়ে থাকে তখন নীলাংশ আর কাছেপাশে আসেনা। কারণটা জানা পায়রার।
নীলাংশ যেমন খোলামেলা। তেমনই বিনীত, মার্জিত।
যতটুকু সীমান্ত, ঠিক ততটুকুতেই তার বাস। এমন কাউকে পায়রা তার মনে ঠাই দিয়েছে ভাবতেই ভালো লাগার শীতল স্রোত বয়ে যায়। মনের সুপ্তকোণ থেকে কেউ গর্ব করে বলে-‘ তুই তোর তাঁরা বুবুর মতো ভুল করিসনি পায়রা! তোর সুন্দর সাহেবকে ভালোবেসে ভুল করিসনি!’

পায়রা ভেজা গামছাটা চুলে পেচায়। ওড়না গায়ে টেনে
এগিয়ে যায়। হাত মুঠো করে সামনে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু ফল আন্ডা। নীলাংশ নির্বিকার চিত্তে মোবাইলে কিছু দেখছে। পায়রা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে-
‘কখন এসেছেন?’

নীলাংশ তীক্ষ্ণতা নিয়ে এক বার তাকিয়ে ফোনটা পকেটে ঢোকায়। পায়রা শুকনো ঢোক গিলে নেয়। নীলাংশের রাগ আজ পর্যন্ত বোঝার সাধ্যি তার জন্মায়নি। কবিরা বলেন, নারীলোকের মনে কী চলছে তা বোঝার ক্ষমতা আদৌও কোনো পুরুষের নেই। কিন্তু পায়রার ক্ষেত্রে তা বিপরীত। বলতে গেলে হুটহাট পায়রার মনে হয়, নীলাংশ একদমই রহস্যময়। কখন তাঁর হাসি পায় কখন রাগ হয় কিছুই বোঝে না। যখন রাগে তখনও পায়রা কারণ খুঁজে পায়না। কিন্তু অভ্যাস বলতেও তো একটা জিনিস আছে! এতদিনে যখনই নীলাংশ তাঁর দিকে এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামায় তখনই পায়রা টের পেয়ে যায় ‘এটা ঝড়ের পূর্বাভাস’। এরপরই যত রকমের প্রলয় আছে তা পায়রার উপর দিয়ে যায়। পায়রা হাসার চেষ্টা করে কোনোরকমে বললো-

‘কী হয়েছে? ওভাবে কী দেখছেন? ‘

নীলাংশ পায়রার দিকে তাকালো। চোখের পলক না ফেলে সে তাকিয়েই রইলো। পায়রার খুঁত তার চোখে পড়ে না কেনো জানি! এই যে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্নিগ্ধ রমনী। খুব সাধারণ কামিজটাও অসাধারণ লাগছে। গামছা বেঁধে রাখা লম্বা চুল গুলো দেখে সদ্য বউ বউ রূপ ভাসছে। হয়ত, ভালোবাসার মানুষটা সবার চোখেই সুন্দর। একটা কারণে মনে মনে খুব রেগে ছিলো সে। ভাবভঙ্গি দেখে কেউ যদিও টের পাবেনা তা। পায়রার দিকে তাকিয়ে সে অশান্ত ভাবকে কমিয়ে আনলো। মুখ এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে পায়রার হাত টেনে বিছানায় বসালো। প্রথমবারের মতো পায়রাকে ঝটকা দিয়ে তাঁর কোলের একেবারে শেষাংশে আলতো করে মাথা রাখলো। এতটাই আলতো যে মনে হবে একদমই অস্পৃশ্য! তারপরও পায়রার গা শিরশির করে উঠলো৷ এতটা কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি তাঁর। প্রথম কারো শুভ্র মুখটা এত কাছ থেকে দেখে হৃদয় কেঁপে উঠলো। আবেগের বাহকে একদফা ভ্রমণ হয়ে গেলো। ঘোর ভেঙে গেলো নীলাংশের কথায়।

‘চুল টেনে দাও পিচ্চি! মাথা ব্যাথা করছে। ‘

কোমল আদুরে আবদারে পায়রার মন দুলে উঠলো। খুবই দ্বিধাদন্দে অথবা ভয়ে হাত রাখলো নীলাংশের মাথায়। দুই একবার টানতেই বুঝতে পারলো নীলাংশ বৃষ্টিতে ভিজে এসে নিজের ঘর অব্ধিও যায়নি। সোজা তাঁর ঘরে এসে বসেছে। তাই এখনও চুলগুলো বৃষ্টির জলে ভেজা। নিঃসংকোচে নিজের ওড়নার কোণা দিয়েই মাথাটা ভালো করে মুছে দিলো। ওড়না সরিয়ে আনতে নিলেই নীলাংশ সেটা টেনে মুখের উপর ধরে রাখলো। পায়রা অবাক হয়ে বলে-

‘একি!ওড়নার কোণা মুখের উপর ধরে আছেন কেনো? ‘

নীলাংশ চোখ বন্ধ করে ছিলো। পায়রার প্রশ্নে চোখ বন্ধ করেই উত্তর দেয়-

‘তোমার ওড়নায় আপন আপন ঘ্রাণ আসছে পিচ্চি!’

নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রয় পায়রা। কতরকমের ঘ্রাণের কথা শুনেছে সে, ফুলের ঘ্রাণ, মাটির ঘ্রাণ,কেরাসিন তেলের ঘ্রাণ। কিন্তু নীলাংশের বলা ঘ্রাণটার কথা তো শোনেনি। পায়রা ঝুঁকে বললো-

‘আপন আপন ঘ্রাণ কী হয় সুন্দর সাহেব?’

‘হয়তো পিচ্চি। যার বাস আমাদের বুকের সবচেয়ে রক্ষিত, সযত্নে গড়া সে মানুষটার সামান্য ঘ্রাণও আমাদের আপন আপন!’

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here